মহুয়া গল্প লিখতে ভালবাসে। আগে গল্পের নায়কগুলোকে তৈরি করতে অনেক ভাবতে হত, এখন আর হয় না। মহুয়ার সব গল্পের নায়িকা সে নিজে, আগেও ছিল। কিন্তু নায়করা এখন আর টম ক্রুজ, লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও, হিউ জ্যাকম্যানের কোন চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত হয় না। সব বদলে গেছে, বদলে গেছে মহুয়া, মহুয়ার গল্প ও মহুয়ার মন।
দিনটি ছিল ভর্তির দিন। ঐ দিনই মহুয়া দেখেছিল অন্যরকম একজন লোককে। লম্বা, রুগ্ন-শুকনো গড়ন, বিষণ্ণ চেহারা, চোখে মোটা কালোফ্রেমের চশমা, উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরছিলেন। লোকটিকে দেখেই রবিঠাকুরের “গল্পগুচ্ছ” বইয়ের “অতিথি” গল্পের তারাপদকে মনে পড়েছিল মহুয়ার। আবার মনে হচ্ছিল,ভীষণ বিষণ্ণ একজন মানুষ লোকটা।
মহুয়া কখনো প্রেম করে নি। প্রেম-ভালবাসা নিয়ে তাই অনেক জল্পনা-কল্পনা রয়েই গেছে। বাংলা সিনেমার মত ‘ভালবাসা পবিত্র, ভালবাসা স্বর্গ থেকে আসে’ টাইপ রিকশাওয়ালা ও চৌধুরীসাহেবের মেয়ের প্রেমের মত কল্পনা হয়ত নেই। কিন্তু গল্প-উপন্যাসের মত ‘হয়ত কিছু একটা হবে’-এটাই মহুয়ার প্রত্যাশা। তাই হয়ত অদ্ভুত ভবঘুরে স্বভাবের লোকটাকে ভালো লেগেছে। দু’বছরের বড় সেই সিনিওরকে শুধু দূর থেকেই দেখে যায় মহুয়া। লোকটা গম্ভীর ও ঠান্ডা স্বভাবের, পুরোই মহুয়ার বিপরীত। কখনো কখনো ক্যাম্পাস থেকে পুরোপুরি হাওয়া হয়ে যান। তখন মহুয়ার মন কেমন কেমন যেন করে। মহুয়া বোঝে না কেন লোকটাকে ভালো লাগে। এমন নয় যে লোকটা দেখতে হ্যান্ডসাম। দেখতে বরং গাঁজাখোরদের মত। তাও ভালো লাগে। মানবমন বোধহয় এজন্যই বিচিত্র। মহুয়ার বন্ধু আবীর প্রায়ই বলে, “মেয়েরা নাকি ভালো নরমাল ছেলেদের প্রেমে পড়ে না। জত্তসব অ্যাবনরমাল ছেলেদের প্রেমে পড়ে।” মহুয়া ভাবে, লোকটা মোটেও অ্যাবনরমাল না, বরং চূড়ান্ত পর্যায়ের intellectual। মহুয়া তাই আবীরকে বলে, “মেয়েরা বলদ পোলাদের প্রেমে পড়ে না, বলদ।”
“কিন্তু বলদদেরই বিয়ে করে”
“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?” বলে ভেঙচি কাটে মহুয়া।
মহুয়া সবসময়ই লোকটাকে খেয়াল করে আড়চোখে। কিন্তু লোকটা একটা বারের জন্যও মহুয়ার দিকে কখনো তাকায়নি। মহুয়ার মনের কথা মনেই রয়ে যায়। মহুয়া নজর কাড়ার মত কেউ নয়। কিন্তু তাই বলে লোকটার চোখে না পড়ার কথা নয়। মহুয়া নানা ধরনের কর্মকাণ্ড করে যা চোখে পড়ার মত। মহুয়ার লেখা গল্পের উপর নাটক হয় , সেসব নাটকে অভিনয় করার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায় ক্যাম্পাসে।
