ড্রইংরুমে নাহিদ বসে আছে। মীরা এসে নাহিদকে দেখে বলল, "কিরে,কি হয়েছে? হুট করে চলে এলি যে। তোকে এতো অস্থির লাগছে কেন?"
"শক খেয়েছিরে।"
"সে তো বুঝতে পারছি। কিভাবে খেয়েছিস-সেটা বল"
নাহিদ গাঢ় নীল রঙের একটা খাম দিলো মীরার হাতে। বলল, "খুলে দ্যাখ।"
মীরা বলল, "লাভ-লেটার নাকি? কে দিয়েছে তোকে?"
খাম খুলতেই ভেতর থেকে মৌ মৌ করে গোলাপের গন্ধ বের হল। মীরা বলল,"বাহ, পারফিউম দিয়েছে।"
"ওটা পারফিউম না, আতর।"
"যাই হোক, গন্ধটা কিন্তু বেশ।"
ভেতর থেকে গোলাপি রঙের টিস্যু কাগজের লম্বা একটি চিঠি বের করল। বলল, "মেয়েটির Aesthetical নলেজ দেখেই মুগ্ধ হচ্ছি। বেনামী রোমান্টিক চিঠি, দারুণ।" বলেই মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো মীরা।
কালোকালিতে ছাপানো অক্ষরের মতো করে লেখা। মীরা বলল, "চিঠি খুললেই একটা আইডিয়া করা যায়। কি বলতো?"
"কি?"
"চিঠি খুব সুন্দর করে লেখা, কোথাও কোন কাটাকাটি নেই। এ থেকে কি বুঝিস?"
"মানে বেশ কয়েকবার লিখেছে। এটি হল ফ্রেশ অ্যান্ড ফাইনাল কপি।"
মীরা পড়তে শুরু করল-
' অনেক আগেই চিঠি দিতে পারতাম। কিন্তু দেই নি। অপেক্ষায় ছিলাম, আপনি কবে ইন্টার্নশীপ করে বের হবেন। আপনার বের হবার আগে চিঠি দিলে, আপনাকে সামনাসামনি দেখলে হয়তো অস্বস্তিবোধ করতাম। তাই এতোদিনের অপেক্ষা।
ঠিক কিভাবে ব্যাখ্যা করবো-সেটাও বুঝতে পারছি না। আপনাকে ভালো লাগা বা আপনার প্রতি আমার অনুভূতির বয়স বেশক'টি বছর। কিন্তু বলতে পারিনি। মেয়েদের স্বভাব কি জানেন? একটা মেয়ে যতোই আধুনিক হোক না কেন কখনোই আপ্রোচ করতে চায় না। আজকাল অনেকেই করে অবশ্য। কৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে যাবার পর রাধা অপেক্ষা করে গেছে সারাটা জীবন। মেয়েরা এমনই, অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে আছি কখন আপনার চোখজোড়া এসে আটকে পড়বে আমার উপর, বন্দী করে রেখে দেবো।
"হ্যারি পটার" পড়েছেন কিনা জানি না। 'লাভপোশন' নামক তরল দ্রবনের উল্লেখ আছে বইটিতে। জাদুকরীরা লাভপোশনের মাধ্যমে ভালবাসার মানুষকে বশে আনতো। বাস্তবে লাভপোশনের অস্তিত্ব নেই, থাকলে আমি অবশ্যই অ্যাপ্লাই করতাম। আপনি খুব সুন্দর ছবি আঁকেন। আপনাকে দিয়ে নিজের একটা পোট্রেট আঁকানোর খুব ইচ্ছে আমার। আপনার সব কিছুই আমার ভালো লাগে, ভীষণ ভালো লাগে। বেনামী চিঠিতে বেহায়ার মতো সব বলা যায়। বলছি আমিও...
আপনি কি কারো কাছে থেকে ভয়াবহরকমের কষ্ট পেয়েছেন? যখন থেকে আপনাকে চিনি, আপনি কারো সাথে সম্পর্কে জড়ান নি। আপনি কি সম্পর্কে জড়াতে ভয় পান? রবীন্দ্রনাথের "অতিথি"গল্পের তারাপদের মতো আপনারো কি বন্ধনকে বেড়ী মনে হয়? সন্ন্যাস কি আপনার জীবনের আদর্শ? প্রশ্ন করেই যাচ্ছি, অথচ আপনার উত্তর দেবার সুযোগটাও রাখিনি।
"হোয়াইট ভ্যালেন্টাইন" নামের একটি ফিল্মে একলোক কবুতরের মাধ্যমে তার মৃত প্রেমিকার উদ্দেশ্যে চিঠি দিতেন, কখনোই উত্তর আসতো না। কবুতরটি তার লেখা চিঠিই ফেরত আনত। হঠাৎ একদিন তিনি চিঠির উত্তর পান। বাকি কাহিনী বলবো না। কোন রকম রেসপন্স পাবার জন্য আমার এই চিঠি নয়। আফসোস করতে চাই না জীবনে। ভালো লাগার মানুষকে ভালো লাগার কথা জানিয়েছিলাম অ্যাট লিস্ট। হোক না পরিচয় গোপন করেই। কি যায় আসে?
