কুটিমিয়ার বয়স তখন নয় কী দশ। গ্রীষ্মের এক ঝিমধরা দুপুরে ঘরের মেঝেতে খালি গায়ে শুয়ে সে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। এমন সময় প্রাণের বন্ধু গুঞ্জর আলী এসে হাঁক দেয়, ‘ও কুডি, গাব পাড়বার যাবি নি? নু, বাগে যাই।’
বাগের পাতি গাবগাছটায় এবার মেলা গাব ধরেছে। টসটসে পাকা গাবে দারুণ রস; বিচিগুলো মুখে পুরে জিহ্বার মাথায় অনবরত নাড়তে থাকে কুটিমিয়া; এ এক অমৃতের স্বাদ! এবার একদিনও সে বাগে যেতে পারে নি। কারণ, এ বছর সে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। দুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ক্লাস, অথচ বাগে ছেলেদের খেলা জমে ওঠে ঠিক দুপুরবেলাটায়, যখন সে স্কুলে থাকে।
আজ তার স্কুল ছুটি। কত দুপুর চলে গেছে সে বাগে গিয়ে খেলে না, বনের গাছগুল্ম থেকে ফলফলাদি খায় না। সহসা বাগে যাওয়ার কথা শুনে কুটিমিয়ার হুঁশ থাকে না। গলায় একটা গামছা জড়িয়ে গুঞ্জর আলীর সংগে রুদ্ধশ্বাসে গভীর বাগের দিকে ছোটে।
ঘন জঙ্গল আর ফলমূলের গাছপালায় পরিপূর্ণ গভীর বনটাকে এ গাঁয়ের সবাই ‘বাগ’ ডাকে। অজানা কাল থেকেই এ বাগ শণ, কাশ, বেত, আরো নানা জাতের আগাছায় ছেয়ে থাকতো। এর একধারে একটা ছোটো ডোবা; এ ডোবার পানিতে গোসল কিংবা রান্না হয় না, কারণ এটি কচুরিপানায় ভর্তি; এর পানি দেখতে কুচকুচে কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত, অধিকন্তু বসতিস্থান থেকে বেশ দূরে। এ ডোবার পানি শুকিয়ে কমে এলে ছেলেরা দল বেঁধে পানি সেচে মাছ ধরে। বাগের শণ আর আগাছা সাফ করে কেউ ফসল ফলাবার চেষ্টাও করে না, কেননা তাতে শ্রম ও অর্থব্যয়ের তুলনায় প্রাপ্য শস্যের পরিমাণ নেহায়েতই কম হয়। এ বাগের প্রকৃত কোনো মালিক আছে কিনা তা নিয়ে কেউ কোনোদিন ঘাঁটাঘাঁটি করে নি। কারো শণের প্রয়োজন হলে শণ কেটে নেয়। যার লাকড়ির দরকার পড়ে সে এসে আস্ত একটা গাছ কেটে ফেলে। বাগের আরেক ধারে কয়েকটা কবর আছে; যে-সব মৃতের স্ব-ভূমিতে জায়গা হয় না, তাদের জন্য বাগের এই কোনাটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাগের ভিতরের গাছগুলো একেবারেই বনজ, ওগুলোকে কেউ বপন বা রোপণ করেছে বলে কারো জানা নেই। গাছগুলোর কোনো পরিচর্যাও হয় না, ওগুলো বেড়ে ওঠে প্রকৃতির আপন হাতের আদরযত্নের মধ্য দিয়ে। বাগের উত্তর ধারে একজোড়া অতি লম্বা তালগাছ; মৌসুম এলে তাল পাকে, পাখিরা ঠুকরে খায়, তলায় পড়ে, সেগুলোও বাগের পশুপখিরাই খায়। এ বাগে আমগাছের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। দু-তিনটা কাঁঠাল গাছও আছে, একটা বরই গাছ, বড়ো দুটি শিমুল গাছ, আর আছে প্রচুর বেতঝাড়। আর আছে প্রচুর শেয়াল; সন্ধ্যা, মধ্যপ্রহর এবং শেষরাতে এদের সম্মিলিত শোরগোলে পুরো এলাকা সচকিত হয়ে ওঠে, এমনকি দুপুরেও কোনো কোনো নিঃসঙ্গ শিয়াল মাঝে মাঝে হঠাৎ ডেকে ওঠে। বাগের মধ্যিখানে সর্বাপেক্ষা বেশি স্থান দখল করে বিশাল ঝুপড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীনতম একটি গাবগাছ।
গরমের দিনে বাগের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া নালাগুলো শুকিয়ে চর হয়; তখন ছেলেরা ওখানে খেলায় মেতে ওঠে। কেউ গেছোমেছো খেলে, আম কুড়ায়, কুল পাড়ে, তেঁতুল ছিঁড়ে; কেউ পাখির বাসা খোঁজে; কেউ ডাংগুলি বা মার্বেল খেলে; কেউ কেউ চড়ুইভাতির আয়োজন করে; কেউ গাছের শাখায় দোলনা বেঁধে আপন মনে দোল খেতে খেতে গান গায়। কেউ কেউ দারুণ ইঁচড়ে পাকা; তারা তাস খেলে, গাঁজা কিংবা আফিম খায়। যখন মাঠে মাঠে ফসল কাটার ধুম পড়ে যায় তখন কিন্তু বাগের দুপুরবেলাটা প্রায় নিরালা হয়ে পড়ে। যাদের কাজ নেই, কিংবা কাজের বয়স হয় নি কেবল ওদের দু-চারজনকে তখন বাগে দেখা যায়। দুপুরের গরমে প্রচুর গাব পাকে। তাই ছেলেরা দুপুরেই বাগে এসে গাবগাছে হানা দেয়।
