অর্চি যে রাতে মারা গেল
ইদানীং একটা ঝামেলায় পরেছি। শুন্য দৃষ্টিতে কোথাও তাকিয়ে থাকলে, দৃষ্টি স্থির হওয়া সেই জায়গায় কার যেন অবয়ব দেখতে পারি। এর মাঝে ছোট একটা বেড়ালের বাচ্চাকে বেশ কয়বার দেখেছি। যখন বুঝতে পারছি সেখানে একটা বেড়াল আছে, ঠিক তখনই বেড়ালটা অদৃশ্য হয়ে যায়। কখনো দেখেছি ছোট পলিথিন ব্যাগ উড়ছে। কিন্তু পরক্ষণেই দেখি সেখানে আসলে কিছু নেই। এই বিষয়টার সাথে প্রতিদিনের মৃত্যু ভয় বেড়েই চলেছে।
সেটা কি রকম?
নাকের উপর ঝুলিয়ে রাখা চশমা গলে যে লোকটি আমাকে প্রশ্নটি করলেন তিনি বিশিষ্ট সাইকিয়াট্রিস্ট। আমার কাউন্সেলিং করছেন। লোকটাকে আমার একদম পছন্দ না। এতো বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট কিন্তু পেসেন্টের সাথে উনার কথোপকথন শুনলে মনে হয় না যে তিনি পেসেন্টের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। আমি জানি কাউন্সিলিং এর সময় ডক্টর খুব নম্র ভাষায় কথা বলেন। রুগীকে জোরাজুরি করেন না। কিন্তু ড. মোহাম্মদ হাদি অন্য রকম মানুষ।
বেশ কিছু দিন ধরেই সমস্যাটা আমার। মাঝে মাঝেই মনে হয় আমি হয়তো এখন জীবিত নই। কেমন যেন বেমানান লাগে নিজেকে। কারও সাথে নিজেকে মেলাতে পারি না। নিজের দিকে বারবার চেয়ে দেখি সব ঠিক আছে কি না! কখনো মনে হয় আমি হয়তো উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় হাঁটছি। বারবার পরনের কাপড়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি, প্যান্ট পরেছি তো? আর শার্ট কিংবা টি শার্ট? হ্যাঁ, সব ঠিক আছে কিন্তু তবুও খানিক পর মনে হয়, নাহ, আমার পরনে কিছুই নেই। রাস্তায় হাঁটার সময় মনে হয় আমার শরীরের ওপর দিয়ে গাড়ি চলে গেল কিন্তু আমার কিছুই হয়নি। রাস্তা পার হয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, নিজেকে দেখি। মনে হয় এটা আমি নই। অন্য কেউ। এমন কেউ যে আমি ছিলাম কিন্তু এখন আমি নই। মৃত কোন মানুষ, যাকে কেউ দেখতে পারে না। ছুঁতে পারে না। যার জন্যে কেউ অপেক্ষা করে না, ভালবাসে না। মুখ ফুটে বলে না, কেমন আছি।
এ পর্যন্তই হয়তো ঠিক ছিল। সবাই ভেবে নেবে, ওহ, এইটা তো ছ্যাকা খাওয়া কেস। কিন্তু আসলে ছ্যাকা না, বিষয়টা খুব জটিল। আপনি যখন দেখবেন একটা জীবিত মানুষ, অন্য সবার মতোই কিন্তু তার জীবন ধারণ, চিন্তা ভাবনা, একদম অন্য রকম। কারও সাথে মিলবে না। আর সবাই যেভাবে কথা বলে স্বস্তি পায়, আমি সেটা পাই না। সব কিছুতেই কেন যেন আমার খুবই বিরক্তি। কেউ একটা কথা বলছে তো অন্য কেউ পাল্টা যুক্তি দিয়ে নিজেকে জাহির করতে চাইছে। আসলে এইসব দেখতে আর শুনতে মোটেই ভাল লাগে না আমার। হ্যাঁ, ঠিক আছে তুমি যখন বলছ তখন কেন মানতে পারছ না? না মানতে পেরেও তুমি হাসিমুখে আবার তর্ক করে যাচ্ছ। এইসব বিষয় যখন খুব পীড়া দেয় আমাকে তখন আমি নিজেকে নিজের ভেতর খুঁজে পাই না। তখন নিজেকে মৃত মনে হয়।
এটা আমার কোন অসুখ কি না জানি না। আমার সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক আমার কথা শুনে কাগজে খসখস করে কি সব লেখেন। তারপর সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে চলে যান। আমার তো করার কিছু নেই। বাবাই আমার সব আবার আমিই বাবার একমাত্র সাথী। এই সাজানো গোছানো সুন্দর একটা হাসপাতালে আছি ১২ দিন। বাবা প্রতিদিন এসে দেখে যান আমাকে। বাকি সময় নেন আমার সাইকিয়াট্রিস্ট। দিনের অধিকাংশ সময় নেটে কাটাই। করার মতো কিছুই করি না। ফেসবুকে বসে থাকি। সবার স্ট্যাটাস পড়ি আর বারবার মৃত থেকে মৃত হতে থাকি। তবে ইদানীং ফেসবুকে একটা মানুষের কথা খুব