গাইনোকোলোজিস্ট মিসেস সাবরিনার কেস নিয়ে হুলস্থুল পড়ে গেল। সাংবাদিকেরা মিসেস সাবরিনাকে হেডলাইন বানিয়ে খবর ছাপাচ্ছে। কিছু কিছু পেপারের হেডলাইনও সেইই হচ্ছে, যেমন 'কন্যাশিশুহন্তারক ডঃ সাবরিনা', 'ডাইনি সাবরিনা', 'জল্লাদিনী না ডাক্তার?' ইত্যাদি ইত্যাদি। এক প্রাইভেট ক্লিনিকে দিনের পর দিন মেয়েশিশুর অ্যাবরশন করে আসছেন। একজন নারী হয়ে কিভাবে এ কাজ করছেন তা সমাজের প্রশ্ন, ব্লগারদের প্রশ্ন, মানুষের প্রশ্ন। বিভিন্ন স্কুল কলেজের মেয়েরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল কেস চলাকালীন সময়ে। কেসের রায়ের দিনেই সব বদলে গেল। Criminal abortionএর প্রমাণস্বরূপ যথেষ্ট কাগজপত্র পাওয়া গেল। পুরোসমাজ মহিলাকে ধিক্কার দিচ্ছে, জীবিতপুতে ফেলতে চাইছে। ডঃ সাবরিনাও defence-এ কিছুই বলেন নি, সব মেনে নিয়েছেন। Self-justificationএর সময় তার কথা শুনে সবাই থমকে গেল।
ডঃ সাবরিনা কথা বলার জন্য সময় চাইলেন। আদালত সম্মতি দিলে বলা শুরু করলেন ডঃ সাবরিনা, "দেখুন, আমি যা করেছি সজ্ঞানে করেছি। আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। শুধু জানাতে চাই যে, যা করেছি তা টাকার জন্য নয়, সমাজের জন্য করেছি। আপনারা আমাকে ঠেকিয়ে কি সারাদেশের ক্রিমিনাল অ্যাবরশন বন্ধ করতে পারবেন? না পারবেন না, আপনাদের আইনের ক্ষমতা খুবি সীমাবদ্ধ। আজ আমি যদি কোন অ্যাবরশন করতে Deny করি, ঐ দম্পতি অবশ্যই অন্য কোথাও যাবে। হয় অন্য কোন ডাক্তার, নার্স, দাই, ওয়ার্ডবয়ের কাছে। অদক্ষ নার্স, দাই, ওয়ার্ডবয়দের অ্যাবরশন পদ্ধতি সম্পর্কে কোন আইডিয়া আছে? প্রায়ই ঐসব septic অ্যাবরশনে মা মারা যায়। হয় ইনজেকশনের মাধ্যমে এসিড, ক্ষার বা বিষাক্তরস বা পেস্ট পুস করবে, নয়ত স্টিক, রড, বাঁশের কঞ্চি ঢুকাবে। আপনি কতটুকু ধারণা রাখেন? পুরুষ কন্যাসন্তানকে মারার জন্য স্ত্রীকে ইলেকট্রিক শক দিতেও দ্বিধা করে না। এসব থেকেই নিরীহ মেয়েগুলোকে আমি বাঁচাচ্ছি। আপনাদের চোখে আমি দোষী, কিন্তু আমার বিধাতা জানেন- আমি কি। কন্যাসন্তান যেসব পরিবারে welcomed নয়, সেসব পরিবারে এসে তারা আর ভোগান্তির শিকার হবে। এই সমাজ মেয়েদের deserve করে না। যদি সমাজব্যবস্থা চাইতো, তারা অনেক better স্টেপ নিতে পারতো। খাবার স্যালাইন, পরিবার পরিকল্পনাগুলোর ব্যাপারগুলো টিভিতে প্রচার হচ্ছে। আমাদের সিস্টেম কি পারতো না প্রচার করতে যে- সন্তানের সেক্স নির্ধারিত হয় বাবার জিন দ্বারা। বাবার থেকে Y জীনটি আসলেই সন্তান ছেলে হয়। কিন্তু না, সিস্টেম সেটা প্রচার করবে না। কন্যাসন্তান প্রসব করার জন্য কতো মেয়ে তালাকপ্রাপ্ত হচ্ছে, নির্যাতিতা