নজরুলের আরবী-ফার্সী শব্দ ব্যবহারেও চমক সৃষ্টি হত বটে, কিন্তু সে সকল শব্দ ব্যবহারের আরো গুরুতর কারণ কবির উপলব্ধির গভীরে প্রোথিত ছিল। যে সকল আরবী-ফার্সী শব্দ নজরুল ব্যবহার করেছেন, সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে একটি পরিষ্কার ধারণার সৃষ্টি হবে। কতিপয় আরবী-ফার্সী শব্দ তাঁর কবিতা-গানে একেবারে মনের ভেতর থেকে উঠে এসেছে। আর কতেক শব্দ তিনি ভাষাজ্ঞানের জোরে বাংলা কবিতায় নিয়ে এসেছেন। যে শব্দগুলো একেবারে তাঁর অস্তিত্বের ভিতর থেকে মাতৃভাষার মত স্বাভাবিকতায় বেরিয়ে এসেছে সেগুলোর পরিপূরক হিসাবে পড়ে পাওয়া শব্দগুলো এসে পোষ মেনেছে।
তাই মোহিতলাল কিংবা সত্যেন দত্তে আরবী-ফার্সী শব্দের ব্যবহার ছিল একটা নিরীক্ষার ব্যাপার মাত্র। কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল একটা ঐতিহাসিক কর্তব্যবোধ। নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্যভাষা নির্মাণে চলতি ভাষারীতির পাশাপাশি গৌণভাবে হলেও মুসলমান লিখিত পুঁথিসাহিত্যের ভাষাশৈলীটির দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতার স্পর্শে পুঁথিসাহিত্যের ভাষার মধ্যে নতুন একটা ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়েছে। এই বিষয়টিকে শুধুমাত্র সাহিত্যস্রষ্টার বিশেষ স্টাইল হিসাবে চিহ্নিত করলে নজরুলের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি উপেক্ষা করা হবে বলে মনে করি। আরবী, ফার্সী এবং উর্দু ভাষার শব্দ বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশেল দিয়ে কাব্য রচনা, তার সঙ্গে পুঁথিসাহিত্যের একটা সাদৃশ্য আবিষ্কার করা খুব কঠিন কাজ নয়। অতীতের পুঁথি-লেখকেরা বাংলা ভাষার সঙ্গে এন্তার বিদেশী শব্দ মিশিয়ে এক সময়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন। সে সাহিত্যের বৃত্ত খুবই সংকুচিত ছিল। যথেষ্ট মৌলিকতার স্ফূরণও সে সাহিত্যে কদাচিৎ লক্ষ্য করা যায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতারা এককথায় ‘বটতলার পুঁথি’ আখ্যা দিয়ে সেগুলোর বিশেষ একটা শ্রেণী নির্ণয় করেছেন। সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচারে পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে সারবান পদার্থ অধিক হয়ত পাওয়া যাবে না, কিন্তু নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এগুলোর মূল্য যে অপরিসীম, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সর্বপ্রথম হুমায়ুন কবীর তাঁর ‘বাংলার কাব্য’ গ্রন্থে পুঁথিসাহিত্যের এই বিশেষ দিকটির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। বাঙালী মুসলমান লিখিত পুঁথিসমূহে বাঙালী মুসলমান সমাজের মানস-জগতটির যথার্থ পরিচিতি ধরা পড়েছে। বাঙলার শ্রমজীবী-কৃষিজীবী আর মুসলমান জনগণের জীবন-জিজ্ঞাসা, মূল্যচিন্তা, বিশ্বাস-আচার রস-পিপাসা এসব বিষয় পুঁথিসমূহের উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এক সময়ে বাংলার আম মুসলিম জনগণের মধ্যে পুঁথিসাহিত্যের চর্চা ব্যাপকভাবে আদরণীয় হয়ে উঠেছিল।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক রূপায়ণের যে প্রক্রিয়াটি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শুরু হয়েছিল সেই বিশেষ সময়টিতেও দেখতে পাই, মুসলমান সমাজে পুরনো পুঁথি পঠিত হচ্ছে এবং লেখা হচ্ছে নতুন পুঁথি। তারপরে আধুনিক বাংলা ভাষা যখন সকল শ্রেণীর, সকল ধর্মের বাঙালী জনগণের উপর অপ্রতিহত প্রভুত্ব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে, আমরা দেখতে পাই, তখন সেই প্রক্রিয়াটিতে ছেদ পড়ে গেছে।
