স্বেচ্ছায় কান ধরে উঠবস করেছেন বলে নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের বক্তব্য শুনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত। পত্র- পত্রিকায় এমনটাই এসেছে। নির্যাতিত শিক্ষক জানান, সেদিন সেলিম ওসমান তার দুই গালে দুটি করে চারটি চড় মারেন। এরপর বলেন, 'শালা কান ধর।' ইসলাম ধর্ম নিয়ে কোনো কটূক্তি করেননি জানিয়ে শিক্ষক বলেন, সেদিনের পুরো ঘটনাই সাজানো। তবে সঠিক সত্যতা নিয়ে বেশ সন্দেহ আছে, পক্ষ ও বিপক্ষ একটি গোষ্ঠীর জন্ম নিয়েছে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সামাজিক যোগাযোগ ফেসবুকে এ নিয়ে তুমুল তর্ক- বিতর্ক। অনেক ব্যবহারকারী প্রোফাইল পিকচার কান ধরা ছবি আপলোড দিয়েছেন। শিক্ষকের প্রতি সমবেদনা দিয়ে। অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে কান ধরেছেন।
শিক্ষকের প্রতি অবহেলা আমাদের স্বয়ং শাসক গোষ্ঠীর। বেতন কাঠামো, মর্যাদা,পদোন্নতী,বেতন স্কেল,পেনশন সহ নানান ত্রুটি আছে। পিপার স্প্রে ও লাঠির আঘাতের ঘটনা তো খোদ রাজধানীতে হয়ে গেল বছর দু’এক আগে শহীদ বেদীমূলেই। ছাত্রলীগ কর্তৃক কলার চেঁপে ধরার ইতিহাস,বাথরুমে আটকিয়ে রাখা,লিফট থেকে ধাক্কা মারা,শিক্ষিকার শাড়ি টেনে ধরা, গায়ে হাত তোলার বহু ঘটনা পত্র পত্রিকায় হরহামেশাই আসে।
খানপুর শহরে ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের দেয়া সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন মিডিয়ার সামনে মনের দুঃখ ও লজ্জার কথা বলেন, যা আমরা স্যাটেলাইট মিডিয়াতে দেখেছি। ঘটনার দিন শিক্ষক স্বেচ্ছায় কান ধরে উঠবোস করেছেন বলে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান দাবি করেছেন। কিন্তু এ নিয়েও মতভেদ আছে। মিডিয়াতে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে শিক্ষক বলেন, 'প্রশ্নই ওঠে না। পুরো ব্যাপারটিই ছিল সাজানো। মসজিদের মাইকে উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছিল। সভার কথা শুনে তিনি স্কুলে যান। কিন্তু গিয়ে দেখেন পরিস্থিতি ভিন্ন।' তিনি বলেন, 'সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্থানীয় কয়েকজন আমাকে পেটায়। বিকালে সেলিম ওসমান ঘটনাস্থলে আসেন। আমার শরীর তখন একেবারেই দুর্বল। যে ঘরে আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল, সংসদ সদস্য সেখানে ঢুকে কোনো কথা না বলে দুটি করে চারটি চড় মারেন। লজ্জায় তখন আমার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছিল। এরপর ঘর থেকে বের করে সংসদ সদস্য লোকজনের সামনে এনে আমাকে বলেন, শালা কান ধর। ১০ বার উঠবোস কর।' জীবন বাঁচাতে তা করতে বাধ্য হন। আমরা দেখেছি যে, শিক্ষকটি উঠবস করতে গিয়ে মাটিয়ে পড়ে যান, দেহের ভারসম্য রাখতে পারেন নি।
পত্র-পত্রিকার মারফত জানা যায়, কেন এ রকম ঘটনা ঘটল-জানতে চাইলে শিক্ষক বলেন, 'আমি স্কুলটি দাঁড় করিয়েছি। কিছু লোকজন চাচ্ছিলেন আমি যেন স্কুলে না থাকতে পারি। তারাই ষড়যন্ত্র করেন।' ইসলাম ধর্ম নিয়ে কোনো কটূক্তি করেছিলেন কিনা, জানতে চাইলে শিক্ষক সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে বলেন, 'আমি কোনো কটূক্তি করিনি। পুরোটাই সাজানো। স্কুল থেকে বের করতেই এসব ষড়যন্ত্র হয়েছে।'