কিছুদিন বাদেই আবীরের কাছে লোকটা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারে মহুয়া, ভেঙ্গে যায় মহুয়ার মন। লোকটা নাকি তারই এক ক্লাসমেটকে ভালবাসে। অসংখ্যবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সেই আপুর কাছে। তারপর থেকেই এমন বিষণ্ণ, হতাশাগ্রস্থ। কিন্ত এই বিষণ্ণতাই কেন মহুয়াকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে-মহুয়া তারউত্তর খুঁজে পায় না। লোকটা নাকি এরপর থেকে সিগারেটের টান বাড়িয়েছে চতুর্গুণ, শুধু ধূমপানেই সীমাবদ্ধ থাকে নি তার যন্ত্রণা। আগে লোকটাকে শুধু ভালো লাগতো, এখন সে ভীষণ মায়া অনুভব করে। লোকটার বিষণ্ণতা মহুয়াকে গ্রাস করে। মহুয়ার মনে হয়, এইলোকটাকে যে খুশি করার ক্ষমতা রাখে, তার পক্ষে বিশ্বজয় করাও কঠিন নয়। মহুয়া বোঝেনি, মহুয়ার জগত জুড়ে সেই লোকটা, অথবা মহুয়ার জগত লোকটা।
মাসখানেক যেতেই লোকটা আবার গায়েব সপ্তাহখানেক ধরে। তারপর জানা যায়, লোকটার নাকি নতুন প্রেমিকা জুটেছে। অদ্ভুত, এও হয়? ভীষণ রাগ হল। এতদিন মহুয়া ভেবেছে, লোকটা আপুকে যে পরিমাণ পছন্দ করে, ঐ পরিমাণ পছন্দ যদি কেউ মহুয়াকে করে তবে মহুয়া তার পায়ে বিশ্বসমর্পণ করবে। আর সেই লোক এর মধ্যেই ... ছিঃ
আবীর বলল, “বুঝিস না এসব? তুই কিসের রাইটার রে?”
“মানে?”
“ছ্যাকা খেলে মানুষ কত অদ্ভুত কাজই তো করে”
“যেমন?”
“এতদিন গাঁজা টেনেছে। কাজ হয় নি। তাই এখন অন্যমেয়েতে মজেছে ভোলার জন্য... খুবই নরমাল”
“লোকটা গাঁজাও টানে?”
“তাই তো শোনা যায়”
মহুয়ার মন আবার খারাপ হয়ে যায়। যে লোকের সাথে একটা কথাও হয় নি, তার জন্য এতো মন পোড়ে কেন মহুয়ার? মহুয়া জানে না, শুধু জানে- মনপোড়ে।
মহুয়ার জীবন থেমে নেই। জীবন থেমে থাকে না। ভালো লাগাও চলছিল সমান গতিতে। মাসকতক বাদেই শুনল, সেই প্রেমিকার সব চুকেবুকে গেছে। ক্যাম্পাস থেকে আবার গায়েব।
লোকটার ফেসবুকও লোকটার মত। এই আছে এই নেই। হঠাত একদিন লোকটা ফেসবুকে মহুয়াকে নক করল। ভীষণ অবাক হল মহুয়া। গত তিন বছরে একবারো নককরে নি লোকটা। ‘হাই, হ্যালো’ দিয়ে শুরু, কিছুক্ষণ পর মহুয়া বলল, “আমাকে আজ নক করলেন যে? আগে তো কখনো করেন নি”
“আজ অনলাইনে যাকে পাচ্ছি তাকেই নক করছি। তুমিও তো কখনো নক কর নি”
হুম... মহুয়া তো যে সেই... মহুয়া নক করেনি কারণ যেচে গিয়ে কথা বলার মত ব্যাক্তিত্ব নয় মহুয়ার। কিন্তু ইদানীং সে প্রায়ই নক করে, বোধহয় ব্যাক্তিত্বের বারোটা বাজানোর সময় হয়েছে। লোকটা একেবারে যে নক করে না তা না, কিন্তু খুব কম। আরেকদিন অনলাইনে মহুয়া বলল, “ভাইয়া, আপনি কি গল্প পড়েন?”
“কি মনে হয়?”
“May be”
“May be না must”
“আমার লেখা কোন গল্প পড়েছেন?”
“তুমি গল্প লিখো?” মহুয়া স্তম্ভিত হয়ে গেল। পুরো ক্যাম্পাস জানে, আর এই লোকটা জানে না। আসলেই গাঞ্জুট্টি।
লোকটা বলল, “তোমার প্রফাইলে আছে?”
