somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আশংকা

০৮ ই জুন, ২০১০ সকাল ৭:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(ছবিতে গুটলুশ পুটলুশ আমার বুকে গুড়ি মেরে ঘুমুচ্ছে!)

পাশের বাসার চাঁদ ভাবীর কুটলুমনি (পুচকা একটা মেয়ে) হইছে কয়দিন আগে। দাঁড়ান, হিসাব করে দেখি, কয়দিন… উমম, চব্বিশ-পঁচিশ দিন! এইখানে ডাক্তাররা মা হওয়ার আগে মেয়েদেরকে মোটামোটি লেকচার টেকচার দিয়ে, ওয়ার্কশপ টুয়ার্কশপ করায়ে এক একটা ছোটখাটো বেবী-স্পেশালিস্ট বানায়ে ফেলে। অতএব, চাঁদভাবীর লেকচার- ‘তুই ওর সাথে এত কথা বলছিস, সে তো তোকেই দেখেনা!’
আমি অবাক, ‘মানে?!’
‘নিউ-বর্ণ বেবী এক হাত দূরের জিনিষও স্পস্ট করে দেখেনা’।
সাথে সাথে আমি আমার মাথা কুটলু পুটলু’র চোখের এক হাতের ভিতর ঢুকায়ে ফেলি। ‘এই দেখ, তোর বড়টা কিন্তু আমাকে কাকী ডাকে। আমি এই কাকের মত কাকী ডাক পছন্দ করিনা। তুই আমাকে সাদা চামড়ার বিদেশীদের মত নাম ধরে ডাকবি, বুঝছস?! তাইলে আমার নিজেকে ছোট ছোট মনে হবে। তোর বান্ধবী মনে হবে। আর তোর মা কিন্তু তোকে পিটার উপর রাখবে, তোর বাপ বলছে তুই একটু বড় হইলেই ধরে বেঁধে দেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিবে। বুঝতেছস তো? আমি ছাড়া তোর এম্নিতেও কোনো গতি নাই!’

চাঁদ ভাবী হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খান আমার কথা শুনে। আর আমি বার বার চেক করি আমার মাথা কুটুশ-পুটুশের চোখের এক হাতের ভিতর আছে কিনা। কাছের থেকে ভাল করে ওর চোখ দেখি। ছোট্ট দুইটা চোখ! ছোট ছোট লম্বা লম্বা চোখের পাঁপড়ি। সে চোখে অবাক তাকানো। কী নরম ত্বক ওর! যেন একটু চাপ দিলেই গলে যাবে। নতুন একটা বাচ্চাকে আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথম আশ্চর্য মনে হয় সবসময়। বুকের কাছে আংগুল লাগালে ধুক ধুক করছে ছোট্ট একটা হৃদপিন্ড। ছোট ছোট কান, ছোট নাকের ফুটা… এই বাচ্চাটাই একদিন বড় একটা মানুষ হবে!!

পুটলুশটা হঠাৎ করে হাই তুলে। সে এক অবাক কান্ড বটে। ছোট্ট গোলাপী দুইটা ঠোঁট একটুখানি হা হয়, তারচেও ছোট্ট নরম তুলতুলে শরীরটা একটু মোচড় মারতে চেষ্টা করে। আমি তার ঠোঁটের হা’এর ভিতর দেখতে চেষ্টা করি, আমাদের মতই ছোট্ট একটা জিহবা! তালুটাও আমাদের মত। খালি পার্থক্য হলো ছোট্ট মাড়িটাতে কোনো দাঁত নাই। দাঁত ছাড়াই কিটলি-মিটলিটা মাঝে মাঝে হাসে। সে তো হাসি না, রাজকণ্যার দয়া করে যেন একটু মিলাদের তাবারক ছিটানো, পুরা বাসায় হই চই পড়ে যায়, ‘এই এই, এইমাত্র হাসছে! আমি দেখছি! আমি দেখছি!’ যে দেখছে সে এইবার চাপা মারতে থাকে। বড় ভাব আমাদের এই গুটলুশের। সহজে হাসেনা।