শিক্ষককে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান 'তারছেড়া' বলেছেন। জানিয়েছেন, ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির ব্যাপারে সংসদ সদস্যের কাছে প্রমাণ আছে। শিক্ষকের পরিবার লিখিত দিয়েছে। এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত বলেন, 'আমার স্ত্রী হাসপাতালে আছেন। তাকে ডাক দেন। এগুলো ভিত্তিহীন কথা।'
সংসদ সদস্য শিক্ষকের গায়ে হাত তোলেন, তাকে যেন বরখাস্ত করা হয়। সরকারের তদন্ত কমিটি শিক্ষককে স্বপদে বহাল করেছে। শিক্ষক এ জন্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ সবাইকে শত কোটি প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানান। শিক্ষার্থীকে মারধর ও 'ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির' অভিযোগে গত শুক্রবার শ্যামল কান্তিকে স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে মারধর ও কান ধরে উঠবোস করানো হয়। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান, 'ধর্মীয় অবমাননার' অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সত্যতা পায়নি সরকারি তদন্ত কমিটি। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি অন্যায়ভাবে শ্যামল কান্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল। তাই ওই কমিটি বাতিল করা হয়েছে।
সাংসদের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান, এ ঘটনায় সারাদেশের লোক 'সরি স্যার' বলছে। সাধারণ জনগণ ও রাজনৈতিক মহল থেকে সাংসদের ক্ষমা চাওয়ার দাবি উঠেছে। আপনি ক্ষমা চাইবেন কিনা? এতে সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করে সাংসদ বলেন, 'আমি কার কাছে ক্ষমা চাইব? আল্লাহর কটাক্ষকারীকে সাজা দিয়েছি। আমি যদি মরেও যাই তাও ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।' ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, সেদিন ঘটনা শুরু হয়েছিল সকাল ১০টার দিকে। আমি সেখানে গিয়েছি বিকাল ৪টায়। গিয়ে দেখি চার থেকে পাঁচ হাজার লোক সেখানে জড়ো হয়েছে। গিয়ে আমি শুনেছি, ওই শিক্ষক একজন ছাত্রকে মেরেছিল। ছাত্র পরে অসুস্থ হয়ে যায়। শিক্ষক বাজার থেকে ওষুধ এনে ছাত্রকে খাওয়ায়। ওই ছাত্র আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর মধ্যেই ওই শিক্ষক ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছে বলে এলাকার লোকজন তাকে গণপিটুনি দিয়েছিল। পুলিশ শিক্ষককে একটি ঘরে নিরাপত্তা দিয়ে রাখে। আমি সেখানে যাওয়া মাত্র এলাকার লোক আমাকে বলেছে, 'ওই শিক্ষককে আমাদের হাতে ছেড়ে দেন।' কিন্তু আমি কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চাইনি। আমি তখন শিক্ষকের কাছে যাই। তিনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির কথা স্বীকার করেন। শিক্ষকের কাছে জানতে চাই, তোমার কী শাস্তি হবে? তিনি যেকোনো শাস্তি মাথা পেতে নেবেন বলে জানান। সাংসদকে বলেন, আমার তিন মেয়ে আছে। তাদের বিয়ে হয়নি। সেলিম ওসমান বলেন এ সময় তার মনে হয়, তার নিজেরও তিন মেয়ে আছে। সেলিম ওসমান দাবি করেন, ওই শিক্ষক নিজেই কান ধরে উঠবোস করার প্রস্তাব দেন। এতে আমি রাজি হই। শিক্ষক স্বেচ্ছায় কান ধরে উঠবোস করেন। আমি যা করেছি একজন মানুষের জীবন রক্ষার জন্য।
