অমূল্য স্বাধীনতা অর্জনের পর বাঙালি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের দেশে ফেরার দিনটির জন্য। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী কারা বরণ শেষে বাংলার মাটিতে পা রাখার সাথে সাথেই এক শ্রেণীর কুচক্রী রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বঙ্গবন্ধুর সরলতার সুযোগে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে বাঁকা পথে নিয়ে যাবার জোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু তার বিচক্ষনতার কাছে সবকিছু পরাজয় বরণ করে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে আহত, পঙ্গু ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভেবে এবং তাদের পরিবারগুলোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গঠন করেন ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাষ্ট।’
একজন প্রবীণ সাংবাদিক কামাল লোহানী লিখেছেন - "মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা ইত্যাকার দেশের কথা যদি ভাবি দেখব মুক্তিসেনারাই পরবর্তীকালে রেড আর্মি, পিপলস আর্মি, পিপলস লিবারেশন আর্মি নামে খ্যাত হয়েছে এবং এরা কেবল দেশ রক্ষাই নয়, উৎপাদন ক্ষেত্রে বিপুলভাবে তৎপর থেকেছে। দেশের মানুষের উন্নতির শরিক হয়ে গর্বোদ্ধত বুকে জনগণের বন্ধু হিসেবে রয়েছে। এরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারও অংশ। তারা নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে চলেছে নিজ নিজ দেশে। কিন্তু বাংলাদেশে একাত্তর-উত্তরকালে মুক্তিবাহিনীকে চরমভাবে কলুষিত করে বিভিন্ন বেসরকারি বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। আর পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা সেনাদের বাংলাদেশ বাহিনীতে ঢোকানো হয়েছিল বলেই পরবর্তীতে ক্যুতে ক্যুতে জর্জরিত হয়েছে দেশটা, আর আমরা হারিয়েছি প্রকৃত মুক্তিসেনাদের।"
স্বাধীনতাত্তোর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ বিরোধীতা যেমন শুরু থেকে দানা বাঁধছিল, তেমনি আওয়ামী লীগ নিজেও দলীয় কোন্দলে ডুবে গিয়েছিল। খন্দকার মোশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম চক্র সক্রিয় ছিল কোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে আবারো একটা সম্পর্কে জড়ানো যায় কিনা সেটা নিয়ে।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ভীষণ সমালোচিত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়। পরে ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দল হিসাবে “বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ- বাকশাল” গঠিত হয়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে ভীষণ উচ্ছাস দেখা গেলেও সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন মানুষ পছন্দ করেনি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এটা সাময়িক ব্যবস্থা। দেশের অবস্থার উন্নতি হলেই আবার সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাবেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ছাড়া বহুদলীয় ব্যবস্থায় ফেরা সহজ হতো না।
সপরিবারে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার ঠিক ৭৯ দিন পরে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ আর ঐ সময়কার অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান। বলা হয় শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত এই হত্যাকান্ড।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাক ক্ষমতা নেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ স্পিকার বা ভাইস প্রেসিডেন্ট না হয়েও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি বৈধ ক্ষমতার দাবিদার ছিলেন না। মোশতাকের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন জিয়াউর রহমান। মোশতাক ও জিয়া সামরিক ফরমানবলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসংবলিত সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করেন। এতে রাষ্ট্রীয় মূল স্তম্ভের মৃত্যু হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ মুছে ফেলা হয়। বাংলাদেশ বেতার কে করা হয় রেডিও বাংলাদেশ। স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করেন জিয়াউর রহমান। চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়। কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানকে করা হয় মন্ত্রী। পাকিস্তানের সহযোগীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা ধ্বংস করে দেন জিয়া। এমনকি বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃত খুনিদের পুনর্বাসন করেন। খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেন। জিয়া খন্দকার মোশতাকের সহায়তায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের পথ বন্ধ করেছিলেন। জেনারেল জিয়া রহস্যজনক কারণে কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ আনেন। এতে ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়। ধারণা করা হয়, ৭ই নভেম্বর কর্নেল তাহেরের জনপ্রিয়তা দেখে জিয়াউর রহমান শঙ্কিত ছিলেন। তাই ক্ষমতা নিষ্কণ্টক রাখার জন্যই তাহেরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ আনেন।
১৯৭৫ সালের ৭ ই নভেম্বর আদৌ সিপাহী জনতার বিপ্লব ছিলো না, ছিলো ক্ষমতা দখলের পাল্টা অভ্যুত্থান। জিয়ার খল চরিত্রে বিভ্রান্ত না হলে তাহেরই হতেন নায়ক, ফাঁসিতে না ঝুলে তিনিই হতেন রাস্ট্রপতি। সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা ও নির্মুল করা কিন্তু শুরুটা সে সময়েই। বিপ্লবের নামে চরম বাম ও চরম ডানের মিলন ছিলো সেটা, যার ফসল জিয়ার ক্ষমতা দখল।
জিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। মোশতাক, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমানের মতো এইচ এম এরশাদও অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী।
গোলাম আযম, যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিটি অন্যায়, বেআইনি, অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজ প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন; যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিয়ে তাঁদেরকে সমূলে ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছিলেন; যিনি আলবদর বাহিনী গড়ে তুলে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করার প্ররোচনা দিয়েছিলেন।’ ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে পাকিস্তানে যান। এরপর তিনি আর দেশে ফেরেননি।
তারপর পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও তিন মাসের বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসেন তিনি। পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী গোলাম আযম বাংলাদেশে এসে আর ফিরে যাননি। গোটা আশির দশক ছিলেন জামায়াতের অঘোষিত আমির। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে প্রকাশ্যে আমির ঘোষণা করে জামায়াত। তবে সে সময়ের বিএনপি সরকার শহীদজননী জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন দেশবরেণ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা মাথায় নিয়েই জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালে ক্যানসারে ভুগে মারা যান। ওই বছরই গোলাম আযমকে বিএনপি সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, যার পূর্বনাম ছিলো জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ বাংলাদেশের একটি কুখ্যাত রাজনৈতিক দল যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতার অভিযোগ আছে। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। এই দলটির ছাত্র শাখার নাম বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। দলটির বর্তমান প্রধান কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী। ২০১০ সালের ২৯শে জুন তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। বাংলাদেশবিরোধী জামায়াতিরাই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সেটা নানা প্রমাণের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই। তাই জামায়াত আর রাজাকার সমার্থক শব্দ।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ শহীদদের পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের হয়। মিছিলে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা হয়। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে দেয়া বেতার ও টিভি ভাষণে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গটি আবার সামনে নিয়ে আসেন। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমাসংক্রান্ত প্রেসনোটে বলা হয়, ‘ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজে অগ্নিসংযোগের দায়ে দন্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।’
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত গ্রেপ্তার ছিল মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ জন। তাদের দ্রুত বিচারের জন্য সরকার সারা দেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। অক্টোবর পর্যন্ত দুই হাজার ৮৮৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর প্রায় ২৫ হাজার ৭১৯ জন আসামি ছাড়া পায়। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আটক থাকা প্রায় ১১ হাজার আসামির বিচার চলছিল। এ ছাড়া ৭৫২ জনের সাজাও হয়। এদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুদন্ড হয়েছিল। বাকিদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড হয়েছিল। পরে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় চারটি সুনির্দিষ্ট অপরাধে কারাগারে আটক ১১ হাজার আসামি, এমনকি সাজাপ্রাপ্তরাও জেল থেকে ছাড়া পায়।
প্রত্যেক সরকারের সময়েই মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে জরীপ ও তালিকা তৈরী করা হয়েছে। সব তালিকা মিলিয়ে তা আড়াই লাখের কাছাকাছি। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে সন্তানদের তথ্যও যুক্ত থাকবে। সবকিছু যাচাই বাছাই শেষে আশাকরা যায় প্রায় নির্ভূল একটি তালিকা প্রণয়ন অচিরেই হবে। স্বাধীনতা অর্জনের ৪০ বছরের মধ্যে দীর্ঘ ১৭ বছরই বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে সামরিক শাসক দ্বারা। তাইতো গণতান্ত্রিক ভিত্তি এখনও সুদৃঢ় নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্যই ছিল প্রকৃত গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বাঙালি রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিক মুক্তি আজও পায়নি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি গোটা সমাজ ব্যবস্থায় এক ক্যান্সার হয়ে দেখা দিয়েছে। সৎ মানুষরা রাজনীতি থেকে ক্রমশ:দূরে সরে যাচ্ছে। রাজনীতি কোটিপতি ব্যবসায়িদের হাতে চলে যাচ্ছে ক্রমশ:।