“আমার লেখা গল্প আপনি আর কার প্রফাইলে পাবেন?” মহুয়া মনে মনে বলল, গাঁজা টেনে এসে ফেসবুকে বসছে নাকি ব্যাটা।
লোকটা বলল, “না, ফেসবুকে দাও না কোন পেজে দাও তাতো জানি না”
“একেবারে খারাপ লিখি না আমি। সবগুলো ভালো নাওলাগতে পারে-”
“ভালো লাগলো কিনা সেই কমেন্টটা আমাকেই করতে দাও”
“ভাইয়া মনে হয় হুমায়ুনভক্ত”
“হুম”
“বছর দুয়েক পর বইমেলাতে আমিও বই বের করব। কিনবেন কিন্তু। সৌজন্য কপি দিতে পারবো না ”
“অবশ্যই”
লোকটার আইডি গায়েব হয়ে গেলে মহুয়া মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। ভাবে, ‘যাবি যা, আইডি নিয়ে যাস ক্যান?”
মহুয়া মেসেঞ্জারের পুরোনো মেসেজগুলো বারবার পরে। খেয়াল করল, ‘হু’, ‘হুম’, ‘আচ্ছা’ ধরনের সব উত্তর দেন। সব কথা মহুয়াই বলে, সব জিজ্ঞাসা মহুয়ার। সে মহুয়ার কিছুই কখনো জানতে চায় নি। মহুয়া চারবার নক করলে সে মাসখানেক বাদে হয়ত একদিন নক করে। ছিঃ... মহুয়া এভাবে নিজের ব্যাক্তিত্বের বিসর্জন দিল, মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল মহুয়ার। আর নক করবে না।
আবার অনেকদিন পর লোকটা নক করল। মহুয়া জানতে চাইল, তার কোন গল্প পড়েছে কিনা।
লোকটা বলল, “উহু”
“পড়লে আমার ফ্যান হয়ে যেতেন”
“আমি কেন জানি কারো ফ্যান হতে পারি না। লাইট হতে পারি। চলবে?”
হাসি পেল মহুয়ার। উত্তর দিল, “হুম, চলবে”
কিছুদিন বাদেই মহুয়া আবার নক করে বলল, “আমার গল্প পড়েছেন?”
“না পড়া হয় নি। আজি পড়বো”
“কেউ কথা রাখে না, এক সপ্তাহ কেটে গেল। কেউ কথা রাখে নি”
“তুমি সুনীলপ্রেমী?”
“না, আমি রবিপ্রেমী। ‘গল্পগুচ্ছ’ পড়েছেন?”
“অনেক সুন্দর। ‘গল্পগুচ্ছ’বইএ ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদের সাথে আপনার অনেক মিল। কেমন যেন বন্ধনহীন, উদাসীন...”
উত্তর না দিয়েই আইডি নিয়ে ভেগে গেল। মহুয়ার কীবোর্ড ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করল। আইডি ডিএক্টিভেট করার কি দরকার? তাহলে অন্তত প্রফাইলে দেখতে পেত তাকে। রাগে মহুয়া বলল, “ম্যানারলেস গাঁজাখোর, গাঁজা টান গিয়ে”
মহুয়া ভাবল, প্রেমপত্র দিলে কেমন হয়? নীলা প্রেমপত্রের আইডিয়া শুনে বলল, “নিজেকে কি জোকার প্রমাণ করতে চাস এভিডেন্সসহ?”
“তো কি করবো?”
“ভুলে যা”
মাসখানেক বাদেই আবার তার উদয়, মহুয়ার রবি। নক করে মহুয়াকে। মহুয়া ডিটারমাইন্ড যে লোকটাকে গল্প পড়িয়ে ছাড়বেই, প্রেমপত্র তো দিতে পারছে না। এছাড়া উপায় কি? বলল, “আমার গল্প পড়েছেন?”