কুটিমিয়া আর গুঞ্জর আলী বাগে ঢুকে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো, কারণ, ওরা দুজন ছাড়া বাগে আজ কেউ নেই; গাছের সবগুলো পাকা গাব আজ ওদের।
প্রকাণ্ড ঝাঁকড়া গাছটাতে দুজনে হুড়হুড় করে উঠে পড়ে। এবার প্রচুর গাব ধরেছে, গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি। দু বন্ধু টুকটুক পায়ে এক ডাল থেকে আরেক ডালে যায়, মগডালে পৌঁছে একটার পর একটা টিপে পরখ করে দেখে পেকেছে কিনা। পাকাগুলো ছিঁড়ে লুংগির কোঁচড়ে গোঁজে, মাঝে মাঝে দু আঙ্গুলের চাপে টাস করে পাকা গাবের পেট ফাটিয়ে চুমুক দিয়ে রস খায়, বিচিগুলো মুখে পুরে নেবুনচুষের মতো চুষতে থাকে।
‘কয়ডা পাইলিরে কুডি?’ জাবর কাটতে কাটতে গুঞ্জর আলী জিজ্ঞাসা করে।
‘আট-দশটার মতন অইবো।’ কুটিমিয়া জবাব দেয়।
‘রসে একদুম টসটস করবার লাগছে, তাই না কুডি?’
‘হ…মি-ডা কী!’ কুটিমিয়া টেনে টেনে বলে।
দুজনের মুখক্রিয়া চলতে থাকলেও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বন্ধ থাকে। হঠাৎ কুটিমিয়ার চোখদুটো চকচক করে ওঠে। একটা চিকন ডালের একেবারে মাথায় বড়ো একটা গাব পেকে হলুদ হয়ে আছে। চিকন ডালটি বেয়ে অতোদূর যাওয়া যায় না, মুহূর্তে মটমট শব্দে ডাল ভেংগে পড়ে যাবে। তবু সে বার কয়েক ঝুলে পড়ে ওটা নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সব চেষ্টাই বার বার বৃথা যায়। টসটসে এ গাবটা পাড়তে না পারলে তার মনে খুব আফসোস থেকে যাবে।
‘ও গুঞ্জর আলী, ক তো দেহি কী করন যায়?’ বলেই সে গুঞ্জর আলীর দিকে তাকায়, আর মুহূর্তের মধ্যে বাগের চারদিক কাঁপিয়ে সে ভয়ে বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠে— 'ও বাবা রে…।’ কুটিমিয়ার পেছনের এক ডালে, যেখানে এতক্ষণ গুঞ্জর আলী গাব পাড়ছিল, সেখানে গুঞ্জর আলী নয়, বসে আছে অন্য একজন, সে হনু পাগলি, তিন বছর আগে যে হনু পাগলি এ গাছের নীচের একটা ডালে ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়েছিল, সেই হনু পাগলি; ফরসা ধবধবে একটা লালপেড়ে শাড়ি তার পরনে। কুটিমিয়ার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, গলায় ফাঁস দিয়ে মরবার সময়ে তার পরনে এমন একটি লালপেড়ে সাদা শাড়ি ছিল, তবে সেটি এত ধবধবে ছিল না, খুব নোংরা আর ময়লা ছিল। অন্য কেউ হলে এখন ভয়ে জ্ঞান হারাতো, পা ফস্কে পড়ে গিয়ে কোমর-হাত-পা-ঘাড় ভাঙতো, মৃত্যুও হতে পারতো। কিন্তু কুটিমিয়া ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে সত্যি, তবু দু হাতে শক্ত করে গাছের ডাল ধরে চোখ বন্ধ করে গলা ফাটিয়ে ‘ও বাবারে’ করে চিৎকার পেড়ে যাচ্ছে।
আচমকা কুটিমিয়ার কাঁধের ওপর একটা শক্ত হাত পড়তেই সে আরো জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। সেই হাত ওর কাঁধ ধরে ওকে ক্রমাগত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কুটিমিয়ার মনে হচ্ছে হনু পাগলির হাতটাতে বাঘের হিংস্র ও ধারালো নখর গজিয়েছে, সেই নখর দিয়ে ওর কাঁধটাকে খামচে চিলেবিলে করে ফেলছে।
হঠাৎ কুটিমিয়া এক পরিচিত কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পায়—‘ও কুডি, তর কী অইছে রে? কী অইছে?’
