বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই বহুল আলোচিত বিষয় হচ্ছে, স্বয়ংক্রিয়করণ ও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার কারনে
বহু লোকজন চাকুরী হারাবে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। একটি বিশাল আর্থসামাজিক ঝুঁকি তৈরী হবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, নিশ্চয়ই এই সমস্যার সম্ভবনাময় বিকল্প আছে।
অবশেষে, সুসান লান্ড ও এরিক হাজেন এর একটি গবেষনা প্রবন্ধ পেলাম প্রজেক্ট সিন্ডিকেট-এ। অনেকটা আমি যেরকম ভাবছিলাম-প্রায় সে রকম। ঐ প্রবন্ধটির আলোকে এই লেখাটি।
“স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ঠ্যই হচ্ছে শুরু থেকেই ধাপে ধাপে কাজ করে যাওয়া যেখানে একটি শিশুকে প্রথমে বড় হয়ে উঠতে হয়; তারপর তার সুনির্দিষ্ট কাজ শিখতে ও করতে হয়। তার মানে, দুই দশকজুড়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন এবং তারপর চার বছরের জন্য কাজ শেখার পরিবর্তে একজন কর্মীর জন্য জরূরী হচ্ছে কাজের কোন একটি ক্ষেত্র নির্বাচন করে, সেটি শেখা এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, নতুন নতুন আরোও দক্ষতা অর্জন করা এবং তার কর্ম জীবনের পুরোটা সময়জুড়ে ক্রমাগত নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।”
একজন ট্রাক ড্রাইভারের জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করতে পারা থেকে শুরু করে একজন নার্স, তার রোগীদের চরমমাত্রার ঝুঁকিসমূহ রেকর্ড করতে পারা, হ্যান্ডি ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে একজন টিকেট চেকারেরর ট্রেনের টিকেট চেক করা- প্রতিটি জায়গাতেই বর্তমানে সবাইকে নূন্যতম হলেও ডিজিটাল দক্ষতা থাকতে হয়। প্রযুক্তি দক্ষ কর্মীদের চাহিদা বিগত দুই দশকজুড়ে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে; এই ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি বর্তমানে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে এবং এর হাত ধরে শুধু টেকনোলজি খাতই নয় বরং পুরো কর্মী বাজারের রুপই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।
সুনির্দিষ্ট পাচঁটি ক্ষেত্রের ২৫ ধরনের কোর স্কিলে-যেমন ফিজিক্যাল বা ম্যানুয়াল, সাধারন বুদ্ধিবৃত্তীয়, উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তীয়, সামাজিক ও আবেগ সম্বন্ধীয় এবং প্রযুক্তিক্ষেত্রে কর্মরতরা বর্তমান সময়ে এবং ২০৩০ সালে গড় কত ঘন্টা সময় ব্যয় করবে- তার একটি তুলনা দেখানো হয়েছে “ম্যাকেজ্ঞি গ্লোবাল ইনস্টিটিউট” এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে।
উক্ত রিপোর্ট অনুসারে প্রথমেই বলে নেওয়া যায়, বর্তমানে প্রচলিত প্রযুক্তিজ্ঞান, বেসিক ডিজিটাল জ্ঞান ও প্রোগ্রামিং এর পরিবর্তে ২০৩০ সাল নাগাদ কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার গড়ে ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
সামাজিক যোগাযোগ ও আবেগবৃত্তীয় বিষয়ে যান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনোও পিছিয়ে রয়েছে। যেমন, দলীয়ভাবে কাজ করা, নেতৃত্ব দেওয়া, প্রয়োজনে আলাপ-আলোচনা করা, প্রয়োজনে কোন কিছু বুঝতে পারা ইত্যাদি। এগুলোও খুব দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাবে। স্বাস্থ্য কেন্দ্র, শিক্ষা, বিক্রয় ও বিপনন, ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীদের চাকুরীর বাজার প্রতিবছর ২৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তীয়, বিশেষ করে উদ্ভাবন ও জটিল সমস্যা সমাধানে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার চাহিদা ক্রমাগত আরোও বৃদ্ধি পাবে। এ ধরনের কর্মক্ষেত্র- যেমন, উচ্চতর সাহিত্য ও সমালোচনা, পরিমানগত ও পরিসংখ্যানগত জটিল হিসাব নিকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে যান্ত্রিকতা ইতোমধ্যে তার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। “ম্যাকেজ্ঞি গ্লোবাল ইনস্টিটিউট” এর এই রিপোর্টে এটিও ফোকাস করা হয়েছে যে, অটোমেশন এবং কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা হিসাব রক্ষক, বিনিয়োগ কর্মকর্তা ও আইনী সেবাদানকারীর মতো হোয়াইট কলার চাকুরীর জায়গাগুলো প্রতিনিয়ত দখল করে নিচ্ছে।