ভাল লাগছে। তিনিও গতানুগতিকতার বাইরে নন কিন্তু কিছু একটা আমাকে তার প্রতি টানছে। আমি যখন সে লোকটির লেখার প্রতি একটু করে ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যাচ্ছি, তার লেখার মাঝে নিজের মৃত হয়ে বেঁচে থাকাটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি ঠিক তার কিছুদিনের মধ্যেই শুনলাম তিনি না কি হার্ট এটাকে মারা গেছেন। তখন পর্যন্ত উনি আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেননি। সত্যি বলতে আমি কাঁদিনি। কাঁদার কথা বললাম এ কারণে যে যখন তার মারা যাবার সংবাদ জেনেছি তখন প্রিয়জন হারানোর মতো কষ্ট অনুভব করেছি কিন্তু কাঁদতে পারিনি। দু’দিন সবাই স্ট্যাটাস দিয়ে শোক প্রকাশ করল। কাঁদল, বলল এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কম আসে। উনার মৃত্যুতে আমাদের মতো অন লাইন এক্টিভিস্টদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়, ইত্যাদি সব ইত্যকার কথা পড়তে পড়তে টায়ার্ড হয়ে গেছি আমি। এরপর যথানিয়মে আমিও উনার কথা ভুলে গেছি।
ড. হাদি বাবাকে জানিয়েছেন আমি এখন বাড়ি যেতে পারব। আমার কাউন্সেলিং শেষ হয়েছে। তিনি আশা করছেন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে গেছি। আসলে আমি জানি আমি কেমন আছি। আমার পাশে যখন কেউ থাকে না তখন আমি আবার মৃত মানুষ হয়ে যাই। ঘরময় ঘুরে বেড়াই। ডক্টরদের বিশ্রামের রুমে রুমে গিয়ে ঘুরে আসি। কেউ টের পায় না। তবে একদিন এক ইয়াং অস্ট্রেলিয়ান ডক্টর আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গিয়েছিলেন কি করে যেন! হুজ দেয়ার, হুজ দেয়ার বলে যখন চেঁচিয়ে উঠেছেন তখন আমি দৌড়ে আমার রুমে ফিরে এসেছি। এরপর মাঝে মাঝেই আমি সেই ছোকরা ডক্টরের রুমে গিয়ে উঁকি দেই। তাকে আমার খুব ভাল লাগে। প্রচণ্ড গরমে এসির বাতাসেও ছেলেটি ঘেমে থাকে। তার গাল দুটো লাল টসটসে টমেটোর মতো হয়ে থাকে। আমি তাকে দেখি, সে তার গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ভিডিও চ্যাট করে। মেয়েটি অতো সুন্দর না দেখতে কিন্তু ওদের খুব ভাব। প্রতিদিন একবার চ্যাট না হলে ওদের ভাল লাগে না। আমি শুধু দেখি, রুমে এসে চ্যাট অন লাইন হই। কাউকেই খুঁজে পাই না কথা বলার মতো। এরপর আবার অফ লাইন হয়ে যাই। কাল বাবা আমাকে বাড়িতে নিতে আসবেন। আজকে একটা মেইল এসেছে ইউনিকো নামের এক বিদেশি সংস্থা থেকে, আমি যেন তাদের অফিসে এক্সিকিউটিভ ম্যানেজমেন্ট অফিসার হিসেবে জয়েন করি। আমার খুব ইচ্ছে হয় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিস করতে। একটা পারফেক্ট অফিসিয়াল ভাব ফুটিয়ে তুলতে ইচ্ছে করে নিজের মাঝে। খুব বুঝে শুনে কথা বলতে ইচ্ছে করে। সবাইকে দেখাতে ইচ্ছে করে আমি খুব ব্যস্ত আছি। এইসব ভাবনা মাথায় এসেই আবার ক্লান্তি ভর করে মনে। আজকে সে রকম কিছু হচ্ছে না। বেশ ভাল লাগছে আমার। ফেসবুকে একটা নোটিফিকেসনের শব্দে এলিয়ে থাকা শরীরটা টেনে তুলে চোখ রাখলাম নোটিফিকেসন বারে। একটা চরম আতংকে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে আমার। আমি কাঁপছি। কুলকুল করে ঘেমে যাওয়ার বিষয়টা খুব ভাল করে টের পাচ্ছি। অনেক দিন আগে ঝুলে থাকা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট হয়েছে। দুই দুয়ারি এখন আমার ফ্রেন্ড কিন্তু আমি খুব ভাল করে মনে করতে পারছি গত প্রায় ১০/১২ দিন আগে দুই দুয়ারি নামের ফেসবুকার হার্ট এটাকে মারা গেছেন এবং আমার এও খুব ভাল করে মনে আছে সেদিন খুব কষ্ট পেলেও আমি কাঁদতে পারিনি। তাহলে কে একসেপ্ট করল আমার রিকোয়েস্ট?