কিন্তু অবাক কান্ড জানেন? যেই চাঁদভাবী তারে কোলে নেয়, তার দিকে তাকায়ে হাসে, সেও সাথে সাথে হাসে!! একী অবাক কান্ডরে বাবা। চব্বিশ দিনের এই পুটলুশ নিশ্চয় তার মা’রে চিনেনা, তাইলে চাঁদভাবী কোলে নিলে সে হাসে ক্যান? এইটা একটা রহস্য। এবং এই রহস্য উদঘাটনে আমাদের বিল্ডিং’র চারটা বাংগালী পরিবারই মহাব্যস্ত। যেহেতু চাঁদভাবীর আগে এই চার পরিবারে কেউ মা হয় নায়, তাই মা-খালাদের জায়গাটা দখল করে নিয়ে চাঁদভাবী লেকচার দেন, ‘আরে ওর সাথে আমার একটা নাড়ীর টান আছেনা?’

আরিশামনি যখন চাঁদভাবীর কোলে উঠে ভাবীর দিকে তাকায়ে হাসে, আমি সত্যি ভীষণ অবাক হয়ে দেখি দৃশ্যটা। মা আর তার সদ্যজাত সন্তান- দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়ে হাসছে, পৃথিবীর অন্যতম সেরা দৃশ্য। কিন্তু আমি একটা খাটাশ, কারণ সে দৃশ্য দেখে খুশী হওয়ার বদলে আমার বুক দুরুদুরু কাঁপে। এই কঠিন পৃথিবীতে এই দৃশ্য’র স্থায়ীত্ব কতদিনের সে কথা চিন্তা করতে না চাইলেই চিন্তারা মিছিল করে চলে আসে। হয়তো দেশের মত অলিগলিতে আগুন লেগে মরে যাওয়া এত্তগুলো মানুষের মত কিছ হবেনা, হয়তো বন্যার পানিতে একের পর এক দূর্ঘটনার মত কিছু হবেনা, হয়তো প্রতি বছর একের পর এক ওভারলোডেড শিপ ডুবে যাওয়ার মত কিছু হবেনা, হয়তো বখাটেদের অত্যাচারে সীমা-রীমাদের আত্নহত্যা করার মত কিছু হবেনা, হয়তো হরতালে পুলিশ বা বিরোধীদলের ছুটন্ত গুলি লেগে হঠাৎ মরে যাওয়ার মত কিছু হবেনা, হয়তো এই স্কুল না ঐ স্কুল, এই কলেজ না ঐ কলেজ, এই ইউনি না ঐ ইউনি তে পড়ার জন্যে ভর্তি পরীক্ষার চাপে ভর্তা হয়ে যেতে হবেনা, হয়তো কোনো আদর্শের পতাকাবাহী হওয়ায় কোনো শিক্ষকের বিরাগভাজন হয়ে নামীদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হবেনা…… এইরকম অনেককিছুই হয়তো হবেনা। যেহেতু ও বাংলাদেশে জন্মায়নি।

কিন্তু তারপরও যে কথা থেকে যায়। বাংলাদেশ থেকে বের হয়ে গেলেই কী সব শেষ হয়ে যায়? পুরো পৃথিবীটাই যে একটা বাংলাদেশ! পুরো পৃথিবীতেই যে আছে ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স! ……… আমি যতবার চাঁদভাবী আর আরিশামনি, মা মেয়ে দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসার দৃশ্যটা দেখি, ততবার মনে মনে প্রার্থনা করি, আল্লাহ, ও যেন সাধারণ মানুষ হিসেবে বড় হয়ে হেসে খেলে জীবনটা পার করে দিতে পার। ওর কোনো বিপ্লবী হওয়ার দরকার নেই। ওর কোনো পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখার দরকার নেই। ওর কোনো পৃথিবী নিয়ে, এর জটিল জীবন নিয়ে চিন্তাভাবনা করার দরকার নেই। কারণ এইসব করতে গেলেই যে ওর মুখের এত সুন্দর হাসিটা নষ্ট হয়ে যাবে। ও যে অন্ধকার গর্তে পড়ে যাবে, যেখান থেকে হাপুশ হুপুশ করে নাভিশ্বাস উঠে গেলেও, কেউ বাঁচাতে আসেনা। খুব কম মানুষই যেখানে কাছে এসে বলে, আমিও আছি, আমিও হাবুডুবু খাচ্ছি, তুমি একা না! ……… ওর মুখের এই হাসি মুছে গেলে চাঁদ ভাবীর মুখের হাসিটাও যে মুছে যাবে! পৃথিবীর অন্যতম সেরা একটা দৃশ্য যে মুছে যাবে!

