উত্সর্গঃ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের লাখো শহীদ দের...
"সালে বহোত্ ঘোরেল হ্যায় ! ইতনা টরচার কীয়া মাগার কুচভী নেহী বাতা রাহাহে !" বলেই কষে আরেকটা লাথি চালালো ছেলেটার তলপেটে । ঘেয়ো কুকুরের মতো একটু কুকিয়ে ওঠা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না শাতিল । পাকী অফিসার এবার ঘোত্ করে শূকরের মতো দলা পাকানো থুথু ফেললো ওর ওপর ।গজরাতে গজরাতে প্রায় অণ্ধকার ঘরটা থেকে বেরিয়ে গেলো মেজর সরফরাজ ।
দেখে অবশ্য ওকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না । একটা রক্তাক্ত মাংসপিন্ডের মতো পড়ে আছে মৃতপ্রায় ছেলেটা । মৃত্যুদূত দ্রুত আসলেই ভালো হতো বোধহয় । প্রচন্ড ব্যাথায় শরীরের প্রতিটি রোমকূপ শিউরে উঠছে বারবার । ছেলেটা শুধু "মা, মাগো" বলছে । কিন্তু শব্দটা তিনটা ভাংগা দাত আর থ্যাত্লানো দেয়াল ঘেষে কেমন গো গো শব্দ হচ্ছে ।
এই কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে ও আছে এক সপ্তাহ হলো । অত্যাচার নির্যাতনের স্টিম রোলার চলেছে ওর ওপর এই কটা দিন। শরীর অসংখ্য পোড়া চুরুটের দাগ ফোসকা খেকে দগদগে ঘায়ে রূপ নিয়েছে । হাতের আংগুলে একটা নখও নেই, সবগুলো উপড়ে ফেলেছে পশুরা । রডের আঘাতের নির্মম ক্ষত আর অতিরিক্ত গরম পানির তাপে সিদ্ধ হয়ে যাওয়া ত্বকটা শুধু যন্ত্রণার মাত্রা বাড়িয়ে যাচ্ছে । সারা দেহে কেমন একটা ভোতা অনুভুতি ।
ও ধরা পড়েছে কুমিল্লা সীমান্ত দেশে আসার সময় । ওদের বিশাল একটা দল ভারত থেকে ট্রেনিং শেষ করেছে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে । নির্দেশনা ছিলো যুদ্ধে যোগদানের জন্য সীমান্ত দিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে বাংলাদেশে চলে আসবে । চলে যাবে যার যার ক্যাম্পে । সাথে করে আলুর টুকড়ি কিংবা বাজারের ব্যাগে করে নিয়ে আসবে আপাত প্রয়োজনীয় গ্রেনেড বুলেট কিংবা অন্য অস্ত্র ।
পাক হানাদার বাহিনীর চট্টগ্রাম সীমান্তের দায়িত্ব থাকা মেজর সরফরাজ খবরটি পেয়ে গেছে কয়েকঘন্টা আগেই । তাই সম্ভাব্য দুর্গম কিন্তু তুলনা মূলক নিরাপদ সেখানে গোপন পাহাড়া বসিয়েছিলো সে । আর ওদের ই একটা গ্রুপের কাছে ধরা পড়েছে মুশফিক, শাতিল, দেলোয়ার, মাহমুদদের গ্রুপটা । আহসান, ইশান কোন রকমে পালিয়ে বেচেছে । ওরা ভাবতেও পারে নি যে ওই পয়েন্টে হানাদাররা ওত্ পাততে পারে !
তিনটা দিন নোংরা স্যাতস্যাতে জঙ্গল দিয়ে পাঁচ ছয়টা পাহাড় ডিঙিয়ে ওরা অনেকটাই ক্লান্ত ছিলো । যখন সবাই একসাথে বসে রাতের খাবার হিসেবে শক্ত শুকনো রুটি চিবানোর চেষ্টা করছিলো তখনই কোথূকে হঠাত্ সার্চলাইটের আলোতে ঝলসে উঠে চারপাশ হঠাত । হঠাত দাড়িয়ে কাধ থেকে ঝোলানো গামছা বাধানো স্টেনগানে হাত পৌছুবার আগেই ওরা এলোপাতারি গুলির বৃষ্টি শুরু হল । গুলিবিদ্ধ হলো দেলোয়ার,মুশফিক আর মাহমুদ । অনেকটা কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেলো তিনজন । শাতিল ছিলো সবচেয়ে অপ্রস্তুত ।কিন্তু কী কারনে ওকে গুলি করলো না ওরা ।
সৌভাগ্য ক্রমে ইশান আর আহসান ছিলো একটু দুরে । প্রথম সার্চলাইটের আলোটা অনেকটা দূরে থাকায় ও প্রশিক্ষণের নির্দেশনা অনুসারে ক্রলিং করে দূরে সরে যায় । এতো দিনের বন্ধু আর সহপাঠীদের ছেড়ে যেতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু কিছু করার নেই । বিশ্রামের জন্য অস্ত্রটাও কিছুক্ষণ আগে নামিয়ে রেখেছে।ওটাও অনেক দুরে । হঠাত্ কী হয়েগেলো কিছুই করতে পারলো না । আত্মরক্ষাথে পালিয়ে যাচ্ছে ওরা । সবাই মারা যাওয়ার দেশের জন্য অন্তত দুই জন বাচলেও ভালো ।পরপর কয়েকবার গুলির শব্দ শুনে নিঃশব্দে গুমড়ে কাদছিলো দুজন ।
