somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ "দণ্ড"

২৫ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দীপা বেডসুইচটা অন করে দিল। নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঘুমোচ্ছেন না কেন? খালি এপাশ ওপাশ করছেন। ঘুমুন তো। নাকি ডরমিকাম (ঘুমের ওষুধ) নিয়ে আসবো?”
“কিছু লাগবে না” বলল নিলয়।
লাইটটা অফ করে শুয়ে পড়লো দীপা। পিছন থেকেই জড়িয়ে ধরল নিলয়কে। বলল, “টেনশন হচ্ছে?” নিলয় কোন উত্তর দিল না। দীপা আবার বলল, “সব ঠিকমতো হবে”
নিলয় এবার ঘুরে দীপাকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিল। বলল, “বাইরে ঝড় হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছো?”
“গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড় হচ্ছে আপনার মনে”
“তোমার মনে আছে, ২০০১এর দিকে যখন তোমার আমার পোস্টিং ছিল দেশের দুইপ্রান্তে। প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিউটি শেষে দু’জন দু’জনার কাছে যাওয়ার জন্য ছুটতাম। তুমি দূর থেকে যখন আমাকে দেখতে একটা হাসি দিতে। আশেপাশে লোকজন না থাকলে স্যুটকেস মাটিতে ফেলে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে আর ক্ষণিকবাদেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে। রাতে ঘুমানোর সময় আমাকে জড়িয়ে ধরতে আর বলতে ‘আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন’”
“হুম। মনে আছে। আর আমার সব রোমান্সে পানি ঢেলে দিয়ে বলতেন, ‘এই গরমে এতো জড়াজড়ি ভাল লাগে না। এই ছাড়ো তো’।”
“আর তুমি রাগ করে ছেড়ে দেয়ামাত্র আমি তো আবার জড়িয়েও ধরতাম”
“বিয়ে-প্রেমে প্রথম প্রথম অনেক উত্তেজনা থাকে। পরে মিইয়ে যায়”
“এখন উত্তেজনা নেই বুঝি?”
“সামনে ছেচল্লিশে পা দেবেন। আবার উত্তেজনা। কিছু কিছু বুড়ো ব্যাটাদের উত্তেজনা থাকে আজীবন। আর সেটাই হল ভীমরতি”
“আমি কি বুড়া ব্যাটা?”
“তো আপনি কি? খোকা?”
“না। কচি বুড়ো”
দীপা হাসতে লাগলো। অন্ধকারেই মাথা তুলে তাকালো নিলয়ের দিকে। বলল, “আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন”।
নিলয় বলতে লাগলো, “দীপা, তোমার মনে আছে যে বিয়ে দু’মাস যেতেই আমি তোমাকে বলেছিলাম, ‘ঐ ব্যাংকারকে বিয়ে করলেই পারতে। সোনা দিয়ে মুড়িয়ে রাখতো তোমায়। তোমার আফসোস হয় না?’ তখন তুমি হঠাৎ করেই আমাকে-”
“সব মনে আছে। তারপর বলেছিলাম, ‘An eye for an eye. আপনার মুখ বন্ধ করার জন্য এর থেকে মোক্ষম অস্ত্র নেই। গান শোনেন নি, ‘You say it best when you say nothing at all’?”
“কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে তোমার সব বান্ধবীদের মধ্যে সবচেয়ে সাদামাটা পোশাকে থাকতে তুমি। তোমার বান্ধবীরা যারা পুলিশ, উকিল, ব্যাংকার, ইঞ্জিনিয়ার বিয়ে করেছে, সবাই ভারী ভারী জুয়েলারী পড়ত। আমার ভেতরটা হু হু করে উঠত। মনে হতো, কি পেলে আমাকে বিয়ে করে? তুমি বুঝতে পেরে আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলেছিলে, ‘আপনাকে পেয়েছি, আমার গহনা, আমার এফ.সি.পি.এস পার্ট ওয়ান গহনা। গহনার কাজ কি? শো-অফ। আপনি আমার শো-অফ’।”
“এত্ত ভাল একটা বউ থাকলে লোকজন কত্ত সোহাগ করে”
“আমি কম করি সোহাগ?”
“এহ। সোহাগ বোঝেন আপনি? আমার পার্ট ওয়ান পরীক্ষার আগে কি করেছিলেন- মনে নাই?”
“সোহাগ করেছিলাম। আর কি করবো?”
“আপনার কি উচিত ছিল না এক কাপ চা বা কফি বানিয়ে দেয়া? তা-না”
“তুমি টেনশন করছিলে। আমি তোমার টেনশন রিলিফ করেছি”
“বদ-ব্যাটা। টেনশন রিলিফের আর কোন উপায় নেই নাকি?”
নিলয় কিছুক্ষণ হাসল। কিছুক্ষণ পর বলল, “জানো, সবচেয়ে কষ্ট কবে দিয়েছো আমাকে? যেদিন আমাকে কাপুরুষ বলেছিলে”
দীপা ঘুমিয়ে যাওয়ার ভান করল। নিলয় বলে উঠল, “এই দীপা, দীপা, ঘুমিয়ে পড়েছ?” তারপর হাত বুলোতে লাগলো দীপার মাথায়।

