(সাম্প্রতিক সময়ে আমার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত শায়খ আনওয়ার আল আওলাকী রহ. এর ঐতিহাসিক অডিও লেকচার Allah is Preparing us For Victory এর বাংলা অনুবাদ বই আকারে প্রকাশ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের অনেক গুলো প্রেক্ষাপটে বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় এর অংশ বিশেষ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। আশা করি এটি আমাদের সকলের উপকারে আসবে ইনশাআল্লাহ।)
পূর্বের লেখা: পূর্বের লেখা: আল্লাহ আমাদের বিজয়ের জন্য প্রস্তুত করছেন
পূর্ব প্রকাশের পর:
পূর্ব প্রকাশের পর:
আমরা যদিও আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে শুধু অভিযোগ করি আর আমাদের অবস্থা যদিও আক্ষরিক অর্থে হুবহু সাহাবায়ে কিরামের সময়ের মতো নয়, তথাপিও সার্বিক বিচারে আমরা দেখতে পাই যে, এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি মিল রয়েছে সাহাবায়ে কিরামদের সময়ের সাথে। এই বক্তব্যের সমর্থনে যে বিষয়গুলো তুলে ধরা যেতে পারে তা হলো:
ক. (মাক্কী জীবনে) সাহাবায়ে কিরাগণ যখন ইসলামের পথে এসেছেন তখন সমাজে মুসলমানদের কোনো নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিলো না। ইসলামিক হুকুমতও ছিল না। আর বর্তমানের অবস্থাও অনুরূপ। অথচ মুসলমানদের এমন নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও ইসলামিক রাষ্ট্রবিহীন এমন দূরাবস্থা (১৯২৪ সনের পূর্বে) ১৪শত বছরের ইতিহাসে আর কখনো হয়নি।
খ. সাহাবায়ে কিরামদেরকে যেমন তাঁদের সময়ে তাঁদেরকে বেষ্টন করে রাখা গোটা আরব উপদ্বীপ, তৎকালীন দুই শক্তিশালী পরাশক্তি রোমান ও পারস্য সম্রাজ্যসহ বহুবিধ শক্তির মোকাবেলা করতে হয়েছে, বর্তমান সময়েও এই একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঘরের শত্রু, বাইরের শত্রু সবাই মিলে আজ ইসলামের বিজয়কে রোধ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোমর বেঁধে লেগেছে। এমন নাজুক পরিস্থিতি (১৯২৪ সনের পূর্ব পর্যন্ত) আমাদের অতীত ইতিহাসে আর কখনো আসেনি। ভালো হোক মন্দ হোক মুসলমানদের কোনো না কোনো নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিলো। সত্যকে সাহায্য করার মতো একদল লোক সব সময়ই সমাজে পাওয়া যেতো।
অন্ততঃ পক্ষে খারাপ পরিস্থিতি থেকে নিজের দ্বীন-ঈমানকে হিফাজত করার জন্য হিজরত করে যাওয়ার মতো কোনো না কোনো স্থান পাওয়া যেতো। বর্তমান সময়ে গোটা বিশ্ব ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আর এই পরিস্থিতির মিল একমাত্র সাহাবায়ে কিরামদের পরিস্থিতির সাথেই পাওয়া যায়। আর এজন্য এটা খুবই স্বাভাবিক যে, এই কঠিন পরিস্থিতিতে যাঁরা কাজ করবে তাঁদের প্রতিদানও বহুগুণ বেশি হবে। তাঁদেরকে নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা অনেক বেশি পরিমাণ আজর বা বিনিময় দান করবেন এবং তাঁদের মর্যাদা অনেক উঁচু স্তরে তুলে দিবেন। আমরা একথা বলছি না যে এদের বিনিময় সাহাবায়ে কিরামদের সমান হবে; তবে এটা বলছি যে এদের বিনিময় অনেক উঁচু দরজার হবে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের আকীদা হলো, মর্যাদার দিক থেকে এই উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে প্রথম হলেন সাহাবায়ে কিরামগণ, তারপর তাবেঈন, তারপর তাবে তাবেঈন। কিন্তু আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সেই হাদীসটিকেও মনে রাখতে চাই, যে হাদীসে তিনি বলেছেন,
فَإِنّ مِنْ وَرَائِكُمْ أَيّاماً الصّبْرُ فِيهِنّ مِثْلُ الْقَبْضِ عَلَى الْجَمْرِ، لِلعَامِلِ فِيهِنّ مِثْلُ أَجْرِ خَمْسِينَ رَجُلاً يَعْمَلُونَ مِثْلَ عَمَلِكُمْ". قال عَبْدُ الله بنُ المُبَارَكِ: وَزَادَني غيرُ عُتْبَةَ قِيلَ: يَا رَسُولَ الله أجْرُ خَمْسِينَ رَجُلاً مِنّا أوْ مِنْهُمْ؟ قال: "لاَ، بَلْ أَجْرُ خَمْسِينَ رَجُلاً مِنْكُمْ". (قال أبو عيسى: هذا حديثٌ حسنٌ غريبٌ.)
