ব্লগে একটা পোস্ট প্রকাশ করার পর সে-পোস্টের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যত বেশি হবে, সাধারণ ভাবে সে-পোস্টটি তত বেশি গুরুত্ববহ হয়ে উঠবে। সব পোস্ট যেমন আলোচনার যোগ্য নয়, বা কম আলোচনার যোগ্য, আবার সবার পোস্টই আলোচনা বা সমালোচনার ঝড় তুলবে, সেটাও খুব কমই দেখা যাবে। নিজেদের প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, অন্য ব্লগারদের সাথে মিথস্ক্রিয়া ও সৌহার্দপূর্ণ আচরণ দ্বারা কোনো কোনো ব্লগার জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির দিক থেকে প্রথম সারিতে স্থান লাভ করতে সক্ষম হোন। তেমনি, কোনো কোনো ব্লগার হয়ত তাদের অসামাজিক, অমার্জিত ও আপত্তিকর আচরণ দ্বারা সর্বকালের নিকৃষ্ট, বিতর্কিত, ধিকৃত ও নিন্দিত ব্লগারদের তালিকায় নিজেকে নামিয়ে ফেলেন।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায়, বাংলা অক্ষরে বাংলা ভাষায় ব্লগিং করার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে জানা-আরিল্ড দম্পতি বাংলাদেশসহ সমগ্র বাংলাভাষাভাষীদের জন্য যে অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলেছেন, কালের গর্ভে তা চির-অম্লান ও অক্ষয় থাকবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিসহ যে-কোনো সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দেশ ও জাতির স্বার্থে ব্লগারগণ যেভাবে সোচ্চার ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন, তা নজিরবিহীন। 'ব্লগার' - এ নামটার মধ্যে একটা গাম্ভীর্য আছে, যাতে বিবেক, বিদ্যা, বুদ্ধি, মেধা, আভিজাত্য, শিক্ষা, সদাচরণ, মার্জিত রুচিবোধ, ইত্যাদি যাবতীয় সদ্গুণের সমাহার থাকবে বলে প্রত্যাশিত।
বিভিন্ন জাতীয় ও সামাজিক ইস্যুতে ব্লগারগণ একযোগে অংশগ্রহণ করে থাকলেও ব্লগের সূচনালগ্ন থেকেই ব্লগারদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ বা মতানৈক্য দেখা দিয়েছে, এবং কখনো তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যখন এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে ব্লগের বাইরে, অফ-লাইন লাইফে, যেখানে ধর্মীয় বা অন্যান্য ইস্যুতে বেশ কয়েকজন ব্লগারকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। সেটা ব্লগের জন্য একটা কালো অধ্যায় বটে, যা থেকে জনমনে ব্লগ ও ব্লগার সম্পর্কে একটা নেগেটিভ ইম্প্রেশনও সৃষ্টি হয়েছিল। তবে, আমার ধারণা, সেই নেগেটিভ ইম্প্রেশন ধীরে ধীরে অনেকাংশেই কমে এসেছে।
বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য বা মতবিরোধ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মতবিরোধের বিষয়গুলো আলোচনা বা সমালোচনার ভাষা হতে হবে মার্জিত, অভিজাত, বিশুদ্ধ, অহিংস, নিরপেক্ষ ও বুদ্ধিদীপ্ত। আমরা শুধু একটা পোস্ট পড়েই তা থেকে আনন্দ বা জ্ঞান লাভ করি না, অনেক সময় পোস্টের উপর যে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়, তা মূল পোস্টকে ছাপিয়ে যায়, জ্ঞানপিপাসু পাঠকগণ ওসব কমেন্ট পড়ে অধিক জ্ঞান লাভ করেন, এবং বুদ্ধিদীপ্ত তর্ক-বিতর্ক অনেক সময় আমাদের মনকেও খুব আনন্দিত ও উদ্বেলিত করে তুলতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্লগে সবচাইতে আলোচিত বা সমালোচিত বা ঘৃণিত শব্দ বা টার্মটির নাম 'ব্যক্তি-আক্রমণ'। ব্যক্তি-আক্রমণকে কেন্দ্র করে ব্লগে এখন দুটো গ্রুপ বিদ্যমান; একটা গ্রুপ, যারা মনে করেন তারা ব্যক্তি-আক্রমণের শিকার, তাদের সংখ্যাই সর্বাধিক, হয়ত ৯৫% ব্লগারই নিজেদেরকে ব্যক্তি-আক্রমণের শিকার মনে করছেন, তারা বাকি ৫%-কে ব্যক্তি-আক্রমণকারী মনে করছেন। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, এই ৫% ব্যক্তিরাও নিজেদেরকে ব্যক্তি-আক্রমণের শিকার মনে করছেন বাকি ৯৫% ব্যক্তিদের দ্বারা। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? কেউ কি ব্যক্তি আক্রমণ করেন নি? নাকি, সবাই ব্যক্তি-আক্রমণকারী? আরো মজার বিষয় হলো, এই ৫% ব্যক্তিরা বলছেন, তারা কাউকে ব্যক্তি-আক্রমণ করেন নি কখনো, শুধু বিষয়ের ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছেন, বা সমালোচনা করছেন। এদের এ দাবি অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ৯৫% ব্যক্তিরা কখনো মেনে নেন নি, তারা বিভিন্ন সময়ে সমালোচনা ও ব্যক্তি-আক্রমণ কী, তা নিয়ে বেশকিছু পোস্টও লিখেছেন, যা দিয়ে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে চেয়েছেন, তারা ৫% ব্যক্তিদের দ্বারা ব্যক্তি-আক্রমণেরই শিকার, তা কখনো সমালোচনা ছিল না; সমালোচনা তো একজন ব্লগারের কোয়ালিটি ও তার লেখার কোয়ালিটির জন্য সহায়ক, সমালোচনাকে সব সময়েই স্বাগত জানানো হয়।
আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে এর আগে একটা পোস্ট লিখেছিলাম - ব্লগীয় লেখালেখি - কীভাবে একটা বিশ্লেষণমূলক কমেন্ট লিখবেন। এতে আমি আমার ধারণা দিয়েছি, কীভাবে একটা পোস্টের সমালোচনা করা যায়, এমনকি আমার রম্যপোস্ট তারকাজরিপ-২-এও এ বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আমার ১৪ বছর সামহোয়্যারিনীয় ব্লগীয় জীবনে আমি প্রচুর সমালোচনা করেছি, বিশেষ করে সাহিত্যের বিষয়গুলো, যেমন, গল্প, কবিতা, ছড়া, রম্য, ইত্যাদি গত ৮-১০ বছরে আমার চাইতে বেশি সমালোচনা করেছেন, এমন ব্লগার কেউ আছেন বলে আমার মনে হয় না। সবাই যে আমার সাহিত্যসমালোচনামূলক কমেন্টগুলো খুব সহজ ও হাসিমুখে গ্রহণ করেছেন তা না, কেউ মুখ কালো করেছেন, কেউ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তবে, অধিকাংশ ব্লগারই তা সানন্দে গ্রহণ করেছেন। আমার একটা কথা হলো - আমি অনেক মনোযোগ দিয়ে একটা কবিতা বা গল্প পড়লাম, ওটার ভালো ও দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরলাম যাতে দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা যায়, এতে আমার কোনো লাভ নেই, লাভ হলো ঐ লেখকের। আমি নিজের খেয়ে অন্যের উপকার করছি, এতে বাহবা চাই না, মূল্যায়ন চাই, কিন্তু কেউ উলটো রিঅ্যাক্ট করলে তখন চিরতরে আমি সেই ব্লগারের পোস্ট পড়া বাদ দিয়ে দিই।