আরেকটা কথা জেনে রাখুন, আমার গুনমুগ্ধের অভাব নেই। তারপরও আপনাকে ভালো লাগে। আবেগের বেগের উপর কারো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যদি খুঁজতে চান, আমায় পাবেন রঙের মেলায়। ভালো থাকবেন এবং মনে রাখবেন, কেউ একজন আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। '
পড়া শেষে মীরা অভিভূত ভঙ্গিতে বলল, " অসাধারণ billet-doux"
"বিলি-ডু"
"প্রেমপত্র"
"একটা মেয়ে আমাকে পছন্দ করে- ভাবতেই যেন কেমন লাগছে।"
"জানি, ছেলেরা এই ধরনের thought দ্বারা খুবই fascinated হয়।"
"মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে চাই।"
"কেন?"
"কেন আবার? জানবো না মেয়েটা কে?"
"জেনে কি লাভ? তোদের ছেলেদের এইটাই সমস্যা। মেয়েটাকে হয়তো গ্রিন সিগন্যাল দিবি না। কিন্তু খুঁজে বের করবিই। কেনো?"
"মীরা, বাজে বকিস না। তুই জানিস, কাল রাতে আমি ঘুমুতে পারিনি।"
"ও আচ্ছা। শান্তির ঘুম ঘুমানোর জন্য মেয়েটাকে খুঁজে বের করে মেয়েটার ঘুম হারাম করতে হবে?"
"না। ভুল বুঝছিস আমায়। আমার অলফেক্টরি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে, সারাক্ষণই আমি ঐ আতরটার গন্ধ পাচ্ছি। সত্যি বলতে আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি। ওকে খুঁজে বের করতে চাই। অ্যান্ড আই নিড ইওর হেল্প।"
"ঊরে বাবা, একটা লাভলেটারেই কুপোকাত তুই? আচ্ছা। কিছু ব্যাপার তো চিঠি থেকেই উদ্ধার করা যায়।"
"কি কি বুঝলি?"
"মেয়েটা আমাদের জুনিয়র। কলেজের ম্যাগাজিনে খুঁজতে হবে। নামটা বের করতে পারলেই হল। রঙের নামে নাম।"
"এতো রঙের মাঝে নাম খুঁজবো কিভাবে?"
"রঙের মাঝে নাম খোঁজা কোন ব্যাপার না।"
"কে বলেছে? তোরা মেয়েরা সবুজের মধ্যে bottle green, lemon green, olive green,কত কিছু পাস।"
"ধুর। মেয়ের নাম নিঃসন্দেহে bottle green হবে না, গাধা। রঙ আছে লাল, সবুজ, নীল, বেগুনী, গোলাপি, হলুদ, কমলা, ম্যাজেন্টা, খয়েরী, সাদা, কালো, ধূসর, আকাশী, ফিরজা-এই তো।"
"সবুজ, বেগুনী, কালো, সাদা, হলুদ, খয়েরী, ধূসর, ম্যাজেন্টা বাদ। সবুজ ছেলেদের নাম হয়। খ্যেত নাম হলে হবে কমলা, গোলাপি, ফিরোজা। লাল দিয়েও নাম হতে পারে, যেমন, টুকিলাল, চম্পালাল।"
"উফ, লালও বাদ। নীলা হতে পারে। সাদা বাদ দিলি কেন? শুভ্রাও তো হতে পারে।"
"তাহলে তো কালোও বাদ যাবে না। কৃষ্ণা বা কৃষ্ণকলি টাইপ।"
"মেয়েটির অনেক গুনমুগ্ধ আছে, অর্থাৎ মেয়েটি রূপসী। সুতরাং কালো বাদ যাবে।"