“স্যরি”
“আজ রাতেই পড়ব। স্যরি again”
“মানুষকে এভাবে বলে বলে পড়াতে হয়। কি অভাগা লেখক আমি! গুনীলোকের কদর নাই সমাজে... :’( ”
“স্যরি”
“ইট’স ওকে। আপনি মনে হয়, আরো শুকায়ে গেছেন। দেখতে যক্ষ্মা রোগীর মত লাগে”
“যক্ষ্মা হতে পারে”
“সোমালিয়াবাসি মনে হয়”
“উহু, আমার ওজন ৬২ কেজি”
এই লম্বালোকের ওজন ৬২ কেজি! হাড্ডি ছাড়া আর কিছু কি আছে? মহুয়া কল্পনা করে, মহুয়াকে দু’হাতে উঁচু করেছে লোকটা। হঠাত কার্টুনের মত পটাশ করে হাঁটু গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়... দীর্ঘনিঃশ্বাস মহুয়ার...
আজকাল মহুয়ার শাহানার গান “একটা ছেলে” গানটা খুব ভালো লাগে। গানটা ছাড়ল,
“একটা ছেলে মনের আঙ্গিনায় ধীর পায়েতে এক্কাদোক্কা খেলে
বন-পাহারি ঝর্না খুঁজে বৃষ্টি জলে একলা ভিজে...”
এমন সময় লোকটা নক করল। ক্যাম্পাসে আর বেশিদিন নেই তার। মহুয়া বলল, “একটা কথা বলি, যদি প্রমিস করেন কাউকে বলবেন না”
“বলো”
“প্রমিস?”
“হু প্রমিস”
“ফার্স্ট ইয়ারে মেয়েরা একটু বেশিই বোকা থাকে। তখন সব কিছু অন্যরকম থাকে। আর সেই ফার্স্ট ইয়ারেই আপনার উপর আমার ক্রাশ ছিল”
“!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!”
লোকটাকে বিব্রত না করার জন্য মহুয়া বলল, “এখন নাই”
“ভালো তো”
“তখন তো বোকা ছিলাম। এখন হাল্কা হাল্কা জ্ঞান হয়েছে”
“চালাকও হয়েছো, তাই না?”
“আমাকে আপনার চালাক মনে হয়?”
“As usual”
“কাউকে বলবেন না প্লিজ”
“আচ্ছা, কাউকে বলবো না”
“আপনি আমার গল্পগুলো পড়েন নাই L ”
“পড়বো, একদিন সময় নিয়ে পড়ে ফেলবো”
“সে তো কবে থেকেই বলছেন”
“সিরিয়াসলি একদিন পড়ে ফেলবো”। মিনিটবাদেই বলল, “ক্রাশ চলে গেল কেন?”
মহুয়া ভেবে পেল না কি উত্তর দিবে, ক্রাশ তো এখনো কাটে নি। এক মিনিট পর উত্তর দিল, “আপনার তো অ্যাফেয়ার হয়েছিল মাঝখানে”
“তোমার অ্যাফেয়ার নেই এখন?” প্রশ্ন মেসেঞ্জারবক্সে ভাসলেও লাড্ডু ফুটল মহুয়ার মনে। মহুয়া উত্তর দিল, “থাকলে কি রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস না দিয়ে বসে থাকতাম। ভালো থাকবেন। বাই” লিখেই অফলাইন হল মহুয়া, বসে থাকলো বেশকিছুক্ষণ।
দিনকতক বাদেই মহুয়ার জন্মদিন। জন্মদিন হাইড করে রাখা। লোকটা রাত ১২টার বেশ আগেই নক করল। লোকটা জানে না মহুয়ার জন্মদিন, কিন্তু তার জন্যই ভীষণ খুশি মহুয়া। এদিকে ফ্রেন্ডের মেসেজ ও কলে ফোন ভরে গেছে, সেই হুশ নেই। হুশ হল রাত একটায়, যখন লোকটা টাটা দিল।
লোকটা পাশ করে বের হয়ে গেল। আবার গায়েব। ভবঘুরে লোকটাকে কেন এতো মিস করে মহুয়া? লোকটা তো মহুয়াকে এতটুকুও মিস করে না। আবার একদিন ফেসবুকে লোকটাকে দেখেই নক করে মহুয়া। লোকটা আগেই মতই উদাসীন, মহুয়ার কাছে কিছুই জানার নেই তার। মহুয়া বলে, “ভাইয়া, আমি আপনাকে একদিন একটা মিথ্যা কথা বলেছিলাম”
“তাই নাকি?”
“হুম”
“কোন কথা?”
