somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: কনসেনট্রেসন ক্যাম্প

২৭ শে মার্চ, ২০১২ রাত ১০:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উত্‍সর্গঃ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের লাখো শহীদ দের...


"সালে বহোত্‍ ঘোরেল হ্যায় ! ইতনা টরচার কীয়া মাগার কুচভী নেহী বাতা রাহাহে !" বলেই কষে আরেকটা লাথি চালালো ছেলেটার তলপেটে । ঘেয়ো কুকুরের মতো একটু কুকিয়ে ওঠা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না শাতিল । পাকী অফিসার এবার ঘোত্‍ করে শূকরের মতো দলা পাকানো থুথু ফেললো ওর ওপর ।গজরাতে গজরাতে প্রায় অণ্ধকার ঘরটা থেকে বেরিয়ে গেলো মেজর সরফরাজ ।

দেখে অবশ্য ওকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না । একটা রক্তাক্ত মাংসপিন্ডের মতো পড়ে আছে মৃতপ্রায় ছেলেটা । মৃত্যুদূত দ্রুত আসলেই ভালো হতো বোধহয় । প্রচন্ড ব্যাথায় শরীরের প্রতিটি রোমকূপ শিউরে উঠছে বারবার । ছেলেটা শুধু "মা, মাগো" বলছে । কিন্তু শব্দটা তিনটা ভাংগা দাত আর থ্যাত্‍লানো দেয়াল ঘেষে কেমন গো গো শব্দ হচ্ছে ।

এই কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে ও আছে এক সপ্তাহ হলো । অত্যাচার নির্যাতনের স্টিম রোলার চলেছে ওর ওপর এই কটা দিন। শরীর অসংখ্য পোড়া চুরুটের দাগ ফোসকা খেকে দগদগে ঘায়ে রূপ নিয়েছে । হাতের আংগুলে একটা নখও নেই, সবগুলো উপড়ে ফেলেছে পশুরা । রডের আঘাতের নির্মম ক্ষত আর অতিরিক্ত গরম পানির তাপে সিদ্ধ হয়ে যাওয়া ত্বকটা শুধু যন্ত্রণার মাত্রা বাড়িয়ে যাচ্ছে । সারা দেহে কেমন একটা ভোতা অনুভুতি ।

ও ধরা পড়েছে কুমিল্লা সীমান্ত দেশে আসার সময় । ওদের বিশাল একটা দল ভারত থেকে ট্রেনিং শেষ করেছে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে । নির্দেশনা ছিলো যুদ্ধে যোগদানের জন্য সীমান্ত দিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে বাংলাদেশে চলে আসবে । চলে যাবে যার যার ক্যাম্পে । সাথে করে আলুর টুকড়ি কিংবা বাজারের ব্যাগে করে নিয়ে আসবে আপাত প্রয়োজনীয় গ্রেনেড বুলেট কিংবা অন্য অস্ত্র ।

পাক হানাদার বাহিনীর চট্টগ্রাম সীমান্তের দায়িত্ব থাকা মেজর সরফরাজ খবরটি পেয়ে গেছে কয়েকঘন্টা আগেই । তাই সম্ভাব্য দুর্গম কিন্তু তুলনা মূলক নিরাপদ সেখানে গোপন পাহাড়া বসিয়েছিলো সে । আর ওদের ই একটা গ্রুপের কাছে ধরা পড়েছে মুশফিক, শাতিল, দেলোয়ার, মাহমুদদের গ্রুপটা । আহসান, ইশান কোন রকমে পালিয়ে বেচেছে । ওরা ভাবতেও পারে নি যে ওই পয়েন্টে হানাদাররা ওত্‍ পাততে পারে !


তিনটা দিন নোংরা স্যাতস্যাতে জঙ্গল দিয়ে পাঁচ ছয়টা পাহাড় ডিঙিয়ে ওরা অনেকটাই ক্লান্ত ছিলো । যখন সবাই একসাথে বসে রাতের খাবার হিসেবে শক্ত শুকনো রুটি চিবানোর চেষ্টা করছিলো তখনই কোথূকে হঠাত্‍ সার্চলাইটের আলোতে ঝলসে উঠে চারপাশ হঠাত । হঠাত দাড়িয়ে কাধ থেকে ঝোলানো গামছা বাধানো স্টেনগানে হাত পৌছুবার আগেই ওরা এলোপাতারি গুলির বৃষ্টি শুরু হল । গুলিবিদ্ধ হলো দেলোয়ার,মুশফিক আর মাহমুদ । অনেকটা কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেলো তিনজন । শাতিল ছিলো সবচেয়ে অপ্রস্তুত ।কিন্তু কী কারনে ওকে গুলি করলো না ওরা ।

সৌভাগ্য ক্রমে ইশান আর আহসান ছিলো একটু দুরে । প্রথম সার্চলাইটের আলোটা অনেকটা দূরে থাকায় ও প্রশিক্ষণের নির্দেশনা অনুসারে ক্রলিং করে দূরে সরে যায় । এতো দিনের বন্ধু আর সহপাঠীদের ছেড়ে যেতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু কিছু করার নেই । বিশ্রামের জন্য অস্ত্রটাও কিছুক্ষণ আগে নামিয়ে রেখেছে।ওটাও অনেক দুরে । হঠাত্‍ কী হয়েগেলো কিছুই করতে পারলো না । আত্মরক্ষাথে পালিয়ে যাচ্ছে ওরা । সবাই মারা যাওয়ার দেশের জন্য অন্তত দুই জন বাচলেও ভালো ।পরপর কয়েকবার গুলির শব্দ শুনে নিঃশব্দে গুমড়ে কাদছিলো দুজন ।