শাতিল এখন বুঝতে পারলো ওরা কেন ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে ।একটা অজানা আশংকায় টার শিড়দাড়া দিয়ে একটা স্রোত বয়ে গেলো । পিছু হাতে হাতকড়া পড়িয়ে জঙ্গল পেড়িয়ে জীপে ওঠালো । নির্মম দুর্ভাগ্যের আগাম পূর্বাভাষ দিতেই বোধহয় লাথি আর চড়ের বৃষ্টি বইয়ে দিচ্ছে ওরা ।
শাতিল এখন শুয়ে আছে স্যাতস্যাতে মেঝেতে । পরপর সাতটি দিন পেরিয়ে গেছে । শারীরিক মানসিক সব রকমের অত্যাচারের মাত্রা বাড়ছে প্রতিদিন । ওরা জানতে চাচ্ছে যে ওরা কতজন এসেছে, কোন কোন ক্যাম্পে যাবে ওগুলোই বা কোথায় ? কোন উত্তরই দেয়নি শাতিল, অনেক নির্যাতনের পরেও ।ও মনে মনে ভাবে পাকিস্তানি হানাদারেরা বাংলাদেশীদের অস্ত্রের ভান্ডার খোজে , বিস্ফোরকের উত্স জানতে চায় ! অথচ প্রতিটি কন্ঠসর এখন যে একেকটা জলন্ত আগ্নেয়গিরি প্রতিটি হৃদয় এখন একেকটি পারমানবিক বোমা !
নিজের অদ্ভুত দৃঢ়তায় অবাক হয় সে । তারা সারা জীবনের কষ্ট যন্ত্রণা এক করলেও বোধহয় গত কয়েক দিনেরটাই বেশী হবে , অনেক বেশী । মনে পড়ে ক্লাস টেনের কথা । একদিন দেরী করে বাসায় গিয়েছিলো বলে আব্বা তাকে চড় দিয়েছিলেন । তারপর রাগ করে ২দিন সে কিছুই খায়নি। আম্মুও খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন । আব্বাই আবার আদর রাগ ভাংগিয়ে ছিলেন; লোকমা দিয়ে খাইয়েছিলেন । একটা ক্রিকেট ব্যাটও কিনে দিলেন সেবার । ওটাই প্রথম মার ছিলো ওটাই শেষ ।
"আচ্ছা আম্মা আব্বা কেমন আছেন ? বেচে আছেন কীনা কে জানে ?" শাতিল ভাবার চেষ্টা আরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার ছেড়ে যেদিন তাদের পরিবারের গ্রামের বাড়ী চলে যাবার কথা সেদিনই ও একটা চিঠি রেখে পালিয়ে চলে এসেছিলো যুদ্ধে ।অনেক খারাপ লাগছিলো তার । সারাটা দিন মায়ের কাছে কাছে ছিলো । আব্বুর পায়চারী দেখছিলো । মনে হচ্ছিলো,"যুদ্ধে না গেলেও তো হয়! অনেকেই তো আছে !" বিবেকের সাথে বোঝা পড়া করে দায় এড়াতে পারলো না । মা বাবার জন্য একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি রেখে পালালো ছয় বন্ধু । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই সবাই । ক্যাম্পাসে একসাথে আছে তিনটি বছর ধরে । বিভিন্ন বিভাগের কিন্তু খুবই কাছের । ওদের দলটার একটা বিশেষ নাম ছিলো "ষষ্ঠ পান্ডব" !
লোহার দরজাটা আবার খুললো। একটা খাকী কুকুর আসছে । মুখে কেমন একটা নিষ্ঠুর বিদ্রুপ । এসেই একটা গালি দিয়ে দাড়াতে বললো । ও পারছিলো না । এক পর্যায়ে পশুটা হ্যাচড়াতে হ্যাচড়াতে বাইরে নিয়ে গেলো। অনেকদিন পর সূর্যের আলোতে আসলো শাতিল । আলোর তীব্রতায় অনেকটা কুকড়ে গেলো ও ।
যখন চোখ খুললো দেখলো পেছনে একটা বিশাল দেয়াল, ওখানে অনেক রক্তের দাগ । সামনে তাকালো সে দেখে ২০-৩০ ফুট দুর থেকে তার দিকে তাক করা পাচটি মেশিন গান । তারমানে ও এখন একটা ব্রাশফায়ার গ্রাউন্ডে । হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ঝাঝড়া করে দেয়া হবে । অবাক হলো সে তারতো কোন ভয় লাগছে না । মুখে কেমন যেন একটা মুক্তির আভা ।
শাতিলের ক্ষতবিক্ষত মুখটায় একটা প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে । এ হাসি অত্যাচারীদের প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি, জালিমের প্রতি শোষিতের বিদ্রুপ।
একটা অফিসার বারবার ঘড়ি দেখছে । হয়তো আর কয়েক সেকেন্ড ।তারপরই সবকিছু শেষ। কিন্তু আসলেই কী সব শেষ ? উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালো শাতিল, হয়তো এই আকাশটার দিকেই তাকিয়ে আছে তার মা; আরো লাখো শহীদের মায়েরাও ...