আমরা যে হাইস্কুলে পড়তাম তার নাম মালিকান্দা মেঘুলা মাল্টি লেটারেল হাইস্কুল। আমাদের গ্রাম থেকে হাইস্কুলের দূরত্ব দেড় মাইলেরও বেশি। সে-স্কুলে আবার দুই শিফটে পড়ানো হতো। সকালের শিফটে মেয়েদের, আর দুপুরের শিফটে ছেলেদের।
আমাদের গ্রামের আমরা তিনজন সমবয়সী - আমি, নুরু ও সাইফুল, সব সময় গলায় গলায় থাকতাম, স্কুলেও যেতাম একসাথে। ক্লাস শুরু হওয়ার প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে বাড়ি থেকে রওনা দিতে হতো। ও-বয়সে আমাদের তিনজনের কারো কোনো হাতঘড়ি ছিল না, বাড়িতেও ছিল না কোনো দেয়ালঘড়ি, এমনকি আমাদের নিকট-প্রতিবেশী কারো কাছেও কোনো ঘড়ি ছিল না। সময়ের আন্দাজ করতে হতো সূর্যের অবস্থান দেখে। তাতে-যে সময়ের খুব একটা হেরফের হতো তা কিন্তু নয়। তবে গ্রীষ্মের সময়ে ঠিকই গণ্ডগোল লেগে যেত। সময় পার হয়ে যাচ্ছে মনে করে তড়িঘড়ি ঘর থেকে বের হয় উর্ধ্বশ্বাসে স্কুলমুখে ছুটতাম; স্কুলে গিয়ে দেখতাম মেয়েদের শিফ্ট তখনো ভাঙে নি। কিংবা রাস্তায় কারো হাতে ঘড়ি দেখে সময় জিজ্ঞাসা করলেই দেখা যেত ক্লাস শুরু হওয়ার তখনো অনেক সময় বাকি।
মেয়েদের শিফ্ট ভাঙবার আগেই স্কুলে পৌঁছে গেলে স্কুল গেইটের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ভিন্ন গত্যন্তর ছিল না। তবে মাঝে মাঝে আমরা স্কুলের অদূরে মেঘুলা বাজারে চলে যেতাম; বাজারে যেতে মাত্র দু-তিন মিনিটের পথ। আমরা বাজারে গিয়ে সাইকেল চালনা শিখতাম। নুরু ছিল সবচাইতে বুদ্ধিমান ও কথায় পটু। কিন্তু সাইকেল চালাতে গিয়ে সাইকেলের চেইনে আটকে গিয়ে ও সবচাইতে বেশি পা কাটতো, নখ ফাটাত। সাইফুল আমার চাইতে কিছু কম বোকা নয়, এবং ওর হাত পা-ও আমার চাইতে কম ভাঙে নি। সাইকেল চালনা শেষে তিনজনে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে স্কুলের দিকে ছুটতাম, পাছে আবার অ্যাসেম্বলি প্যারেড শুরু হয়ে যায়।
আমরা তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। গ্রীষ্মকালের ঘটনা। আমরা তিনজন - আমি, নুরু ও সাইফুল বার বার সূর্যের দিকে তাকাই আর সময় পার হয়ে যাচ্ছে ভেবে দ্রুত পায়ে স্কুলের দিকে ছুটে চলি। কখনো মৃদু দৌড় দিই। মেইন রোডে উঠে দেখি আমাদের আগেপিছে অন্য কোনো স্কুলগামী ছাত্র নেই। আমরা নিশ্চিত আজ ঢের দেরি হয়ে গেছে- প্রথম ক্লাসটি নিশ্চয়ই এতক্ষণে অর্ধেক শেষ। বেতিয়ে স্যার আজ আমাদের পিঠের চামড়া তুলে নিবেন।
আমরা ত্রস্ত পায়ে প্রায় দৌড়ে ছুটতে লাগলাম।
স্কুল গেইটে পৌঁছেই একেবারে আহাম্মক বনে গেলাম। গেইটের দারোয়ান মুচকি হেসে আমাদের উদ্দেশ্যে বলে বসলো, এত্ত সকালে স্কুলে আইছো ক্যান? বাড়িতে মন টিকে না?