আবার বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে দেখতে পাই কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে ঠিক পুঁথিসাহিত্যের মত অতটা শিথিল ঢালাওভাবে না হলেও আরবী-ফার্সী শব্দ ব্যবহার করার একটা প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। এই বিশেষ ঘটনাটিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। বেশিরভাগ সমালোচক এটাকে নজরুল প্রতিভার বিশেষ দিক বলে চিহ্নিত করেছেন। কথাটা মিথ্যাও নয়। তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টির জন্য এটা লাগসই ব্যাখ্যা বটে। কিন্তু তাতে করে নজরুলের ভাষারীতির যে সমাজতত্ত্ব-সম্মত একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়, সে দিকটি উপেক্ষিত থেকে যাবে। নজরুলের সৃষ্টির সঠিক মূল্যায়নের জন্য আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিকাশ-প্রক্রিয়ার পাশাপাশি পুঁথিসাহিত্যের প্রেক্ষাপটের বিষয়ে ধারণা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
২
আমরা বাংলা ভাষার যে লেখ্যরূপটি ব্যবহার করে থাকি, তার সঙ্গে আমাদের জনগণের মুখের ভাষার বিরাট এক ব্যবধান রয়েছে। পৃথিবীর খুব কম ভাষার মধ্যে লেখ্যরূপ এবং মুখের ভাষার মধ্যে এই পরিমাণ দূরত্ব বর্তমান। বাংলা ভাষার আদি বিকাশ-প্রক্রিয়ায় এই ফারাক ছিল না। আধুনিক ভাষার যে বিকশিত রূপ আমরা ব্যবহার করে থাকি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা সংস্কৃত অভিধান ঘেঁটে এই ভাষার প্রাথমিক রূপরেখাটি তৈরি করেছিলেন। এই ভাষাটিই নানারূপ পরিবর্তন এবং রূপান্তরের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। যদিও পরবর্তীকালে ভাগীরথী-তীরের ভাষার সঙ্গে এই ভাষার একটা সুন্দর সংশ্লেষ ঘটেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের ভাষার সঙ্গে ভাগীরথী-তীরবর্তী জনগণের ভাষার সংযোগ-সমস্বয়, মিলন-বিরোধের ইতিহাসই আধুনিক বাংলা ভাষার ইতিহাস। প্রতিভাধর এবং সৃষ্টিশীল সাহিত্য-সাধকদের চেষ্টা-প্রযতœ এবং শ্রমের মধ্য দিয়ে এই ভাষাটি ভাব-চিন্তা, অনুভব-বিভব ধারণ করার উপযোগী হয়ে উঠেছিল, তাও প্রতিষ্ঠিত সত্য। তথাপি স্বীকার করতেই হবে, তামাম বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি অর্জনের পেছনে একটি মুখ্য এবং অগ্রগণ্য কারণ বর্তমান ছিল; আর সেটি হল শহর কলকাতার ভাষাটিই মুদ্রাযন্ত্র, সংবাদপত্র, পাঠ্যপুস্তক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার কল্যাণে বাঙালী জনগোষ্ঠীর উপর চেপে বসতে পেরেছিল। ভাষার এই বিকশিত রূপটি অগ্রাহ্য করার যেমন কোন কারণ নেই, তেমনি অভিধান থেকে এই ভাষার জন্ম সে-বিষয়ে একটা প্রাথমিক ধারণা না থাকলে বাংলা ভাষায় বিকাশ-প্রক্রিয়া সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা যাবে না।
ভারতবর্ষীয় ভাষাসমূহের মধ্যে বাংলাই প্রথম আধুনিক ভাষা হিসাবে গড়ে ওঠার সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল। অধিকন্তু বাঙালী মনীষীবৃন্দের সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়ায় এই ভাষা প্রাণবান, ভাবসমৃদ্ধ এবং অপূর্ব প্রকাশক্ষমতা-সম্পন্ন ভাষা হিসাবে বিশ্বমানবের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা ভাষার জন্য এ কম শ্লাঘার কথা নয়। তারপরেও কিন্তু এই ভাষার সঙ্গে জনগণের মুখের ভাষার দূরত্ব কখনো ঘোচেনি। প্রাথমিক নির্মিতির পর্যায়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের যে আত্মা ভাষার শরীরে আশ্রয় নিয়েছিল তা ছিঁড়ে ফেলা কখনো সম্ভব হয়নি।
পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত সময়ে বাংলা ভাষা বিবর্তিত হয়ে যে রূপটি পরিগ্রহ করে আসছিল, আরবী-ফার্সী ভাষার শব্দ যেভাবে বাংলা ভাষার মধ্যে স্থান করে নিচ্ছিল, সে প্রক্রিয়াটি হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে যায়। বাংলা ভাষায় সে রূপটির কিছু কিছু নমুনা এখনো একেবারে দু®প্রাপ্য নয়। ড. আনিসুজ্জামান সা¤প্রতিককালে কিছু প্রমাণ তুলে ধরেছেন। কবি ভারতচন্দ্রের মত সংস্কৃত জানা লোকের পক্ষেও এই ভাষার প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। তাঁকেও ‘যাবনী মিশাল’ ভাষায় কাব্য রচনা করতে হয়েছে। বাংলা দেশে মুসলমান শাসন শুরু হওয়ার পরে, ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতি লাভের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষাতে আরবী-ফার্সী ইত্যাদি শব্দ এসে মিশে যাচ্ছিল এবং ভাষার একটি নতুন চেহারা দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। ভাষাকে নদীর সঙ্গে যদি তুলনা করতে হয়, মেনে নিতে হবে এটা একটা উল্লেখ করার মত বাঁক।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষার আরেকটা বাঁক সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁরা আরবী-ফার্সী শব্দাবলী সম্পূর্ণ বিতাড়িত করে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত অভিমুখী একটি ভাষা হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। তাঁদের সে প্রয়াস সবটুকু ফলবতী হয়নি। কিন্তু যে ঝোঁক এবং প্রবণতা তাঁরা ভাষার শরীরের মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছিলেন, তার প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী হয়েছে। যদি পলাশীর বিপর্যয় না ঘটত, আজকের দিনে বাংলা ভাষার অন্যরকম একটি বিকশিত রূপ হয়ত আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। তবে ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’ নিয়ে তো আর আলোচনা চলে না, যা ঘটেছে তা-ই সত্য। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের যুগ থেকে বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে।
কলকাতা-কেন্দ্রিক বাংলা ভাষা কিন্তু শেষপর্যন্ত বাঙালী জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে বিস্তৃত হতে পারেনি। এই ভাষার বলয়টি ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং সঙ্কুচিত। ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব, সংখ্যাল্প সাক্ষরতা ইত্যাদি নানা কারণ নতুন নির্দেশিত ভাষাটিকে একটি বিশেষ সীমারেখার বাইরে অনেক দিন পর্যন্ত বিকশিত হতে দেয়নি। বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠী, আধুনিক শিক্ষার দুয়ার যাদের জন্য অনেক দিন পর্যন্ত রুদ্ধ ছিল তারা, পুঁথিসাহিত্যের মধ্যেই আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ পারস্পরিক সম্পর্কের যোগসূত্র হিসাবে যে ভাষাটি ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, পুঁথিসাহিত্যের ভাষার মধ্যে তার কিছু প্রমাণ মিলে। ভাষার সামাজিক চর্চার উপর নির্ভর করেই তো সাহিত্য রচনা করা হয়ে থাকে। একেবারে সামাজিক সম্পর্ক বিরহিত সাহিত্যের ভাষার কথা কল্পনাও করা যায় না।
(চলবে)