আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে …
গোধূলির আলোয় ভরে ওঠা নিমগ্ন জলাভুমির ওপর ভাসমান নৌযানে পাশাপাশি বসে আছি আমরা দুজন। দাঁড় বাইছে মাঝি। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ নিশুতি রাতের গভীরে হারিয়ে যাবার প্রাক্কালে গোধূলির বাতায়ন খুব বেশি মায়াময় হয়ে উঠেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, অরণ্যের মাঝে অচেনা অজানা শব্দ, হয়তো কোন রাত জাগা পাখি, হয়তো বন্য কোন জীব। নৌকা চলছে ধীরে, ধীরে, খুব ধীরে। জীবন চলছে ঠিক এভাবে; ধীরে ধীরে। আজ তুমি কোথাও যেও না আমাকে ছেড়ে। তোমাকে আজ সব শুনতে হবে। জানি তোমার কাছে এসব কথার মুল্য নেই। নাই বা থাকুক তবু একবার তুমি শোন। কতবার বলেছি। শতবার, হাজারবার তবুও আজ আবার বলবো। আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে আমার। একটু পাশে থাকো। বিরক্তি নিয়ে উঠে চলে যেও না। একটা হাতে হাত রাখার দুর্বিষহ স্বপ্ন আজীবন কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে আমাকে। আমি মানুষকে ভালবাসি, ভালবাসাকে নয়। ভালবাসা বিষয়টা আমি বুঝতে পারি না। তোমার আগেও অনেকের জন্যে আজকের এই আকুলতা বোধ করেছি। খুব বেশি অনুভব করেছি সেসব হারিয়ে যাওয়া মানুষদের। হ্যাঁ, সবাই হারিয়ে গেছে। কেউ পাশে রাখেনি আমাকে। কেউ পাশে থাকতে চেয়েছে বলে যে চোখে রাজ্যের রংধনু আঁকবো আমি, তার প্রয়োজন হয়নি কখনো। তবে আমি খুব করে চাইতাম এই প্রয়োজন হোক। আমিও হারিয়ে গেছি তাদের কাছ থেকে। এখন তাদের প্রতি আমার কোন অনুভূতি কাজ করে না। আমি এখন আর তাদের জন্যে কাঁদি না। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে দুর্বিষহ মাথা ব্যথায় কাতর হই না। এই মন এখন তোমাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। শুধু ধরে রাখতে চাইছে বললে কিছুই বলা হবে না আমার, মন তোমাকে খুব কাছে পেতে চাইছে। এটা কোন নিষিদ্ধ কিংবা অন্যায় আবদার নয়। এ সত্য তুমি জানো। তুমি বোঝ দেহের এই আকর্ষণ কি করে সুকঠিন পাথরও ভেঙ্গে ফেলে। তুমি কোন কথা বোলো না। তুমি আমার পাশে বসে থাকো। আরো অনেক কথা বলার আছে তোমাকে। তরঙ্গে তরঙ্গে কতো কথাই তোমাকে ফিরিয়ে দেই। সেখানে কোন আবেগ থাকে না। আমি তখন তোমার চোখ দেখতে পারি না। বুঝতে পারি না নিমগ্ন চোখে তুমি আমার কষ্ট কতোটা বিস্তৃত করে রেখেছ। হয়তো তখন তুমি রঙিন স্ক্রিনে রঙিন মানুষদের উড়োউড়ি দেখছ। আমি তো জানি না তুমি তখন কিভাবে আমার প্রেরিত কষ্ট তরঙ্গ গ্রহণ করেছো। আদৌ করেছো কি না তাও জানি না। আজ তুমি আমার পাশে বসে থাকো। আমি তোমাকে শোনাব আমার কথা।
ভালোবাসার কথা শুনতে তুমি পছন্দ কর না। আমার মতো তোমারও অনেকেই থাকে। প্রতিনিয়ত তুমি একজন দুজন এভাবে অসংখ্য জনের হাতে হাত রেখে অনুভূতির তীব্র অথবা মৃদু আলোড়নে আলোড়িত হও। এ তোমার অভ্যাস। এ ছাড়া তোমার ভাল লাগে না। তোমার ভাল লাগে না আমার ভালোবাসার কথা শুনতে। তোমাকে আশ্রয় করে আমি ভালবাসাকে ভালবেসেছি। আদতে আমি তোমার এই চোখ, ঠোঁট, চিবুক আর অনিন্দ্য সুন্দর দু'হাতকে ভালবেসেছি। এর বেশি কিছু ভালবাসাতে আমার সাহস হয় না। খুব ইচ্ছে করে তোমার খুব গভীরে হারিয়ে যেতে। খুব গভীরে যেখানে আমি তোমার হৃদয়ের কাঁপন অনুভব করতে পারি। যেখানে তুমি শুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণ কর বেঁচে থাকার জন্য আমিও তেমনই শুদ্ধ অনুভূতি হয়ে তোমার খুব গভীরে বেঁচে থাকতে চাই। এতো গভীরে এতো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে থাকতে চাই যেন শুদ্ধতায় তুমি উচ্ছ্বসিত আনন্দে খিলখিল করে হেসে ওঠো। আমি মুগ্ধ হয়ে সে হাসি শুনতে থাকবো। শুনতেই থাকবো আজীবন।
