ইতিপূর্বে আপনারা প্রথম পর্ব 'তারকাজরিপ' পড়েছেন। এরপর পড়েছেন রানি ভানুসিংহীর ব্লগ। ‘রানি ভানুসিংহীর ব্লগ’ তো শেষপর্যন্ত একটা ধাঁধাই হয়ে গেল; মুষ্টিমেয় দু-একজন ব্লগার, যেমন কথাকথিকেথিকথন, সোহানী ছাড়া আর কেউ এর মূল রহস্যই ধরতে পারলেন না।
এবার আরেকটি জরিপ করা যাক। এটা ঠিক জরিপও না, কী জিনিস তা নিজেরাই নির্ধারণ করে নিন।
তো, আমাদের সুপার সেলিব্রেটি বুবুজান ওরফে কল্পলোকের রাজনন্দিনী এবার তার জীবনের প্রথম কবিতাটি ব্লগে পোস্ট করলেন। তিনি গতকাল দিবাগত রাতে ১২টা ৪১ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের সময় লেখা সমাপ্ত করিবা মাত্রই উহা ব্লগে পোস্ট কইরা দিলেন। এ যাবতকাল তিনি অসংখ্য গল্প, রম্য, ভ্রমণকাহিনি, ছবি ও গবেষণাধর্মী আর্টিকেল পোস্ট করলেও এ প্রথম তিনি কবিতা লিখলেন। তাঁর লেখার জন্য আমরা, মানে আম-ব্লগারগণ সর্বদাই হাঁ করে থাকি। ব্লগে তাঁর নামডাক এমনই যে, প্রায় প্রতিটি পোস্টেই কোনো না কোনোভাবে তাঁর নাম আলোচনায় উঠে আসে, আর তিনি ঘুমের ভেতরেও স্বপ্নে দেখেন যে কে বা কাহারা ব্লগে তাহাকে নিয়া আলোচনা করিতেছেন, অমনি তিনি ঘুম থেকে একলাফে উঠিয়া পড়িয়া ব্লগে ঝাঁপাইয়া পড়েন।
বুবুজানের পোস্ট মানেই শত শত লাইক আর কমেন্টের বন্যা। ব্লগারগণ উপর্যুপরি হুমড়ি খেয়ে পড়ায় অনেক সময় ব্লগ হ্যাঙ হইয়া যায়। এ টেকনিক্যাল সমস্যার জন্য অতীতে ব্লগ-অ্যাডমিনকে বেশ ঝামেলায়ও পড়তে হয়েছে কয়েকবার।
বুবুজান ব্লগভুবনের রত্নতুল্য একজনা। আমরা সবসময় তাঁর মন যুগিয়ে চলি- যদিবা তিনি অভিমান করে ব্লগ ছেড়ে চলে যান, এ আশঙ্কায়। একবার তাঁর একটা পোস্টে কেউ একজন বে-ফাঁস একটা কমেন্ট করে ফেলায় বুবুজান প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ব্লগ ছেড়ে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন। আমরা অনেক কান্নাকাটি, অনুনয়-মিনতি করার পরও তাঁর অভিমান পড়ে নি, তিনি সব পোস্ট ড্রাফটেড করে চলে গিয়েছিলেন। আমরা তাঁর কথা ভুলে গেছি-গেছি অবস্থায় যখন পৌঁছে গেছি, তখন হঠাৎ একদিন তাঁকে ব্লগে দেখা গেল- কী মনে করে তিনি একা-একাই ফিরে এসেছেন। এ দেখে কয়েকজন দুষ্টু ব্লগার মনে মনে তাঁকে ‘বেহায়িনী’ বলেছিলেন বলে নিউজে প্রকাশ।