সেলিম ওসমানের দাবি, ওই দিন তিনিই পুলিশকে বলে ঘটনাস্থল থেকে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। হাসপাতালে সব চিকিৎ?সার খরচ তিনিই বহন করছেন। শ্যামল কান্তি ভক্তের সঙ্গে তার ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে। সকালেও শিক্ষকের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। ওই শিক্ষক ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত। বলেছেন, উন্নত চিকিৎ?সার জন্য তিনি ভারতের ভেলোরে যেতে চান। তিনি তাকে সহায়তা করবেন।
শিক্ষকগণ জাতি গড়ার কারিগর হলেও তা আর নেই। মোঘল বাদশাহ্ আলমগীরের শিক্ষকগুরুর মর্যাদা আর কেউ দিতে পারবেনা। জাতি হিসাবে আমরা খুবই হতভাগ্য, পুলিশের ঠেঙ্গানী খেতে হয় আমাদের পিতৃতুল্য সম্মানিত শিক্ষকদের, গরম জলকামানও খেতে হয় আমাদের পিতাদের। কথিত দুর্বৃত্তের ছুরির আঘাতে জবাই হতে হয় । যেখানে শাসকগোষ্ঠীই জড়িত সেখানে সৎভাব কেমন করে থাকবে? নাস্তিক-আস্তিক ভিন্ন কথা। যে কেউ নাস্তিক্যবাদকে গ্রহণ করতে পারে, তবে ধর্মের প্রতি কটুক্তি বা দ্রোহীতা ক্ষমার অযোগ্য মহা অপরাধ। বিশ্বের কিছু দেশে ব্লাশফেমি আইন আছে, যা সবোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। ধর্ম না মানা মানা ব্যক্তির একান্ত নিস্ব ইখতেয়ার, দ্রোহীতা অন্যায়। তবে অভিযোগ আনার পূর্বে প্রমান ও স্বাক্ষ্য লাগবে।
শত শত শিক্ষার্থীর সামনে একজনকে কান ধরিয়ে উঠবস করা কী অন্যায় নয়? যখন ঐ শিক্ষক ঠিকমতো উঠবস করতে পারছিলেন না, তখন কিছু বখাটে কে শিস বাজাতে দেখা গেছে। শ্লোগান ও দিয়েছিলো- জয় বাংলা বলে! ধর্মদ্রোহীতা নিয়ে যেখানে সরকার আইন করছেনা সেখানে সাংসদ বিচার করে কী ভাবে? সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর পূর্নাঙ্গ বিচার যেখানে হয়নি সেখানে কেমন করে বিচার হয়? ব্লগ নিয়ে এতো মাতামাতি,ধর্মদ্রোহীদের আখড়া সহ ইসলাম নিয়ে মিথ্যে বানানো জঘণ্য ধরণের লেখা হয় সেখানে মনটরিং নেই, কোন গণমাধ্যমের বিধি বিধান নেই সেখানে সেই ধর্মের দোহায় দিয়ে শিক্ষক নির্যাতন! কতো জঘণ্য মানুষিকতা। পশুবৃত্তি মনে।
ওসমান পরিবার নিয়ে এতো ঘটনা,এতো কাহিণী, এতো খবর। সেই ওসমান পরিবার আজ অনেকের কাছে অতিব প্রাণপ্রিয় হয়ে গেছে। মানুষ যেখানে কথা বলতে ভয় পায় সেখানে ঐ সাংসদ কে নিয়ে গুণগান ও বিজয়ের শ্লোগান। গত জুমা;র দিনও সাংসদের পক্ষ হয়ে ঐ এলাকার অনেকেই শিক্ষকের ফাঁসি ও সেলিম ওসমানের সাফাই গেয়েছেন। নাস্তিকের অস্তিত্ব শাসনযন্ত্রেও আছে। শাহবাগের সেই শ্লোগানেও ধর্মবিদ্বেষীর গন্ধ ছিলো, আমার দেশ ও ইনকিলাব এ নিয়ে অনেক রিপোর্ট করলেও ফলশ্রুতি কিছু আসেনি।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৬ দুপুর ১:৪৬