আগের পর্বের লিংক
⇲ আবির্ভাব
রাত দেড়টা। বাংলা মদের স্বাদ নিতে ভুলানাথের ঘর থেকে বেরিয়ে বটিজার গাঁয়ের দিকে ফিরছে যোসেফ। এটা তাঁর দ্বিতীয় দিন এই গ্রামে।
বিখ্যাত ঐ বটগাছের নিচে এসে সে যতটা অবাক হয়েছে তার পরিমাপ করলে সেটা অতীতের সব বিস্ময়কে ছাড়িয়ে যাবে। মদ খাওয়ার কারণে সে কোনদিনও মাতালগিরি করেনি। হ্যালুসিনেশনও হয়নি। কিন্তু আজ যে-টা দেখছে সেটা কি হ্যালুসিনেশন নয়?
সম্পুর্ণ নগ্ন একটি মেয়ে। চুল অনেক দীর্ঘ। মাটিতে পড়ে যায় যায় এমন। চাকচিক্যময় যৌবন। ঠায় ১০ মিনিট দাঁড়ানোর পর তার জ্ঞান কাজ করল।
আরে, পাশেই তো সবুজ আছে। ওকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়? সে যা দেখছে সবুজও কি তা দেখছে?
কিন্তু পেছনে চেয়ে দেখে সবুজ ওখানে নেই। তাহলে কি ঘটলো? আমি কি স্বপ্ন দেখছি? গায়ে চিমটি কেটেও বুঝে নিল যোসেফ, যে এটা স্বপ্ন নয়, এটা বাস্তব-ই।
মেয়েটির দিকে আরো তাকিয়ে থাকতে যোসেফের মন চাইল। তার পেছনদিক দেখা যাচ্ছে। আরো এগিয়ে যেতে চাইল আর তখনই ভুপৃষ্টে পতিত সহচর সবুজের নিতম্বে হোঁচট খেয়ে ওকে আবিস্কার করলো। আর বিশাল একটা উদ্বেগ থেকেও যেন মুক্তি পাওয়া গেল।
সমস্যার কথা হলো সবুজ অজ্ঞান হয়ে গেছে। টর্চ দিয়ে দেখল মুখে ফেনা। এ নির্ঘাত ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। কিন্তু যোসেফের কাছে সবুজের চেয়েও বড় ইস্যু হলো ঐ রহস্যময়ী নারীর কাছে যাওয়া।
সবুজের জ্ঞান ফেরানোর জন্য, যোসেফ যে একেবারে চেষ্টা করেনি তা নয়। মাথায় জুতা দিয়ে কয়েকবার আঘাত করেছিল ডঃ যোসেফ।
এতে করেও যখন জ্ঞান ফেরার কোন উপায় দেখলো না, তখন সে সিদ্ধান্ত নিল এটা পরে দেখা যাবে। অথবা ঐ মেয়ের কাছ থেকেই সাহায্য চাওয়া উচিত। সে লক্ষ্যেই কদম ফেলে এগুতে থাকল।
একরাশ ভয়, শংকা, উত্তেজনা, কৌতুহলমিশ্রিত মন নিয়ে অভিনব কোন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে যোসেফকে। মনে হচ্ছে আজ পৃথিবীর গুঢ় কোন রহস্যের সাথে বাস্তবিকই তার মোলাকাত হবে। এমনও হতে পারে এই মোলাকাত করতে গিয়ে সে নিঃসীম সীমান্তে মিলিয়ে যাবে। দেহ এখানে কোথাও পড়ে থাকবে। হয়তবা সুইজারল্যান্ডেও তার দেহ না পৌঁছাতে পারে। তাতে কি? একদিন তো মরতেই হবে।
দিব্যজ্ঞান থেকে মষ্তিষ্ক সচেতন রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে যোসেফ, কিন্তু ঘোর লাগা শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। তার চোখ এখন ঐ দীর্ঘকেশী নগ্ন কন্যা ব্যতিত কোনদিকেই যাচ্ছে না। আশপাশের কিছুই যে, চোখ দিয়ে আর অবলোকন করা যাচ্ছে না। একটা অদ্ভুত শক্তি যেন ভর করেছে তার মষ্তিষ্কে। যেটা তার দৃষ্টিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে।
ঢের মনে আছে নীল ট্রাউজারটি পরে বেরিয়েছিল যোসেফ যা এই আঁধারে বোঝাই যাচ্ছে না। আর গায়ে ফুলহাতা টি শার্ট। এ-দেশে গরমকাল সবে শুরু হচ্ছে। অমাবস্যা হলে থাকত ঘুটঘুটে অন্ধকার। আজও চাঁদ পুর্ণতা পায়নি। পশ্চিমদিকে ঘন্টা দুয়েক পরেই অস্ত যাবে। তাই এখনো অতোটা আঁধার না।
