মোমবাতি আলাপন ( ধারাবাহিক উপন্যাস)
==============
ফেরদৌস
মেজর সাধারণত সন্ধ্যার পরেই তার ঘরে উঠে আসে৷ মজার ব্যাপার হল, সারা সাততলা ভবনটাতে আইপিএস থাকলেও মেজরের রুমে তা বিচ্ছিন্ন৷ ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত আর রহস্যময়, বাড়ির সবার কাছেই৷ সাতফুট বাই আটফুট খাটটার উপরে অসম্ভব সুন্দর একটা লাল চাদর বিছানো, সবসময়ই তাই থাকে৷ অন্য কোন রঙের চাদর কখনো সেখানে দেখা যায়না, এমনকি কাজের ছেলেটাও দেখেনি, শুধু লাল রঙেরই একচ্ছত্র আধিপত্য৷ এর পেছনের কারণও মেজর ছাড়া অন্য কারো জানা নেই৷ মেজর তার দামী ব্রান্ডের সিগারেটটা ধরায় এবং নির্ভার হয়ে ধোঁয়া ছাড়ে মোমবাতির ঠিক বিপরীত দিকে, যাতে মোমবাতিটা নিভে না যায়৷ এই সিগারেট খাওয়ার সময় তার চোখগুলো পাকা ডালিমের মত লাল হয়ে যায় এবং পরিচিতজন ছাড়া সকলেই, যারা তাকে প্রথম সিগারেট খেতে দেখে-তারাও ভীষণ ভয় পেয়ে যায়৷ কেমন জানি একটা রাক্ষুসে রাক্ষুসে প্রতিমূর্তি মেজরের মুখমণ্ডলের উপড়ে ভর করে৷ মেজরের সিগারেট খাওয়ার পেছনের দর্শনটাও দারুণ৷ স্রেফ আত্মকথন হিসেবেই তার সিগারেট খাওয়া একটা উছিলা হিসেবে কাজ করে! গ্রামে ছোট্ট করে কোন এক নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে বড় ভাই আর বন্ধুদের প্ররোচনায় পড়েই প্রথম বিড়ি ফুঁকতে শেখে মেজর৷ সেও অবশ্য যুক্তিটা জানে, সিগারেট ধোঁয়া ছাড়ে এবং সে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে সিগারেটখোর নামক মানুষটার মানসিক চাপ অসংলগ্ন ছুটে বেড়ায়-যাতে টেনশনটা সাময়িকভাবে একটু কাবু হয়৷ কিন্তু এ অস্ত্র যে বেশ ভোঁতা মেজর তা জানে৷ টেনশন বরাবরই আগের অবস্থায় বহাল থাকে৷ মেজর সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় এই সিগারেট ছেড়ে দিতে পারতো কিন্তু দেয়নি ঐ লাল-রঙা চোখটা অধঃস্তনরা বেশ জমের মত ভয় করতো এবং মেজরের হুকুমগুলো কাঙ্ক্ষিত সময়ের আগেই তামিল হয়ে যেত তার সামান্য চোখ রাঙ্গানিতেই৷ তাছাড়া সেনাবাহিনীর এমন কঠিন আর নিষ্ঠুরতম শৃংখলাবদ্ধ জীবনে এরকম উটকো অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া তার জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না৷ মেজরের সেনাবাহিনীর জীবনে আমিনা নামের মায়ের বয়সের ফকিন্নিটার কথা আর মুখটাই অনেক বেশী নিঃসঙ্গ সময়ের স্মৃতিচারণের উপলক্ষ্য ছিল যে রোজ মঙ্গলবারে ভিক্ষা মাগতে আসতো প্রায় পোনে-পাঁচ কিলোমিটার হাটু-পরিমাণ ধূলো-ভরা কাচা রাস্তা মাড়িয়ে৷ মেজরের সাথে রাজ্যের গল্প করতো খুব ইনিয়ে বিনিয়ে, মুখে পান চিবোতে চিবোতে আর প্রচণ্ড রকমের নিপুণ অঙ্গভঙ্গি করে৷ তার মধ্যে যা ছিল তা সবই বাস্তবের আঙ্গিকে কিন্তু ছল বা প্রতারণার তেমন কিছুই ছিলনা৷ আশট্রেতে অর্ধেক সিগারেটটা শক্ত করে গুঁজে দেয় মেজর এবং মোমবাতির আলোর দিকে তীব্র ও গভীর দৃষ্টিতে তাকায়৷ আমিনাকে দেখতে পায়, যেন মাথায় দেখা আধপাকা চুলগুলো ধবধবে শাদা আর চোয়াল শুকিয়ে ভেতরের দিকে যাত্রা শুরু করেছে অদ্ভুতভাবে৷ আমিনার কাছ থেকে আবারো গল্প শোনার অভিপ্রায় হয় তার কিন্তু সে দেখতে পায়- আমিনার দাঁতগুলো সব মাড়ি থেকে উধাও এতদিনে, হাত-পাগুলো পাটকাঠির মত সরু হয়ে গেছে৷ এখন আমিনার চোখদুটিই যেন কোন অসমাপ্ত গল্প কিংবা বড় পরিধির উপন্যাস যেখানে পাঠকও সে নিজেই৷
মেজরের মনে পড়ে, সেই নিশুতি রাতে মায়ের কোলঘেষে শুয়ে শুয়ে 'পিঠার গাছ আর ডাইনি বুড়ির' গল্প শুনার আবছা আবছা দৃশ্যের ধারাবাহিকতা কিংবা দলবেঁধে মাছ ধরার জন্য 'বৈথ' নামার সেই চমৎকার আমুদের উৎসবের উত্তেজনা মাখানো শৈশবকথা! কিংবা ছুটন্ত মুরগি ধরে তার পালক ছিড়ে নিয়ে সে পালক দিয়ে অখণ্ড মনযোগের সাথে কান চুলকানোর মত অদ্ভুত ছেলেমানুষিগুলো৷ (চলবে)