রাত সাড়ে ১২টায় এমিরেটস এর ফ্লাইট আমাকে দুবাই নামিয়ে দিল। ইমিগ্রেশন, চেক-আউট করে টার্মিনাল-২ দিয়ে বের হতেই আমার পরিচিতজনের সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি শারজাহতে থাকেন এবং পরবর্তী ৫দিন তার বাসাতেই থাকব। তার গাড়িতেই শারজাহর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এসেছি আফ্রিকার এক অনুন্নত, জঙ্গলময় এলাকা থেকে। হঠাৎ করে রাতের আলো ঝলমলে দুবাই দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গেল!
পরদিন সকালে বের হলাম দুবাই আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে। প্রথমেই গেলাম দুবাই মলে। কারন দুবাই মলে গেলে একইসাথে মল, দুবাই অ্যাকোরিয়াম, আন্ডারওয়াটার জু, দুবাই ফাউন্টেন আর বিখ্যাত বুর্জ খলিফা (আগের নাম বুর্জ দুবাই) দেখা যাবে।
দুবাই মলঃ বিশ্বের সবচে বড় শপিং মল। ইলেকট্রনিক্স, কসমেটিকস, জামাকাপড় সহ শপিং এর স্বর্গভূমি এই মল। দামও মোটামুটি আকাশচুম্বী। শপিং ছাড়াও এ মলে বিশ্বের প্রায় সব বিখ্যাত ফুড কোর্ট পাবেন, সেখানে লাঞ্চ/ডিনার সহ স্ন্যাকস করতে পারেন। দুবাই এলে দুবাই মলে অবশ্যই যাবেন। এই মলেই পাবেন বিশ্বের সবচে বড় মিষ্টির দোকান। দুবাইতে কেনাকাটার ব্যাপারে আমার অভিমত হলঃ একমাত্র কিছু ইলেকট্রনিক্স (টিভি, মোবাইল) ছাড়া অন্যান্য যেকোন জিনিসের দাম বেশি (আমাদের অনেকেরই ধারনা দুবাইতে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কম)। এমনকি ল্যাপটপ, ডিএসএলআর ক্যামেরার দামও বেশি (থাইল্যান্ডের সাথে তুলনা করে বলছি)। তবে দুবাই থেকে যে জিনিসই কেনেন সেটা অন্তত দুই নাম্বার বা নকল জিনিস হবে না এটা মোটামুটি নিশ্চিত থাকতে পারেন।
দুবাই মল
দুবাই মলের পশ্চিম গেট (বুর্জ খলিফা সংলগ্ন)
দুবাই মলের ভেতর (ফুড কোর্টের সামনে)
রাতের দুবাই মল
দুবাই অ্যাকুরিয়াম ও আন্ডারওয়াটার জুঃ দুবাই মলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে অ্যাকুরিয়াম আর ১ম এবং ২য় তলায় আন্ডারওয়াটার জু। চমৎকার সুন্দর এই জু-তে কুমির, পেংগুইন, হাংঙর, অক্টোপাস সহ হরেক প্রজাতির প্রাণী দেখতে পাবেন। আন্ডারওয়াটার টানেল সহ অ্যাকুরিয়ামে প্রবেশ মূল্য ৮৫ দিরহাম আর জু-তে ৬৫ দিরহাম। তাছাড়া অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে কাঁচের নৌকায় (গ্লাস বটম বোট) ভ্রমনও করতে পারেন এবং মাছ ছুঁয়ে দেখতে পাবেন। দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে শার্ক ফিডিং। সকাল ১০টা-রাত ১০টা (রবি-বুধবার) এবং সকাল ১০টা-রাত ১২টা (বৃহঃ-শনি) খোলা থাকে এই অ্যাকুরিয়াম আর জু।
আন্ডারওয়াটার টানেল
আন্ডারওয়াটার জু
শত শত মাছ অ্যাকোরিয়ামে ....
কেঁচোর মত মাছগুলোর নাম ভুলে গেছি
ডাইনোসরের কঙ্কাল
বুর্জ খলিফা/ বুর্জ দুবাইঃ দুবাই মল থেকে বের হয়ে গেলাম বুর্জ খলিফায়। ১৫৩ তলা বিশিষ্ট, ৮২৮ মিটার উঁচু এই অসম্ভব সুন্দর স্থাপনার অবজার্বেশন ডেক (১২৪ তলায়) বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু অবজার্ভেশন ডেক। এখান থেকে পুরো দুবাই এর ভিউ পাবেন। অবজার্ভেশন ডেকে উঠতে হলে কমপক্ষে দুইদিন আগে দুবাই মলের গ্রাইন্ড ফ্লোর থেকে টিকেট কেটে রাখতে হবে। ট্যুরিস্ট বেশি হলে সাত দিন আগেও টিকেট কেটে রাখতে হয় শুনেছি! প্রবেশ মূল্য প্রায় ১০০ দিরহাম! চূড়ায় না উঠলে এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারেন। রাতের বুর্জ খলিফা ছবি তোলার জন্য অন্যতম পছন্দের জায়গা।
বুর্জ খলিফা..
