৪.
সারারাত ঘুমুতে পারলাম না। বরাবরই অতি উৎসাহ নিয়ে প্রেমভালবাসা শুরু করেছি এর আগেও। কিন্তু মাঝপথে থেমে গেছি নানান কারণে। কিন্তু মনের কোণে এক টুকরো কালো মেঘ আনাগোনাও করছে। আমার বুঝতে বাকি নেই এটাই সেই অশুভ লক্ষণ যা আমার প্রেম আমার ভালবাসাকে বিপর্যস্ত করে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়ার ইংগিত। কেন জানি মনে হচ্ছে এ যাত্রায়ও আমি ফেল করছি।
সকালবেলা মিটিং ছিল লাভগুরু মেহেদী, আতিফ, ফারহা, রুমিন, চুমকী, রাইসুল ও মেহেরুল্লাহকে নিয়ে। ওদের কাছ থেকে যা আইডিয়া পেলাম সেটা হলো আপাতত পড়াশোনার বারোটা বাজার জন্য আমার প্রিপারেশন নিতে হইবে। ফিলোসফির উপরে ডক্টরেট করতে হবে নেট ঘেটে অথবা বই কিনে এনে আইডিয়া নিতে হবে। আর কয়েকদিন পড়ানোর পরপর প্রপোজ করতে হবে। প্রপোজ করতে গিয়ে যেন তালগোল না পাকাই সে ব্যাপারে সবগুলা দোস্তই সতর্ক করেছে।
বাসায় বসে বসে দুনিয়ার যত রোমান্টিক গান/মুভি সিন আছে সবগুলা দেখছি আর ফ্লার্ট করার জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছি। যাক, অবশেষে মনে হয় কপাল খুলে গেছে। আমার অবস্থা হয়ে গেছে ফইন্নী সিকান্দার বক্সের মতো। আয়নার সামনে যেয়ে ইচ্ছে করছে বারবার নিজেরে ফইন্নী বলে গালে থাপড়া দিই। কিন্তু কোথাও একটা বাঁধার কারণে তা পারছি না।
মাইয়াডা এরুম ক্যা? উফফ! বুকটা ধক করে ওঠে চোখ বুজে ওর কথা ভাবলে। এমন হয়! মনে ইচ্ছে করে এখুনি ওর বেডরুমে গিয়ে চেপে ধরে বলি- এই ছেরি, তোরে আমি লাভু করি। তোর পছন্দ না হলে আমারে চড় মাইরা বিদায় করে দে। আমি গিয়া বাসার ছাদ থেকে ঝাঁপ মেরে সুইসাইড খাই।
পিরিতের জ্বালা টাইপ কি কি গান আছে সেইগুলো সার্চ করে শুনতে থাকলাম। ভীষণ ভীষণ ভাল লাগছে। আগে এইগুলা খ্যাত-মার্কা বলে একদমই ধর্তব্যে ধরতাম না। আর এইগুলা শুনে আজ আমি নিজেই সুপার ফিলিংস নিচ্ছি!!
ফিলোসফি নিয়া রিসার্চ করতে করতে কখন বিকেল ৪টা বেজে গেছে সেটা খেয়াল-ই নাই। ফারহা‘কে রিং করলাম। বেচারি আমার মিশনের একজন ক্রু। সে ৩০ মিনিট আগে থেকেই প্রস্তুত। আমাকে একটানা ১৫ দিন ব্যবহার করার জন্য ওর ওর এলএক্স হান্ড্রেড + ড্রাইভার‘কে বরাদ্ধ করে দিয়েছে। লাগলে আরো বেশিদিন রাখতে পারবো। কোন সমস্যা নাই। যদিও আমাদেরও গাড়ি আছে তবে সমস্যা হলো ঐটা নিয়ে গেলে মিশনে গোলমাল হতে পারে। কারণ এত দামী গাড়ি নিয়ে গেলে কমিশনার আংকেলের সন্দেহ হতে পারে।
নিচে নেমেই দেখি বেচারা আযাদ ২৮ দন্ত বিকশিত করে হাসছে। মনে হয় এই মিশনের কথা সেও জানে। জানলে জানুক সমস্যা কি। বাধ্য ড্রাইভারের মতো মাথা একটু কাত করে ডোর খুলে সে বলল -স্যার বসে পড়ুন। যাত্রা শুভ হোক। আমি মনে মনে বললাম - একটা ফাত্রা জুটেছে এই মিশনে!!