ঐ কনে আবার পরী টরী না-তো? না-কি কোন এঞ্জেল? কি হতে পারে? ভেতরের যত জাগরিত শক্তি আছে সেটা দিয়ে ভাবার ও জানার জন্য চেষ্টা করছে ডঃ যোসেফ। আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঐ বিবসনা নারীর পিছু পিছু হাটছে।
আজ যোসেফের ভাগ্য ভালই বলতে হয়। বেশ কিছুদুর যাবার পর তার মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠলো। আইফোন ফাইভ এস। এর চমৎকার শব্দে ঐ নারী পিছন ফিরে তাকালো। কিন্তু যোসেফ মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকায় ঐ নারীর সম্মুখ-দেশ প্রদর্শনের ভাগ্য হলো না। তবে অন্তঃচক্ষু দিয়ে সে দেখে নিল। দুইটি চিত্রও মানসপটে এঁকে ফেলল। এর একটা সুদর্শন আর অপরটি কুৎসিত।
ফোনটা কেটে দিয়ে ক্যামেরা অন করে ভিডিও রাখার মতলব করেছিল। কিন্তু এই সম্মোহন ভংগ হওয়াতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঐ নারীটি আর ওখানে ছিল না। সে কোনদিকে যে চলে গেল যোসেফ কোনভাবেই ঠাহর করতে পারলো না।
⇲ কোলাহল
সরকারী দলের বেশ প্রভাবশালী নেতা আলাল মিয়া'র সুনজর পড়েছে বটবৃক্ষের ওপর। অবশ্য নজর একদমই পড়ত না। এর কৃতিত্ব ডঃ জোসেফ এর।
কিছুদিন আগে "Effect of Different Concentrations of IAA (plant hormone) on Root Initiation" শিরোনামে প্লান্ট সায়েন্স নিয়ে গবেষণা শেষ করেছে ডঃ জোসেফ।
বটবৃক্ষের ওপর নজর পড়েছে তার এখন। আর বটিজার গাঁয়ের বটবৃক্ষের অদূরে সম্মোহিত হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে সে খুব ইন্টারেস্টেড।
গ্রামের মানুষের কাছ থেকে ভয়াবহ সব ঘটনা জানার পর কলকাতা যাবার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়ে ভিসার মেয়াদ একমাস বাড়িয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডঃ যোসেফ। আর এলাকার যে কয়জন প্রভাবশালী আছেন তাদের সাথে যোগাযোগ করে এই গাছ নিয়ে গবেষণা করতে সাহায্য চাইল সে।
এখানেও আরেক বিপত্তি ঘটে গেল। সরকারী দলের স্থানীয় এম.পি. এক সাংবাদিকের কাছে বলেছেন, এই গাছটি অত্র জেলার অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ ঐতিহ্য। এটা নিয়ে ধানাই পানাই তিনি সহ্য করতে রাজি নন। এটা থাকবে এবং এজন্য উনি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও গাছের জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখবেন।
সাধারণ জনগণের কাছে এই গাছটি আলোচনার কোন বিষয়ই ছিল না এতদিন। কিন্তু পত্রিকা মারফত এখন এটা ভালই উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। চায়ের দোকানে আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে ভালই জায়গা করে নিয়েছে বটগাছটি। অন্যতম কারণ হলো জেলা প্রশাসন ও এলজিইডি চাচ্ছে এই দিকে রাস্তা সম্প্রসারণ করতে। আর এই কাজ করতে গেলে বটগাছ কাঁটা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
