আরো দুবার রিং বাজলো। কি ব্যাপার এখনো রিসিভ করছে না যে! তৃতীয়বার চেষ্টার পর স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে তৌফিক। অধীর আগ্রহে মুঠোফোনটি কানে ঠেকানো। হঠাৎ কাছে কোথায় যেন বাজ পড়ার প্রচন্ড শব্দ হয়। চমকে ধ্যাৎ বলে লাইনটি কেটে দেয় সে।
শ্রাবণের দিন, বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। উদাস হাওয়া নাচানাচি করছে মন থেকে মনে। প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রিয়জনদের নিয়ে মনে মনে ব্যস্ত। এমন বৃষ্টি আর হয় না, প্রেমে পড়ার মতো বৃষ্টি।
এতোবার রিং হওয়ার পরও রিসিভ করছে না কেন! আমার নাম্বার দেখেই কি রিসিভ করছে না? ও কি আমাকে এখনো এড়াতে চাচ্ছে? আবার লাইন কেটেও তো দিচ্ছে না! ফোন রেখে বাইরে গেছে?
এ রকম আরো কিছু প্রশ্ন জমাট বাধে তৌফিকের বুকে। কেমন যেন বিষণ্ণ ও ক্লান্ত দেখায় ওকে। আনমনে আবারো কল করে তৌফিক। হয়তো রিং-টোনকে লক্ষ্য করেই জন ডানের কবিতা আওড়ায় সে, For god's sake hold your toung/and let me love!
২.
শেফালি, এক মাগ কফি দিয়ে যাস।
নিজের রুমে ঢুকতে ঢুকতে গৃহপরিচারিকাকে বললো বৃষ্টি। সেল ফোনটি বালিশের পাশে। ভেজা কাপড়েই বিছানায় বসতে বসতে ওটা হাতে তুলে নিল। এখনো বাজছে। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সে। নিচের ঠোঁটে দাত দিয়ে বার দুয়েক চিমটি কেটে রিসিভই করে বৃষ্টি।
হ্যালো!
তারবিহীন যন্ত্র থেকে তৌফিক ও বৃষ্টির মধ্যকার অবস্থানগত দূরত্ব ঘুচিয়ে ভেসে আসে বৃষ্টির সুরেলা কণ্ঠ। তৌফিক যেন হাপ ছেড়ে বাঁচে। ওহ, এভাবে দেরিতে হলেও যদি অন্য কিছু গ্রহণ করতো! তৌফিক এখনো কিছু বলেনি। তার খুব ইচ্ছা করে সেই আগের মতো দুষ্টুমি করে বলতে, হ্যাঁ, হেলেই তো আছি। এবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে না কি? বৃষ্টি হেসে বলতো, ন্যাকামি রাখো, তোমার লোমশ বুকে সুন্দরবনের বানরও ঝাঁপ দেবে না। তৌফিকের মোক্ষম জবাব, আচ্ছা, তাই নাকি! তা আমার বুকটা যে লোমশ সেটা কিভাবে বললে? তুমি তো কখনও...! বৃষ্টি হাল ছেড়ে দিত।
না, আজ আর ওভাবে বলা হলো না তৌফিকের। উল্টো গলাটা কেঁপে উঠলো সামান্য।
ব- বলো।
বলো মানে! ফোন আমি করেছি না কি?
বাহ। তেজ দেখি আগের মতোই আছে।
আর তুমি? তোমারও তো কথার ঢঙ পাল্টায়নি দেখছি। যদিও কণ্ঠস্বর কিছুটা অন্যরকম লাগছে।
তিন বছর পরও আমার কণ্ঠস্বর চিনতে পারছো এতেই আমি অবাক। তবে শুনেছি, সামিরের কাছ থেকে আমার নতুন নাম্বারটা নিয়েছিলে। এরপর কতো আশা করেছি তুমি ফোন করবে; কিন্তু করোনি। শেষমেশ আমিই করলাম... কি ব্যাপার কথা বলছো না যে?
না, ভাবছি।
কি ভাবছো?
কি বলবো তাই-ই ভাবছি।
এতোদিন কিছুই ভাবোনি?
ভেবেছি তো অনেক কিছু। বলার মতো কথাও আছে অনেক।
তাহলে?
এ মুহূর্তে কি বলবো তাই ভাবছি।
... আচ্ছা, তুমি আমাকে এড়াতে চাচ্ছো না তো?
কেন বলো তো?
না মানে, ফোন ধরতে এতো দেরি করছিলে...
ও এ কথা! ছাদে ছিলাম।
ছাদে! তুমুল বৃষ্টির মাঝে ছাদে?
বৃষ্টি হেসে বললো, বৃষ্টির মাঝে বৃষ্টি থাকবে না তো কে থাকবে শুনি? তৌফিক হঠাৎ কণ্ঠস্বর নরম করে, সেদিনও এমন বৃষ্টি ছিল, তাই না?