কিন্তু, এই যে আমি এত লেখকের সমালোচনা করেছি, আমার নামে কেউ কোনো অভিযোগ রিপোর্ট করেছেন, এটা শুনি নি। আমার দ্বারা অতীষ্ঠ হয়ে কেউ ব্লগ ছেড়ে গেছেন, এটা অসম্ভব। কারণ, আমি বুঝি, কোনটা সমালোচনা, কোন কাজটা করা অন্যায় নয়; আমি ব্যক্তি-আক্রমণও বুঝি, এও বুঝি ব্যক্তি-আক্রমণ হলো একটা অপরাধ, ক্রিমিনাল অফেন্সও বললে অত্যুক্ত হবে না মনে করছি (আমি জানি না, আইনে এর কোনো বিধান আছে কিনা)।
খুব সহজ কথায় ব্যক্তি-আক্রমণ হলো ব্যক্তিকে আক্রমণ করা। ব্যক্তি-আক্রমণে শুধু 'আক্রমণ' বা অ্যাটাক বা আঘাতই থাকবে। সমালোচনার ক্ষেত্রে ব্যক্তি নয়, ব্যক্তির পোস্টের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হয়; সেই আলোচনায় ভালো ও মন্দ উভয় দিকই থাকে; কীভাবে মন্দ বা খারাপ দিকগুলোকে ইম্প্রুভ করা যায়, সে ব্যাপারে সুপারিশ বা পরামর্শ দেয়া হয়। ব্যক্তিকেও সমালোচনা করা যায়, তবে, সেখানেও ব্যক্তির ভালো ও মন্দ উভয় দিকই থাকতে হবে। সমালোচনার ভাষা হয় মার্জিত ও রুচিশীল, সমালোচিত ব্যক্তি বা বিষয়ের উন্নতির জন্য। ব্যক্তি-আক্রমণ করা হয় কাউকে আঘাত, অপমান বা হেয় করার জন্য। কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক।
আপনি চাল কিনতে গেছেন। চালগুলো ভাঙা ভাঙা, মরা চাল প্রচুর, পাথরকণাও প্রচুর, তূষ দেখা যায়, কিরাও নড়েচড়ে। চালের দর ৫০ টাকা কেজি। সব দেখেশুনে আপনি দোকানিকে বললেন, হালার পো, তুই একটা শূকরের বাচ্চা। খেয়াল করুন, আপনি কিন্তু বলতে পারতেন, আপনার চালে ভাঙা দানা বেশি, মরা চাল প্রচুর কেন? এত পাথরকণা কেন? তূষ কেন? আপনি চালের দাম ৩০ টাকা, এমনকি ১৫টাকাও বলতে পারতেন। তা না বলে আপনি শুরুতেই চালওয়ালাকে আক্রমণ করে বসলেন, হালার পো, তুই একটা শূকরের বাচ্চা। আপনি যদি চাল সম্পর্কে আলোচনা করেন, সেটা হবে বিষয়ভিত্তিক সমালোচনা, আর যদি চালের দোকানিকে ঐরকম হুট করে গালি দিয়ে বসেন, সেটা হবে ব্যক্তি-আক্রমণ। এখন বলুন, আপনি চাল কিনতে যেয়ে কখনো চালের দোকানদারকে এভাবে গালি দিয়ে বসেন? মাছের দোকানিকে কি বলেন, তুই দেখতে বান্দরের মতন? কাপড়ের দোকানদারকে কি কখনো বলেন, তোর বাবা একটা চোর, তোর মা একজন পতিতা? নিশ্চয়ই বলেন না। সেখানে আপনার আচরণ ভদ্রজনোচিত হতে হবে। তাহলে, একটা পোস্ট পড়ে আপনি কেন বলবেন, আপনার মগজে কুকুরের ক্রোমোজম? যদি কোনো ব্লগার কাউকে 'আপনার মগজে কুকুরের ক্রোমোজম?' বলে আক্রমণ করতে পারেন, তিনি সর্বকালের নিকৃষ্ট ব্লগার ও সবচাইতে দাগী ক্রিমিনাল। আপনি কি মনে করেন, কোনো ব্লগে এ ক্রিমিনাল ব্লগারের ব্লগিং করার অধিকার থাকে?