সবচেয়ে বেশী হুমকির মুখে রয়েছে ডাটা এন্ট্রির মতো কিছু সাধারন বুদ্ধিবৃত্তীয় চাকুরীর বাজার; যেগুলো বিগত ১৫ বছরের মধ্যে এই ধরনের চাকুরীর বাজার বর্তমানে সর্বোচ্চ হারে হ্রাস পাচ্ছে। এই ধরনের সাধারন বুদ্ধিবৃত্তীয় যোগ্যতা; যা কর্মঘন্টার বিচারে ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকাসহ অনেক দেশে এখনোও সবচেয়ে বড় কাজের ক্ষেত্র। এর বাইরে কিছু কিছু দেশ যেমন ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশে এই ধরনের কর্মীদের জায়গা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ ও আবেগবৃত্তীয় যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মীরা এবং জার্মানীতে শারিরীক পরিশ্রম ও হাতের কাজের কর্মীদের জায়গা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছে উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তীয় যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মীরা।
কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের যোগ্যতার এবং কর্মীদের ধরনের এই যে পরিবর্তন হচ্ছে; সেদিকে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা, কর্মচারী ইউনিয়নগুলোর এখনই নজর দেওয়া উচিত; কারন এর ফলে আমরা একটি বিশাল আর্থসামাজিক ঝুঁকির সন্মুখীন হতে যাচ্ছি। পাশাপাশি, যেহেতু সামাজিক যোগাযোগ ও আবেগবৃত্তীয় যোগ্যতার কর্মক্ষেত্রগুলোর পরিসর প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে, তাই এই শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়তা ও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়গুলো সংযু্ক্ত ও সুসমন্বিত করা এখন সময়ের দাবী।
তার উপর পুরো পৃথিবীব্যাপীই কোটি কোটি কর্মীদের পুনঃপ্রশিক্ষনের ব্যবস্থা নিতে হবে; যার কোন সমন্বিত উদ্যোগ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তা না হলে প্রায় ৭.৫ কোটি থেকে ৩৭.৫ কোটি কিংবা বলা যেতে পারে পুরো পৃথিবীর ৩-১৪ শতাংশ কর্মীর চাকুরীর ক্ষেত্র ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবর্তিত হবে অথবা চাকুরী হারানোর ঝুঁকি তৈরী হবে। যদি এই রূপান্তর ভালোভাবে নিয়ন্ত্রন করা না যায় অথবা খাপ খাওয়ানো না যায়- পরিনতি তাহলে আরোও খারাপ হতে পারে এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মীদের কাজের যোগ্যতার উত্থান ও ক্রমাগত বেতন বৃদ্ধির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কোম্পানীগুলোতে অটোমেশনের ফলে কর্মীদের যোগ্যতার চাহিদার যে পরিবর্তন ঘটবে, তা আরোও চ্যালেঞ্জিং কারন এই পরিবর্তনের ফলে প্রচলিত বিজনেস মডেলগুলো ভেঙে যাবে এবং বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের সমন্বয় কৌশলও বদলে যাবে।
জরীপে- তিন হাজারেরও অধিক ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, যারা এই গবেষনায় অংশ নিয়েছিলো, সেখানে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, কোম্পানীগুলোতে সমন্বায়িত ও গ্রুপ ভিত্তিক কাজের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই নতুন চ্যালেঞ্জ কর্মীদের, বিশেষ করে প্রাযুক্তি জ্ঞান ও উচ্চভিলাষ সম্পন্ন কর্মীদের কাজের ভবিষ্যৎ সফলতা নিশ্চিত করবে।
সুইডেনে, কোম্পানীগুলোর চাঁদা দিয়ে পরিচালিত ‘জব সিকিউরিটি কাউন্সিল’ এবং ইউনিয়নগুলো পৃথকভাবে কাজ কর্মীদেরকে সময়োপযোগী পূনঃপ্রশিক্ষণের জন্য এমনকি যারা এই পরিবর্তনের কারনে চাকুরীচ্যুত হয়েছে তাদের স্বল্প সময়ের জন্য আর্থিক সাপোর্ট দিয়ে।
কিন্তু কোম্পানীর এই স্বয়ংক্রিয়করণ ও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানের সাথে তাল মিলাতে আরোও উদ্যমী হতে হবে। শুধু যথাযথভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিযোজনযোগ্য কর্মীবাহিনীর মাধ্যমেই আমরা আমাদের অর্থনীতির জন্য পরিপূর্ণ উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে পারি। পাশাপাশি, মুনাফা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির উত্থানও নিশ্চিত করতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:০৬