মুস্তাফিজ সাহেব অনেকক্ষণ ধরে হেটে চলেছেন রাস্তায় । অনেকটা উদ্ভ্রান্ত ।পা চলছেনা । মাথায় চিন্তার ঢেউ ।মামুনের মাকে কী বলবেন তিনি ?একজন বাবা কিভাবে এই কাজটা করলেন ! এতটা নিষ্ঠুর তিনি ।
মনে পড়ে বাইশ তেইশ বছর আগের কথা । মামুন তখনো হাটতে শেখেনি । আদর করতে কাছে গেলেই আঙ্গুল খামচে ধরতো আর হেসে বলে উঠত 'বাব্বু' ! তখনো আব্বু বলতে শেখেনি । ছেলেকে কাঁধে নিয়ে কত যায়গায় ঘুরেছেন । মানুষ বলতো ছেলের আনন্দে পাগল হয়ে গেছে । পাগলই তো ! দীর্ঘ এগারটি বছর পর তাদের সন্তান এসেছে ঘর আলো করে পাগলতো হবেনই !
রাস্তার পাশে কিছু বখাটে ছেলে উদ্ধত ভঙ্গিতে সিগারেট টানতে টানতে যাচ্ছে ।একটা ছেলে বলতে গেলে তার মুখের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে গেলো । চেহারা দেখে মনে হয় নেশা টেশাও করে । তিনি বিরক্ত ভরে মনে মনে খিস্তি ঝাড়তে ঝাড়তে সরে গেলে ওখান থেকে । তার হঠাত্ মনে পড়লো, মামুন কখনো কী এমন করেছে ? হয়তো বা তাকে কেউ গালি দিয়ে এভাবে ।তার জন্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করে !
ছোট থেকেই অনেক মেধাবী ছিলো ও ।কখনো আলাদা করে পড়তে বলতে হয়নি । সবসময় নিজের তাগিদেই পড়েছে ।এস এস সি তে যখন ও গোল্ডেন A+ পেল ।ভর্তি হলো একটা ভালো কলেজে । ছেলে যা চেয়েছে তাই তিনি দিতে চেষ্টা করেছেন সাধ্যমত ।মনে হয়েছিলো এখন থেকে যে ছেলে হয়তো নিজের ভালো মন্দ নিজেই দেখতে পারবে ।অতিরিক্ত বিশ্বাসের জন্য কখনো তার আলাদা কোন খোজ নেয়া হয়নি ।খোজ নিলেও সেটা শুধু লেখাপড়া কেন্দ্রিক । যদি তখন তার নৈতিকতার খোজটুকুও রাখা হতো তাহলে হয়তো এতটা অধপতনের সুযোগই পেতো না । অনুশোচনায় গুমড়ে উঠে তাঁর বুক ।
কলেজর হোষ্টেলে থাকতো ও।বাসায় ও আসতো না অতটা । বলতো পড়ার চাপ । আর ওদিকে কিছু খারাপ ছেলের সাথে থেকে সিগারেট শুরু করে আস্তে আস্তে মাদকের সাথেও সখ্য হয় তার । কখনো বাসা থেকে আলাদা টাকাও নেয়নি । যাতে কেউ বুঝতে না পারে । সেই টাকা যোগাতেই মাদকের ব্যবসায় ও জড়িয়ে পড়ে ।
যেদিন ওর মা ব্যাপারটা ধরতে পারে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে । একদিন বাথরুম একটা সিরিন্জ দেখেন তিনি । পরে এটা তার মুস্তাফিজ সাহেব দেখে ব্যাপারটা ধরতে পারেন । তারপর ছেলেকে অনেক বোঝানো হয়েছে । নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে; লাভ হয় নি ।
গতকয়েকদিন মাদক চোরাচালানের একটা গ্রুপকে ধরতে পুলিশ হন্যে হয়ে ঘুরছে । চক্রের অন্যতম সদস্য হিসেব মামুনের নামেও গ্রেফতারী পরোয়ানা ঝুলছে । শুনেছেন ছেলে তার দেশের বাইরে যাবার ব্যবস্থাও করে ফেলেছে সীমান্ত দিয়ে । একটি বার শুধু মায়ের সাথে দেখা করতে গভীর রাতে বাসায় আসবে । এরপরই দেশান্তর । নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত হাতে ফোন তুলে নিলেন মুস্তাফিজ সাহেব ।
আজ শনিবার শুনানী ছিলো মামুনের । জজ সাহেব সবশুনে মামুনের গ্রুপের মোট ৬ যাবতজীবন কারাদন্ড দেন । জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টাই তার কাটবে কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে । একই শহরে থাকবেন তারা সবাই । কিন্তু মা বাবা আর সন্তানের মাঝে থাকবে কারাগারের বিশাল প্রাচীর । আইনের দূর্ভেদ্য দেয়াল ।
মুস্তাফিজ সাহেবের বুকটা কেমন যেন করে ওঠে । মামুনকে বাচানোর কোন চেষ্টাই তিনি করেন নি । ওর মা অনেক অনুরোধ করেছিলো । কিন্তু তিনি বিবেকের কাছে থমকে গেছেন বারবার । সেদিন মামুন নিজেই ওর বাবাকে 'পিশাচ' ডেকেছিল ওকে ধরিয়ে দেয়ায় !
রাস্তা যেন শেষ হতে চায় না । এ পথের ওপার অনেক চিন্তিত মুখে বসে আছেন একজন মা । তার সপ্ন যত কিছুই হোক জজসাহেব মামুন নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবেন । এবার বাসায় এলেই ওকে একটা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করাবেন তিনি । ছেলেকে আবার গড়বেন তিল তিল করে । একে বারে ছোট্টবেলার সেই মামুনের মত । তার জীবনের সব কালীমা মুছে দেবেন ।তার সব সপ্নগুলো জোড়া লাগবে ফের ।কিন্তু তা কী হয় !