নাহিদ ফলো-আপ দিয়ে এসে পেপার হাতে নিল। এমন সময় ফোন বেজে উঠল। নীলার নাম স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে।
“হ্যালো”
“হুম, বলো”
“ব্যস্ত তুমি?”
“না। আচ্ছা শোনো, যে ডঃ দীপান্বিতার কথা পেপারে ছাপা হচ্ছে ইদানিং, উনি কি তোমার দীপা ম্যাম না?”
“হুম। খুবই ভাল মানুষ। পেপার-পত্রিকা তো কত কিছুই ছাপে”
“কিছুদিন আগের পেপারগুলোর হেডলাইনও খুব নোংরা ছিল। ‘ডাক্তারের অবহেলায় জনদরদী নেতা হারালেন পৌরুষ’, ‘একি কাণ্ড করলেন ডাঃ দীপা!’, ‘ভুল অপারেশনে আল-রাফি সাহেব হারালেন সব’, ‘ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে হারালেন পুরুষাঙ্গ ডাক্তারের ছুড়িতে’ হাবিজাবি...”
“আরে, ভুয়া। দীপা ম্যাডাম আমার দেখা ভাল মানুষদের মধ্যে একজন। উনি সার্জন হিসেবেও প্রশংসার দাবি রাখেন। ওটিতে ওপেন করার পর অবস্থা দেখে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে অনেক অ্যাকসিডেন্ট হতেই পারে। অনেক রিস্কি জানা সত্ত্বেও পেশেন্টকে বাঁচানোর জন্য সার্জনরা ডিসিশন নেয়, ক্যারিয়ারের ঝুঁকি নেয়। মানুষের শরীর তো আর ডিসাইন্ড ডিভাইস না যে হলুদ তারের জায়গায় হলুদ তার আর লাল তারের জায়গায় লাল তার থাকবে। এক একজনের শরীরের ভেতরটা এক এক রকম, রিপোর্টাররা সেটা বোঝে? ম্যাডামের পক্ষে Gross Negligence সম্ভব না। উনি ভীষণ অনেস্ট ও রেস্পন্সিবল মানুষ”
“উনি হাইড্রোসিলির পেশেন্টের টেস্টিস ফেলে দিলেন- ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত না?” [হাইড্রোসিলি হল শুক্রাশয়ের এমন একটি রোগ যেখানে অন্ডকোষের চারপাশে তরল জমা হয়ে স্ফীতাকার ধারণ করে]
“অনেকদিন ধরেই হাইড্রোসিলির পেশেন্ট ছিলেন উনি। হাইড্রোসিলির কমপ্লিকেশন হিসেবে Atrophy of testis(অন্ডথলি নষ্ট হয়ে যাওয়া) হতেই পারে যদিও ব্যাপারটা রেয়ার”
“তাই বলে Bilateral (দুইপাশের) Hydrocele থেকে Atrophy of both testis?”
“Two-faced baby, eight-legged baby, conjoint twin তো রেয়ার। But they do exist.”
“ম্যামের সাথে তোমার নিয়মিত যোগাযোগ হয় না এখন?”
“হয়। উনার জন্যই তো কোর্সের পাশাপাশি ঐ হাসপাতালটায় সপ্তাহে ৩-৪টা ডিউটি করতে পারি। নইলে এই বয়সেও চলার জন্য বাসার থেকে টাকা নেয়া লাগতো। সাধারণ মানুষ ভাবে, আমরা টাকার বিছানায় ঘুমাই। তারা যদি ডাক্তারদের ডাক্তার হবার পেছনের গল্প জানতো, এতো অভিযোগ করতে পারতো না। আমরা নাকি সরকারের টাকায় পড়ি? দেশকে সেবা দেয়া শুধু আমাদেরই দায়! অন্য পাবলিক ভার্সিটির ছেলেপেলের দায় নাই? ভর্তির পর ২০ হাজার টাকার কঙ্কাল কি সরকার কিনে দিয়েছিল? এখন তো দাম আরো বেড়েছে, ৩৫-৪০ হাজার। এক একটা মূল বইয়ের দাম ৩-৪০০০টাকা। ৬ বছরের পরিশ্রমের পর বিনা বেতনে ৪বছর খাটার পর ফুটো পকেট নিয়ে সেবার মন থাকা কি সম্ভব? আমাদের বাঁচতে হবে। মূর্খ জনগণ খালি অভিযোগই করবে। যে মানুষটা ১০-১৫ বছর ধরে হাজার খানেক প্রাণ বাঁচিয়েছে, তারাও আজ দুষছে আমার দীপা ম্যাডামকে”
“I hope she might get rid of all those bullshit”
“মেডিকেল রিপোর্টস সব ম্যাডামের পক্ষে। তবে আল-রাফি শয়তানটার ল’ইয়ার একজন ফেসবুক সেলেব্রিটি, সো সবাই তার পক্ষেই সাফাই গাচ্ছে”
“হ্যালো, রাখছি। পরে কথা হবে”