হয়ত একজন ব্লগার ফরেইন রিজার্ভ নিয়ে একটা পোস্ট লিখেছেন। ঐ ব্লগারের পোস্ট পড়েই বুঝতে পারলেন, সাবজেক্টের উপর তার জ্ঞান খুবই সীমিত। এ ব্যাপারে আপনার কিছু জ্ঞান থাকায় সুন্দর একটা কমেন্ট লিখলেন, কীভাবে ফরেইন রিজার্ভ হয়, সেটাও ব্যাখ্যা করলেন। অন্য এক ব্লগার আপনার কমেন্ট দেখে হুট করে বলে বসলেন, এসব মগজহীন, বেকুবদেরকে নোবেল প্রাইজ দেয়া হোক। এটা তার ব্যক্তি-আক্রমণ। তিনি যদি জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্লগার হতেন, তাহলে শালীন ভাষায় আপনাকে বলতেন যে, আপনার দেয়া ব্যাখ্যায় কিছু ত্রুটি আছে; তারপর প্রয়োজনীয় রেফারেন্সসহ (প্রয়োজনে) ফরেইন রিজার্ভের ব্যাখ্যা পেশ করতেন। তার ব্যাখ্যাই যে সঠিক, তা নাও হতে পারে। তখনই শুরু হবে আপনার পালটা ব্যাখ্যা। এভাবে উভয়ের মন্তব্যে-প্রতি-মন্তব্যের মাধ্যমে উক্ত পোস্টটি জ্ঞান আহরণের একটা উন্মুক্ত ও উপভোগ্য স্পট হয়ে উঠতে পারে। শালীন ভাষায় কেউ একটা ভুল ধরিয়ে দিলে পোস্টদাতা উপকৃত হয়; অনেক সময় নিজের ভুল তথ্যের জন্য অবনত ও লজ্জিতও হয়ে থাকেন।
এই যে দুটি উদাহরণ দিলাম, চাল, মাছ, কাপড় এবং ফরেইন রিজার্ভের ডেফিনিশন - এগুলো ব্যক্তি-আক্রমণের উদাহরণ।
অমুক ভাই কবিতার রাজা, তমুক ভাই গানের কোকিল, আমি এমন তোষামোদকারী কমেন্ট পছন্দ করি না, যারা করেন তাদেরও পছন্দ করি না। লেখক হিসাবে আমি আমার লেভেলটা জানি। লেখাটা কতখানি ভালো বা মন্দ হয়েছে সেটুকু জানি। এজন্য ধন্যবাদ আমার কতখানি প্রাপ্য বা মন্দ হলে কত গ্রেড নীচের রেটিং পেতে পারে, সে ধারণাও আমার আছে। যার পোস্ট মানসম্পন্ন হয় নি, তাকে সরাসরি বলতে কোনো অপরাধ নেই, এটা ভালো পোস্ট নয়; সম্ভব হলে বলুন, কীভাবে ভালো পোস্ট লেখা যায়। কিন্তু পোস্টদাতাকে মগজহীন, বেকুব, ডোডো, পিগমি, ইত্যাদি বলে ব্যক্তি-আক্রমণ করা শালীনতার মধ্যে পড়ে না, এগুলো হলো ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি। যখন আপনি নিজেই এসব ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটির প্রচলন করেছেন, তখন অন্য কোনো ব্লগারকে ক্রিমিনাল বলা আপনার শোভা পায় না, ওটা খুবই হাস্যকর হয়ে যায়। যদি কেউ বিরামহীন ভাবে এরকম ব্যক্তি-আক্রমণচর্চা চালিয়ে যেতে থাকেন, তখন এটাকে তার ভয়ানক আচরণগত সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করতে হবে, এটা কোনো স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়।
ব্লগার জুল ভার্ন একজন পুরোনো ব্লগার। তার প্রতিটা পোস্টে তার মেধা, বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান ও মার্জিত রুচিবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। ব্লগারদের সাথে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। তার পোস্টগুলো খুব পাঠকনন্দিত হয়। ওগুলো পড়ে নিজেকে ঋদ্ধ ও মননশীল করা যায়। তিনি নিজের আচরণ দ্বারা ব্লগারদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্লগার। ব্লগের প্রাণ সঞ্চালনক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য তার ভূমিকা অপরিসীম। তার লেখা পোস্টগুলো এ ব্লগের আর্কাইভকে সমৃদ্ধ করেছিল। কিন্তু ব্লগের দুর্ভাগ্য, তিনি তার সকল পোস্ট ড্রাফটেড করে ব্লগ ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি চলে যাবার পর থেকেই পুরো ব্লগে তোলপাড়, ব্লগ ও ব্লগারগণ অস্থির এবং তাকে নিয়ে বেশকিছু পোস্ট প্রকাশিত হয়েছে ব্লগে; অনেক আলোচনা হচ্ছে তার চলে যাওয়ার বিষয়টি; প্রতিটা পোস্টেই তার প্রতি ব্লগারদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা এবং তার উন্নত মানের লেখালেখির বিষয়টি উঠে এসেছে। এমন একজন বিদগ্ধ ব্লগারের ব্লগ ছেড়ে চলে যাওয়া ব্লগের জন্য বিরাট ক্ষতি।
কিন্তু কেন তিনি ব্লগ ছেড়ে চলে গেলেন? তাকে নিয়ে লেখা পোস্টগুলো থেকে (যেখানে তার কমেন্ট বা কমেন্টের স্ক্রিনশটও আছে) জানা যায় যে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে জনৈক ব্লগারের ব্যক্তি-আক্রমণের শিকার হয়ে আসছিলেন, যা তার সহ্যের বাইরে চলে গেছে। এ ব্যক্তি-আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতেই তিনি ব্লগ ছেড়ে চলে গেছেন। উল্লেখ্য, অল্প কয়েকজন ব্লগার 'ব্লগের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন বলে ব্লগার জুল ভার্ন চলে গেছেন' বা 'এমনি এমনি চলে গেছেন', বা 'নতুন নিকে আসবেন বলে চলে গেছেন', বা 'কেউ ব্লগ ছেড়ে চলে যেতে চাইলে তাকে বাধা দেয়া উচিত না, এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার' বলে ব্লগার জুল ভার্নের ব্লগ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি খুবই হালকা করার চেষ্টা করেছেন (এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করে থাকলে তার নিন্দা জানাচ্ছি)।
ব্লগে ব্যক্তি-আক্রমণের মাত্রা সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। একগুঁয়েমি করে নিরন্তর এভাবে ক্রিমিনাল অফেন্স করে গেলে প্রথম সারির অন্য কোনো ব্লগার যে এভাবে ঘোষণা দিয়ে ব্লগ ছেড়ে যাবেন না, তা বলা যায় না।
আমি নিজেও ব্যক্তি-আক্রমণের শিকার হয়েছি বহুবার। অন্যায়ের প্রতিবাদও করেছি মার্জিত ভাষায়। এরপর ব্যক্তি-আক্রমণের শিকার থেকে রক্ষা পাবার জন্য আমি আমার নিজস্ব পন্থায় প্রিভেন্টিভ মেজর অ্যাপ্লাই করে আসছি। কিন্তু আমার প্রিভেন্টিভ মেজরগুলো হলো খুবই প্যাসিভ। প্রথমত, আমি কোনো ব্যক্তি-আক্রমণকারীর পোস্টে কমেন্ট করতে যাই না। দ্বিতীয়ত, আমি আমার পোস্টের মধ্যেই বেশিরভাগ কমেন্ট আদান-প্রদান করে থাকি। তৃতীয়ত, আমি এমন কোনো পোস্টে কমেন্ট করি না, যে পোস্টে হুট করে কোনো ব্যক্তি এসেই ব্যক্তি-আক্রমণমূলক কথা বলে বসতে পারেন। আমি নিজের পোস্টে অন্যের কমেন্ট মডারেট/কন্ট্রোল করতে পারবো, অন্যের পোস্টে সেটা সম্ভব নাও হতে পারে।