তোমাকে নিয়ে লেখা কবিতায় আমি তোমার নাম দিতে পারি না কখনো। তোমাকে খুব সাধারণ করে ভালবাসতে চাই বলে, সবাইকে জানাতে চাই যে তুমি লোকের চোখে পতিতা হলেও আমার চোখে তা নও। তুমি আমার ভালবাসা। তুমি তোমার চোখ, ঠোঁট, চিবুক আর অনিন্দ্য সুন্দর দু'হাতের ভালবাসা আমার। কেউ যখন তোমাকে নিয়ে, তোমাকে না জেনে, তোমার এই সৌন্দর্যের অনুমান না করেই, তোমাকে ভালোবাসার সাহস না করেই শুধু অবজ্ঞা নিয়ে কটুক্তি করে তখন আমার বুক ভেঙ্গে যায়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে কেউ যখন পতিতা শব্দের চিরাচরিত ভুল প্রয়োগ করে। আমি তোমাকে মানুষ জেনেছি। তোমার শত শত পরিচিত অপরিচিত নব্য পুরনো ভালবাসিয়েদের কাছে তুমি যেমন হও, তাদের সাথে তুমি তোমার অথবা তাদের প্রয়োজনে যাই করে থাকো না কেন তুমি আমার কাছে, আমার মনের একান্ত যে গোপন এবং কবিতায় উন্মুক্ত বাগান সেখানে সবচেয়ে সুন্দর আমার প্রিয় কাঁঠালিচাঁপা ফুল হয়ে, হয়তো এরচেয়েও সুন্দর ফুল হয়ে ফুটে থাকো। সেসব ইতিহাস আমি জানি, মানুষ জানে না। আমি তাদের দোষ দেই না তবুও যখন ওরা আমার একান্ত প্রিয় এবং আমার আপন পতিতা নিয়ে, আমার তোমাকে নিয়ে ভুল, গতানুগতিক ব্যাখ্যা করে তখন আমি খুব অসুস্থ বোধ করি। আমি তখন জীবিত অথবা মৃত নই, আমি তখন অনুভূতি শুন্য মানুষ হয়ে যাই। আমার কথা শেষ হয়ে যায়। আমার প্রতিবাদ শেষ হয়ে যায়। আমার চোখে ক্লান্তি ভর করে। আমার কবিতায় যা সত্য সুন্দর, তা তুমি। সে আমি জানি, তুমি জানো না আর জানে না অসংখ্য লোকের জনসমাগম।
একটা হাত আমার হাত ধরে রেখেছে কিংবা একটা মানুষ আমার কাঁধে হাত রেখে পাশাপাশি বসে আছে, এটুকুই চাওয়া। এ জীবনে খুব সামান্য কিছু হয়তো চাইতে নেই। তুমি সামান্য কেউ নও। সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে বানিয়েছেন, যত্ন করে চোখ এঁকেছেন, ঠোঁট গড়েছেন, চিকুব ফুটিয়ে তুলেছেন আর অনিন্দ্য সুন্দর দু হাত গড়েছেন সে তুমি সামান্য তো কেউ নও। তবুও মনে হয় আমার এই চাওয়াটুকু নিতান্ত তুচ্ছ। এই তুচ্ছ চাওয়া কখনো পূরণ হবার নয় ভেবে যে অশ্রু নিয়মিত ব্যবধিতে ঝরে পড়ছে তার কোন মুল্য দেয়নি কেউ। পাথরের ঈশ্বরকে আর্তি জানাতে জানাতে চোখে জমে ওঠা জল জ্বালা ধরায় চোখে যখন, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেলে ঈশ্বরও ঝাপসা হয়ে যান। নিথর, স্থির চোখে মুখে সৌম্য কারুকার্য মেখে আমার ঈশ্বর পাথর হয়ে রন। যেমন হাসির মাঝে তেমনই দুঃখের দিনে, পরিবর্তনহীন এক ঈশ্বর প্রতিনিয়ত আমার চোখের জলে স্নাত হন। তিনি মানুষের চোখের জল হয়তো খুব পছন্দ করেন। চেয়ে চেয়ে দেখেন, পরিমাপ করে জল গ্রহণ করে আবারো নিথর হয়ে যান। কে জানে তাঁর মনের কথা। না তুমি, না আমি।
আঁধার নামছে। ঘন অন্ধকার। গমগম শব্দে ধ্বণিত হচ্ছে চরাচর। তুমি হঠাৎ আমার হাতে হাত রাখলে। তখন হয়তো পৃথিবীর কোন গল্প ছিল না, আমি বুঝিনি, আমি শুনিনি কোন শব্দ। সুদূর অরণ্য ভেদ করে ভেসে যাচ্ছে তোমার গান...