হচ্ছে- জানেন? পারলে ডাটা দেখবেন। আমি অ্যাবরশন করলে দোষী, পুরো সমাজটাই যে অ্যাবরশন করে আসছে-সেটা কি? শুধু শুধু কিছু নিস্পাপ মেয়েশিশুকে অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে কেন আসতে দেব? তারা তখনই আসবে যখন তারা হবে কাঙ্ক্ষিত। একটা মেয়ে জন্মের পর থেকেই গঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, আমি সেটা কেন হতে দেব? Can you tell me? যে সমাজে কয়েক মাসের কন্যাশিশু থেকে শুরু করে ৮৫বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত রেপএর শিকার, সেই সমাজে তাদের কেন আসতে দেব? কোন মেয়ে ধর্ষিত হলে, সবাই মেয়েটির পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে চোখ দেয়। সেগুলো ঠিক থাকলে, মেয়েটির চলন-বলন। চলন-বলন ঠিক থাকলে বলবে, মেয়েটি ঘর থেকে বের হয়েছিল কেন? ঘরেও যখন রেপ হয়, তখন সমাজ চুপ। সমাজ ধর্ষককে খোঁজে না, খোঁজে ধর্ষিতাকে, আর ধর্ষকের চোখ খোঁজে নতুন ধর্ষিতাকে। ধর্ষকের কোন ধর্ম নেই, কিন্তু সমাজ ধর্ষিতাকে ধর্মহীন করে ছেড়ে দেয়। ধর্ষকের শাস্তি হয় না, দিব্যি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় যেন ধর্ষণ তার অধিকার। শুধু পুরুষের দোষ দেওয়া যায় না, মেয়েরাও কম যায় না। "Don't teach me what to wear, teach your son not to rape"কথাটিকে বহু মেয়ে ধিক্কার জানায়। এসব মেয়েদের সন্তানেরাই ধর্ষক হয়ে ওঠে। নারীআন্দোলনকে ধিক্কার জানিয়ে এসব মেয়েরা নানা বুলি ছাড়ে, 'মাতৃত্বকালীন ছুটির মত পিতৃত্বকালীন ছুটি নেই কেন?' নিজের মাকে এভাবে অপমান করতেও বাঁধে না ঐসব মেয়ের। ওদেরকে কে বুঝাবে যে- তোরা পিতার গর্ভে আসিস নি? সুশীল সমাজ ও তথাকথিত ধার্মিকেরা তো আছেই। ইতিহাস বিকৃত করে আসছে ভণ্ডের দল, তাদের পক্ষে ধর্মকে বিকৃত করাও কোন ব্যাপার না। নতুন নতুন সূরা, শ্লোক, হাদিস বানিয়ে মেয়েদের ঘরে বেঁধে রাখতে চায় নপংশুকের দল।
ধর্ম কখনোই নারীস্বাধীনতাবিরোধী নয়, কখনো ছিল না। ভেজাল শুধু খাবারে নয়, পুরুষজাতি ভেজাল মেশায় ইতিহাস ও ধর্মে।
সতীদাহ, যৌতুক, বহুবিবাহ, হিল্লাবিয়ে সব লোভীপুরুষের সৃষ্টি। হিন্দুধর্মে কন্যাদের সম্পত্তিপ্রদানের কথা আছে বিয়ের সময়, যার উপর শুধুমাত্র তার অধিকার। আগ্রাসী পুরুষসমাজ 'যৌতুক' বানিয়ে দখল করল, আজো চলছে শিক্ষিত সমাজে 'গিফট' নামে। রাজা রামমোহন সতীদাহ রদ করলেন, বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ চালু করলেন শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনকে ব্যাখ্যা করেই। কিন্তু সুশীল সমাজ ও বাংলা সাহিত্যের বাঁকা চাঁদ 'বঙ্কিমবাবু'র সহ্য হল না, লিখে