১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের এখন চলছে মরণদশা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের লাভজনক ৩২টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো রকমে টিকে আছে মাত্র ৩টি। বন্ধ হয়ে গেছে তাবানী বেভারেজের মতো জনপ্রিয় এবং লাভজনক সম্ভাবনাময় শিল্প প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতা, সিদ্ধান্তহীনতা, অযৌক্তিক বিভিন্ন বিষয় ট্রাস্টের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই ট্রাস্টের এই বেহাল অবস্থা। এর মধ্যে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ও সম্পত্তি বেহাত হতে চলেছে।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টের অধীনে এক সময় লাভজনক অনেক প্রতিষ্ঠান ছিলো যেগুলি এখন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের চর্যাবৃত্তির কারণে। এই ট্রাষ্টের ১৮০০ কোটি টাকা ব্যায়ে চার দলীয় জোট সরকারের সময় কালুরঘাট কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা দুবেলা ভাত পাচ্ছেন না, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারছেন না। অনেকের মতে, এই টাকা দিয়ে জীবিকার জন্য যারা ভিক্ষে করতে বাধ্য হচ্ছে তাদের পূণর্বাসন করা সম্ভব ছিল। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায়ত্ব লাঘব করতে পারেনি।
বিশ্ব ইতিহাসে একমাত্র বাংলাদেশের ২ লক্ষ ৫০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সবাই অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন। সেইসব যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাত চিহ্নিত করতেই ৩৬ বছর সময় লেগেছে। কার্ড পেলেও টাকা পাননি, পাননি একটি হুইল চেয়ার- এ রকম অভিযোগও আছে অনেক। দেশ স্বাধীন করতে যাঁরা একদিন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তাদের হাতে আজও ভিক্ষার পাত্র।
বর্তমানে কল্যাণট্রাস্টের যে তিনটি প্রতিষ্ঠান চালু আছে, সেগুলো হলো ঢাকার পূর্ণিমা ফিলিং অ্যান্ড সার্ভিস স্টেশন, চট্টগ্রামের ইস্টার্ন কেমিক্যাল লিমিটেড ও ঢাকার মিমি চকলেট লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানগুলোসহ কয়েকটি মার্কেটের ভাড়া থেকে কল্যাণ ট্রাস্টের মাসিক গড় আয় ২০ লাখ টাকা। অথচ কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতি মাসে খরচ এক কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, সরকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ পরিবার ও বেগম তারামন বিবি বীর প্রতীকসহ মোট সাত হাজার ৮৩৮ জনকে যে আর্থিক সুবিধাদি দেয়, তা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।
বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ১৩০ কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করায় বর্তমানে এই ট্রাস্টের আর কোনো ঋণ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন নিশ্চিত করতে ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাসে ২ হাজার টাকা করে দেড় লাখ অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন। ২০০০-২০০১ অর্থবছরে প্রথম এ ব্যবস্থা চালু করা হয়। মাসে ১৫০ টাকা করে ৪১ হাজার ৬৬৬ জনকে এ সুবিধা দেয়া হয়। খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ন্যূনতম ভাতা করা হয়েছে ২ হাজার টাকা। বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীকের জন্য মাসে যথাক্রমে ২৫০, ২০০, ১৫০ ও ১০০ টাকা ভাতা চালু আছে। এটি বাড়িয়ে ৬ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত করা হবে।
স্বাধীনতার দলিলপত্র ১৫ খণ্ড কিনতে ১৫ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। অনেকের পক্ষেই এটা কেনা সম্ভব হয় না। তাই ওয়েবসাইটে পুরো ১৫ খণ্ড দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাঠক ইচ্ছেমতো আগ্রহের অংশটুকু বিনা খরচে পড়তে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের সনদ নকল প্রতিরোধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আধুনিক পদ্ধতিতে সনদ তৈরি করা হচ্ছে, যাতে কেউ নকল বা বিকৃত করতে না পারে।
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের ৩০ শতাংশ কোটা এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কোটা সংক্ষরণ নিশ্চিত করা হয়েছে। যে মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ এ শহীদ হয়েছেন ২০১১ সালে তাদের মৃত্যুর ৪০ বছর হয়েছে। এই কারনেই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান না পাওয়া গেলে নাতি-নাতনি কোটার প্রবর্তন করা হয়েছে। ড. আকবর আলি খানের রিপোর্টে, ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখানো হয়েছে, এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ ভাগ কোটার খুব সামান্যই পূরণ হয়েছে।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চেষ্টা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারগুলোকে সহযোগিতা ও সম্মান দিতে। চাকরির ক্ষেত্রে প্রবর্তন করা হয় ৩০ শতাংশ কোটার সুবিধা। কিন্তু তারপর আবারও এ কোটা নিয়ে হয়েছে নানা ধরনের কাটাছেঁড়া। ২০০৮ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এলে আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো এবার মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে 'মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান' কোটার জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৩০ শতাংশ কোটার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আসবে। এর মাধ্যমে হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নূ্ন্যতম সম্মান জানানো হবে। কিন্তু অবস্থা উল্টো!