তো, বুবুজানের কবিতার নামখানি হলো- ‘আমি কি ডরাই সখী ভুঁড়িঅলা জামাইকে’? তিনি পোস্টের হেডিঙে উল্লেখ করেছেন- ‘আমার স্বরচিত জীবনের প্রথম কাব্যগাঁথা’। কবিতার মাথায় একটা ‘ডিসক্লেইমার’ মেরেছেন- ‘আমার ৩৯ বছরের সাহিত্যিক জীবনে এবং ৪২ বছরের দাম্পত্য জীবনে অনেক চরাই-উৎরাই গুঁড়াইয়া যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছি, ইহা তারই বাস্তব কাব্যচিত্র। ইহা সকলের মগজে প্রবেশ করিবে না। তাই, পাঠকদিগের প্রতি অনুরোধ থাকিল, আমার কবিতা বুঝিবার তরে দয়া করিয়া কয়েকজন মাঝারি মানের কবি, যেমন রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রমুখের কবিতা ভালো করিয়া অধ্যয়ন করিয়া লইবেন। অন্যথায়, আমার কবিতা আপনাদের বোধগম্য হইবে নাহ। বিনীত নিবেদিতা- কবিনি কল্পলোকের রাজনন্দিনী’
ব্লগে কবিতাখানি পাবলিশ হবার সাথে সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে আমরা ভিড় করিতে লাগিলাম। কদাচিৎ কোনো পোস্টে আমার প্রথম কমেন্ট দিতে পেরেছি। তবে, বুবুজানের পোস্টটি পাবলিশ হবামাত্র আমার চোখে পড়ে এবং পোস্ট না পড়িয়াই আমি মন্তব্য জুড়ে দিই- ‘কবি আইনস্টাইনের পর আপনিই প্রথম, যিনি এ বিষয়টি নিয়ে লিখলেন। সত্যি কথা কী, কবি আইনস্টাইনও সঠিক ভাবে মূল বিষয়টা চিহ্নিত করতে সক্ষম হন নি, যেটা আপনি পেরেছেন। হৃদয়ের অকুস্থল থেকে আপনাকে ভূরি ভূরি কদমবুচি ও শ্রদ্ধা জ্ঞেপন করিতেছি। আরেকটা কথা, জীবনের প্রথম কবিতায়ই এরকম বাজিমাত করতে পারেন নি কলাবরিষ্ঠা কবি শায়মা হকও'।
কিন্তু আমার কমেন্ট ‘সেন্ড’ করা যাচ্ছে না। হ্যাং হয়ে গেল নাকি? বারংবার ট্রাই করেও কিছুতেই কিচ্ছু হচ্ছে না। হায়, একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল প্রথম কমেন্ট পোস্ট করার, কিন্তু হলো না।
ইতোমধ্যে বেশকিছু কমেন্ট জমা হয়েছে।
রূপসী নায়ক রাকিব খান। আহ! কবিতা পাঠে মারা গেলাম। আমারে মাইরালাইলেন বুবুজান। এইভাবে কেউ লেখে? অদ্ভুত হাত আপনার। প্রথম কবিতা পড়েই আমি আপনার প্যান হইয়া গেলাম।
ভারপ্রাপ্ত ব্লগার বারভুঁইয়া। আপনি সত্যিই সাহিত্যের শহরে একমাত্র মেয়রনি। আপনি অদ্বিতীয়। একটাই অনুরোধ থাকিবে, প্লিজ প্লিজ প্লিজ নন্দিনী আপু, আপনি অনুগ্রহ করিয়া হাত গুটাইয়া রাখিবেন না। দুহাতে ধুমাইয়া লিখিবেন। আপনি কবিতার রানি। আপনাকে অভিনন্দন হে কবিতার সম্রাজ্ঞী।
লুতুপুতু বেগম। একেবারেই আমার কথা মনের কইছেন বুবুজান। জামাইরে সবসময় দৌড়ের উপর রাখিতে হইবে। জামাইর মানিব্যাগ চেক করতে হবে ঘর থনে বাইরনের সময় একবার, ঘরে ঢুকনের সময় আরেকবার। পুরুষ মানুষরে বিশ্বাস করবেন না। ঘরের বাইরে গেলেই ওরা লুল হইয়া যায়। বুঝলেন কিনা। কবিতা পইড়া আমি মুগ্ধ হইছি। চালাইয়া যান।
--