হু, তাই...
এতোটুকু বলে কি এক লজ্জায় থেমে গেল বৃষ্টি। স্পর্শে যেমন লজ্জাবতী লতা আড়ষ্ট হয়ে যায়!
৩.
আপা, কফি আনছি।
কফির মাগ হাতে দরজার ওপাশে দাঁড়ায় শেফালি।
এদিকে নিয়ে আয়।
বৃষ্টি কফির মাগ হাতে নেয়। শেফালি চলে যায়।
কফি খাবে?
তৌফিককে শুধায় বৃষ্টি।
তুমি জানই তো, আমি কফি খাই না, বমি বমি লাগে...
আহারে! যেন মুখে কফি তুলে দিচ্ছি। সিগারেটটা তো ভালোই খাও, ওতে বমি লাগে না?
সিগারেট খাই তোমাকে কে বলেছে? ...নিশ্চয় সামির? আচ্ছা, ফাজিলটা আর কিছু বলেনি তো!
তৌফিকের কণ্ঠ আতঙ্কগ্রস্ত মনে হয়। কিন্তু বৃষ্টি অতোটা আমলে নিল না। কফিতে প্রথম চুমুক দিয়ে বললো, আর কি বলবে! তুমি মদ খাও, গাজা খাও, নিষিদ্ধ পল্লীতে যাও... এসব? এ কথা বলে হেসে ওঠে বৃষ্টি।
তুমি দেখি বেশ দুষ্টু হয়েছে।
তা সিগারেট ধরেছো কবে থেকে?
সামির নিশ্চয় বলেছে... আমার মুখে তিন বছর শব্দ দুটো শুনতে চাচ্ছো, তাই না?
বিব্রতবোধ করে বৃষ্টি। হঠাৎ কিছু আবিষ্কার করেছে এমন ভঙ্গিতে বলে ওঠে, সর্বনাশ, তোমার অনেক টাকা বিল উঠবে যে! তুমি রাখো, আমি ফোন করছি।
দরকার নেই, তোমার নাম্বারটা FnF করা আছে।
তবু...
বৃষ্টির মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় তৌফিক, ওসব কথা বাদ দাও। সেই বৃষ্টি ভেজা দিনটির কথা বলো। যেদিন তোমার আমার দেখা হয়েছিল কলেজের প্রথম দিনটিতে। সেই প্রথম দিনটির কথা বলো। এমন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় অতীত রোমন্থনের স্বাদই আলাদা।
বাহ, কবি হয়ে গেলে দেখছি! কি হবে অতীতের কথা বলে? অতীত মানেই তো দুঃসহ বেদনা! অতীত মানেই...
আমার কাছে অতীত মানেই আনন্দের শিহরণ। অতীত মানেই ছেঁড়া পাল নয়, অতীত মানেই এখনো বেঁচে আছি। সত্যিই অতীতের কিছু সুখ স্মৃতির ওপর ভরসা করেই তো এখনো বেঁচে আছি, আজ তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
ঠিক আছে বাবা! কুমারীর প্রথম পরশ তো আমি পাইনি, পেয়েছো তুমি। সুতরাং তুমিই বলো।
এই মেয়ে, তুমি বুঝি কুমারের প্রথম পরশ পাওনি? না কি আমার কুমারত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে? হা হা হা। কিংবা আমার আগেই অন্য কারো পরশ....। হি: হি: হি:
হাসতে হাসতে কথাগুলো বললো তৌফিক। সেই হাসিতে বৃষ্টিও যোগ দিল। না না, মেঘের বৃষ্টি না, তৌফিকের বৃষ্টি। আসলে দুজনই চাচ্ছে বিবাদের হাওয়ায় মরচে ধরা সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতে। বিরহের শীতে শুষ্ক হওয়া ভালোবাসার বৃক্ষকে বসন্তের ছোয়া দিতে।
ওরা কি জানে না আকাশে এখনো মেঘ, বসন্ত আসতে অ-নে-ক দেরি।
৪.
গল্প বলার ভঙ্গিতে এক রোমাঞ্চকর দিনের উপাখ্যান বলতে শুরু করলো তৌফিক, দিনটি ছিল রবিবার, কিন্তু কথা রাখলেন না রবি। তার বদলে মেঘের আনাগোনা। সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। কে জানতো তুমি বৃষ্টিও সেদিন আমার হৃদয়ে এসে পড়বে।
এটুকু বলার পর থামলো তৌফিক। নিজের অজান্তেই বুক থেকে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বের হলো। সেই দীর্ঘশ্বাসকে প্রশ্ন বানিয়ে আচমকা বৃষ্টির প্রতি ছুঁড়ে দিল, কেমন আছো বৃষ্টি?