মিনিট পনের পরেই কমিশনারের বিলাসবহুল বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম। ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে বসে সামনের সময় ও বিপদ আপদ আঁচ করতে চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যে একপলক কন্যাকে দেখেও ফেললাম। আমার সামনে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে ভেতরে চলে গেল। যাবার সময় আমার দিকেও এক পলক সে না দেখে থাকতে পারেনি। মনে বুঝলাম, ইহা ফ্যাশন জাতের মানুষ। মনে হয় এখুনি পার্লার থেকে ফিরে এসেছে। আমারে ডাবল ট্রিপল ক্রাশ খাও্যানোর মতলব করছে মনে হয়।
এইসব ভাবতে ভাবতে আমি খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে সেটা ভেঙে দিতে কমিশনার আংকেল এসে সামনাসামনি বসে বললেন, মাস্টার সাব! আচেন ক্যামন?
- হ্যাঁ, ভাল। আপনি কেমন আছেন আংকেল?
- ভালা আচি। উঠেন, আমার লগে আহেন।
- সিউর।
(বামে গিয়ে একটু পরেই সেই প্রাণহরিণীর বাসকক্ষের সন্ধান পেয়ে গেলাম। উনার পিছু পিছু নিশ্চিন্ত মনে ঢুকে পড়লামও।)
- এই বিউটি, কই গেলি?
(ওয়াসরুম থেকে ওভার ঝাঁঝাল একটা গলা শুনলাম।) - হ, আইতাচি। উনারে বসান না ক্যান।
- আপনে চেয়ারে বহেন না ক্যান। বইচা পড়েন।
- সিউর!
২ মিনিটকে আমার মনে হলো ২ ঘন্টা! এর মধ্যে এই বদমেজাজী আংকেল কিছু না বললেও আমি সুইটি এবং বিউটি দুইটা নাম নিয়ে তালগোল পাঁকালাম। কারণ ঐদিন নাম শুনেছিলাম সুইটি, আর আজ শুনছি বিউটি! অবশ্য এর মধ্যে কখন সে এসে গেছে খেয়াল করিনি। কমিশনার আংকেলের কন্ঠে সম্বিত ফিরে পেলাম।
- আমি বাবা পড়ালেহা করি নাইক্কা। সো, ইংরেজি বাংলা গুলাই গুলাই কথা কইতে অয়। আমার মাইয়ারা আবার বাংলায় কথা কইতে পারে। এই বিউটি উনার থিকা সব পপলেম সলভ কইরা নিবি। আমার কাম আচে আমি গেলাম।
- নো প্রবলেম আংকেল। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। ও যেখানে যেখানে আটকাবে আমি সলভ করে দেব।
(এতক্ষণ আমি একবারও মেয়েটার দিকে তাকাতে পারিনি। কোনও একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে ওর দিকে তাকানো থেকে বিরত করে রাখছে। আমি সেই শক্তির সাথে কেন যেন পেরে ওঠছি না।)
- তাহলে আপনিই হলেন আমির খান?
- না। (আমি নীরব। একটা কলমের দিকে চোখের ৩৬০ ডিগ্রি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে।)
- হাঃ হাঃ তাহলে আপনি কে শুনি?
- আমি হচ্ছি আমির সাইয়েল আহমাদ! তোমার স্যার!!(এক চিলতে হাসি উপহার দেবার চেষ্টা)
- ওহ! স্যরি স্যার। আমির স্যার। তা আপনি কোন ইয়ারে আছেন?
- আমি মাস্টার্স করছি সুইটি!
- ওহঃ তাহলে তো স্যার ডাকতেই হয়। হাঃ হাঃ হাঃ
এবার ওর দিকে তাকালাম। সব সংকোচ দুরে ঠেলে দিয়ে বেশ ধীরে ধীরে ওর চোখের দিকে তাকালাম।
৫.
- আমি সুইটি এটা কে বলেছে?
- কে আবার। তোমার বাবা?
(এমনিতেই আমার চোখ চড়ক গাছের পাতা হয়ে গেছে। এই মেয়ের বয়স আমার প্রাণহরিণীর চেয়ে কমসে কম কয়েক বছর বেশি হবে। ক্যামনে কী? আগের মেয়ে কখনো শাড়ি পরেছে কি না ঢের সন্দেহ। আর এ দেখি শাড়ি পরে একেবারে আমার খালা সেজে বসে আছে। আর এঁরেই কি-না আমি তুমি তুমি করছি! ও মাই গাড!!)
- আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
- হুঁ (চোখের পাপড়ি প্রসারিত করে আমি ভালভাবেই চোখ পাকালাম।)
- পছন্দ হয়েছে মানে?
- আরেহঃ আপনি স্মার্ট, সুশিক্ষিত একজন ভদ্রলোক। স্যার মানুষ।
- হুমম। বুঝা গেল ব্যাপারটা। (এক চিলতে হাসি উপহার দেয়ার পুনঃচেষ্টা)
- আচ্ছা স্যার। আপনি খুব ভদ্র একজন পার্সন তাই না?(আমার দুশ্চিন্তার পারদ ওঠা শুরু হয়ে গেল।)
- হাঃ হাঃ সন্দেহ হয়?
- না, সন্দেহ হবে কেন? স্টাডি করবো ব্যস!
- আচ্ছা! বিউটি/সুইটি দুটাই কি আপনার নাম?
- না, সুইটি আমার ছোটটা। সারাদিন খালি ঘুরঘুর করে। ওকে তো দেখার কথা।
- হুঁ। বুঝছি ব্যাপারটা।
- সুইটি কেন বলেছে বাবা সেটা বুঝতে পেরেছি। সেটা আসলে বাবার একটা কমন ভুল। প্রায়ই বাবা নামে গোলমাল করে আমাদের। হাঃ হাঃ হাঃ
- হাঃ হাঃ বুঝছি।
- স্যরি, আমাকে আপনি করে কেন বলছেন?
- আসলে আমারই ভুল। প্রথমেই যদি আপনার দিকে দেখতাম তাহলে এই ভুলটা হতো না। আমি মনে করেছিলাম ছাত্রী যেহেতু বয়স কমই হবে। অথচ আপনি আমার চেয়ে ঢের সিনিয়র।
- উঁহু! এই সমস্যা? আরেহঃ না। স্যার। এটা কোন কথা হলো। সেভেনে থাকতে আমার মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে ৮ বছর গ্যাপ দিয়ে ক্লাস এইটে পড়তে হয়েছিল। এ কারণে আমার এই অবস্থা!
- অহঃ বুঝলাম ব্যাপারটা। আজ আমরা Concept of Matter নিয়ে আলোচনা করি কেমন?(বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম)
- সিউর, স্যার!
- ল্যাটিন ওয়ার্ড māteria থেকে ম্যাটার এসেছে বুঝেছেন? এটা আসলে কাঠ বা ঐ টাইপ কিছু মিন করে। ...
- স্যরি! স্যার? আমাকে আপনি আপনি করছেন কেন? প্রথমেই তো ঠিক ছিল। নাকি?
- অহহোঃ বললাম না? প্রথমেই আমি ভুল করেছি।
- না। এখন ভুল করছেন, প্রথমেই ঠিক ছিলেন। দেখেন স্যার, আমি অনেক জুনিয়র আপনার চেয়ে। কেবল বয়স কি সিনিয়রিটি দেয়? এই যেমন ধরেন শেখ হাসিনার কথাই ধরেন..
- উহু, বুঝেছি তো। আমি আসলে তুমি শব্দে সংকোচবোধ করছি।
- মাইন্ড করলাম কিন্তু!
- নাহঃ মাইন্ড করার কি আছে এখানে। আচ্ছা আপনার স্টাডি স্কেমটা দেখি একটু..
একটানা ১ ঘন্টা বকর বকর করে পাংশু মুখে ফিরে এলাম। ড্রাইভারকেও হালকা মাত্রায় চিন্তিত দেখলাম। কোন শব্দ না করেই বাসায় এসে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম।
৬.