কোটার নামে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরা যদি কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে তাতে জাতির কোনো ক্ষতি হবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জাতি যা পেয়েছে তা কোন কিছুর বিনিময়ে শোধ করতে পারবে না। আর মেধাবীরা যে কি রকম মেধাবী তা বিভিন্ন অফিস-আদালতে পা দিলেই বোঝা যায়। আসলে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে চারদলীয় জোট আমলে। তখন মূলতঃ জামায়াতই ক্ষমতায় ছিল বিএনপি'র ছদ্মাবরণে। সারাদেশে তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শাখাগুলোকে বিএনপি বা জামাতীকরণ করতে গিয়ে অনেকস্থানে রাজাকারকেও সংসদের কমান্ডার বানানো হয় কিংবা বিভিন্ন লোভ-লালসা দেখিয়ে হতদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাকে দলে ভেড়ানো হয়। ফলশ্রুতিতে এখন দেশে আর কোনো রাজাকার নেই, সবাই মুক্তিযোদ্ধা। সবাই এখন সম্মানীভাতা পাচ্ছেন। এই ভাতাগুলো দেয়া হয় সমাজকল্যাণ দফতর থেকে। ওই সময় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন জামায়াতের মুজাহিদ। তিনিই মুক্তিযোদ্ধাদের অবিভাবক ছিলেন এবং ভাতার ব্যাপারটা দেখতেন।
কোটা থাকা উচিত বলেই দুনিয়ার প্রায় সব সভ্য দেশেই কোটা আছে। আমাদের মতন জোচ্চুরি গণহারে হয় বলে মনে হয় না। আসলে সিষ্টেম যত ভালই হোক না কেন সফলতার পরিমান চুড়ান্তভাবে নির্ভর করে কারা সেই সিষ্টেম চালাচ্ছে তাদের উপর। নৈতিকতার মান দূর্বল হলে গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র কিছুতেই ভাল ফল আসবে না। একজন মুক্তিযোদ্ধা ৯ মাস যুদ্ধ করে যুদ্ধপূর্ব চাকরি হারিয়েছেন, ব্যবসা ধ্বসে পড়েছে- এ রকম নজির অনেক। তাদের পুত্র-কন্যাদের অধিকার আছে সরকার থেকে চাকরির সুযোগ পাওয়ার।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা হারালে মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমানে প্রাপ্ত সমস্ত সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে এটা নিশ্চিত। চাকরি তো দূরের কথা, মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখার সাথে সাথেই আবেদন বাতিল হবে। সেই সাথে আবার শোষনের যাতাকলে পিষ্ট হবে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট। কোটা ব্যবস্থা নিয়ে সামুসহ সবখানেই পাকিস্তানি ঔরসদের আহাজারি দেখে এই পোস্ট দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
পরিশেষে একটা কথাই বলবো - মুক্তিযোদ্ধার বংশধরেরা কখনো হয়তো ভুল করে ছাগু, কিন্তু রাজাকারের বংশধরেরা সবসময়ই ছাগু।
তথ্যসূত্র সমূহ:
১। http://bn.wikipedia.org/wiki/
২। http://forum.projanmo.com/topic19040.html
৩। Click This Link
৪। Click This Link
৫। http://penakash.wordpress.com/2011/05/16/
৬। http://www.amrabondhu.com/masum/2038
৭। Click This Link
৮। http://prothom-aloblog.com/posts/16/90473
৯। Click This Link
১০। http://blog.bdnews24.com/Shahriaque/9689
১১। Click This Link
১২। http://amarblog.com/kohin/posts/117455
১৩। http://www.amarblog.com/dura/posts/119677
১৪। Click This Link