“আপনি সেটা জানেন বা বোঝেন। At least বোঝার মত intellectual পার্সন আপনি। ভালো থাকবেন। বাই”
মহুয়ার জন্য বাসা থেকে ছেলে খুঁজছে। প্রায়ই রেস্টুরেন্টে যেতে হয় পাত্রদের সাথে দেখা করতে। মহুয়া বিশেষ সুন্দরী না হওয়ায় এখনো কোন সম্বন্ধ আগাতে পারে নি। মহুয়া ঠিক করল, লোকটাকে মুছে ফেলবে মন থেকে। মনে থেকে না পারলেও ফেসবুক প্রফাইল থেকে, ব্লগ থেকে, পেজ থেকে। যখন গল্পই নেই, তখন গল্পের নায়কের অস্তিত্বও বিলীন।
মহুয়া রেস্টুরেন্টে বসে আছে সুদর্শন বেকারপাত্রের সামনে। পাত্র বিয়ে পরবর্তী কন্ডিশন দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় গল্পের নায়ক আরেকটি মেয়েকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকল। সাথের মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দর। মহুয়ার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসলো। কাজল লেপ্টে গেলে বিপদ। “এক্সকিউজ মি” বলে ওয়াশরুমে গেল মহুয়া। ফিরে এসে দেখল, লোকটা ও সাথের মেয়েটি নেই। পাত্র বলল, “আমার একটু ব্যস্ততা আছে। আজ ওঠা যাক”
মহুয়া রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। পেছন থেকে কেউ একজন ‘মহুয়া’ বলেডাক দিলো। মহুয়া ঘুরে দাঁড়াল। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বারের মত কথা বলছে মহুয়া। লোকটা মৃদু হাসল। লোকটাকে খুব কম হাসতে দেখেছে মহুয়া। গম্ভীর লোকজনের হাসি নাকি সুন্দর হয়। কথাটা বোধহয় সত্য। লোকটা বলল, “কেমন আছো, মহুয়া?”
“ভালো, আপনি?”
“ভালো। অনেকদিন পর দেখা হল। ছেলেটা কি তোমার বয়ফ্রেন্ড ছিল?”
“না। আমাকে দেখতে এসেছিল”
“বিয়ে করবে ছেলেটাকে?”
“জানি না”
“ক’নম্বর?”
“১২”
“ছেলেটাকে বিয়ে করো না”
“কেন?”
“ছেলেটা ড্রাগ- অ্যাডিক্ট”
মহুয়া বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসল। বলল, “সে তো আপনিও ছিলেন”
“হাল্কা ছিলাম। অস্বীকার করবো না। সেজন্যই বুঝতে পেরেছি। জীবনে সকল অভিজ্ঞতাই অর্জন করতে চাই”
“বন্ধনেরও?”
লোকটা হাসল, বলল, “তোমার গল্পগুলো পড়েছি। গল্পগুলো ভালো লেগেছে”
“মিথ্যে বলছেন। গল্পগুলো বেশ আগেই আমি ডিলিট করে দিয়েছি”
“তারও আগে আমি সেভ করে রেখে দিয়েছিলাম পরে পড়ব বলে”
কিছুক্ষণ থেমে বলল, “ভালো করেছো ডিলিট করে। তোমার সব গুলো গল্পের নায়ক বিভিন্ন রকমের হলেও প্রত্যেকের মধ্যেই আমার কোন নির্দিষ্ট ক্রাইটারিয়া আছে। একার্থে সব গুলো নায়কই আমার চারিত্রিক অবয়বে নির্মিত। কেউ খাটো সাংবাদিক, কেউ দুষ্টু হ্যাকার, কেউ দুধর্ষ গোয়েন্দা, কেউ টাকলু বস, কেউ বা রোমান্টিক প্রেমিক”
মহুয়া লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা মাথা নিচু করল। মহুয়ার গাল ভিজে গেল কালোজলে। লোকটা মাথা তুলে মহুয়ার দিকে তাকাতেই মহুয়া দৃষ্টি সরিয়ে নিল। লোকটা বলল, “আমি বন্ধনহীন মানুষ। আমার সাথে নিজেকে জড়িও না”
“আমি যদি বৃষ্টিআপু হতাম, তাহলে কি এ কথা বলতেন?”