সারাটা রাত কাটল আজগুবি সব স্বপ্ন দেখে দেখে। কম হলেও ৪ বার ঘুম থেকে উঠে পানি খেয়েছি। মাথা আজ আমার সাথে ঢং শুরু করেছে নাকি কে জানে। আজ সকালবেলা জেগে জেগে রুমিনকে নিয়ে ভাবলাম। তাও যেইসেই ভাবনা না। একেবারে বউ টাইপ কেউ। মনে হলো একটু পরে ফোন করে ওকে বলি- এই চলো না আজ সন্তোষ স্যারের ক্লাস বাদ দিয়া দাবা খেলি। আমি তো খুব বোরিং ফিল করি এই লোকটার ক্লাস।
ঘোর কাটতে সময় বেশি লাগেনি। ক্লোজ হয়ে গেলে মানুষ আরো বেশি কিছুও ভাবতে পারে ভেবে নিজেই নিজেকে সুবোধ দিলাম। তবে ফোন করে ওকে সবকিছু আপডেট করা দরকার তাই ফোন দিলাম।
ওর কন্ঠে মনে হলো এক দমকা খুশির হাওয়া বয়ে গেল। যথাসম্ভব লুকিয়ে সে আমার সাথে কথা বলতে থাকল।
- শোন, তোর কপালে কি আছে সেটা বুঝেছি।
- কি আছে?
- বুড়ি। তুই বুড়ি বউ পাবি। হিঃ হিঃ হিঃ
- বয়স?
- উমম ধর কমসে কম তো ৫০ হবেই। হিঃ হিঃ হিঃ..
- খাইসে। তাইলে কি পোলা মাইয়া পয়দা হইবো না নাকি?
- চুপ কর শয়তান। এইসব বাজে কথা আমার সাথে বলবি না কয়দিন সাবধান করেছি?
- স্যরি, তবে একটা ভয়ে আছি। শুনবি?
- কি?
- শুনেছি ৩৫ বছরের পর মেয়েদের সন্তানধারণ বিপদজনক আর ৪০ এর পরে...
- এই বদের বদ। একটু আগে বললাম না এইসব উল্টাপাল্টা কথা আমার সাথে বলবি না?
- স্যরি কিন্তু এডভান্স বলে দিয়েছি। তারপরও রি-স্যরি।
- হয়েছে।
(কিছুক্ষণ চুপ)
- আজ কি পড়াতে যাবি?
- আরেহঃ এত কষ্ট করে ফিলোসফির নানান খুঁটিনাটি শিখে গিয়ে এ কি শুনলাম? আমার বউয়ের বোনকে পড়াব ফিলোসফি। যেটা আমার চ্যাপ্টার না। আর আমার বউ পড়ে সিএসই যেটা আমি নিজেই পড়ি। উমম.. কি কপাল আমার!
- হিঃ হিঃ হিঃ আমার তো দারুণ লাগছে ব্যাপারটা!
- কেন? তুই কি আমার সাথে প্রেম করতে চাস নাকি?
- এই দেখো! তোর মতো অগা বগা ফাউ লোকের লগে প্রেম করতে আমার বইয়েই গেছে।(কনফিডেন্ট টা কিন্তু চরম লেভেলের)
- হয়েছে। আমি না হয় ফালতু লোক। কিন্তু তোর কাছে দারুণ লাগার কাহিনী কি আমরে বল।
- আহঃ না। বলা যাবে না।
- খাইসে। মেয়েদের বদনাম তো আর এমনিতে হয় না সেটার আরেকটা প্রমাণ দিলি তুই।
- কি কী? কী?
- এই যে মাইয়ালোকের বুক ফুটে তো মুখ ফোটে না।
- এত কতার কি আছে রে! তবে শোন-
- হুম
- আমি হাসলাম কারণ হলো মাইনশে লটর পটর করে শালিদের সাথে। তোর কপাল মোটা। জেঠাসের* লগেও পিরিত করছিস। হিহঃ হিঃ হিঃ হিঃ
- ওহঃ এই কথা। এইটা বুঝি বাজে কথা না?
- হ্যাঁ
- তাইলে বাজে কথা আমি বললে দোষ। তুই বললে দোষ না।
- না
- এই উদ্ভট নীতি কেন? এত অন্যায় কেন? এত অবিচার..
- এই থামবি শালা?
- হুঁ বুঝলাম। এই দেশে নারীরা স্বৈরাচারী।
- তবে রে। শোন, আমি বলতে চাইনি তো প্রথমে। তুই-ই তো জোর করে শোনালি। শাআলা এখন আবার করছিস ঘ্যানর ঘ্যনর। উফফ!!
- আচ্ছা রাখি।
এই বলে ফোনটা রেখে দিলাম। যাক বাবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল।
* জেঠাস বলতে বউয়ের বড় বোনকে বোঝায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৩:৪৭