যৌবনে গল্প লেখার সময় তার মাধ্যমে বহু নারীকেই খুন করেছি। আজকাল তারা স্বপ্নে আসে। আমাকে সাথে করে বহুদূরে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। আমি বাঁধা দেই। চিৎকার করি। ওরা কিছুতেই কিছু শোনে না। আমার বুক চিড়ে তার ভেতরে বহুদিন যাবৎ যত্নে রাখা হৃদপিন্ড টাকে ছিড়ে খায়। দর দর করে ঘামতে থাকি।
কখন যেন ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় উঠে দেখি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নুসু। নুসু আমার কুকুর। গঙ্গার ধার থেকে একদিন সঙ্গ নিয়েছিল। সেই থেকেই সাথে আছে। হয়ত কুকুর বলে তাই। মানুষের আর ভরসা কি.? কম তো দেখলাম না এই জীবনে। কখনও কখনও নিজেকেই কেমন বিশ্বাস হয়না। আয়নায় নিজের ছবি দেখে আৎকে উঠি। দৌড়ে রাস্তায় চলে যাই। পাড়ার ছেলেরা ছুটে আসে। ঢিল ছোড়ে। আমি পাগলের মত ওদের তাড়া করি। নুসুও ছোটে আমার সাথে। এক সময় ক্লান্ত হয়ে রাস্তার ভেতর বসে পরি। শ্বাস কষ্টের মত হয়। পথচারীদের ভেতর কারো কারো হয়ত মায়া হয়, ওপাশের দোকান থেকে কয়েকটা রুটি কিনে দেয় আমাকে। আমি আর নুসু সেটা ভাগাভাগি করে খাই। তারপর বসি গান করতে। না, গানটা আমি খারাপ করিনা। করবই বা কি করে। আমাকে তো গান গাইতে শিখিয়েছিল তিথি। সাক্ষাৎ সরস্বতী ছিল মেয়েটা। হাসলে গালে টোল পরে। তবে সব কিছুর উপরে ছিল ওর গান। কি পাগলই না ছিল সেই ব্যাপারে। গলা জড়িয়ে বলত, গান গেয়ে একদিন পৃথিবীর অস্থিরতা কমাবে। শুনে আমি হাসতাম। ভালোবাসার অভিনয়ে ওকে নিয়ে তুলতাম বিছানায়।
বয়স অল্প হওয়ার কারণে দেখতেও ছিলাম মন্দ না। তার উপর লেখক হিসাবে বেশ নাম করেছি। সহজেই বিশ্বাস করত মানুষ। সন্মান দিত। ভাবত লেখক অথবা কবি মানেই হয়ত দেবতা। বুঝত না আমিও মানুষ। সুন্দরী নারী দেখলে আমার মনের ভেতরও কামনা এসে ভীড় করে। নিজেকে তাই কখনই প্রকাশ করতাম না আমি।
রোজই কোন না কোন মেয়ের চিঠি পেতাম। তারা দেখা করতে বলত। আমি বাদ দিতাম না কাউকেই। শরীর দেওয়া নেওয়া খেলায় কারো একবিন্দু ও সম্মতি থাকলে ক্ষুদার্থ হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পড়তাম তার উপর।
তিথির সাথেও আমার পরিচয় হয় এভাবেই। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পরে যাই। কিন্তু অল্প কিছু দিনের ভেতরই বুঝতে পারি তিথি সে ধরনের মেয়ে নয়। অতি সরল মেয়েটার ভেতর আত্ম সম্মানটা ষোল আনা। কথাটা বুঝতে পেরে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা আমি। সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করতাম। কিছুতেই যেন সহ্য হতনা তিথিকে বিছানায় না আনতে পারার যন্ত্রনা। অবশেষে সিদ্ধান্তে আসি ওর ফাঁদেই ওকে ফেলব।
পরদিনই ভালবাসি কথাটা ওকে বলি। ও শুনে কথা বলেনা। আমি কেন কিছু বলছে না জানতে চাইলে আমাকে নিয়ে যায় একটা বস্তি মত এলাকায়। আমার এখানে কেন নিয়ে এসেছ কথার উত্তরে ও আমাকে বলে, এখানেই তার বাড়ি। আমি শুনে অবাক হই। তবু নিজেকে যতটা হয় সামলিয়ে নিয়ে ওর সাথে যাই ওদের বাড়িতে। ছোট্ট একটা বাড়ি। পায়রার খোপের মত কয়েকটা ঘর। আমাকে দেখেই ওর মা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠার মত রেগে ওঠে। আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই তিথির চুলের মুঠি ধরে বলে, খানকি মাগি। এই বয়সেই খদ্দের নিয়ে এসেছিস.? আমার আর বুঝতে বাকি থাকেনা তিথির পরিচয় আসলে কি..? আমি কি বলে এই পরিস্থিতি সামাল দেব বুঝে উঠবার আগেই তিথি আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকায়। সে হাসির ভেতর আনন্দের বিন্দু মাত্র না থাকলেও কান্নার গভীরতা ছিল প্রবল। আমি আর দাঁড়াই না সেখানে। ধীরে ধীরে বাইরে চলে আসি। কিছুটা আসতেই তিথি আমাকে পেছন থেকে থামায়। হাত ধরে বলে, সবার কপালে