সবসময় একটা বটগাছ ছায়া দিত রোদের সময়,বৃষ্টির সময় বৃষ্টির ফোঁটার হাত থেকে বাঁচাত।রাতের বেলা আকাশের তারা গোণা হতো এই বটগাছের ছায়ায় বসে।
হঠাৎ বটগাছটা বাতাসে মিলিয়ে যায়,মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝিনি,এর মর্ম কি।আজ বুঝি।
ওহ হ্যা,বাবার কথা বলছিলাম আর কি।
"বাবা"এই চরিত্রটা একটু অদ্ভুত।কখনো হয়ত খুব কাছ থেকে আপনি তাকে পাবেন না।তবে,দূরে গেলেই হয়ত বুঝতে পারবেন বাবা নামক এই মানুশটি আপনার কত কাছে ছিলো।প্রত্যেক বাবার কাছেই তার মেয়ে রাজকন্যা এবং তার ছেলে রাজপুত্র।এই বাবা তার সন্তানের জন্য কতটা ছাড় দিয়ে থাকেন তা হয়ত একটা ছেলে বাবা হওয়ার আগে টের পায় না।
জানেন,আমাদের দেশের মায়েরা সন্তানদের সারাদিনই বকাবকি করে,আর সে সময়টাতে সন্তানের আশ্রয়স্থল থাকে বাবা।মায়ের বকাবাদ্য হয়ত বাবার কোল পর্যন্ত শোনা যায় না।তাই পরম শান্তিতে বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া যায়।তবে,বাবারাও হয়ত রাগে।সে সময়টাতে হয়ত মায়ের কোল পর্যন্ত গিয়েও সন্তানের নিস্তার হয় না।
একটা কথা শুনেছিলাম,একটা মেয়ে তখনই মা হয় যখন সে জানতে পারে সে মা হতে চলেছে।আর একটা ছেলে তখনি বাবা হয় যখন সে তার নিজ সন্তানকে কোলে নিয়ে দুচোখ ভরে দেখতে পারে।
আমার বাবাটাও না,ঠিক একই রকম ছিলো,বাবা ব্যাবসার কাজে চট্টগ্রাম থাকতো।সপ্তাহে/দুসপ্তাহে হয়ত দু তিনদিনের জন্য আসতো।সে সময়টা যেমন খুশির ছিলো তেমনি ভয়েরও ছিলো এখন না বুঝি বাবা রেগে যায়।বাবার কাছে কখনো আবদার করে হয়ত ঠকিনি।সাধ্যমতো দিয়েছিলেন।তবুও কেনো জানি,দুরুত্ব রয়েই গিয়ে ছিলো।দিনে মোবাইলে এক/দুইবার কল করে কথা বলে কতটুকুই বা কাছে আসা যায়?বাইরে ঘুরে বেড়ানো স্বভাব ছিলো বলেই হয়ত বাবা যে কয়দিন বাসায় থাকতো সে কয়দিনও বাবার কাছে আসতে পারি নি।খুব একটা অবাক ব্যাপার কি জানেন,আমি যখন ক্লাশ ফোরে সোসাইটি বৃত্তি পেয়েছিলাম তখন মা খুশি হয়ে বাবাকে বলে ছিলো।বাবা নির্বিকার ভাবে মাকে জিগ্যেস করেছিলো হৃদয়(আমার ডাকনাম)এবার থ্রি তে বৃত্তি পাইছে না?খুব হেসেছিলাম,আর বাবাকে রাগিয়েছিলাম,এই কথা বলে যে তুমি জানোই না আমি কোন ক্লাশে পড়ি,হুহ।বাবা হাসতো,খুব অদ্ভুত একটা হাসি।হয়ত বুঝি নি,সেই হাসিটাতে ছিলো শত ব্যস্ততা আমাকে মানুষ করার জন্য শত প্রচেষ্টা।আমার বাবাটা হয়ত খুব স্বার্থপর ছিলো,তাই যখনই কোন ভালো কাজ করতাম তখনই বলে উঠতো:-
আমার ছেলে।
আর খারাপ কাজ করলেই হয়ে যেতাম মায়ের ছেলে।এটাই হয়ত প্রত্যেক বাবার রীতি।
সেই বাবাটা আজ নেই।হারিয়ে গেছে সেই বটগাছটার মত।আজ বুঝি,এই বাবাটা আমার কত কাছে ছিলো।আমার আজোও মনে পড়ে বাবার সাথে আমার শেষ কথাগুলো,হয়ত এমনই ছিলো,মোবাইলে কল করে বলেছিলাম:-
আব্বু,আসসালামু আলাইকুম।কেমন আছো?
আব্বু:ভালো,তুমি?
আমি:ভালো,আব্বু।আম্মু মোবাইলে টাকা শেষ,টাকা ফ্লেক্সি করে দাও।
আব্বু:এখন তো দোকান সব বন্ধ।আজান দিয়ে দিছে।দোকান খুললে দিবো.(যোহরের আজান)
আমি:আচ্ছা,ভাত খেয়ে ফোন দিও।
আব্বু:আচ্ছা,ঠিকাছে।রাখি।
হুম,আমি ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ার পর কল এসেছিলো ঠিকই,আব্বুর নাম্বার থেকেই।তবে,কল করে ছিলো আব্বুর ব্যবসার ম্যানেজার।জানিয়েছিলো,আব্বু ভাত খেতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।আমরা ভাবলাম,হয়ত ডায়াবেটিস বেড়ে/কমে গিয়েছে।(আব্বুর ডায়াবেটিস অতিরিক্ত ছিলো,নিয়মিত ইনসুলিন নিত)।কিন্তু ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হয়ে গেলো,যখন কল করে বললো আব্বু এখন আইসিউতে।আমরা বুঝলাম,অবস্থা শোচনীয়।নাহলে আইসিউতে কেনো।সাথে সাথে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।৪/৪:৩০এর ট্রেনে উঠে পড়লাম।আমি,আম্মু আর কাকা।প্রায় ১০ টা বেজেছিলো চট্টগ্রামে গিয়ে হাসপাতাল পৌছাতে।আমরা যাওয়ার পরপরই বাবাকে ঢাকায় পিজি হাসপাতালে পাঠানোর জন্য এ্যাম্বুলেন্সে বাবাকে উঠানো হয়।উঠানোর পর আমরা বাবার রুমে গিয়ে বসেছিলাম।কিন্তু রাত প্রায় ২ টার দিকে আমাদের সামনে গাড়ি এসে দাড়ালো।আব্বুর ব্যাবসায়িক কলিগ সহ সবাই ছিলো সেখানে।আমাদের উঠতে বলা হলো।রোবটের মত উঠে পড়েছিলাম।গাড়িটি লাকসামের(আমাদের বাসস্থান) উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।পথেই জেনেছিলাম,বাবা আর নেই।আমি কান্না করিনি।কেনো জানি ভূলে গিয়েছিলাম,কান্না করতে।
পরিশিষ্ট:আমরা যখন এলাকায় আসি তখন ভোর প্রায় ৫ টা।আমি এসেই শুনছিলাম মাইকে ভেসে আসছে
"একটি শোক সংবাদ,পশ্চিমগাঁও,বাগিচাপাড়া নিবাসী চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী,জনাব মোঃ আমিনউল্যাহ তালুকদার আজ রাত আনুমানিক ২ টার সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ইন্তেকাল করিয়াছেন।ইন্নালিল্লাহির.........রাজীউন।মরহুমের জানাযার নামাজের সময় জানিয়ে দেয়া হবে"
সময়টা ২০১২সালের ২নভেম্বর দিবাগত রাত ১টা ৩৩ মিনিট।তখন আমি কান্না করিনি।হয়ত বুঝিনি ছোট ছিলাম বলে কি হারিয়েছি।তখন আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।আজও কান্না করি না,শুধু মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে জ্বলজ্বল করা তারাগুলোর মাঝে বাবাকে খুঁজি।হয়ত একদিন খুঁজে পাবো বাবাকে ওই দূর আকাশে,যে আমায় দেখে হাসছে আর দোয়া করছে।
ভালো থাকুক,সকল বাবা রা।এপারের অথবা ওপারের।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৭ রাত ৮:১২