"মেয়েটি সুন্দর কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছিস? সুন্দর মেয়েরা এভাবে চিঠি দেয় না। তারা সামনে দিয়ে ঘুরপাক খায় আর 'প্রপোজ মি'এক্সপ্রেশন নিয়ে বসে থাকে। মেয়েটি মোটেও সুন্দর হবে বলে মনে হচ্ছে না।"
"আমার মনে হচ্ছে মেয়েটি ভয়াবহ রকমের সুন্দর। নাম আকাশী বা আসমা হতে পারে। একটু বোস্, আমি কলেজের ম্যাগাজিন নিয়ে আসছি।"
মীরা ম্যাগাজিন নিয়ে এলো। ছবিসহ নাম দেখা শুরু করল। বের করল- মেহের আইরিন নীলা, নীলাঞ্জনা আহমেদ, আফরোজা শুভ্রা, কৃষ্ণাক্ষী নীলাপ্সরা ইসলাম, ফাহমিদা আসমা, ফিরোজা খান পিয়া। সাতজনের লিস্ট। এরপর মীরা বলল, " এদের মধ্যে থেকেই খুঁজে বের করতে হবে। দাঁড়া, পরিচিত জুনিয়রকে ফোন করে খোঁজ নিচ্ছি। "
মীরা ফোনে অনেকক্ষণ কথা বলল। তারপর নাহিদকে বলল, " শোন, লিস্ট শর্ট হয়েছে। ফিরোজার বিয়ে হয়ে গেছে। সো ও বাদ।"
"এমন কি হতে পারে না যে বিবাহিত মেয়ে চিঠি দিয়েছে?"
মীরা কটমট করে তাকাল, বলল, "না, পারে না।"
"ফিরোজা মেয়েটা দেখতে কিউট ছিল। ইস্..."
"নীলাঞ্জনা, শুভ্রা-দুজনেরই বয়ফ্রেন্ড আছে। বাকি থাকলো চারজন। কাল কলেজ যাবি। চারজনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবি।"
"আমার থাপ্পর খাওয়ার শখ নাই।"
"তুই সিনিয়র, থাপ্পর খাওয়ার প্রশ্নই আসে না। মাথায় একটা প্ল্যান আছে। চারটি মেয়ের ছবি মাথায় ঢুকিয়েছিস?"
"ধ্যাৎ"
"মেমোরিতে সেঁটে নে। আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটি ফাহমিদা আসমা বা নীলাপ্সরা। দুজনই অনিন্দ্যসুন্দর, এদের অবশ্যই অনেক admirer থাকার কথা।"
"আমার তো মনে হচ্ছে না। প্ল্যানটা কি?"
"প্রতেকের ক্লাসশেষে দাঁড়িয়ে থাকবি। ডেকে সুন্দর করে কথা বলবি। যেহেতু সিনিয়র, অসম্মান করবে না।"
"কৃষ্ণাক্ষী আর নীলাপ্সরা তো একই ব্যাচের। কাকে রেখে কার সাথে কথা বলবো?"
"ক্লাস তো একটা না, অনেকগুলোই হয়। একটা ক্লাস শেষে কৃষ্ণাক্ষী, আরেকটা শেষে নীলাপ্সরা। কিন্তু খুব গুছিয়ে কথা বলবি, ফাউল কথা বলবি না।"
নাহিদ পরদিন কলেজ গেল। মেহের আইরিন নীলা, কৃষ্ণাক্ষী খানম, ফাহমিদা আস্মা-প্রত্যেকের সাথেই কথা বলে বুঝলো, তাদের মধ্যে কেউই পত্রপ্রেরিকা নয়। কিন্তু নীলাপ্সরাকে টানা তিনদিন গিয়েও ধরতে পারল না। ফাঁকফোকর দিয়ে সটকে পড়তো। নাহিদ মোটামুটি বুঝেই ফেলল-মেয়েটি নীলাপ্সরা। চার নম্বর দিনে নীলাপ্সরা ধরা পড়ল। নাহিদ বলতে গেলে নীলাপ্সরার রাস্তা আটকে ধরল, বলল, " সিনিয়রকে ন্যুনতম রেস্পেক্টও কি করবে না? তোমার সাথে কথা বলতে চাই, নীলা।"
"জ্বি, বলুন।"
"আমাকে নীলখামওয়ালা চিঠিটা তুমিই দিয়েছ?"