চালক হঠাৎ হার্ড ব্রেক কষলে যাত্রীরা যেমন চমকে এদিক সেদিক তাকায়, অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে দেখে কোনো অঘটন হলো কি না- বৃষ্টি অনেকটা সে রকমই চমকালো। ক্ষণিক নিশ্চুপ থাকার পর অদ্ভুত স্বরে বললো, এতোদিন পরে এই প্রশ্ন? তুমি জানো না আমি কেমন আছি, কেমন রেখেছো আমাকে?
প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন
জানি না, জানি না বলেই তো...
জানো না! এ কথা বিশ্বাস করতে বলো আমাকে? না কি আমার দুঃখ নিয়ে মজা করছো।
বৃষ্টির এ শ্লেষমিশ্রিত কথায় আঘাত পায় তৌফিক।
বিশ্বাস করো বৃষ্টি, গত তিনটি বছর অদৃশ্য তোমাকে আমি বারবার শুধু একটি প্রশ্ন করেছি, বৃষ্টি তুমি ভালো আছো তো? কিন্তু আমি জানতাম না তুমি কেমন আছো।
আমি কেমন আছি, তা জানার তোমার যদি এতোই ইচ্ছা তবে একবারও ফিরে আসলে না কেন আমার সামনে? অন্তত একটি চিঠি, একটি ফোন কিংবা SMS? কোথায়, কিছুই তো পায়নি।
এসব কোনো কিছুই আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু... তুমি তো পারতে।
কি বললে, আমি! অদ্ভুত কথা শোনালে। কোন মুখে এ কথা বলছো? যে মুখ দিয়ে আমার প্রতি তোমার ঘৃণা, ক্রোধ, উন্মত্ততা প্রকাশ পেয়েছিল সেই মুখে! যাকে তুমি এক গাদা মিথ্যা অভিযোগে জর্জরিত করে চলে গিয়েছিলে, তাকে এ কথা বলছো? এতো কিছুর পর আমার পক্ষে সম্ভব অথচ তোমার পক্ষে সম্ভব ছিল না- এ কথা বলছো কি করে? তুমি পারো বটে। কোথায় যেন কি হয়ে গেল বৃষ্টির। একি বৃষ্টির মাঝে মেঘের আর্তনাদ। তারস্বরে একদমে আরো কথা বলে যায় সে, তিন বছর আগে শেষ দিনটিতে শেষ কথাগুলো ছিল তোমার। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দাওনি। শুধু নিজের অভিযোগের কথা জানিয়েছো। আমার কোনো কথাই শুনতে চাওনি। রাতারাতি বদলে গিয়েছিলে তুমি, তোমার ভালোবাসা রূপ নিয়েছিল ঘৃণায়। চমৎকার ভালোবাসা তোমার! কি পেয়েছো তুমি? আজ এতোদিন পর আবার সেই ভালোবাসার মুখোশ পরেছো...
চুপ, চুপ করো!
নিজের ভালোবাসার কথা অশ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হলে যে কোনো প্রেমিকই চায় নির্দয় মুখটিকে থামাতে। হোক না সে প্রিয় মুখ।
কিন্তু কথা বলার নেশা যেন পেয়ে বসেছে বৃষ্টিকে।
চুপ করতে বলছো। আবারো চুপ করতে বলছো তুমি আমাকে? আর কতো বছরের জন্য চুপ করতে বলছো? আরো তিন বছরের জন্য... না কি অনন্ত জীবনের জন্য?
বৃষ্টি হাত থেকে কফির মগটা মেঝেতে ছুড়ে মারলো। হাতবন্দি ফোনটাকে নামিয়ে রেখেছে কোলের ওপর। উত্তেজনায় সারা শরীর কাপছে, নিঃশ্বাসটা অস্বাভাবিক দ্রুত ও ভারি। ওর চোখ দেখলে কে বলবে ও দুটো ঝর্না নয়। বৃষ্টি জানে না ওপাশে তৌফিক কেঁদে চলেছে অঝোরে। তৌফিক এইচআইভি পজিটিভ। যার জীবনের আয়ু আঙুলে গোনা যায়। আর এ কারণেই তিনটি বছর মিথ্যা অভিযোগে দূরে সরিয়ে রেখেছিল বৃষ্টিকে। কিন্তু আজ কি যে হলো তাঁর। তীব্র ভালোবাসার কাছে হেরে গেল! আহ ভালোবাসা এমন কেন? একজন জোছনার মতো ভালোবেসে কাঁদছে আরেক জন সে ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়ে কাঁদছে।
প্রকৃতিরও বুঝি এ বিরহ সহ্য হয় না। সেও কাঁদে নিজের মতো।
"আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।"
পূর্বপ্রকাশ: দৈনিক যায়যায়দিন