সেই সাথে আরেকটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারী দলীয় নেতা আলাল মিয়া'র সাথে বিদেশী শয়তানদের নাকি একটা গোপন চুক্তি হয়েছে। একটা শয়তান নাকি ইতিমধ্যে বটগাছ নিয়ে তার যন্ত্রপাতি দিয়ে নানান পরিক্ষা নিরিক্ষা শুরু করেছে।
তাকে যাবতীয় সহায়তা করছে ঐ নেতা, তার পাতিনেতা আর গুন্ডারা। এলাকার কোন মানুষকে গাছের ধারে কাছে ভিড়তে দেয়া হচ্ছে না। তবে খোদ বটিজার গাঁয়ের মানুষ বেশিরভাগ লোকই এইসব ব্যাপারে নির্লিপ্ত মনে হচ্ছে। এর কারণ হতে পারে তাদের কেউই শিক্ষা দিক্ষায় তেমন নজর দেয় না। আর এখনো আগ্রহ জন্মায়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য মেট্রিক পাস কোন মানুষও এই গাঁয়ে নেই।
তবে গাঁয়ের সুবিখ্যাত ছিফৎ মিয়ার চায়ের দোকানে বসে কবিরাজ সফদর আলী সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ধর্মের কল বাতাসে এমনিতেই নড়ে।
এই কথায় সবাই আশ্বস্ত না হলেও গুটিকয়েক বুড়ো মানুষ নিশ্চিন্ত। জোয়ান বয়সী কিছু মানুষ আবার উন্মুখ হয়ে আছে। ওরা অপেক্ষা করছে একটি বা অনেকগুলো কল্লা কাটা লাশ দেখার জন্য।
⇲ ব্যর্থ অপেক্ষা
সবুজের জ্ঞান ফিরেছে আড়াই দিন পর। সদর হাসপাতালে আইসিউতে ছিল। হৃদযন্ত্রে গোলযোগ ছিল। মষ্তিষ্কে রক্ত চলাচল অস্বাভাবিক ছিল। জ্ঞান আসার পর এক ঘন্টা কোন কথা বলতে পারেনি। এরপর তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সবুজের সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার খবর ডঃ জোসেফ নিজে শুনতে চান। কেন ও এইভাবে পড়ে গিয়েছিল। সে কি দেখেছিল। আমার সাথে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটার সাথে কি ওর মিল আছে? নাকি হ্যালুসিনেশন কেবল আমার হয়েছিল। আমি মনের ভুলে ঐ রহস্যময়ী নারী-কে দেখেছিলাম।
অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য উসখুশ করছে ডঃ যোসেফের। কিন্তু ডাক্তাররা বলেছে আগামি তিনদিন ছেলেটার সাথে কোন কথা বলা যাবে না। নিতান্তই মিঃ যোসেফ অধৈর্য হবার যন্ত্রণায়, অপেক্ষায় থাকবার কষ্টে ভুগতে থাকল।
আর যাই হোক, ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত একটি স্বভাব ধরে রেখেছে যোসেফ। রহস্য উদঘাটন করার নেশা এই পরিণত যুবক বয়সেও তাকে ভালই চেপে ধরেছে।
যোসেফ শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিল সবুজের জন্য তিনদিন সময় নষ্ট করা বৃথা হবে। তাই ট্যুরিজম অফিসে ফোন দিয়ে আরেকজন গাইড দেয়ার জন্য ফোন করল। যথারীতি একজন মধ্যবয়সী লোকও পাওয়া সম্ভব হল। তবে লোকটা এসে যখন ভুত প্রেতের কথা শুনতে পেল তখনই একটা চিরকুট লিখে ক্ষমা প্রার্থনা করে না জানিয়েই চম্পট দিল বেচারা।
এই ঘটনার পর ডঃ যোসেফ আজ আর ফোন দিল না ট্যুরিজম অফিসে। গাইড ছাড়াই আজ রহস্য উন্মোচনে যেতে মনস্থির করলো। তবে অবশ্যই সাথে থাকবে তার নিরাপত্তার জন্য যা যা দরকার সব।
