একেবারে শেষ মুহূর্তে আমাদের অনিবার্য প্রেম-সম্ভাবনা চিরতরে তিরোহিত হয়ে গেল অতি তুচ্ছ একটা কারণে। কারণটা আমার কাছে যদিও ‘তুচ্ছ’ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার আরাধ্য ব্লগকন্যা এটিকে এক এবং একমাত্র কারণ হিসেবে ধরে নিয়ে তার লাভার-লিস্ট থেকে আমাকে ডিলিট করে দিয়েছে।
ব্লগকন্যাকে নিয়ে একটা গল্পের প্লট ফেঁদেছিলাম। এটা পাঠ করে ব্লগকন্যা হিরোশিমার আণবিক বোমার মতো বিস্ফোরিত হলো।
‘এই তর আমারে নিয়া গল্প লেখা? তুই একের ভিতর পাঁচজনের কথা লিখছস। অর্থাৎ তর বিবির সংখ্যা ৫জন। কিন্তু আফসোস, ঐ ৫জনের মধ্যে আমি নাইক্যা। আমি তর গল্পখানা ৩৩বার পড়ছি, কিন্তু আমারে নিয়া তুই একটা শব্দও লিখিস নাই। ফেইসবুকে এখন আমি সর্বকালের সেরা সেলিব্রেটি। ‘আমি গোসল করছি’- এমন একটা মামুলি স্টেটাসেও ঘণ্টায় সাড়ে সাতহাজার ‘লাইক’ পড়ে আর ১৫শ শেয়ার হয়। নিজের রেকর্ড নিজে ভাইঙ্গা গিনেস বুকে ৩বার নাম লিখাইছি। তুই ভুইলা গেছস যে তর যে কোনো স্টেটাসে সবার আগে আমিই লাইক আর কমেন্ট দিতাম। সেই আমি’রে তুই অবজ্ঞা করলি? অপমানে আমার শরীর জ্বইলা যাইতেছে। যাক, ভালোই করছস। তর সাথে আমি আর নাইক্যা। তুই তর ৫বিবি নিয়াই থাক। আজ থেকে তরে আমি তিন-তালাক দিয়া জন্মের লাইগ্যা ব্লক মারলাম।’
বোঝেন অবস্থাটা। যার সাথে বিয়ে তো দূরে থাক, প্রেমও হয় নি, সেই মেয়ে আমাকে তিন-তালাকসহ ব্লক করে দিল? যদিও তার প্রতিটা অভিযোগই খণ্ডনযোগ্য, কিন্তু আমাকে ব্লক করে দেয়ায় তাকে আর ইনবক্স করা গেল না। এ নিয়ে স্টেটাস হয়তো একটা দেয়া যেতে পারে, কিন্তু স্টেটাসও তার গোচরীভূত হবে না, যেহেতু সে আমাকে দেখতে পাবে না। এমন অবস্থাটাকে কী বলা যায়? ফেবুর করাত?
তার ‘৫জন বিবি’ সংক্রান্ত কথাগুলো অশ্লীল, রুচিবহির্ভূত, বিদ্বেষমূলক এবং সতীন-ভাবাপন্ন বা সতীনদাহের সমতুল্য। আমি এ কথার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করছি।
৫জন না, অন্তত ৫০জন মানসীর মানসিক ও শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে একত্র করে একজনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছি। এখানে একটু চালাকি আছে বৈকি, যারা বুদ্ধিমান ও ট্যালেন্টেড তারা সহজেই এই চালাকিটা ধরতে পেরেছেন এবং তা নিয়ে ইনবক্সে বিস্তর মত বিনিময় করেছেন।
আসলে পুরো ব্যাপারটা হলো রাশিফল বর্ণনার মতো। আপনি যে রাশির জাতকই হোন না কেন, যেটি পড়বেন সেটিই মনে হবে আপনার সম্পর্কে বলা হয়েছে। গল্পে যে গুণবতী প্রমীলাকে চিত্রায়িত করা হয়েছে, তা মেয়েদের কমন বৈশিষ্ট্য। যে পড়বে তারই মনে হবে গল্পটি সম্ভবত তাকে নিয়ে লেখা। গল্পে মেয়েদের আকাঙ্ক্ষিত গুণগুলো হাইলাইট করা হয়েছে; কোনো কোনো গুণ হয়তো কারো মধ্যে অনুপস্থিত থেকে থাকবে, কিন্তু মনে মনে তারা নিজেদের মধ্যে ঐ গুণগুলোও কামনা করবে।
ফেইসবুক ও ব্লগের পাঠকের অনেক বড় একটা দুর্বলতা দেখতে পেলাম। যারা নীলপরীর ভক্ত, তারা সব মেয়ের মধ্যেই নীলপরীর গুণাবলি দেখতে পান। অতএব, তারা ধরেই নিলেন যে, গল্পটি যাকে নিয়ে লেখা হয়েছে সে হলো এক এবং অদ্বিতীয়া নীলপরী অমৃতভাষিণী।
আবার যারা নীলপরীকে চিনেন না, কিন্তু তাহমীনার একনিষ্ঠ ফ্যান, তারা ভাবলেন- তাহমীনা রীমা - এমন কবিতার মতো মেয়েটি, সর্বগুণে গুণান্বিতা মহিয়সী পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর কেউ নেই।