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “এর উত্তর আমি দেব না”। তারপর মহুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ভালো থেকো”
বলে উল্টোদিক ঘুরে হাঁটতে লাগলো। মহুয়া দাঁড়িয়ে রইল, চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরতে লাগলো। লোকটা একবার ফিরেও দেখলো না। ভালবাসা হয়ত সবার ভাগ্যে থাকে না।
প্রায় এক বছর পর। নীলার বিয়ের গিফট কিনতে মার্কেট ঘুরছিল মহুয়া। হঠাৎ পাশের একটা দোকানে লোকটাকে দেখল। বাঁশের আসবাবের দোকান। মহুয়া অন্য একটা দোকানে ঢুকে পড়ল। আধা ঘন্টা পরে লোকটা একটা বাঁশি হাতে পাশে এসে দাঁড়ালো। বলল, “কেমন আছো, মহুয়া?”
“ভালো। আপনি এখানে কি করছেন?”
“বাঁশি কিনতে এসেছিলাম। তোমাকে দেখলাম। তুমি হয়ত আমাকে দেখনি”
“ও। বাঁশি বাজাতে পারেন?”
“হাল্কা”
তারপর লোকটা বলল, “তোমার নম্বরটা দাও তো”
“আপনি ফোনও ব্যবহার করেন?”
“কেন করবো না?”
“মনে তো হয় না। সবসময় তো বন্ধই থাকে”
লোকটা মুচকি হেসে বলল, “তুমি ট্রাই করেছিলে?”
“না”
“আমি যখন নিরুদ্দেশ হই, তখন পুরোপুরি নিরুদ্দেশ হই। সম্পূর্ণ সংযোগ বিচ্ছিন্ন”
“নম্বর চাইছেন যে। কখনো যোগাযোগ করবেন বলে তো মনে হয় না”
“সেদিন ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার গল্পগুলো পড়ার পর ঠিক করেছিলাম, তোমাকে উপহার দেব। পরে যখন মনে পড়ল তোমার সাথে কন্টাক্ট করতে পারিনি”
“আপনি আমাকে উপহার দিতে চান?”
“হু”
“কি উপহার?”
“তুমি কি চাও?”
“যা চাইব, পাব?”
“যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে অবশ্যই পাবে। যদি তুমি চাঁদ চাও, তাতো এনে দিতে পারবো না, তাই না?”
“আমি আপনাকে আমার দাস বানাতে চাই”
লোকটা হো হো করে হেসে দিলো। বলল, “এতো রাগ আমার উপরে? এতো সুন্দর যে লিখতে পারে, তার সারাজীবনের দাস হতে না পারলেও একদিনের জন্য তো হতেও পারি”
“মানে?”
“আমার জীবনের একটা দিন তোমাকে দেব। ঐদিন তোমার সব ইচ্ছে পূর্ণ করবো, যা আমার পক্ষে সম্ভব। চলবে?”
“একদিন মানে? সকাল হতে সন্ধ্যা? না ২৪ ঘন্টা?”
“যেটা তুমি চাও। কিন্তু ২৪ ঘন্টাকে segment হিসেবে ভাগ করে যদি ২ঘন্টা করে ১২দিনচাও, সেটা হবে না”
মহুয়া হেসে দিল। বলল, “দিনটি কি আমি ঠিক করতে পারি?”
“Obviously,your highness”
“আমিই আপনাকে জানাবো। ভালো থাকবেন”
দু’সপ্তাহ পরে মহুয়া লোকটাকে ফোন দিল, বলল, “সামনের সপ্তাহের মঙ্গলবার সকাল এক্সেক্ট ৬টায় আমার বাসার সামনে আপনাকে দেখতে চাই আমি। আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে?”
“তুমি কি আমাকে ফতুর করার প্ল্যান করছো নাকি?”
“আপনি বলেছেন, আপনার সাধ্যের মধ্যে সব করবেন। এখন টাকা খরচ করতে চাইছেন না?”
“আমি তোমার মতি-গতি বুঝতে পারছি না। আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি আর ফোনই করবে না”
“আপনি অনেক intellectual হতে পারেন, কিন্তু তাই বলে আমি এতোটাও predictable নই। যত টাকা পারেন, নিয়ে আসবেন
মঙ্গলবার সকাল ৬টায় মহুয়া দেখল, লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। মুখে দাঁড়ির জঙ্গল নিয়েই উঠে এসেছে সাতসকালে। মহুয়া বলল, “আমি আপনার সাথে ঘুরতে চাই আপনার প্রিয় জায়গাগুলোতে। তবে অবশ্যই বিকেল ৩টার আগে ফিরে আসতে চাই”
“তিনটার পর আর ঘুরবে না? তিনটার পরপরই এই দাসের মুক্তি?”