দীপা কোর্ট থেকে এসে টিভি অন করল। দীপার ল’ইয়ার মৃদুলকে দেখাচ্ছে কোর্ট থেকে বের হবার পর। মৃদুল বলছে, “দেখুন, আল-রাফি সাহেবের মেডিকেল রিপোর্টস এবং উইটনেস আই মিন আগে যেসব ডাক্তারকে উনি দেখিয়েছেন- সব আমার মক্কেলের পক্ষে। দেশের আইনে আমাদের বিশ্বাস আছে। এই কেসে সাফল্য এলে আমরা মানহানির মামলা করবো। ধন্যবাদ”।
এরপরেই দেখা যাচ্ছে আল রাফি সাহেবের ল’ইয়ার ফেসবুক সেলেব্রিটি কাদের আজমকে। সে বলছে, “বিবাদীপক্ষ যেসব কাগজকে ভিত্তি করে কেসটি সাজাচ্ছে সেগুলো ফেক। আমার মক্কেল জনাব আল-রাফি সাহব সরল বিশ্বাসে সকল রিপোর্টস ডাক্তার দীপার হাতে তুলে দিয়েছেন। সেসব রিপোর্ট সব গায়েব করে ফেক রিপোর্ট বানিয়ে সম্পূর্ণ প্লান করে ঘটনাটি করেছেন। পুরো ব্যাপারটাই একটা ষড়যন্ত্র”। একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, “আপনার কি মনে রাজনৈতিক আতাত থাকতে পারে?” উত্তরে বললেন, “দেখুন এই ব্যাপারে আমাদের হাতে সেরকম প্রমাণ নেই। সো নো কমেন্টস। তবে ডাক্তার দীপান্বিতার মত ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল না হলে দেশের ডাক্তাররা এমন অপরাধমূলক কাজ করার প্রেরণা পাবে। ধন্যবাদ”
নিলয় বলল, “তোমার রেজিস্ট্রেশন বাতিলের দাবিতে ফেসবুকে ইভেন্টও খুলেছে লোকজন”
“ফেমাস হয়ে গেলাম- কি বলেন? দু’দিন পর উইকিতে আমাকে নিয়ে পেজ খুললেও অবাক হবো না”
“গুগলেই তোমাকে পাওয়া যায়, নিউজ পোর্টালগুলোতে”
সাত মাস পরে কেসটা জিতল দীপা। তবে নাম যা খারাপ হবার, হয়ে গেছে। কোর্ট থেকে বাসায় ফিরে কফি বানালো দীপা। নিলয় এসেই বিছানায় শুয়ে পড়েছে। অনেকদিন ধরেই ঠিকমত ঘুম হয় নি নিলয়ের। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে নিলয়ের দিকে তাকালো দীপা। এই চৌদ্দ বছরে কত পরিবর্তন! মাথার চুল কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। চশমার পাওয়ারও বেড়েছে, বাড়েনি শুধু ওজন। দীপা ভাবছে, শেষমেশ কি পাপমোচন হলো? পাপ দিয়ে কি পাপমোচন হয়? চৌদ্দ বছর আগে করা পাপের থেকে কি মুক্তি মিলবে? গঙ্গাস্নানে যদি সত্যিই পাপমোচন হতো, অনেক আগেই করতো। পাপ ওর মনকে মুক্তি দেয় নি, দণ্ড দিয়ে আসছে সেই কবে থেকেই। মেয়েটির চেহারা এখনো প্রায়ই স্বপ্নে দেখে। স্বপ্ন না, দুঃস্বপ্ন। কতোটা অসহায় ছিল দীপা!
