ধর্মীয় অন্ধতা এবং আমাদের বানরায়ন -১(নবীজির মেরাজ)
ধর্মীয় অন্ধতা এবং আমাদের বানরায়ন-২(সুচের ফুটোয় উট)
১.
দশ হাজার বছর আগেই মানুষ বুঝেছিল পার্থিব জীবনে সূর্যের ভূমিকা। সূর্য মানুষ্কে শুধুই আল দিত না, সাথে সাথে নিরাপত্তার বোধ, উষ্ণতা ইত্যাদিও দিত। সেকারনেই প্রাচীন সভ্যতাগুলতে সূর্যকে আলাদা মর্যাদায় দেখা হত। তারা বুঝে ছিল সূর্য ছাড়া শস্য ফলবে না, পার্থিব জীবন টিকে থাকতে পারবে না। এই সত্য গুলোই মানুষকে ধাবিত করেছে সূর্যকে সবচেয়ে সম্মানিত একটি নিমিত্তে পরিণত করতে।
মানুষ আকাশের নক্ষত্র সম্পর্কেও ভালোই জানত। আকাশ পর্যবেক্ষনের ফলেই তারা শিখেছিল নক্ষত্রমন্ডলীর গতি, বছরের বিভিন্ন সময়ে নক্ষত্রের অবস্থান ইত্যাদি। যার ফলে পূর্নিমা বা অমাবশ্যার মত ঘটনাগুলোর মাঝে সময়ের পর্যায় তারা নিঁখুত ভাবে নির্নয়ে সমর্থ হয়।
এই প্রবনতাই তাদেরকে বছরের বিভিন্ন সময়ে আকাশের অবস্থা লিপিবদ্ধ করে রাখতে উতসাহী করে। এই তালিকাটি জন্ম দেয় কন্সটেলেশনের।
নীচের ছবিটি হচ্ছে ক্রস অফ জোডিয়াক, মানুষের ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন কনসেপচুয়াল ছবি।
এই যোডিয়াক আমাদের অনেকগুলো তথ্য দেয় ...
এখানে দেখা যায় সূর্য কিভাবে একটি বছরে বারোটি প্রধান রাশির মধ্য দিয়ে পরিভ্রমন করে। এটা আরও প্রকাশ করে ১২ টি মাস, ৪ টি মৌসুম, জলবিষুব,উত্তর অয়নান্ত ইত্যাদি। রাশিচক্রের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ন কথা হচ্ছে এই রাশিগুলোকে বিভিন্ন মানবীয় বা প্রাকৃতিক উপাদানের সাথে প্রাচীন যুগের মানুষরাই সম্পৃক্ত করে গেছে। এবং সেই নাম গুলো আমরা এখনও ব্যভার করি। এবং প্রাচীন সভ্যতা সমূহ শুধুমাত্র নক্ষত্র সমূহ পর্যবেক্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় নি, তারা বিভিন্ন নক্ষত্রমন্ডলীকে বিভিন্ন পার্থিব উপাদানের নামে নামকরন করেছে এবং তাদের আকাশের গতিবিধিকে সম্পৃক্ত করেছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে।
এবং সূর্যের জীবনদাত্রী গুনাবলীর কারনে সূর্যকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে ঈশ্বরের সাথে। মানবজাতির ত্রাতা হিসেবেই সূর্যকে দেখা হত। এবং ১ ২ টি রাশিকে দেখা হত ঈশ্বরের সহযাত্রী হিসেবে। যারা সূর্যের সাথে ভ্রমন করে।(বছরের বিভিন্ন সময়ে সূর্য আকাশের উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিন পূর্বের বিভিন্ন যায়গায় উদিত হয়। এই উদয়ের সময় মোটামুটি ৩০ দিন পরপর সূর্য একটি নতুন নক্ষত্রমন্ডলীর কাছে উদিত হয়। প্রাচীন পৃথিবীতে মাসের ধারনা এভাবেই এসেছে )। এই সকল রাশি সমূহকে নিয়েও নানা পৌরাণিক গল্প প্রাচীন সভ্যতা গুলো তৈরী করেছিল। মজার ব্যাপার ছিল গল্প গুলো পুরোপুরি গাঁজাখুরি ছিল না।প্রায়ই আকাশের রাশি সমূহের বিভিন্ন গতিকে মেটাফোরিক্যালি এই পৌরাণিক কাহিনীতে প্রকাশ করা হত।
যেমন আ্যাকুআরাস, পানির ধারক, যিনি বসন্তকালে বৃষ্টি নিয়ে আসতেন।
২.
