বাবা, কেমনে এতো কিছু পারো তুমি, কেমনে পারো বাবা ???
সেই ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজর নামাজ পড়ে কুরআন তেলাওয়াত কর। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় তোমাকে হাঁটতে হয়। তা নাহলে তোমার কাছে ভালো লাগে না। তারপর বাসায় এসে আগের রাতের কিছু খাবার ফ্রিজে থাকলে তুমি খেয়ে নাও।
বাসার সবাই তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। আম্মু উঠে তোমার হাতে বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দেয়। মাসের শুরুর দিকে তোমার পকেটে টাকারা খেলা করে কিন্তু তুমি মাইলখানেক হেঁটে বাজারের দিকে রওনা করো। অনেক কিছুই কিন ঘরের জন্য। কিন্তু অনেক দামাদাম করে তারপর কিছু কিন তুমি। বাজার শেষ হলে আবার মাইলখানেক পথ হেঁটেই বাসায় আসো। এতে তোমার খারাপ লাগে না। ভালোই লাগে সংসারের জন্য টাকা বাঁচাতে। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে অফিসে চলে যাও। তোমার টাকার কমতি নেই। কিন্তু তোমার শার্ট, প্যান্ট, জুতা, মৌজা সব পুরাতন হয়ে গেছে। তাও তুমি তা চেইঞ্জ করো নি। তোমার এ ব্যাপারগুলো নিয়ে তেমন কোন আক্ষেপ নেই। ভালোই লাগে তোমার কাছে।
অফিসে লাঞ্ছ আওয়ারে অফিস অনেক বিজি থাকে। তুমি চাইলেই বাসায় আসতে পারো, কিন্তু আসো না। কারণ বাসায় আসলে ফিরতে দেরি হবে। তাই তুমি হোটেলে ঢুকে লাঞ্চ করে নাও। মেন্যু হিসেবে তুমি ডাল আর ভর্তা নাও। খাওয়া শেষে খুশী মনে অফিসে ফিরে আসো। এভাবেই চলতে থাকে তোমার অফিস। খুব বেশি ক্ষুধা না লাগলে তুমি বিকালে বাহিরে নাস্তা ও করো না। মাঝে মাঝে বেশি করে পানি খেয়ে নাও তুমি, যেন ক্ষুধা না লাগে।
অফিস শেষে তুমি ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসো শান্তির খোঁজে। বাসায় এসে তোমার সন্তানের মুখে হাঁসি দেখে সব কষ্ট ভুলে যাও তুমি। ওদের পড়া দেখিয়ে দিতে হয় তোমাকে। তোমার ভেতর এতো কষ্ট কিন্তু কাউকে বুঝতে দাও না তুমি। আম্মু কেও না। কারণ, আম্মু বেশি চিন্তা করে। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাসের শেষের দিক চলে আসে। এরই মাঝে তোমাকে বুয়া বিল, ইলেক্ট্রিসিটি বিল, গ্যাস বিল, পানি বিল, বাসা ভাড়া সহ আরও অনেক খরচ দিতে হয় তোমাকে। তোমার পকেটের টাকার ফুরিয়ে আসে। তুমি চিন্তায় থাকো, কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দাও না।
একদিন হঠাৎ তোমার ছোটন বায়না ধরল তাকে নতুন জামা কিনে দিতে হবে। তুমি তাকে সাথে নিয়ে কিনে দাও। সাথে আম্মু কেও কিনে দাও, যদিও আম্মু বারণ করে। সবাই নতুন জামা পরে, শুধু তুমি পর না। তুমি পড়তে গেলে শেষের কয়েকদিন ঘরে বাজার হবে না। মাসের একদম শেষের দু,তিনদিন তুমি অফিসে পানি খেয়েই লাঞ্চ করে নাও। হোটেলে যাও না। কারণ তোমার পকেট খালি। তুমি ইচ্ছা করেই টাকা ধার কর না। কারণ কথা থেকে দিবে এ টাকা? তাই নিজের উপর দিয়েই চালিয়ে নাও।
রাতে বাসায় যেয়ে তাড়াতাড়ি তুমি ভাত খেতে চাও আম্মুর কাছে। আম্মু বুঝে যায় দুপুরে তুমি কিছুই খাও নি। আম্মুর চোখের কান্নারা আঁচল ভিজিয়ে দেয়, ভিজে যায় তোমার চোখ। তাও তুমি কিছু বুঝতে দাও না আমাদের। কোন অভাব বুঝতে দাও না। কারণ তোমাদের চাওয়া একটাই। যেন আমরা ভালো থাকি। অন্তত ভালো থাকি।
ক্যামনে এতো কিছু পারো তুমি? ক্যামনে পারো বাবা ??? জানো বাবা, ছোটবেলায় তোমাকে খুব ভুল বুঝতাম। মনে করতাম একটু ও ভালোবাসো না, একটুও না। মনে করাতাম তুমি সব জায়গায় বেশি বুঝ। এখন বুঝি কতটা বেশি ভালোবাসতে তোমার ছোটনদের। কতটা বেশি পাগল ছিলে এই ছোটনদের জন্য। এখনও যখন মনে পড়ে তোমার ছিঁড়া শার্ট, রিপু করা প্যান্ট, পুরাতন মৌজা, তালি দেওয়া জুতা, বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া ভিজে ভিজে অফিসে যাওয়ার কথাগুলো।
বিশ্বাস কর বাবা, কথাগুলো মনে পড়লে চোখের কোলেরা ভিজে যায়, কান্নারা আবেগি হয়, অশ্রুরা ভেসে যায়, নয়নেরা সিক্ত হয়। অনেক চেষ্টা করি কান্না থামাতে, কিন্তু পারি না বাবা। কান্নারা জলোচ্ছ্বাসের মত হানা দেয় বাবা। নিজেকে মানাতে পারি না বাবা। এখন বুঝি তোমার এই ছোটনদের কতটা বেশি ভালবাসতে। এখন বুঝি পাগলের মত ভালবাসতে, পাগলের মত। কিন্তু এমন সময় এসে বুঝেছি এই ভালোবাসার কথা, যখন তুমি আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছ।এতো ভালোবেসে কেন এতো দূরে গেলে বাবা? কেন বাবা? কথা বল, বাবা? কথা বল প্লিজ!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:১৩