অর্থ: “তোমাদের পর এমন একটি যুগ আসবে যখন ধৈর্য ধরে দ্বীনের উপর কেবল টিকে থাকাটাই হাতে আগুনের অঙ্গার নিয়ে থাকার মতো কঠিন হবে। সে সময়ে যারা (আল্লার দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য) কাজ করবে তাঁদেরকে পঞ্চাশ জনের সমপরিমাণ বিনিময় দান করা হবে। জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ তাঁদের সমসাময়িক পঞ্চাশজনের সমপরিমাণ বিনিময় নাকি আমাদের পঞ্চাশজনের সমপরিমাণ বিনিময়?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের পঞ্চাশজনের সমপরিমাণ।” (তিরমিযী, হাদীস নং ৩১৫৫)
অতএব তাঁদের সালাত হবে পঞ্চাশজন সাহাবীর সালাতের সমান। তাঁদের সিয়াম হবে পঞ্চাশজন সাহাবীর সিয়ামের সমপরিমাণ। কেনো এতো বেশি বিনিময় দেয়া হবে? কারণ সে সময়টি হবে ভীষণ সঙ্কটময়। এ সময়টি হবে অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। এই কঠিন পরিস্থিতিতে সঠিক ঈমান ও সঠিক আমলের উপর থাকার কারণেই তাদের বিনিময় এতো বেশি দেয়া হবে।
আমরা দেখতে পাই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতের শেষ যামানায় এমন কিছু সৌভাগ্যবান মানুষের কথা আমাদেরকে জানিয়েছেন যাঁরা হবে তাঁর উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্ত। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلى) يَخْرُجُ مِنْ عَدَنِ أَبْيَنَ اثْنَا عَشَرَ أَلْفاً , يَنْصُرُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ هُمْ خَيْرُ مَنْ بَيْنِى وَبَيْنَهُمْ.
অর্থ: “হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (দক্ষিণ ইয়েমেনের) আদনে আবইয়ান অঞ্চল থেকে বারো হাজারের একটি বাহিনীর আবির্ভাব হবে, তাঁরা আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাহায্য করবে এবং আমার ও তাঁদের সময়ের মধ্যে তাঁরাই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।” (মুসনাদে আহমাদ, মু’জামুল কাবীর, তারীখুল কাবীর)
লক্ষ্য করুন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেছেন! তিনি বলেছেন যে তাঁরা আল্লাহর রাসূল ও তাঁদের সময়ের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হবে। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি যে তাঁরা আল্লাহর রাসূলের পর থেকে যতো যুগ, যতো শতাব্দী পরে হবে, তাঁর মধ্যে তারাই হবে শ্রেষ্ঠ। বিগত শতকসমূহের মাঝে তাঁরাই উম্মতের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁদের এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ কি? কারণ হলো তাদের সময়টি সাহাবায়ে কিরামদের সময়ের মতোই জটিল ও কঠিন হবে। তাঁদেরকেও সেই একই ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে, যা সাহাবায়ে কিরামদেরকে করতে হয়েছিলো।
সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টির অর্জনের এই স্বর্ণালী সময় হাতে পেয়েও কেনো এতো অকারণ অভিযোগ?