নীচের ছবিটি হোরাসের। যিনি মিশরীয় দেবতা। তার পূজা হত খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ সালে। তিনি ছিলেন সূর্য দেবতা।
তার জীবন কাহিনী যেভাবে বর্ননা করা আছে প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় একেবারেই টিপিক্যাল মিথলজি। কিন্তু সাবধানে পরীক্ষা করলে বোঝা যায় বোঝা যায় পৌরাণিক গল্প গুলো আকাশে সূর্যের অবস্থান এবং গতি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যের মেটাফোর।
মিশরীয় পূরাণ যেগুলো হায়ারোগ্লিফিক্সে পিরামিডের গায়ে লেখা ছিল সেখান থেকে হোরাস সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা যায়।
যেমন হোরাসের একজন চিরশত্রু দেবতা ছিলেন। যার নাম হচ্ছে সেট। সেট ছিল অন্ধকারের দেবতা। প্রতিদিন সকালবেলা হোরাস সেটের সাথে লড়াইয়ে জিতে যেত, যার ফলে সূর্য উঠতো, অপরদিকে সন্ধ্যায় সেট জিতে যেত হোরাসের বিপক্ষে। যার কারনে রাত্রি নামত।
এখানে গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার হচ্ছে এই আলো বনাম অন্ধকার, অথবা ভালো বনাম খারাপ এটি সেই প্রাচীন কাল থেকেই নানাভবে নৈতিক বা সামাজিক অনুসঙ্গে প্রকাশিত হয়ে আসছে, এবং এখনও নয়। চৈনিক দার্শনিকরাও বিশেষ করে তাওবাদীরা এই ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করেছেন।
হোরাসের সম্পূর্ন জীবন কাহিনীর সারাংশ নিম্নরুপ:
হোরাস:
জন্মদিবস : ২৫ শে ডিসেম্বর
মাতা আইসিস কুমারী ছিলো, অলৌকিক ভাবে কুমারী মাতার গর্ভে তার জন্ম
তার আগমন সংবাদ দিয়েছিল পূর্ব আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র
তার জন্মের পর তিনজন রাজা তাকে আশীর্বাদ করেন
১২ বছর বয়সেই তিনি শিক্ষাদান শুরু করেন মানুষের মাঝে
৩০ বছর বয়সে একজন জ্ঞানী আনুপ দ্বারা সিদ্ধি লাভ করেন এবং তার নিজস্ব মত প্রচার করা শুরু করেন
তার ১২ জন সহচর ছিলো
অনেক অলৌকিক ক্ষমতা তার ছিলো যেমন অসুস্থকে সুস্থ করা, পানির উপর হাটা
টাইফন দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হন, এবং ক্রুশকাঠে প্রাণ দেন, এবং মৃত্যুর তিন দিন পুনুরজ্জীবিত হন
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে বিভিন্ন সভ্যতার দেবতাসমূহের মাঝে একই মিথলজিক্যাল স্ট্রাকচার দেখা যায়,
যেমন
ফ্রাইজিয়ার এটিস
ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ জন্ম
কুমারী মাতা নানা হতে জন্ম
ক্রুসিফাইড হয়েছিল
মৃত্যুর তিন দিন পর পুনুরজ্জীবিত হয়েছিল
ভারতের কৃষ্ণা
কুমারী দভাকি হতে জন্ম
পূর্বাকাশের নক্ষত্র তার আগমন বার্তা জানিয়েছিল
অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল
সহচর ছিল
মৃত্যুর পর পুনুরজ্ঝীবন
গ্রীসের ডায়ানসিস
ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ জন্ম
কুমারী মাতা
অলৌকিক ক্ষমতা ছিল যেমন পানি কে দ্রাক্ষারসে রুপান্তর
তাকে কিং অফ কিংস বলা হত
মৃত্যুর পর পুনুরজ্জীবন
পারস্যের মিত্রা
ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ জন্ম
কুমারী মাতা
১২ জন ভক্ত
মৃত্যুর তিন দিন পর পুনুরজ্জীবিত
এবং ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে তার পূজা হত রবিবার, সানডে ওরশিপ বলা হত
এখানে ব্যাপার হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য সভ্যতার অসংখ্য দেবতা এই একই ধরনের বর্ননা পাওয়া যায়।
৩.
সুতরাং প্রশ্ন আসে কেনই বা কুমারী মাতা, কেনই বা ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ জন্মদিবস??কেনই বা মৃত্যুর পর পুনুরজ্জীবন এবং কেনই বা ১২ জন ভক্ত??
এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যে সবচেয়ে নতুন এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় সোলার মেসায়াহ কে নিয়ে আলোচনা করা যাক
জেসাস ক্রাইস্ট:
জন্মেছিলেন ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ বেথেলহেমে
কুমারী মাতা মেরীর গর্ভে
তার আগমন বার্তা ঘোষিত হয়েছিল পূর্বাকাশের নক্ষত্রের মাধ্যমে
তিনজন রাজা অথবা মেজাই তাকে আশীর্বাদ করেছিল
১২ বছর বয়সে তিনি শিক্ষা দেয়া শুরু করেন
৩০ বছর বয়সে জন দ্যা ব্যাপটিস্ট দ্বারা ব্যাপটাইজড হন
তার ১২ জন ভক্ত ছিলো
তিনি অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেন যেমন অসুস্থ কে নীরোগ করা,পানির উপরে হাটা ইত্যাদি
ভক্ত যুদাসের দ্বারা বিশ্বাস ঘাতকতার শিকার হন
ক্রুসিফাইড হন, এবং মৃত্যুর তিনদিন পর পুনুরুজ্জীবিত হন
প্রথমেই বার্থ সিকোয়েন্সটি সম্পূর্নভাবে এস্ট্রোলজিক্যাল।
পূর্বাকাশের তারা টি হচ্ছে সিরিয়াস, রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ সিরিয়াস ,কালপুরুষের বেল্টের মাঝে অবস্থানকারী তিনটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের সাথে একই রেখায় অবস্থান করে। এই তিনটি নক্ষত্রকে প্রাচীন কাল থেকেই থ্রী কিংস বলা হত।
সিরিয়াস এবং ত্রী কিংস যে সরলরেখায় অবস্থান করে, সে সরলরেখাটি ২৫ তারিখের সূর্যোদয়ের স্থানকে নির্দেশিত করে। অথবা তারা ঘোষনা করে "সূর্যের জন্মকে"(মেটাফোরিক্যালি)। আর ভার্জিন মেরী হচ্ছে ভার্গো কন্সটেলেশন। ল্যাটিনে ভার্গো মানে হচ্ছে কুমারী। ভার্গো কে আরও বলা হয় হাউস অফ ব্রেড। এবং ভার্গো রাশিটির ছবিটি লক্ষ করলে দেখা যাবে একজন কুমারী একটি গম পাতা ধরে রেখেছে। এবং হিব্রু বেথেলহেম মানে হচ্ছে হাউস অফ ব্রেড। সুতরাং বেথেলহেম আকাশের একটি রাশিকে নির্দেশ করে মর্তের কোনো জায়গা নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ন ঘটনা ঘটে ২৫ শে ডিসেম্বরে। আমরা জানি সূর্যের উত্তর আয়নায়ন থেকে দক্ষিন আয়নায়নে দিনের দৈর্য্য ক্রমাগত কমতে থাকে উত্তর গোলার্ধের প্রেক্ষাপটে(পারসিক,মিশরীয়,রোমান,গ্রীক,ভারত,প্যালেস্টাইন সবগুলো দেশই উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত)। সূর্য ক্রমাগত দক্ষিনে সরে যেতে থাকে এবং কৃশ হয়ে পরতে থাকে। সূর্যের এই ক্রমাগত ক্ষীনতর আকৃতি লাভ প্রাচীন মানুষদের কাছে সূর্যের মৃত্যুর প্রতীক ছিল। ডিসেম্বরের ২২ তারিখ সূর্য আকাশের সর্বনিম্ন বিন্দুতে পৌছয়, এবং সূর্য সবচেয়ে কৃশ আকৃতি ধারন করে। এখানে খুব মজার একটি বিষয় ঘটে। সূর্যের দক্ষিন মুখী গতি বন্ধ হয়ে যায়। ৩ দিন সূর্য একই অবস্ঠানে থাকে। এরপর ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ সূর্য উত্তর দিকে ১ ডিগ্রী সরে আসে। এবং সূর্যদয় হয় ক্রক্স নক্ষত্রমন্ডলীর কাছে, যে নক্ষত্রমন্ডলীর আকৃতি ক্রুশের মত। সেজন্যেই সূর্যের মৃত্যু হয় ক্রসে এবং তিন দিন পরে পুনুরজ্জীবিত হয়।
একারনেই জেসাস ক্রাইস্ট এবং অন্যান্য সৌর দেবতারা একই বর্ননা শেয়ার করে।
এবং জেসাসের সাথে ১২ জন ভক্ত হচ্ছে ১২ টি রাশি, যার মধ্যদিয়ে সূর্য সারা বছর পরিভ্রমন করে।
চলবে
(পরবর্তী পর্বে বাইবেলের পুরাতন নিয়ম এবং নতুন নিয়মের অন্যান্য মিথ আলোচিত হবে। সেসাথে পেগান আডাপ্টেশন , ইতিহাসের সাথে যৌক্তিকতা, এবং রাজনৈতিক ভাবে কিভাবে পৌরাণিক জেসাস কে চতুর্থ শতকে ঐতিহাসিক চরিত্র করবার চেষ্টা করা হয়েছে সেটাও আলোচিত হবে)