‘’আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে, আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে
দিন ও রজনী কত অমৃত রস উথলি যায় অনন্ত গগনে
আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে, আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে’’
তুমি গাইছো। আমার চোখে জল ঝরছে। তুমি বন্ধ নয়নে অমৃত সুধা ঢেলে যাচ্ছ আমার কর্ণে। ভেসে যাচ্ছে সে গভীর শব্দ। আকাশ পাতাল এক করে তুমি গেয়েই চলেছ। আমি জানি তুমি চলে যাবে এক সময়। তুমি পাশে বসে থাকতে পারো, গান গাইতে পারো। আর পার আমার হাতে হাত রাখতে। হে প্রিয়, ভালবাসার মতো পবিত্র বিষয় বিধাতা কেন তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিলেন? তোমাকে নিজ হাতে বানিয়েছেন বলেই কি এই খুঁত রেখে দিয়েছেন তোমার মাঝে? আর দেখো তোমার এই দূর্বলতাকেই আমি কতোটা আপন করে দিন দিন নিঃস্ব হবার আয়োজনে করছি। জানি তুমি চলে যাবে। আমি শুনব, আমি কাঁদবো না। আমি তোমার মতো গাইবো। আজীবন বসে থাকব এই জলযানে, তোমার পাশে অথবা তোমার বিরহে। এসো হে প্রিয়, আজ আমার বড় আনন্দের দিন। এসো আমরা সম্মিলিত কন্ঠে গেয়ে উঠি আনন্দের গান। জীবন সুন্দর করি। আর খুব বড় অভিনেতা অভিনেত্রী হবার জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করি। যাপিত জীবন যেন আমাদের সুন্দর হয়, সত্য হয়, পবিত্র হয়; ঠিক আমার আজকের এই পবিত্র অনুভুতির মতো। নিজের মনকে প্রশ্ন করি, ভাবি। শুদ্ধ হই, আর পবিত্র নয়নে নয়ন রাখি। ভালবাসি আর গেয়ে যাই আনন্দের গান...
আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে, আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে
দিন ও রজনী কত অমৃত রস উথলি যায় অনন্ত গগনে
আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে, আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে
পান করে রবি শশী অঞ্জলি ভরিয়া সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি
পান করে রবি শশী অঞ্জলি ভরিয়া সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি
নিত্য পূর্ণ ধরা জীবনে কি রণে
আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে
বসিয়া আছো কেন আপন মনে, স্বার্থ নিমগ্ন কি কারনে
বসিয়া আছো কেন আপন মনে, স্বার্থ নিমগ্ন কি কারনে
চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি ক্ষুদ্র দূঃখ সব তুচ্ছ মানি
চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি ক্ষুদ্র দূঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহ শুন্য জীবনে
আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে, আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে
দিন ও রজনী কত অমৃত রস উথলি যায় অনন্ত গগনে
আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে, আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে
ছবিঃ রাতারগুল ফরেস্ট, গোয়াইন ঘাট, সিলেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১১:০৩