এভাবে প্রশংসার বন্যায় বুবুজানের পোস্ট ফ্লাডেড হতে থাকে। দেখতে দেখতে পোস্টটা কখন স্টিকি করা হয়েছে তা আমার নজরে আসে নি। আমার কমেন্টটি কেন পোস্ট হচ্ছে না তা বুঝতে পারছিলাম না। ‘এই মহান কবিতাখানি স্টিকি করায় মডারেটরকে ধন্যবাদসহ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি’- কেবল এ জাতীয় কিছু বাণী চোখে পড়লেই তবে ব্যাপারখানা বুঝতে পারলাম।
একের পর এক কমেন্ট পড়ছি, আর কমেন্ট করার কলাকৌশল শিখছি, কবিতা কী ও কত মহৎ তা বোঝার চেষ্টা করছি। এত কমেন্টের রিপ্লাই দেয়া কি সহজ? বুবুজানের রিপ্লাই পাওয়ার জন্যও আমরা মুখিয়ে থাকি। তিনি এখনো রিপ্লাই দেয়া শুরু করেন নি।
কমেন্ট পড়তে পড়তে নীচে নামছি। প্রশংসার বন্যার ভেতর হঠাৎ দেখি একটা কমেন্টে বুবুজানের রিপ্লাই। কমেন্ট করেছেন ব্লগার খাজামিয়া। খাজামিয়া ভাই লিখেছেন- কবিতাটা খুব কাঁচা। তবে প্রথম কবিতা হিসাবে মোটামুটি চলে।
আর যাইবেন কই খাজামিয়া, তারে সমানে ধুইতেছেন জনাব রাজনন্দিনী একাই না শুধু, মনে হইল যেন ব্লগের তামাম ব্লগার ভাই ও বহিনেরা সম্মিলিত জোট পাকাইয়া খাজামিয়ার দরবার ভাঙিয়া চুরিয়া গুঁড়া করিয়া সাড়ে সর্ব্বনাশ কইরা ফালাইতেছেন।
রাজনন্দিনী- আফনে তো কোবতেই চিনেন না বাহে। উপরে নীচে একবার তাকাইয়া দেখেন, ব্লগের বোদ্ধা কবি ব্লগাররা আমার কবিতার উপর কীরকম সারগর্ভ প্রশংসা করতেছে। জীবনে প্রথম কবিতা লিখলেই যে হেইডা কাঁচা কোবতে হইবেক তা আফনারে কেডা কইয়াছে? এই কোবতে আমার ৩ যুগেরও অধিক কালের সাধনার ফসল। প্রতিদিন আমি একটু একটু করে ভাবিতাম আর নোট রাখিতাম। কবিতাটা ফাইনাল করতেই আমার দীর্ঘ ৪৮ দিন লাগিয়াছে। কবিতা না বুঝিয়া এইরকম উলটা পালটা কথা কইলে উষ্টা মাইরা উড়াইয়া দিমু। তুই আগে ব্যাডা ভদ্রতা শিক। পাগল ছাগল কোথাকার। উনি একজন সমালোচক আইছেন- যত্তসব।
আহ্লাদী আমেরুন্নেচা। অ্যাট দ্য রেট অপ খাজামিয়া। তুমি সত্যিই কবিতা বুজো না। বুবুজানের কবিতা ১ নম্বর কবিতা। বুবুজান আমাদের ব্লগরত্ন। আমি বুবুজানের কোনো পোস্ট মিচ করি না। সময় পাইলেই বুবুজানের পুরোনো পোস্টগুলো খুঁজে খুঁজে পড়ি। যেহেতু আমি একজন লুল ব্লগার, (কারণ, আমি কেবল নারী ব্লগারদের পোস্টই পড়ি), বলতে দ্বিধা নাই, বুবুজানের ব্লগ পড়েই আমি সবচেয়ে বেশি লুলুয়িত হই। এরকম লুলুমি আর কোথাও জোটে না। বুবুজান অনন্য। তার কবিতা অনন্য। আর আপনি একটা হিপোপটিমাস। কারণ, আপনি বুবুজানের কবিতারে কাঁচা কবিতা বলছেন।