হঠাৎ মনে হল কেউ বুঝি উনার আইডির পাস জানত। অথবা হতে পারে উনার ওয়াইফ এই আইডি চালাচ্ছেন এখন। কিন্তু এটা কি যুক্তিযুক্ত? মৃত মানুষের আইডি চালানোর অধিকার কারও নেই, এমনকি তার ওয়াইফ কিংবা ছেলে মেয়ের। রাগ হচ্ছে খুব। ভয় কেটে গেছে কিন্তু রাগের চোটে উনাকে ম্যাসেজ করলাম। কে আপনি? সাথে সাথেই রিপ্লে এলো, অর্চি, আমি দুই দুয়ারি। গত ১৮ এপ্রিল যার মৃত্যু সংবাদে তুমি কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারনি।
যে মানুষের সাথে আমার কখনো কথা হয়নি সে কি করে জানবে আমি কার শোকে মুহ্যমান ছিলাম! আর এই মানুষ জানবেই বা কি করে, সে তো মৃত। তাহলে কি আমি বেঁচে আছি, না কি এবার সত্যি সত্যি আমিই মারা গেছি?
এরপর আবারও ম্যাসেজ এলো। মালিহার সাথে তুমি যা করেছ তা কি খুব ভাল করেছ? সে তো বেঁচে নেই। তোমার কারণেই ধমনী কেটে সুইসাইড করেছে। তুমি নিজেকে মৃত ভেবে সব কিছু এড়িয়ে চলতে চাও। যারা সব দেখেও না দেখার ভান করে, গা বাঁচিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখে তারা জীবিত থেকেই বা কি করবে! তবে তোমার মতো নিঃস্পৃহ মৃত আমি কখনো দেখিনি। তুমি মৃতদের চেয়েও মৃত। তা তোমার ২য় মৃত্যুর কারণ কি?
আমি জীবিত মানুষ। আপনি দয়া করা আমাকে মৃত বলবেন না। আর আপনি কে? আপনি তো মৃত। আপনি কি করে আমার সাথে ভার্চুয়াল ওয়েতে কথা বলছেন?
তুমি চাইলে আমি তোমার সামনে এসে কথা বলতে পারি কিন্তু আমি নিজে তা চাইছি না। মৃতরা কখনো তোমার মতো জীবিত মৃতের সাথে থাকতে পছন্দ করে না। তোমাকে পছন্দ করার মতো আছেই বা কি! তুমি না পার সুন্দর করে কথা বলতে, না পার সুন্দর সুস্থ্য চিন্তা করতে।
প্লিজ আপনি আমাকে আর ম্যাসেজ করবেন না। আমি আপনাকে চিনি না। আমি আপনাকে ব্লক করব।
ব্লক করে কি করবে তুমি? রাগ হচ্ছে? অভিমান হচ্ছে আমার ওপর? তুমি কেন যাও ঐ অস্ট্রেলিয়ান ছেলেটার রুমে? তুমি পাপ কাজ করছ। মালিহার অনুপস্থিতিতে কেন তুমি ছেলেটির ঘরে যাও? কেন, খুব কি উত্তেজনা অনুভব কর? পাপের শাস্তি তুমি পেয়েছ। কোন মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না তুমি। মালিহা তোমার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করে গেছে। তোমার বেঁচে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। আমি তোমাকে মরে যেতে সাহায্য করতে পারি। আসো, আমার হাত ধর।
তখন রাত কতো হবে মনে নেই। চারপাশে শুনশান নীরবতা কিন্তু আমার রুমে একটা চাপা আওয়াজ। শো শো একটা শব্দ, অনেকটা ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ। দুই দুয়ারির ম্যাসেজ পেয়ে আমি খুব উৎকণ্ঠিত। আমি মরে যেতে চাই না কিন্তু তবুও তার হাতে হাত রাখার জন্যে অপেক্ষা করছি। জীবিত থেকেও কি করে মৃতদের মতো থাকতে হয় আমি তা জানি। কিন্তু এবার আমি প্রকৃতই মরে যেতে চাই। দুই দুয়ারি কে, তা এখন জানার প্রয়োজন বোধ করছি না। হয়তো সে আমারই জীবিত অথবা মৃত অবয়ব। আমি ঠিক জানি না। আমি তার হাতের জন্যে অপেক্ষা করছি। শীতল দুই হাত। আমার গলায় জড়িয়ে রাখবে সে হাত। আমি মারা যাবা আজীবনের শুষ্ক গলায় বরফ শীতল স্পর্শে।
পরদিন ভোর
অর্চির বাবার অর্চিকে নিয়ে যাবার জন্যে হাসপাতালে আসার কথা সকালে কিন্তু ভোরেই তার কাছে ফোন করা হয়েছিল অর্চির মৃত্যু সংবাদ জানানোর জন্যে। মিস্টার আরেফিন নির্বাক বসে আছেন ছেলের লাশ নিয়ে। আর অর্চি আগের মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়। পার্থক্য শুধু এবার তাকে কেউ দেখছে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৩ রাত ১১:৪৬