আরেকটা কাজ আমি সচরাচর করি না - ঘৃণ্য বা বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে আমি আলোচনা করি না; আমি তার সম্পর্কে একটা কথা বললেও আমার নিজের অজান্তেই তার নামটা ছড়িয়ে দিচ্ছি মানুষের মধ্যে, বিনা পয়সায় আমি কোনো ঘৃণ্য ব্যক্তি বা অপরাধীর প্রচারণা করতে চাই না।
জুল ভার্ন ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলতে চাই : ব্যক্তি-আক্রমণের যন্ত্রণায় ব্লগ ছেড়ে চলে যাওয়া মানে পরাজয় বরণ করে নেয়া, ব্যক্তি-আক্রমণকারীকে পুরো মাঠ জুড়ে নির্বিঘ্নে খেলার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া, এতে তার উল্লাস যাপন চিরস্থায়ী করে দেয়া। আপনি ভদ্র লোক, শিক্ষিত লোক, দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এভাবে পরাজিত হওয়া আপনার জন্য সাজে না। আপনি শীঘ্র চলে আসুন ব্লগে। আপনার নিয়মিত সেরা পোস্টগুলো দিয়ে ব্লগকে সরব ও প্রাণবন্ত রাখুন। ব্লগারগণের কাছে আপনার একটা সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য ইমেজ আছে। আপনি নির্বিঘ্নে লিখবেন। কে আপনাকে আক্রমণ করলো, ওদিকে চোখই দেবেন না। ন্যাংটা হয়ে লাঠি হাতে যে লোক মানুষকে দাবড়ানি দিতে থাকে, ভদ্রলোকরাও তাতে দাবড়ানি খান, কিন্তু গাঁয়ের তাবত লোকই জানেন, কে ভদ্রলোক আর কে পাগল। আপনি একজন সুসভ্য, সুশীল মানুষ, এটা ব্লগবাসী জানেন।
ব্লগারদের কাছেও আমার কিছু বিনম্র আরজ আছে। আমি অতীতে দেখেছি, কেউ একজন অবিরাম ব্যক্তি-আক্রমণ করে যাচ্ছেন, আর কিছু ব্লগার তার পোস্টে যেয়ে আনন্দে গদ গদ হয়ে বলছেন, উনি আমাকে এখনো পর্যন্ত কোনোকিছু বলেন নাই, উনি খুব ভালো লোক। আমি তাজ্জব হয়ে গেছি এসব ব্লগারের এমন উৎফুল্লতা দেখে। যেখানে মানুষের কর্তব্য হলো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, সেখানে কীভাবে কিছু ব্লগার এরূপ উল্লাস প্রকাশ করতে পারেন - উনি আমারে কিছুই বলেন না? আমি এরূপ উল্লাস প্রকাশ দেখে আমি বিভিন্ন জায়গায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এদেরকে সতর্ক করেছি বারংবার যে, এভাবে আনন্দ না করে প্রতিবাদ করুন, নইলে একদিন আপনারাও এমন ব্যক্তি-আক্রমণের শিকার হবেন। এরপর নিজেকে সার্থক ভবিষ্যতবক্তা হিসাবে আবিষ্কার করলাম - দেখলাম, তারাও ব্যক্তি-আক্রমণের শিকার হয়ে খুব মুষড়ে পড়েছেন। এখনো কিছু ব্লগারকে দেখা যায়, অতিমাত্রায় আদিখ্যেতা করার জন্য - আমি হারিয়ে যাব, দেখবো আপনি আমায় খোঁজেন কিনা, ইত্যাদি। আমি জানি, ব্যক্তি-আক্রমণ প্রবণতা না কমলে এসব ব্লগারও একদিন সপাট করে তীব্র ব্যক্তি-আক্রমণের শিকার হবেন। যাদের ব্যক্তি-আক্রমণের অভ্যাস, তাদেরকে পারলে মোটিভেট করুন আক্রমণাত্মক না হওয়ার জন্য, কিন্তু তাদের সাথে পেলি পেলি করে তাদের কর্মে অনুপ্রেরণা দেয়া সুব্লগারের বৈশিষ্ট্য না।