ঘরকুনো যাযাবর। ঐ ব্যাটা খাজামিয়া, ফাইজলামির জাগা পাস না বুঝি? বুবুজানের কবিতারে যে কাঁচা কওন যায় না এইডা তুই জানোস না ফাজিলের হাড্ডি। বুবুজানের কবিতাটা একটা ইতিহাস। এইরকম উৎকৃষ্ট কবিতা ব্লগে এই প্রথম। কা_ভা ভাই পর্যন্ত এমন কবিতা লেখতে পারে নাই। আর তুমি আইসা হাজির হইছাও- এইডা একটা কাঁচা কবিতা। তোমার ব্যান দাবি করছি।
--
এরপর, আলোহীন নক্ষত্র, টপ ব্লগার লালচান, পেটমোটা বান্দর, ঘিলুহীন বিজ্ঞানী, মেহেরজান, প্রমুখ অগণিত ব্লগাররা খাজামিয়াকে কাঁচি দিয়া ছুঁইল্যা কাইট্যা লেবুযোগে লবণ দিতে লাগলেন। বুবুজানের কবিতাকে সমালোচনা করার পরিণতি সে বুঝুক রন্ধ্রে রন্ধ্রে চর্মে চর্মে এবং মর্মে মর্মে।
বুবুজানের ৮ লাইনের কবিতাটা আমি আবার মনোযোগ দিয়ে পড়লাম।
আহারে আমার আদরের সোয়ামি
তোমারে আমি অনেক ভালোবাসি
তার চাইতে ভালোবাসি শিপন শাড়ি
তোমারে আর ভাত রেঁধে খাওয়াব না
আমি এখন নারীর অধিকার চাই
তুমি এখন থেকে কানে দুল পরবা
আমাকে তিনবেলা রান্না করে খাওয়াবা
জাগো নারী বাংলার ঘরে ঘরে ও ব্লগে
বুবুজান তাইলে তাঁর ভুঁড়িঅলা জামাইরে ঠ্যাঙাইতে চান? ভালোই তো! আমি আমার আগের কমেন্ট আর ট্রাই করলাম না। ব্লগে এত তোঁয়াচ করে লাভ কী? জীবনে তেলানো তো কম হইল না। এবার একটু রিয়েলিস্টিক ও গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে, ব্লগের সার্বিক মান উন্নয়নের জন্যই। সবাই সমালোচনা যেমন সহ্য করতে পারেন না, সবাই তেমন সমালোচনা পাবার যোগ্যও না। আবার সবাই যদি তোষণকারীই হয়, তাহলে দেশে তেলের দাম আর কখনোই স্থিতিশীল হবে না। কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। যে আদর পাবার যোগ্য, তাকে উৎসাহিত করতে হবে পরিমিত প্রশংসা দিয়ে; যারা খাটাস প্রকৃতির, তাদের লাফাইবার সুযোগ না দিয়ে শুরুতেই পা আর দাঁত ভেঙে দিতে হবে, নইলে তারা প্রশংসার মূল্য বুঝবে না কোনোদিনই।
এ বস্তুর জন্য কোনো গঠনমূলক সমালোচনার দরকার নেই, ওরে মুগুরপেটা করে সোজা করতে হবে। ও নিজেরে ‘মুই কী হনুরে’ ভাবতেছে। নিজে হইল অভদ্রের একশেষ, আবার খাজামিয়ারে ভদ্রতা শিখতে বলতেছে। এদের দুইগালে একটানা থাপড়াইতে হইবে যতক্ষণ না পাটিসমেত বত্রিশখানা দাঁত উৎপাটিত হয়। Be slapped until 32 teeth including jaws fully smashed.
আমি লিখলাম- লিখছেন তো একটা বালছাল কবিতা, এত লাফাইতেছেন কেন? বালছাল কবিতারও একটা মান থাকে, এটা তো কিছুই হয় নাই।
এবার আমার কমেন্ট পোস্ট হতে সমস্যা হলো না। আমার কমেন্টটা একনজর দেখে সারাজীবনের জন্য এই ফয়িন্নির ব্লগ ছেড়ে চলে এলাম।
২৮ এপ্রিল ২০১৮
**
দেখতে পারেনঃ ই-বুক তারকাজরিপ ব্লগীয় রঙ্গ
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৮ দুপুর ১:৪৬