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক সময় অর্থনীতিতে এমন (বুম) স্ফিতি তৈরী হয়। যারা সে সময় একটু বুদ্ধি করে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে, যারা একটু রিস্ক নেয়ার সাহস দেখাতে পারে, তারা হঠাৎ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো বিরাট বিত্তশালী ধনী হয়ে যায়। আবার যখন অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসে, বাজারে মন্দা সৃষ্টি হয় তখন অনেকে আফসোস করতে থাকে যে আহ! ঐ সময়ে আমি একটু বুঝতে পারতাম, যদি একটু রিস্ক নিতাম, যদি সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারতাম, তাহলে আমিও তাদের মতো মিলিয়নার, বিলিয়নার হয়ে যেতাম। তখন মানুষ পরিতাপের সাথে ভাবে ও আশা করে, সুদিন ফিরে পেলে তারাও পূর্বসূরীগণের ন্যায় স্বচ্ছল হতে পারত।
হাসানাত ও আজর অর্জনের পরিমাণ বৃদ্ধির সম্পর্ক পরিস্থিতির সাথে। পরিস্থিতি যতো জটিল কঠিন হবে আজর ততো বেশি হবে। অতএব কেন এই সময় ও পরিস্থিতির ব্যাপারে অকারণ অভিযোগ? এটা তো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সব চেয়ে উত্তম সময়।
আমরা যেখানে এমন একটি সময়ের কথা বলছি, যখন বিজয় একান্ত নিকটবর্তী। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর করে যাওয়া ভবিষ্যতবাণী বাস্তবে প্রত্যক্ষ করছি- যাঁরা ইমাম মাহদীকে বিজয়ী করবেন, যাঁরা ঈসা আ. কে বিজয়ী করবেন। আমরা যদি মনে করি যে আমরা বহুল প্রতিক্ষিত, বহুল আকাঙ্খিত সেই সিদ্ধান্তকর সময় অতিক্রম করছি, আর তারপরও যদি আমরা বাস্তব ময়দানে কাজে অংশগ্রহণ না করি, যদি আমরা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করি, তাহলে আমাদের পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। অতএব জান্নাত ক্রয়ের এই স্বর্ণালী মুহূর্তে কিছুতেই আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা উচিত নয় যখন অন্যরা জান্নাতের অনেক উঁচু মাকামগুলোতে নিজেদের জন্য বুকিং দিয়ে ফেলছে। আমাদের উচিত নয় শুধু অভিযোগ করে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা।
হযরত সাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
ان الله وقد زوى لى الأرض فرأيت مشارقها ومغاربها وان أمتى سيبلغ ملكها مازوى لى منها.
অর্থ: “আল্লাহ আমার সামনে সমগ্র পৃথিবী তুলে ধরলেন, আমি এর পূর্ব হতে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত অবলোকন করেছি। (তোমরা শুনে রাখো) নিশ্চিতভাবে আমার উম্মতের কর্তৃত্ব ততো দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, যতো দূর পর্যন্ত আমার সামনে তুলে ধরা হয়েছে।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮৮৯। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২২২৯৪)
অতএব আমাদের বর্তমান অবস্থা যতো দূর্বলই হোক না কেন, সেদিন ইনশাআল্লাহ বেশি দূরে নয়, যেদিন এই ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিটি নগর, মহানগর, দেশ মহাদেশের উপর এর প্রভাব বিস্তার করবে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর পতাকা প্রতিটি নগর মহা-নগরীতে স্বমহিমায় পতপত করে উড়বে। পৃথিবীর এমন প্রতি ইঞ্চি জায়গার উপর আল্লাহর এই দ্বীন বিজয় লাভ করবে, যেখানে দিন-রাতের আলো-আঁধার পৌঁছে।
এমন স্থান কি পৃথিবীর কোথাও আছে, যেখানে দিনের আলো পৌঁছায় না?
সুতরাং যারা এই দ্বীনের আলো থেকে নিজেদের লুকাতে চাও, তাহলে তোমাদেরকে এই পৃথিবীর বুক ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন এই দুনিয়াতে তোমাদের জন্য এক ইঞ্চি জায়গাও থাকবে না, যেখানে গিয়ে তোমরা আত্মগোপন করবে।
ইনশাআল্লাহ চলবে... পরবর্তী পর্ব: বিজয় অতি নিকটে