কুটিমিয়ার প্রাণ বুঝি ধড়ে ফিরে আসে। ওর চিৎকারের শব্দ স্তিমিত হতে থাকে। সে অতি ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখে, গুঞ্জর আলী ওর কাছে এসে কেবলই কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে যাচ্ছে; ভয়ার্ত স্বরে সে বলছে, ‘ও ভাই কুডি, তর কী অইছে? কী অইছে? ডরাইছা? কী দেইক্যা ডরাইছা?’
কুটিমিয়ার ভয় তবু কাটে না। শংকিত চোখে সে পেছনের ডালে তাকায়, সারা গাবগাছের সবগুলো ডালের দিকে তাকায়, নীচের দিকে তাকায়—না, হনু পাগলি নেই। কুটিমিয়ার শরীর তখনো থরথর করে কাঁপছে। কিছুক্ষণ পরপর বুক থেকে অন্তরকাঁপা ভারী দীর্ঘশ্বাস বের হয়। কিন্তু গুঞ্জর আলীকে সে আসল রহস্য খুলে বলে না। শুধু বলে, ‘গুঞ্জর, বাইত্তে যাবি? আমি যাই গ্যা। যাবি তুই?’
কুটিমিয়া তরতর করে গাছ থেকে নেমে দৌড়ে বাড়ির দিকে ছোটে। ফেরার পথে ভয়ে ভয়ে বার বার পেছনে তাকিয়ে দেখে গুঞ্জর আলীও আসছে কিনা। না, গুঞ্জর আলী আসছে না। কুটিমিয়ার মনের ভিতর আরেকটা ভয় দ্রুত দানা বাঁধতে থাকে—এই যে এতক্ষণ যার সাথে গাবগাছে চড়ে গাব পাড়া হলো ওটা আসলে গুঞ্জর আলী নয়, ওটা অন্য কিছু, অশরীরী কিছু ছিল। এই ভরদুপুরে ওটা গুঞ্জর আলীর ছল ধরে ওকে বাগে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই কোনো বড়ো পীর-আওলিয়ার দোয়া আছে, কুটিমিয়া ভাবে, নইলে হয়তো এটা আজ ওর ওপর আছড় করতো, হনু পাগলির মতো ওকেও গাবগাছের নীচের ডালটাতে, কিংবা হয়তো একেবারে মগডালটাতেও উঠিয়ে গলায় ফাঁস পরিয়ে ঝুলিয়ে দিত। সবাই বলতো—আহারে, গরীবের পোলাডা মনের দুঃখে গলায় ফাঁস দিয়া ভবের মাইয়া ছাইড়া চইলা গেছে।
ভৌতিক ঘটনাগুলো ঘটবার বিশেষ বিশেষ ক্ষণ বা প্রহর আছে। এগুলো ঘটে হয় একেবারে নিরালা দুপুরে, অথবা ভরসন্ধ্যায়, ভরা পূর্ণিমা বা অমাবস্যায়, কিংবা রাত্রির মধ্য অথবা শেষ প্রহরে। ভরদুপুরে ঘরের বার হওয়া কুটিমিয়ার জন্য নিষেধ ছিল। এমন এক নিঝুম দুপুরে একটা অতিভৌতিক ব্যাপার ঘটেছিল। সেবারও সে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিল।
চলবে---
কেউ একসাথে পুরোটা পড়তে চাইলে প্লিজ নীচের লিংকে ক্লিক করে ডাউনলোড করুন। বাংলাদেশে ভিপিএন ছাড়া মিডিয়াফায়ার ওপেন হবে না।
ই-বুক (উপন্যাস) : লৌকিক রহস্য; অথবা অলৌকিক