ফেললেন 'কমলাকান্তের উইল'। বেগম রোকেয়ার আবির্ভাবে যেন আরেক তাণ্ডব হল। মীর মোশাররফ রোকেয়ার স্কুলকে 'যুবতী বিধবার রূপ-যৌবনের বিজ্ঞাপন' উপাধি দিয়েও যেন তৃপ্ত হন নি। যখন কোন নারী এসেছে সমাজের হাল ধরতে, তাকে পুরুষেরা 'ডাইনী' বলেছে। জোয়ান অফ আর্ক। মাদাম কুরীর দুবার নোবেলপ্রাপ্তিকেও ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না, প্রথমবার স্বামীর সাথে ও দ্বিতীয়বার স্বামীর দেখানো রাস্তার মাধ্যমে। পুরুষেরা হিরো হয়ে থাকতে চায় সবসময়। ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈকে তারা চেনে না, প্রীতিলতাকে তারা চেনে 'সূর্যসেনের প্রেমিকা' হিসেবে!!! হিন্দুসমাজ বেদদ্রষ্টা গার্গী, মৈত্রেয়ী, লোপামুদ্রার কথা ভুলে যায়, মুসলিম সমাজ রোকেয়াকে ভুলতে পারলেই যেন বাঁচে। এই সমাজ সংশোধনের জন্য একজন রোকেয়াতে কিছু হবে না, দরকার লাখো রোকেয়া।
হিন্দিসিরিয়ালখেকো রমণীরা সিরিয়াল দেখেই পুরুষকে ভালবেসে ফেলে। সেসব রমণীদের জানা উচিত- তুমি ধর্ষিত হলে, সিরিয়ালের নায়কের মতো তোমার নায়ক তোমাকে গ্রহণ করবে না, অন্য পুরুষ ছুঁলেই তুমি নষ্ট। পুরুষমাত্রই স্বার্থপর। অর্থ, ঐশ্বর্য, যৌনতার জন্য নিজেরা যুদ্ধে লিপ্ত হয় আর দায়ী করে মেয়েদের। 'ট্রয়ের অভিশাপ' হিসেবে সবাই হেলেনকেই জানে, পুরুষের যৌনক্ষুধাকে নয়। বহুপত্নীক পরিবার তাদের কাছে খুবই নরমাল ব্যাপার, কিন্তু বহুপতিক পরিবার জঘন্য। রোকেয়া নারীমুক্তি চেয়েছিলেন, আমিও সমাজের নারীমুক্তি চাই। সমাজ নারীমুক্ত হলেই নারীর মর্ম বুঝবে, তাই না? আরো অনেক কিছু বলার ছিল, থাক।"
মিসেস সাবরিনার পুরোটা বক্তব্য পত্রিকাগুলোতে ছাপা হল। বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানীরা ডঃ সাবরিনাকে 'Psychopath' অর্থাৎ 'মানসিকভাবে অসুস্থ' বলে আখ্যায়িত করেন।
কোর্টে এবার বিভিন্ন সাইক্রিয়াটিস্ট এলেন। তারা প্রত্যেকেই ডঃ সাবরিনার মেন্টাল চেকআপ করে রিপোর্ট দিলেন আদালতে। বের হয়ে আসলো ভয়াবহ কিছু তথ্য। ডঃ সাবরিনা বলল, " আমার হিস্ট্রি সম্পর্কে সকল ইনফরমেশন সঠিক। এসব তথ্য দিয়ে আমাকে অপ্রকৃতস্থ প্রমান করাও সোজা। আসলে কি জানেন? আমাদের সমাজটা অপ্রকৃতস্থদের কাছে থেকেই সত্য শুনতে ভালবাসে। কোন পলিটিশিয়ানকে স্বাভাবিক সুস্থলোক সামনাসামনি 'চোর-বাটপার' বলার স্পর্ধা করবে না, কিন্তু পাগল নির্বিকারে বলে ফেলবে।