আমি ভাবতে ভাবতেই আরাফ দৌঁড়ে আসে। হালুম করে লাফিয়ে পড়ে চাঁদভাবী আর আরিশা’র উপর। দেড়বছরের আরাফের একটাই শখ, আরিশাকে চেপে ধরে চুমু দেয়া! চাঁদভাবী ধমকে উঠে, ‘আরিশা ব্যাথা পাবে আব্বু, ছাড়ো!’ মায়ের ধমক খেয়ে শেষ আশ্রয় হিসেবে মুখ কালো করে ‘কাকী’ ‘কাকী’ করে আমার কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আরাফ। পিচ্চিটাকে বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরলে কেমন যেন একটা উষ্ণতার ছোঁয়া লাগে। আমি সে উষ্ণতাতেও আশংকিত হই। এই পিচ্চিগুলো জানেওনা ওরা কোন পৃথিবীতে এসেছে। নাকি আমি নিজেই বেশী প্যারানয়েড? পৃথিবীতে অনেক আনন্দের, অনেক ভাল দিকও তো আছে। নিজেকে স্বান্তনা দিতে চেষ্টা করি। এই উষ্ণতা, এই হাসি, এই আনন্দ বেঁচে থাকুক। কুটলুশ-পুটলুশের দূর্লভ হাসি বেঁচে থাকুক। চাঁদভাবীর মুখের হাসি বেঁচে থাকুক। মানুষগুলো আনন্দে থাকুক।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১০ সকাল ৭:৪৭
৩২টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বর্ণচোখ

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:৩৮


(ষড়ঋপু সিরিজের তৃতীয় কাহিনি — লোভ)

⸻ সতর্কীকরণ: ছায়া পড়লে আলোও কাঁপে ⸻

এই কাহিনি কেবল একটি গল্প নয়। এটি এক মানসিক প্রতিচ্ছবি, যেখানে লুকিয়ে আছে মানব আত্মার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এসব লুটপাটের শেষ কোথায়!

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:১৮

আধা লিটারের পানির বোতল দোকানদার কেনে সর্বোচ্চ ১২.৫০ টাকায় আর ভোক্তার কাছে বিক্রি করে ২০ টাকা। এগুলো কি ডাকাতি না?

গোপন সূত্রে যতটুকু জানা যায়,
প্রাণ ৮.৫ টাকা কেনা
ফ্রেশ ১০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চারুকলায় আগুনে পুড়ে গেল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৪৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নববর্ষের শোভাযাত্রা উদ্‌যাপনের জন্য বানানো দুটি মোটিফ আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে একটি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি ও আরেকটি শান্তির পায়রা।



আজ শনিবার সকালে চারুকলা অনুষদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামা....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:২৬

ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামা
March for Gaza | ঢাকা | ২০২৫

বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম
আল্লাহর নামে শুরু করছি
যিনি পরাক্রমশালী, যিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী,
যিনি মজলুমের পাশে থাকেন, আর জালেমের পরিণতি নির্ধারণ করেন।

আজ আমরা, বাংলাদেশের জনতা—যারা জুলুমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডক্টর ইউনুস জনপ্রিয় হয়ে থাকলে দ্রুত নির্বাচনে সমস্যা কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৪১



অনেকেই ডক্টর ইউনুসের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার কথা বলছেন। এর জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় নির্বাচন। আদালত যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল করেছে সেহেতু ডক্টর ইউনুস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×