রাতে বুর্জ খলিফার চূড়া আকাশের চাঁদ ধরার চেষ্টা করছে...
দুবাই ফাউন্টেনঃ দুবাই মলের ঠিক পশ্চিমে আর বুর্জ খলিফার দক্ষিণে দুবাই ফাউন্টেন। এই ফাউন্টেন না দেখলে আপনার দুবাই ভ্রমণ সার্থক হবে না। দুপুর ১টা, ১:৩০ টা এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আধা ঘন্টা পর পর বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিউজিক্যাল-ফাউন্টেন শো দেখানো হয়। অবশ্যই অবশ্যই রাতের শো দেখবেন। এসময় এখানে ট্যুরিস্টদের ভিড়ে তিল ধারনের জায়গা পাওয়া যায় না। ফাউন্টেনের পাশেই বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানেও বসতে পারেন। ছবি তোলার জন্য দুবাইয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জায়গা এটা। ক্যামেরার শাটার টিপতে টিপতে আঙুল ব্যথা হয়ে যাবে আপনার!
বুর্জ খলিফার দক্ষিনেই দুবাই ফাউন্টেন
কয়েকটা বিষয়ঃ
১. সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশীদের অন-এরাইভাল ভিসা দেয়না। কাজেই দুবাইতে আসতে চাইলে ভিসা নিয়ে আসতে হবে। ভিসার জন্য সরাসরি দূতাবাসে যোগাযোগ করতে পারেন। অথবা এমিরেটস এর রিটার্ন টিকেট হলে লোকাল এমিরেটস এর অফিসের মাধ্যমে চেষ্টা করতে পারেন, ভিসা পেতে সুবিধা হবে। এতে প্রায় ৬৫ ইউএস ডলার খরচ হবে। আপনার কাগজপত্র আসল হলে সবসময় দূতাবাসের মাধ্যমে ভিসা করাবেন।
২. দুবাই এয়ারপোর্টে নামার পরেই লাগেজ খোঁজা বাদ দিয়ে আগে সোজা নিচতলায় চলে যাবেন, ওখানে দুবাইতে প্রবেশকারী সবার রেটিনা স্ক্যান করা হয়। এই জায়গাটাতে মোটামুটি ভীড় থাকে এবং লাইনে দাঁড়াতে হবে। এজন্য অযথা সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি এখানে চলে আসবেন। রেটিনা স্ক্যান করার পর লাগেজের খোঁজে বের হবেন নতুবা এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই ২ ঘন্টা লেগে যাবে যদি সাথে চেক-ইন লাগেজ থাকে।
৩. দুবাইতে গেলে একেবারে বিপদে না পড়লে ভুলেও ট্যাক্সিতে চড়বেন না। দুবাইয়ের পুবে ইতিসালাত (দুবাই আর শারজাহ এর মধ্যবর্তী এলাকা) থেকে দুবাইয়ের ডাউনটাউনের একেবারে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত অত্যাধুনিক মেট্রো রেল (স্কাই ট্রেন) আছে। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত এই মেট্রোরেল চলাচল করে। একদিনের একটা আনলিমিটেড পাস (১৭ দিরহাম) করিয়ে নিলে ওইদিন রাত ১২টা পর্যন্ত মেট্রোরেলের যেকোন ষ্টেশনে যতবার খুশি ওঠানামা করতে পারেন। দুবাইতে যদি হাতে আপনার কোন কাজ না থাকে তাহলে ১৭ দিরহাম দিয়ে আনলিমিটেড পাস নিয়ে মেট্রোতে উঠে পড়ুন। বিভিন্ন ষ্টেশনে নেমে দুবাই ঘুরে দেখুন। অর্ধেক দুবাই আপনার দেখা হয়ে যাবে। পাসটা সংরক্ষণ করে রাখবেন কারন পরে যদি আবার একদিনের জন্য রিনিউ করতে চান তাহলে ১৭ দিরহামের পরিবর্তে ১৪ দিরহাম লাগবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই কার্ড পাঞ্চ করে আপনি সিটিবাসেও চড়তে পারবেন আনলিমিটেডবার।
দুবাই মেট্রো রেল
(চলবে....)