চৌদ্দ বছর আগে যখন জেলা সদরে পোস্টিং ছিল, সকাল ১০টার দিকে একদল লোকজন একটা মেয়ের ডেডবডি নিয়ে এসেছিল। দীপার সিনিয়র দীপাকে হ্যান্ডেল করার জন্য পাঠিয়েছিল। প্রথমের দীপা সুইসাইড কেস ভেবেছিল। সুইসাইড নোটও ছিল। ডেডবডি এক্সামিন করতে গিয়ে দেখলো, গলায় বসে যাওয়া দাগ দু’টো। একটা দাগ গলার সম্পূর্ণ পরিধি জুড়ে থাইরয়েড কারটিলেজের নিচে। অন্য দাগটি সম্পূর্ণ গলার পরিধি জুড়ে নয় এবং চিবুক ও স্বরযন্ত্রের মাঝামাঝি বাদামী রঙের। নখের দাগও স্পষ্ট। আরো অনেকগুলো চিহ্ন দেখে দীপা বুঝেছিল, দিজ ইজ নট আ কেস অফ সুইসাইড। গলায় ফাঁস দিয়ে মারার পর সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা হিসেবে সাজিয়েছে ক্রিমিনালরা। দীপা যা যা পেল, তাই লিখে রেখেছিল ইঞ্জুরি নোটে। সপ্তাহখানেক যেতেই কোর্টের নোটিশ এল। কয়েকদিন বাদেই কিছু লোক আসে দেখা করতে। তারা ছিল আল রাফি সাহেবের লোকজন। তারা দীপাকে বলল, দীপা যেন কোর্টে কেসটি সুইসাইড হিসেবে দাঁড় করায়। বড় অঙ্কের টাকাও অফার করেছিল। দীপা অফার ফিরিয়ে দেয়। বাগ-বিতণ্ডার শেষে বের হবার সময় একজন বলল, “এই দেশে এমনিই তোদের থাকা সমস্যা। ইন্ডিয়াতে তো যাবিই। ইজ্জতসহ যাবি না ছাড়া যাবি- ভেবে দ্যাখ”। দীপার দিকে বিশ্রী দৃষ্টি দিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। দীপা শিউরে উঠেছিল ভয়ে।
সন্ধ্যার দিকেই ছুটে এসেছিল নিলয় হন্তদন্ত হয়ে। এসেই জিজ্ঞাসা করেছিল, “এখানে নাকি রাফি মাস্তানের লোক এসেছিল?”
“হুম। আপনি কি করে জানলেন?”
“তোমার কলিগ টেলিফোন করেছিল”
“ও”
“ওদের সাথে ঝামেলায় যেও না। ওরা খুবই ডেঞ্জারাস। তুমি জানো-”
“জানলাম কিছুক্ষণ আগে। যেই মেয়েটির ডেডবডি এক্সামিন করেছি, সেই মেয়েটা ছিল রাফি গুণ্ডার বিরুদ্ধে করা ধর্ষণ মামলার একমাত্র সাক্ষী”
“ওরা এসে কি বলেছে?”
“বয়ান বদলাতে। কিন্তু আমি বদলাবো না” বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠেছিল দীপার।
“কী বলছো? আর ইউ স্টুপিড?”
“না। কোন আনইথিকাল কাজ আমি করতে পারবো না”
শক্ত করে দু’হাত দিয়ে দীপার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে নিলয় বলেছিল, “দীপা, তাকাও আমার দিকে। আমি বলছি, তোমাকে করতে হবে”।
সাথে সাথে দু’হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দীপা দৃঢ়কন্ঠে বলছিল, “না”। দীপার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
নিলয় আবার বলে উঠল, “দীপা, বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করো। তোমার আমার কিছু হলে কাউকে পাশে পাবে না। রোগীর লোকজন কিছু হলেই ডাক্তার মেরে চলে যায়, বিচায় হয়? হয় না। আর ওরা হল প্রভাবশালী মাস্তান। ডাক্তারসমাজ এদেশে এমনিই অবহেলিত। আমরা হলাম সংখ্যালঘুর মধ্যে সংখ্যালঘু”
“আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, আপনার মত এক কাপুরুষকে ভালবেসেছি আমি। আমার জীবনের কলঙ্ক আপনি” একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল নিলয় দীপার দিকে। দীপা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, “আজ এই মুহূর্ত থেকে আমি আর কখনো আপনাকে ভালবাসতে পারবো না। আমার ঘেন্না হচ্ছে, আপনি আমার স্বামী। নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করার ক্ষমতা নেই! ঘেন্না করি আপনাকে”
মাথা নিচু করে রইল নিলয়। ঠিক কতক্ষণ মনে নেই। দীপা দেখেছিল, টপটপ করে জল পড়ছিল মেঝেতে। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে বলছিল, “হ্যা, আমি কাপুরুষ। তোমাকে ভালবাসি বলেই আমি কাপুরুষ। তোমাকে হারানোর ভয় আছে, সেজন্যই আমি কাপুরুষ। আমার জীবনে তুমি না থাকলে হয়ত কাপুরুষ হতাম না। কখনো প্রকাশ না করলেও জেনে রাখো, আমি তোমাকে পাগলের মত ভালবাসি... এবং বাসবো তুমি ঘেন্না করলেও। তোমার সাথে থাকার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে পাপী মানুষ হতেও আমি দ্বিধা করবো না”
“নিজে পাপী হচ্ছেন কৈ? পাপী তো বানাচ্ছেন আমাকে। আমি যদি জানতাম, আপনি এতোটাই ভীতু, একটা মেরুদন্ডহীন মানুষ, কখনোই আপনাকে বিয়ে করতাম না” ঘৃণাভরা অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি নিয়ে দীপা তাকিয়ে রইল নিলয়ের দিকে।
নিলয় বলল, “হুম, আমি একজন ব্যর্থ স্বামী। অগ্নিসাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমাকে রক্ষা করবো। কিন্তু এতোটা আত্মবিশ্বাস নেই আমার, দীপা। আমি যদি সব ছেড়েছুঁড়ে ২৪ঘন্টাও তোমার পাশে থাকি, আমি জানি না ঐ হিংস্র জানোয়ারগুলো থেকে তোমাকে রক্ষা করতে পারব কিনা। আমি যদি বলি, তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না- সেটা মিথ্যা। সবাই জগতে একা আসে, একাই যায়। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো, কিন্তু তোমাকে ছাড়া বাঁচতে আমি চাই না”
“ও। ভয় পাচ্ছেন? যদি ছোঁয় আমাকে ঘরে তুলতে পারবেন না?”
“কিভাবে এতো সিওর হচ্ছো যে, রেপ করেই ছেড়ে দেবে? মেরে ফেলবে না। ধর্ষিত হও বা মৃত, আমার হাসিখুশি দীপা তো থাকবে না তুমি। আমি ‘আমার দীপা’কে হারাতে চাই না”
“আপনি অনেকক্ষণ আগেই হারিয়ে ফেলেছেন ‘আপনার দীপা’কে”।