অতিশয় ঐ বটগাছে যাওয়ার শখানেক-গজ আগে কবরস্থান ও শাশ্মান। মুসলমান মুর্দার এলাকাকে কবরস্থান বলে, আর হিন্দু শবদেহের এলাকাকে বলা হয় শাশ্মান। মাঝখানে দুইহাত প্রস্থের একটি সরু খাল দিয়ে পৃথক করা হয়েছে।
ডঃ যোসেফ বটগাছের নিচে যেতে রওয়ানা দিয়েছে আজ রাতে আরো আগে। কবরস্থানের পাশ দিয়ে ভয়ডরহীন একটা ভংগিমায় একমনে হেটে চলছে।
রাত একটা। চাঁদের অবস্থান এখন পশ্চিমদিক থেকে হলেও বেশ ভাল। আবছা অন্ধকার আছে। তবে বটগাছের নিচে নিশ্চয়ই তা থাকবে না। আর যাই হোক, সেদিনের মতো অন্ধকার আজ আর নেই। কিন্তু একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে কবরস্থান থেকে।
টরর-রর, টরর-র, টরর, টরর, টরর-র।
বিভিন্ন লয়ে খটখটে এই শব্দটি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তাও অনিয়মিতভাবে। কিন্তু ক্রমাগত বাজছেই। এত রাতে গাছের উঁচুতে কে শব্দ করতে পারে। তাও যদি হাতুড়ি'র শব্দ কিংবা কুঠারের শব্দ হতো তবে একটা কথা ছিল। এটা মনে হচ্ছে দূর্বল হাতে কেউ গাছের ফাঁটা কান্ডের দুটো টুকরোর মধ্যে শব্দ করছে। অবশ্য তা নাও হতে পারে।
যোসেফ পাঁচমিনিটের মতো দাঁড়ালো। এর মধ্যে মাত্র দুইবার ঐ শব্দটি অনুভূত হয়েছে। সে এই ব্যাপারটা নিয়ে আর এগুতে চাইল না। নির্জন এই রাস্তায় প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে রিভলভারের অস্তিত্বে পুনঃরায় নিশ্চিত হয়ে নিল।
এরপর আবারো একবার শব্দটি শোনা গেল। টরর-রর!!!
বিষয়টা নিয়ে আর ঘাঁটাতে রাজি নয় যোসেফ। সে পুনরায় হাঁটায় মন দিল। আর বেশি দুরে নয়। ঐ-তো দেখা যাচ্ছে বিশাল জায়গা জুড়ে তমসাচ্ছন্ন করে বটগাছটি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
প্রবল উত্তেজনার মধ্যে যোসেফ অপেক্ষা করছে। বটগাছের ঠিক নিচে। কি হতে পারে। অনতিদুরে একটি চিকন সাপ তার দিকে ধেয়ে আসল। যোসেফ স্বভাবসুলভ বুদ্ধিমানের মতই কাজ করলো। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। কোন নাড়াচাড়া করলো না। সাপটি মাথা তুলে কয়েকমিনিট তার দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো। এরপর নিরীহ বেচারা ভেবে মাথা নামিয়ে এঁকেবেঁকে সর্পিল গতিতে চলে গেল।
সাপটি চোখের সামনে থেকে দুরে পাতার নিচে অদৃশ্য হয়ে যাবার পরপরই যোসেফ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। গলা শুকিয়ে গেছে তার। জায়গাটা যে মোটেই নিরাপদ নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত। কিন্তু প্রাকৃতিক এইসব রহস্যের উন্মোচন কাউকে না কাউকে তো করতেই হবে। সেটা করতে গিয়ে নাহয় আমি না-ই হয়েই গেলাম।
এইসব ভেবে আর কানে পপসংগীত শুনতে শুনতে কবে যে রাত তিনটা হয়ে গেল সে টেরই পায়নি। ব্যাপার কি? ঐ নারী আজ আর আসছে না কেন?
ধীরে ধীরে আশাহত হতে হলো ডঃ যোসেফকে। এমনকি ফযরের আজানও শুনা গেল অথচ ঐ নারী আজ রাত আর আসেনি। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:০৭