"আপনি কি বলছেন-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।"
"ভালো করেই বুঝতে পারছ-আমি কি বলছি। অ্যাক্টিং করো না, নীলা।"
নীলা অসহায়ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকাতে লাগলো।
নাহিদ বলল," নীলা, তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে এখানে আসিনি। হয়তো তোমার চিঠিটা লাভপোশনের মতো কাজ করেছে।
নীলা অবাক হয়ে তাকাল নাহিদের চোখে, অপলক দৃষ্টিতে। নাহিদ বলতে লাগলো," তোমার চিঠির প্রতিটি শব্দ cupidএর এক একটা তীরের মতো বেঁধেছে আমার বুকে। তোমার চিঠি পাবার পরপরই "হোয়াইট ভ্যালেন্টাইন" ডাউনলোড করে দেখেছি। ফিল্ম দেখতে আমার একেবারেই ভালো লাগে না, রোমান্টিক তো আরও না। কিছু মনে করো না, ফিল্মটা খুবই বোরিং ছিল। আমাকে কালোজাদু করার জন্য তোমার চিঠিই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু তোমাকে সামনাসামনি দেখে... হিরো আর লিয়েন্ডারের গল্পটা জানো? হিরো ছিল রূপবতী এক priestess, লিয়েন্ডার তাকে দেখে বিমোহিত হয়। শুধু হিরোকে দেখবার জন্য প্রতিরাতে বিশাল সাগর সাঁতরে আসতো লিয়েন্ডার। এক ঝড়ের রাতে সাঁতরে আসার সময় লিয়েন্ডার মারা যায়। তোমার জন্য আমিও আসব রোজ..."
মৃদু হাসল নীলা। হাসলে আরো সুন্দর লাগে নীলাকে।
একটা মেয়ে এতোটা সুন্দর হয় কিভাবে? আর সেই মেয়েই বা কিভাবে আমার প্রেমে পরে?-ভাবছিল নাহিদ। হয়তো এমনই কোন এক রমণীকে দেখে কবিগুরু বলেছেন-'মরিতে চাহি না এ সুন্দর ভুবনে'
নীলা বলল," আপনি বোধ হয় পুরো গল্পটা জানেন না। লিয়েন্ডারের মৃতদেহ দেখার পর হিরো উঁচু টাওয়ার থেকে লাফ দিয়ে সুইসাইড করে যাতে মৃত্যুর পর সে এক হতে পারে তার লিয়েন্ডারের সাথে।"
"জানি, তুমি জানো কিনা দেখছিলাম।"
"একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?"
"কি?"
"আপনি কি স্পীচ রেডি করে এসেছিলেন?"
নাহিদ মুচকি হেসে বলল, "সব কিছু জানতে হয় না।"
দশবারোদিন পর। নাহিদ ও নীলা এক রেস্টুরেন্টে বসে কথা বলছে।
নাহিদ বলল," তোমার নামটা ডিফরেন্ট, উচ্চারণ করাও কষ্ট।"
"জন্মের পরই আব্বু বুঝতে পেরেছিলেন, আমি নাকি আম্মুর থেকেও সুন্দর হবো। দাদা বলেছিলেন,'নাম পরী হোক'। আব্বুর কাছে পরী নামটি unsmart মনে হয়েছিল। আব্বু ঠিক করলেন, অপ্সরা হবে। ওদিকে আম্মু বলল, 'নীলা হওয়া চাই'। তারপর মিলিয়ে হল নীলাপ্সরা। আমার ছোটোটার নাম তো আরো ভয়াবহ।"
"হুম, কৃষ্ণাপ্সরা, উচ্চারণ করা আরো কষ্ট।"
"কৃষ্ণা বলে, ও নাকি আমার থেকে সুন্দর কাউকে দেখে নি।"
নাহিদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে বলল," আমিও দেখি নি।"
"তাহলে গত চার বছরে একবারো কেন তাকাওনি?"
"মামা বলতেন,'খুব সুন্দর কোন কিছুতে একবার চোখ পড়লে চোখ সরিয়ে নিতে হয়। দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দেওয়া ঠিক না। যদি দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দিস, মোহ হবে। পেতে ইচ্ছে করবে। আর না পেলে ভীষণ কষ্ট হবে।' "
নীলা হাসল। শুধু পৃথিবী নয়, পুরো মহাজগতে এতো সুন্দর হাসি কারো হতে পারে না। পৃথিবীর ইতিহাসে হেলেন অফ ট্রয়, মিশরের ক্লিওপেট্রা, নূরজাহানের পাশাপাশি নীলার নামও যুক্ত হওয়া উচিৎ। বাংলার নীলা, উহু, নাহিদের নায়াদ। নায়াদ মানে 'জলপরী'।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৯