মালতী ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে ঘাড়খানি সামান্য কাত করে দাঁড়িয়েছিল। মুখ ছিল ঈষৎ অবনত। তার মুখের হাসি মোনালিসার জগৎবিখ্যাত হাসিকে ম্লান করে দেয়। ফেইসবুকে তার এ ছবিটি দেখার পর আমার জবান ‘হাঁ’ হয়ে গিয়েছিল। তার কবিতা পড়ে মনে হয়েছিল, বাইরের রূপের চেয়ে তার ভিতরটা আরও অনেক বেশি সুন্দর ও মহিমান্বিত। কবিতার মতো এই মেয়েটিকে দেখে আমি আস্ত একটা বইয়ের নাম ‘কবিতার মতো মেয়েটি’ করে ফেললাম। ফেইসবুক ও ব্লগে তার ছবিসহ কবিতা পোস্ট করলাম। কিন্তু আশ্চর্য, আমার এই তুখোড় পোস্টটি তার চোখ এড়িয়ে গেলো।
একদিন তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বললাম, ‘তোমারে নিয়া এত ব্যাপক একটা কবিতা পোস্ট করলাম, একবার ফিরাও চাইলা না?’ মালতী চটজলদি জবাব দিল- ‘হায় রে, আমি তো জানিই না আপনি আমাকে নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন। দাঁড়ান, আমি পোস্টটা আগে দেখে লই, তারপর কথা বলি।’
মালতি আমাকে ‘আপনি’ করে বললেও আমি তাকে শুরু থেকেই ‘তুমি’ করে বলতাম। সে খুব দ্রুত ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এলো, এবং আমার জন্মতারিখ দেখে যখন জানতে পারলো সে আমার চেয়ে ৩দিনের বড়, বলা নেই কওয়া নেই একেবারে ‘তুই-তোকারি’তে নেমে এলো।
মালতি জানালো, ‘তুমি এত্ত ভালো কেন? আমাকে নিয়ে কবিতা লিখছ, আবার ছবিও দিয়েছ। নিজেকে ধন্য মনে করছি। কী যে ভালো লাগছে, বোঝাতে পারবো না।’
এরপর আমাদের নিয়মিত চ্যাট হতো। ওর মতো একজন সেলিব্রেটি ফেইসবুকারের সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ আছে, আমি নিজেই বরং এ নিয়ে গর্ব বোধ করতাম। কিন্তু অত্যন্ত অমায়িক স্বভাবের মালতী খুব বিনয়ের সাথে বলতো, ‘আরেন্নাহ। আমি আবার সেলিব্রেটি হতে যাব কেন? খালি লাইক-শেয়ার-কমেন্ট দিয়া কি মান বিচার হয়? আবাল পোলাপানগুলা আমার রূপ দেইখা লাইক মারে। আমিও একটু চালাকি করি। লাই দিয়া ওদেরকে মাথায় তুইলা নেই।’
মালতী দিনে দিনে প্রস্ফুটিত হতে থাকলো। আগে সে সামান্য ‘মুটকি’ ছিল; কিছুদিন আগে জ্বরে পড়লে শুকিয়ে আরও স্লিম ও সুইট হয়ে ওঠে। সকালবেলা ফেইসবুকে ঢুকে সদ্যতম ছবির জন্য মালতীর হোমপেইজে ঘোরাঘুরি করি। মিষ্টি হাসি। বুক ভরে যায়। মালতীর প্রতি আমি ক্রমশ দুর্বল ও ধাবিত হতে থাকি। আমার প্রতি ওর আচরণে মনে হয় সেও যে-কোনোদিন বলে ফেলবে- ‘তরে খুব ভালো লাগে। তরে এতো ভালো লাগে ক্যান রে? তুই কি জাদু জানোস?’
মালতীকে নিয়ে যে গল্পটির প্লট করেছিলাম, তাতে সযতনে মালতীকে উহ্য রেখেছি। মালতীর কী প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখাই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য। মালতী আমাকে সত্যিই খুব ভালোবেসে ফেলেছিল। তা না হলে ওর প্রতিক্রিয়া এতো ভয়াবহ ও বিধ্বংসী হতো না।
কিন্তু মালতি এটা কী করলো- আমাকে একেবারে ব্লকই করে দিল! ওর মনে যে বিষও ছিল তা কি আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম?
২৩ জুলাই ২০১৫
**
'কালের চিহ্ন', একুশে বইমেলা ২০১৬
**
কালের চিহ্ন ডাউনলোড করতে চাইলে এখানে ক্লিক করুনকালের চিহ্ন ডাউনলোড লিংক
উৎসর্গঃ এ মুহূর্তে কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৮ দুপুর ১২:২৯