“আগে তিনটা তো বাজতে দিন”
“সকালের এই সময়টা রেললাইনের উপর দিয়ে হাঁটার জন্য। চলো”
রেললাইনে উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা বলল, “মীনা, তুমি কি তোমার ২নম্বর ইচ্ছাটা পূরণ করতে চাও? তুমি কি সিনেমার নায়িকা হতে চাও?”
মহুয়া হাসি চেপে বলল, “হুম, আমি নায়িকা হতে চাই, ল্যাট্রিন আমি চাই না, আমার পাকা টয়লেট আছে”
মহুয়া দুপুরের দিকে বলল, “অনেক ঘুরেছি। শপিং করবো” বলেই রিকশাকে শপিং মলের দিকে নিতে বলল। বিয়ের শপিঙের মার্কেটে ঢুকল। নামকরা একটা দোকানে ঢুকেই সেলসম্যানকে বলল, “শাড়িটা বের করেন”
লোকটা বলল, “বিয়ের শাড়ী কিনছ কেন?”
“বিয়ে তো করবেন না, বিয়ের শাড়ি তো দিতেই পারেন, তাই না? টাকা বের করেন”
অটিমেটিক লোকটার হাত পকেটে চলে গেল, মানিব্যাগ বের করে মহুয়ার হাতে দিয়ে দিল। মহুয়া শাড়ির সাথে ম্যাচিং গয়নাও কিনল। মহুয়া একটা শেরওয়ানি কিনে দিল লোকটাকে।
বিকেল ৩টার দিকে মহুয়া বলল, “আমি পার্লার যাচ্ছি। আপনিও শেরওয়ানি পরে রেডি থাকবেন”
“Are you crazy?”
“হয়ত”
“একদিনের জন্য আমাকে বিয়ে করবে?”
“করবো”
“তোমার ধারণা, আমি তোমাকে বিয়ে করবো?”
“আপনি কথা দিয়েছেন, আজ আমার সব ইচ্ছে পূরণ করবেন”
“You are insane”
“আপনি আমার না হন। আপনার উপর আমার সিল তো থাকবে। At least আর কাউকে তো বিয়ে করতে পারবেন না”
“মহুয়া,আমি সংসারী ছেলে নই”
“That doesn’t matter to me at all.”
“তোমারকোন দায়িত্ব কিন্তু আমি নিবো না”
“আমি জানি। আমি বউ সেজে অপেক্ষা করবো। না ইচ্ছে হলে আসবেন না। দায় আমার”
মহুয়া পার্লারে গেল। মহুয়ার মা ফোন দিয়ে বললেন, “তুই যে কি করছিস, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না”
“যা করতে বলেছি সব করেছো?”
“হুম”
“মা, তাহলে বিশ্বাসটাও রাখো”
মহুয়া সাতটার দিকে বাসায় ফেরে। বাসা বিয়েবাড়ির সাজে সজ্জিত। সাড়ে সাতটার দিকে লোকটা এল তার মাকে নিয়ে।
বাসর রাত। মহুয়া বলল, “একদিন ক্রস হয়ে গেছে অনেক আগেই। স্যরি। আপনি বললে আমি কালই চলে যাব”
“কি বল এসব? বিয়ে হল, বাসর করবো না?”
“বিয়ের দায়িত্ব নিবেন না, বাসর কেন করতে চান?”
লোকটা হাসল, বলল, “আমি তো পুরুষ মানুষ”
সকাল ৭টার দিকে ঘুম ভাঙল মহুয়ার। পাশ ফিরে দেখে লোকটা নেই। ঘর থেকে বের হয়ে দেখল শাশুড়ি রান্নাঘরে। শাশুড়ি বললেন, “বদটাকে খুঁজছ?”
মহুয়া মাথা নাড়ল।
“ভেগে গেছে” শাশুড়ি বলল। মহুয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকাল।
শাশুড়ি বলল, “অবাক হয়ো না, মা। কষ্টও পেও না। এরকমভাবে বিয়ে কোন মা মেনে নেয়?”