উপরের দিকে থেকে চাপ আসায় দীপা অবশেষে কোর্টে বয়ান বদলায়। সুইসাইড কেস হিসেবেই মামলা চুকে যায়। শুধু পাপ হয়ে রয়ে যায় দীপার মনে। এরপর অনেক দিন ঠিকমত কথা বলেনি নিলয়ের সাথে। সেইসময় নিলয়ের চেহারা দেখলে বেশ বুঝতে পারতো, ভেতরটা কষ্টে কুঁকড়ে যাচ্ছে। একটা সময় পর দীপা বুঝতে পারল, যে দেশে গুন্ডারা হয় নেতা, সেদেশে টিকে থাকার জন্য মেরুদণ্ডহীন হওয়া ভিন্ন উপায় নেই। অনেক সময় স্বাভাবিক হতে পারেনি ওরা। নিলয় প্রায়ই ভয় পেত, দীপা যদি ওকে ছেড়ে চলে যায় কোন সুপুরুষের হাত ধরে। দীপা যায় নি বা যেতে পারে নি। কারণ সে কাপুরুষটাকেই ভালবেসেছিল।

কেস জেতার পর দীপা আবার অন্য একটা হসপিটালে জয়েন করে। ইন্সিডেন্টালি সেখানেই অন্য এক ডাক্তারের কাছে ফলো-আপে যেতেন আল-রাফি সাহেব। সেই কলিগের রুম থেকে বের হতেই দীপা সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল, “আল-রাফি সাহেব, ভালো আছেন?”
রাফি সাহেব কোন উত্তর দিল না।
দীপা বলল, “আপনার সাথে একটু ব্যক্তিগত কথা ছিল। আপনার সাঙ্গপাঙ্গদের একটু সরতে বলবেন প্লিয”
রাফি সাহেব ইশারা করলেন।
দীপা বললেন, “আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন, জানেন? এতোদিনেও আমাকে চিনতে পারেন নি আপনি। এটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। আপনার মনে আছে, চৌদ্দ বছর আগে আপনার বিরুদ্ধে করা পাঁচ নম্বর ধর্ষণ মামলার একমাত্র সাক্ষী সুইসাইড করেছিল? সেই সাক্ষীর ডেডবডি এক্সামিন করে বয়ান দিয়েছিলাম আমি। আমি আপনার একজন বিশস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী... ছিলাম। কি দরকার ছিল মামলা করে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করার?”
রাফি সাহেব বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। দীপা রাফি সাহেবের কাছে গিয়ে কানে কানে বলল, “ Once upon a time I decided to take out your balls”। বলেই মুচকি হাসি দিল দীপা।
তারপর রাফি সাহেবের বেল্টের নিচের দিকে তাকিয়ে বেশ জোরে জোরেই বলল, “যেসব দণ্ড অন্যের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়, সেসব দণ্ড ভেঙ্গে ফেলাই কি শ্রেষ্ঠ দণ্ড নয়?” তারপর চোখ মারল দীপা। তারপর ঘুরেই বাচ্চাদের মত খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আকাশে-বাতাসে মুক্তির ঘ্রাণ।

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১১:০০
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি কখনো কখনো কিছু ইঙ্গিত দেয়!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭



গতকাল ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এর ভার্চুয়ালি কথা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের অফিসায়াল এক্স পোস্টে এই ছবি পোস্ট করে জানিয়েছে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের পিছনে একটা ছবি ছিল ১৯৭১ সালের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলু

লিখেছেন স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



লতিফপুরের মতি পাগল
সকালবেলা উঠে
পৌঁছে গেল বাঁশবাগানে
বদনা নিয়ে ছুটে



ঘাঁড় গুঁজে সে আড় চোখেতে
নিচ্ছিল কাজ সেরে
পাশের বাড়ির লালু বলদ
হঠাৎ এলো তেড়ে




লাল বদনা দেখে লালুর
মেজাজ গেল চড়ে।
আসলো ছুটে যেমন পুলিশ
জঙ্গী দমন করে!





মতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×