শাতিল এখন বুঝতে পারলো ওরা কেন ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে ।একটা অজানা আশংকায় টার শিড়দাড়া দিয়ে একটা স্রোত বয়ে গেলো । পিছু হাতে হাতকড়া পড়িয়ে জঙ্গল পেড়িয়ে জীপে ওঠালো । নির্মম দুর্ভাগ্যের আগাম পূর্বাভাষ দিতেই বোধহয় লাথি আর চড়ের বৃষ্টি বইয়ে দিচ্ছে ওরা ।

শাতিল এখন শুয়ে আছে স্যাতস্যাতে মেঝেতে । পরপর সাতটি দিন পেরিয়ে গেছে । শারীরিক মানসিক সব রকমের অত্যাচারের মাত্রা বাড়ছে প্রতিদিন । ওরা জানতে চাচ্ছে যে ওরা কতজন এসেছে, কোন কোন ক্যাম্পে যাবে ওগুলোই বা কোথায় ? কোন উত্তরই দেয়নি শাতিল, অনেক নির্যাতনের পরেও ।ও মনে মনে ভাবে পাকিস্তানি হানাদারেরা বাংলাদেশীদের অস্ত্রের ভান্ডার খোজে , বিস্ফোরকের উত্‍স জানতে চায় ! অথচ প্রতিটি কন্ঠসর এখন যে একেকটা জলন্ত আগ্নেয়গিরি প্রতিটি হৃদয় এখন একেকটি পারমানবিক বোমা !

নিজের অদ্ভুত দৃঢ়তায় অবাক হয় সে । তারা সারা জীবনের কষ্ট যন্ত্রণা এক করলেও বোধহয় গত কয়েক দিনেরটাই বেশী হবে , অনেক বেশী । মনে পড়ে ক্লাস টেনের কথা । একদিন দেরী করে বাসায় গিয়েছিলো বলে আব্বা তাকে চড় দিয়েছিলেন । তারপর রাগ করে ২দিন সে কিছুই খায়নি। আম্মুও খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন । আব্বাই আবার আদর রাগ ভাংগিয়ে ছিলেন; লোকমা দিয়ে খাইয়েছিলেন । একটা ক্রিকেট ব্যাটও কিনে দিলেন সেবার । ওটাই প্রথম মার ছিলো ওটাই শেষ ।

"আচ্ছা আম্মা আব্বা কেমন আছেন ? বেচে আছেন কীনা কে জানে ?" শাতিল ভাবার চেষ্টা আরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার ছেড়ে যেদিন তাদের পরিবারের গ্রামের বাড়ী চলে যাবার কথা সেদিনই ও একটা চিঠি রেখে পালিয়ে চলে এসেছিলো যুদ্ধে ।অনেক খারাপ লাগছিলো তার । সারাটা দিন মায়ের কাছে কাছে ছিলো । আব্বুর পায়চারী দেখছিলো । মনে হচ্ছিলো,"যুদ্ধে না গেলেও তো হয়! অনেকেই তো আছে !" বিবেকের সাথে বোঝা পড়া করে দায় এড়াতে পারলো না । মা বাবার জন্য একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি রেখে পালালো ছয় বন্ধু । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই সবাই । ক্যাম্পাসে একসাথে আছে তিনটি বছর ধরে । বিভিন্ন বিভাগের কিন্তু খুবই কাছের । ওদের দলটার একটা বিশেষ নাম ছিলো "ষষ্ঠ পান্ডব" !


লোহার দরজাটা আবার খুললো। একটা খাকী কুকুর আসছে । মুখে কেমন একটা নিষ্ঠুর বিদ্রুপ । এসেই একটা গালি দিয়ে দাড়াতে বললো । ও পারছিলো না । এক পর্যায়ে পশুটা হ্যাচড়াতে হ্যাচড়াতে বাইরে নিয়ে গেলো। অনেকদিন পর সূর্যের আলোতে আসলো শাতিল । আলোর তীব্রতায় অনেকটা কুকড়ে গেলো ও ।

যখন চোখ খুললো দেখলো পেছনে একটা বিশাল দেয়াল, ওখানে অনেক রক্তের দাগ । সামনে তাকালো সে দেখে ২০-৩০ ফুট দুর থেকে তার দিকে তাক করা পাচটি মেশিন গান । তারমানে ও এখন একটা ব্রাশফায়ার গ্রাউন্ডে । হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ঝাঝড়া করে দেয়া হবে । অবাক হলো সে তারতো কোন ভয় লাগছে না । মুখে কেমন যেন একটা মুক্তির আভা ।

শাতিলের ক্ষতবিক্ষত মুখটায় একটা প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে । এ হাসি অত্যাচারীদের প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি, জালিমের প্রতি শোষিতের বিদ্রুপ।

একটা অফিসার বারবার ঘড়ি দেখছে । হয়তো আর কয়েক সেকেন্ড ।তারপরই সবকিছু শেষ। কিন্তু আসলেই কী সব শেষ ? উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালো শাতিল, হয়তো এই আকাশটার দিকেই তাকিয়ে আছে তার মা; আরো লাখো শহীদের মায়েরাও ...
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×