সব সুখ থাকেনা বাবুন। ওটাই আমার নিয়তি। আমার বাবা কে তা আমি নিজেও জানিনা। শুধু জানি আমাকে বড় করতে আমার মাকে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে। সে নিজেও চায়না আমি এই অন্ধকারে হারিয়ে যাই। কিন্তু আমি জানি, আমাকেও হারাতে হবে এই আঁধারে। শুনে আমি কিছু সময় চুপ থাকি। সামনে দাঁড়িয়ে বোকার মত কাঁদতে থাকে ও। এভাবেই কেটে যায় কিছু সময়। তারপর তিথির হাত ধরে বলি, বিয়ে করবে.? কথাটা শেষ হতেই আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পরে তিথি। আমি মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দেই ওর। কোথায় একটা পাখি ডেকে ওঠে। পৃথিবী শান্তি পায়। শুধু আমাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পায়না সে। যদি দেখত, তাহলে আমি নিশ্চিত ঠিক সেই মুহূর্তে আমার চোখের বীভৎসতা দেখে ঠিক ঠিক সে কেঁপে উঠত।
এরপর কয়েকটা দিন কাটে ঘোরের ভেতর। দিন রাত এক করে চলে আমার আর তিথির বিছানা বিলাস সঙ্গম। খুব অল্প দিনেই তিথির পেট স্ফীত হয়। কি জানি, ভ্রুণ পূর্ণতা পেলে সে হয়ত হত তার মায়ের মত সুন্দর। তবে সে সব কোন কিছুই মনে থাকেনা আমার। তিথির মুখে আমি বাবা হতে চলেছি শুনেই রাগে ফেটে পরি। খিস্তি দিয়ে বলি, তোর জন্মগত ব্যাবসার পাপ আমার গলায় ঝোলাতে চাস.? বেড়িয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। এরপর আর কোনদিন যদি তোকে আমার আশে পাশেও দেখি তাহলে নষ্ট মেয়ে মানুষ হয়ে সমাজের একজন বিশিষ্ট ব্যাক্তিকে বিরক্ত করছিস বলে জেলে ঢোকাব। শালী নচ্ছার রেন্ডী। কথাটা শুনে আর কথা বলতে পারেনা তিথি। কি জানি, অতিরিক্ত বেদনা হয়ত মানুষকে নীরব করে দেয়, তাই খুব ধীরে ধীরেই চলে যায় আমার বাড়ি থেকে। আমি দায়মুক্ত হলাম ভাব নিয়ে আসছে বইমেলার জন্য আবার নতুন করে গল্প লিখতে বসি।
এরপর কেটে যায় আরো কয়েকটি বছর। হঠাৎ একদিন জানতে পারি আমার বীর্যে ওর পেটে আসা সন্তানটিকে নষ্ট করেনি তিথি। শুনে আবারো একবার শরীরের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায় আমার। বুঝতে বাকি থাকেনা আমার বিরূদ্ধে কোন এক গভীর চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে ও। কথাটা মাথায় আসতেই গোপনে ওর ঠিকানা জোগার করে দেখা করতে যাই। মনে মনে ঠিক করি নিজে গিয়ে বোঝাব। বলব যে, যা করে ফেলেছে তা ফেলেছে, এখনও সময় আছে শহর থেকে বহুদূরে কোথাও চলে যাক। আর যদি না মানে তো দুটোকেই সরিয়ে দেব এই পৃথিবী থেকে, তবু কিছুতেই এতদিন বিন্দু বিন্দু করে যে সম্মান কামিয়েছি এই সমাজে সেটাকে নষ্ট হতে দেবনা।
কিন্তু সমস্যা হয় জোগার করা ঠিকানায় এসে। দেখেই বুঝতে পারি সেটা কোন পতিতা পল্লী না। বরং মধ্যবিত্ত একটা বাড়ি। সামনে ফুলের বাগান। সুন্দর করে গোছান চারিদিক। বাড়িটিকে ঢুকে তিথির খোঁজ করতে কেমন একটা ইতস্তত করতে থাকি। হঠাৎ একটা পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা এসে আমাকে উপরের ব্যলকনীটার দিকে দেখিয়ে বলে, কাকু কাকু মা আপনাকে ডাকছে। সেদিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার আর কিছুই বাকি থাকেনা আমার। তিথি দেখি সেখানে আটপৌড়ে একটা শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে। বিকালের নরম রোদ পরেছে তার গালে। পাঁচ বছরের ব্যাবধানেও একটুও মলিনতা নেই ওই শরীরে। ঠিক যেন প্রথম দেখা সেই মেয়েটার মত অদ্ভুত কোন জাদুবাস্তবতায় অফুরন্ত প্রান শক্তি নিয়ে এক ঈশ্বরী হাসছে। আমার পা দুটো আর চলতে চায়না। মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে পরি। দেখে নীচে নেমে আসে তিথি। জানতে চায় কেমন আছি। আমি এ কথার উত্তর দিতে পারিনা। কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে ওকে দেখি। মৃদু গলায় বলি, তাহলে কি...