মহুয়া মাথা নিচু করল। বলল, “মা, আমি উনাকে জোড় করে বিয়ে করেছি। আমাকে মাফ করে দেন”
শাশুড়ি বলল, “কাজের কাজ করেছো। পুরোই বাপের মত স্বভাব পেয়েছে। বিয়ে যে করেছে এটাই তো কতো। বিয়ে করবে- সেটাই তো কল্পনার বাইরে। বাপের মত ঢঙ্গের বৈরাগী হয়েছে, অসহ্য। ওর শ্বশুর কি করেছিল, জানো?”
“না। কি করেছিলেন?”
“উনিও এমন বৈরাগী ছিলেন। কয়েকবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। তারপর সবাই ধরেবেধে আমার বাপেরবাড়ি নিয়ে আসে তাকে। সে তো প্রথমে বিয়ে করবেই না, কিন্তু আমাকে দেখামাত্রই সে রাজী”
“মা, আপনি তো এখনো অনেক সুন্দর”
শাশুড়ি হেসে দিলেন। বললেন, “তখন আমি আরো সুন্দর ছিলাম। ঐ সময়ের এক পরিচালক তো আমাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাখো সেসব কথা। তোমার শ্বশুরের কথায় আসি। বিয়ে করল ,কিন্তু বিয়ে করেই ভাগল বাসর রাতের আগেই। আমি তো নতুন বউ, কাউকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। ফিরল এক বছর পর। বদটা তো তাও বাসর রাত করে গিয়েছে, দ্যাখো, তাড়াতাড়িই ফিরবে”। তারপর বললেন, “তুমি কি ভাবছো,ওকে দিয়ে কিছু চাইলেই করানো যায়? এতো সোজা ছেলে নয় আমার। ইচ্ছে না থাকলে ওকে দিয়ে কিচ্ছু করানো যাবে না, এমনই গোঁয়ার। যদি বলে, ‘বাথরুমথেকে বের হব না আজ’, তবে সারাদিন বাথরুমেই বসে থাকবে। যাও, রেস্ট নাও আজ। কাল থেকে তোমার ট্রেনিং শুরু”
মহুয়া বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল। লোকটাকে বিয়ে করেও পেল না সে... ঘুম ভাঙল বেলা ২টায়। গোসল ও খাওয়াদাওয়া সেরে লোকটার ডেক্সটপ অন করল, কিন্তু পাসওয়ার্ড চায়। লোকটাকে ফোন দিল, বন্ধ... আবার নিরুদ্দেশ হয়েছে। লোকটার নাম, শাশুড়ির নাম,শ্বশুরের নাম, লোকটার স্কুল-কলেজ, বৃষ্টি আপুর নাম, ঠিকানা, ফিগার, এমনকি যাবতীয় সব হলিউড হিরোইনদের নাম দিয়ে চেষ্টা করল। কিছুতেই খুলল না। Secret questionএ ট্রাইকরবে এবার। প্রশ্ন হল- “Who is the most amazing girl in my life?” মহুয়া বৃষ্টির নাম লিখল, হল না। কি মনে করে একটা নামটা লিখল, খুলে গেল। সাথে সাথে মহুয়ার ঠোঁটের কোণে ভাজ পড়ল...
[বিঃদ্রঃ গল্পটা আমার এক লেখিকা বান্ধবীকে নিয়ে। সেও আমার মত লিখতে ভালবাসে, কিন্তুএখন আর লিখে না। গল্পটি তাকে নিয়ে হলেও তার জীবনে এসব ঘটেনি। গল্পটি আংশিক সত্য,আংশিক কল্পিত। পাঠকের আনন্দদানের জন্য কল্পিত অংশটি নয়। প্রকৃত ঘটনা লেখিকার গল্পমুছে ফেলা পর্যন্তই, আমার গল্প প্রথমে ওটুকুই ছিল। কিন্তু গল্পটি যখন তাকেশোনালাম, সে কাঁদতে লাগলো। বলল, “বাস্তবে মিল হয় নি দেখে কি গল্পেও মিল সম্ভব নয়?”মহুয়ার অনুরোধেই বাকি অংশটুকু কল্পিত। গল্প তো গল্প...]
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৪