যিনি বা যারা ব্যক্তি-আক্রমণ করেন, আর যিনি বা যারা তাদের সাপোর্ট করেন, তাদের প্রতিও বিনত আরজ, দয়া করে ব্যক্তি-আক্রমণের পন্থা থেকে বেরিয়ে আসুন। ব্লগের সূচনা দিনের মতো অগুনতি ব্লগার এখন ব্লগে নেই। অল্প কয়েকজন ব্লগার আমরা উপস্থিত থাকি, সবার লেখালেখি, এমনকি অনেকের ব্যক্তি-জীবন পর্যন্ত আমরা এখন জানি। মাঝে মাঝেই ব্লগ-ডে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আমরা সশরীরে উপস্থিত থাকি। আমাদের মধ্যে এত রেষারেষি, যুদ্ধংদেহী মনোভাব থাকলে সামনাসামনি দেখা হলে একে অপরকে মুখ দেখাবো কীভাবে? আমাদের চোখে কি লজ্জার একফোঁটাও অবশিষ্ট নেই? আমরা দেশ-বিদেশে মানুষের সাথে মিশি, আমাদের আচরণ, রুচিবোধ আরো অনেক সভ্য হবার কথা। কিন্তু কারো আচরণ থেকে যদি কাউকে খচ্চর বা ইতরশ্রেণির মনে হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, বিদেশে বিভিন্ন বিদেশীদের সাথেও তার আচরণ আপ টু দ্য মার্ক নয়, হয়ত, বিদেশীদের কাছেও নিজের অসভ্য আচরণ দ্বারা দেশের নাম ও মান ডুবাচ্ছেন। আমি পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দে আছি, নাকি পরিবারের কেউ আমাকে দু চোখে দেখতে পারেন না, সপরিবারে, সস্ত্রীক ব্লগপোস্ট পড়ি, নাকি স্ত্রীর কাছেও আমার মর্যাদা একবিন্দু অবশিষ্ট নেই, এগুলো অন্য ব্লগারদের সাথে আমার আচরণ থেকেই বোঝা যায়, আমাকে লিখে বোঝানোর দরকার নেই, আমি আর আমার স্ত্রী এক সার্থক আনন্দজুটি। আমাদেরকে একে অপরের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে। প্রবাদ আছে, দুটি হাঁড়ি পাশাপাশি থাকলে টোকা লাগবেই। সত্য। কিন্তু জোরে ঝাঁকি দিলে হাঁড়ি দুটো ভেঙে যাবে। আমাদের মতানৈক্য থাকবে, কিন্তু তা আলোচনা করতে হবে উপভোগ্য যুক্তি তর্কের মাধ্যমে।
সর্বশেষ যেটি হতে পারে, তা খুবই প্যাসিভ এবং নেগেটিভও - যদি কেউ ব্যক্তি-আক্রমণ অব্যাহত রাখনে, এতকিছুর পরও, একযোগে তার/তাদের পোস্ট বয়কট করাই হবে উত্তম। সেই সাথে, একা একা বা নিজেদের পোস্টে তারা যতই আক্রমণাত্মক কথা বলুন না কেন, ওগুলোতে সাড়া না দিয়ে নিজেদের মতো করে ব্লগিং করে যেতে হবে।
আমাদের কারো লেখালেখি বা জ্ঞানের মাত্রা এমন পর্যায়ের না যে, কেউ বলতে পারেন, আমার লেখাই সেরা ও নির্ভুল। কাজেই, অন্য যে-কোনো ব্লগারই কোনো একটা পোস্টে তথ্যগত ভুল খুঁজে পেতে পারেন। ভুল ধরিয়ে দিলে চটে না গিয়ে সেটাকে সহজভাবে গ্রহণ করে সংশোধন করতে হবে। যিনি ভুল ধরছেন, তাকেও ভুল ধরার সঠিক পদ্ধতিটা জানতে হবে, যে ব্যাপারে পোস্টের মাঝামাঝি স্থানে আলোকপাত করা হয়েছে।
পরিশেষে, জুল ভার্ন ভাইকে দ্রুত ব্লগে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
সেই সাথে, ব্যক্তি-আক্রমণ করা থেকে যেন আমরা সবাই বিরত থাকি, সবার প্রতি পুনর্বার এই আর্জি পেশ করে গেলাম।
শুভ ব্লগিং।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১২:৩২