আমার যখন এগারো বছর, তখন এলাকার মাদকগ্রুপটি আমায় তুলে নিয়ে যায়। ৫৫দিন টানা চলতে থাকে।" ডঃ সাবরিনার চোখ টলটল করতে থাকে, কিন্তু ঠাণ্ডা নির্বিকার গলায় বলতে থাকেন তিনি, " আমায় কলেমা পড়ানো হল। ধর্মহীনেরা আমায় ধর্মদীক্ষা দিল। মিডিয়াতে প্রথমে কিছু না আসলেও এলাকায় সবাই জেনে যায়। হসপিটাল থেকে ফেরার পর বাঁকাচোখে দেখত সবাই। মা সারাদিন আমাকে জরিয়ে কাঁদত। বাবা দেশছাড়ার বন্দোবস্ত করল। আমি যাই নি। আমার অপরাধ কি? আমি কেন পালাবো? এক নিঃসন্তান মুসলিম পরিবার আমাকে দত্তক নিলেন। উনারা আমাকে আমার মতই থাকতে দিলেন, প্রচণ্ড ভালবাসতেন আমাকে আব্বুআম্মু। আমার ঘরে পুজোর আসন করে দিলেন, আত্মীয়রা ভালভাবে নিল না। ঐদিন থেকে "আব্বু-আম্মু" ডাকি। আমি ঘুমুতে পারতাম না, ঘুমের মধ্যে চিৎকার করতাম, কাঁদতাম। Rape Trauma Syndrome। সারারাত আম্মু থাকতো আমার সাথে।
জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর ধর্মান্তরিত করার ঘটনা বিরল নয়, অহরহ হচ্ছে। কিন্তু কোন ধর্মই মানুষকে ভুল শিক্ষা দেয় না।
আব্বু-আম্মু ভালঘরে বিয়ে দিলেন। আমার হাজব্যান্ড আমার অতীতের ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। পুরুষ তো পুরুষ। কৈশোরে বা তারণ্যে নিষিদ্ধপল্লীতে যৌনতা উপভোগ করতে দ্বিধা করেন নি, কিন্তু স্ত্রীর এই অতীতে মর্মাহত। অন্য মেয়ের সতীত্ব নস্ত করতে পুরুষের বাঁধে না, কিন্তু নিজের স্ত্রী সতী চাইই চাই। ড্রাগ অ্যাডিক্ট হয়ে পড়লেন, মারাও গেলেন।"
আদালতের নির্দেশে সাবরিনাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হল। মাসখানেক বাদেই রিলিজ পেলেন। আবার কাজ শুরু করলেন। অপ্রকৃতস্থ থাকায় তার অপরাধ গণ্য হয় নি, তাই বিএমডিসি থেকে নাম কাটা হয় নি।
গুজব আছে, ড্রাগ অ্যাডিক্ট হাজব্যান্ডকে নিজেই স্লো পয়জনিংএর মাধ্যমে মেরে ফেলেন ডঃ সাবরিনা।
ডঃ সাবরিনার সাথে দেখা হয়ে গেল মৃদুলের। মৃদুল বলল, "এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হলেন?"
"দেখুন, সাইক্রিয়াট্রি ওয়ার্ডটা আমিও করেছি।"
"একটা বিষয় কি জানতে পারি?"
"কি?"
"আপনি দেশ ছাড়লে নিজের নাম,পরিচয়, ধর্ম নিয়েই জীবনযাপন করতে পারতেন। কেন গেলেন না?"
"দেখুন, বিধাতার কাছে সবাই সমান। নাম, ধর্ম, ভাষা Doesn't matter.উনি সর্বজ্ঞ। উনি সবার ভাষাই বোঝেন, উনাকে ডাকার জন্য সংস্কৃত, আরবি, পালি, হিব্রু যেমন জরুরি নয়, তেমন নাম, ধর্মতে কিছু যায় আসে না। শয়তান ভণ্ড আস্তিকের থেকে স্রষ্টা সৎ নাস্তিককে বেশি ভালবাসেন। ঈশ্বর মানুষকে কর্ম দিয়ে বিচার করেন, ধর্ম দিয়ে নয়।"
"হুম"
"আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল।"
"কি?"
"আমার ধর্ষকদের শাস্তি।"
"আপনি তো কোন কেস করেন নি।"
রহস্যময়ি হাসি দিয়ে ডঃ সাবরিনা বললেন, "I don't believe in system."
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১৬ রাত ১০:১৩