-হ্যাঁ বাবুন। বেশ্যার মেয়ে বেশ্যা হয়নি গো। হয়ত হত। তবে তার আগেই পড়েছিল কোন এক দেবতার নজরে। যে শুধু সেই বেশ্যার মেয়েকে নয়। আপন করেছিল তার পেটের ভেতর বেড়ে ওঠা পৃথিবীর একমাত্র পবিত্র এক পাপ কে।
গলাটা ধরে আসে আমার। নরম গলায় বলি
-ক্ষমা করো। ক্ষমা করো আমাকে।
শুনে ও মৃদু হাসে। খুব আস্তে আস্তে বলে,
-ক্ষমা আমি সেদিনই করে দিয়েছি তোমাকে বাবুন৷ ভালবাসলে তো ক্ষমা করতেই হয় তাই না। তাই আমি সেসব কিছুই মনে রাখিনা। বরং তোমার জন্যই আমি এমন একজন মানুষ পেয়েছি যায় চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সমস্ত পুরুষ ই পুরুষ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে, তবুও সমস্ত পুরুষ পুরুষ না।
কথাটা শেষ হতেই আমার চোখ দুটো কেমন ঝাঁপসা হয়ে আসে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনা। টলতে টলতে ফিরতে থাকি বাড়িতে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা ট্রাক এসে পেছনে সজরে ব্রেক কষে। চোখ বন্ধ হওয়ার আগে শুধু দেখতে পাই বহুলোক ছুটে আসছে আমার দিকে। আমি পরে আছি সেই রাস্তায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো শরীর।
তারপর কেটে গেছে বহু বছর। আজ আমি বদ্ধ একজন উন্মাদ। যৌবনে গল্প লেখার মাধ্যমে সঙ্গম করে খুন করেছি যেসব নারীদের তারা গভীর রাতে আমার সাথে দেখা করতে আসে। উলঙ্গ হয়ে আমাকে সবাই মিলে টানাটানি করে। কেউ কেউ বুকটা চিড়ে ফালা ফালা করে সেখান থেকে রক্ত খায়। আমি দৌড়ে বেড়িয়ে পরি রাস্তায়। আমাকে সঙ্গ দেয় আমার কুকুর। পেছন থেকে ওরা অট্টহাস্যে ফেঁটে পরে। উফফ...! কি বীভৎস সেই হাসি। আমি সেই হাসির তীব্রতা থেকে পালিয়ে যেতে পারিনা। রাস্তার বসে পরি, কাঁদি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কবি হওয়ার নামে ভন্ডামীর চরম সীমায় গিয়ে মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লোকটা অলৌকিক কোন শক্তির কাছে ক্ষমা চাইতে বসেছে। প্রকৃতিও তার কান্না লোকাতে অক্ষম, সে নিজেও যেন কোন এক পরলৌকিক প্রতিশোধের খেলায় মেতেছে। কথা গুলো চিন্তা করে আরও জোড়ে কাঁদতে থাকি আমি। ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষদের জীবনবোধের তীব্র গন্ধ লেগে থাকা ঝগড়া বিরতির সুযোগে গভীর রাতে মাঝ রাস্তায় একজন চরম ব্যর্থ মানুষকে ওভাবে হু হু করে কেঁদে উঠতে দেখে নুসুর গলা থেকেও অস্ফুটে বেরিয়ে আসে একটা শব্দ। হয়ত সে বলতে চায়, আহারে জীবন...! আহারে...!!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:১২