তার কথায় আমরা ভীষণ লজ্জা পাই। কিন্তু নুরু হলো দারুণ বুদ্ধিমান। দারোয়ানের হাতে বইগুলো সঁপে দিয়ে সে তাকে বলে, চাচা, বইগুলো রাখেন তো। আমরা সাইকেল চালনা শিখতে যাইতেছি।
নুরুর উপস্থিত বুদ্ধিতে আমরা চমৎকৃত হই; আমার আর সাইফুলের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে আনন্দ জেগে ওঠে। দারোয়ানকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে নুরু বলে, ধূর, তোগো জন্য লেট হইয়া গেল। আরো আধঘণ্টা আগে আসতে চাইছিলাম, তোরা আসলি না। আসলে প্রায় পাক্কা এক ঘণ্টা সাইকেল চালানো যাইত।
নুরুর কথায় আমি আর সাইফুল পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি এবং প্রচুর মজা পাই। আসলে নুরুর মত পণ্ডিত সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনেক।
সেদিন আমরা পুরো এক ঘণ্টা সাইকেল চালনা শিখলাম। তারপরও দেখি ক্লাস শুরু হতে আরো আধঘণ্টার মতো বাকি।
পরিশ্রান্ত ও ঘর্মাক্ত অবস্থায় স্কুল গেইটে এসে দেখি সবেমাত্র মেয়েদের শিফ্ট ভাঙলো। দারোয়ানের কাছ থেকে বই নিয়ে আমরা তিনজন গেইটের উলটো পাশে একটি বাঁশঝাড়ের নীচে দাঁড়ালাম। সেই বাঁশঝাড়ের পাশেই একটি পুকুর ছিল। কচুরিপানায় পুকুর ভর্তি। একদল লোক সেই পুকুরের কচুরিপানা তুলছিল, তীরে দাঁড়িয়ে ছোটো ছোটো বহু ছেলেমেয়ে কচুরিপানার ঝোপের মতো শিকড়গুচ্ছের ভিতর কইমাছ খুঁজছিল। আরো অনেকে সেই দৃশ্য দেখছিল। নুরু কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল টের পেলাম না। তবে আমি আর সাইফুল পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে কচুরিপানা ওঠানো ও তা থেকে কইমাছ খোঁজার দৃশ্য দেখতে লাগলাম, একান্ত নিবিড় চিত্তে।
এই আবু!
হঠাৎ আমার নাম ধরে ডেকে কে যেন আমার কাঁধে হাত রাখে। ঘুরে তাকিয়ে দেখি হাসিনা আপু।
আমাদের গাঁয়ের হাসিনা আপু খুব মেধাবী ছাত্রী। প্রায় আট-দশ গ্রামের মেয়েরা এই স্কুলে পড়ে, এবং এত মেয়েদের মধ্যে তাঁর রোল নম্বর বরাবরই এক হয়ে থাকে।
হাসিনা আপু আমাকে খুবই স্নেহ করেন। যখনই তাঁর সাথে দেখা হয় তখনই আমাকে ডেকে অনেক উপদেশ দিয়ে থাকেন; আমার পড়াশুনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, এমনকি আমাদের বাড়ির ব্যাপারেও নানা বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
আমাদের তিনজনের বাড়িই গ্রামের একেবারে দক্ষিণ মাথায়, ধাপারি খালের কোল ঘেঁষে; আর হাসিনা আপুদের বাড়ি গ্রামের উত্তর পাড়ায়, চকের ধারে।
হাসিনা আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার নতুন মা তোমাকে আদর করেন তো?
আমার মা মারা গেছে অনেক দিন। ভাই-বোন আর সংসারের দেখ-ভাল করা একা বাবার পক্ষে খুব কষ্টকর ছিল। আমার ফুফু আর চাচিরা তাই জোর করে বাবাকে আবার বিয়ে করিয়েছেন।
আমি বললাম, মা আমাকে খুব আদর করে।
শুনে হাসিনা আপু খুশি হলেন। তারপর হেসে হেসে বললেন, ঠিকমতো পড়াশুনা করছো তো, নাকি খালি ঘুড়ি ওড়াও?
আমি মাথা নীচু করে নরম স্বরে বললাম, করি।
তুমি কিন্তু আমাদের গ্রামের গর্ব। ফার্স্ট হতে পারলে চারদিকে আমাদের গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়বে। বুঝেছ?
জি।
আর তোমাকে না বলেছি যখন যা লাগে আমাকে বলবে? বলো নি কেন?
আপুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আপু আবার বলেন, অঙ্ক-টঙ্ক সব পারো তো? না পারলে আমার কাছে চলে এসো। তারপর আপু আরেকটু নীচু হয়ে ফিসফিস করে আমার কানে কানে বললেন, তোমাকে একটা স্যান্ডেল কিনতে বলেছিলাম না? টাকা নেই? আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি পরশু বিকেলে আমাদের বাড়িতে এসো। আমি স্যান্ডেল কিনার টাকা দিব।
তারপর সোজা হয়ে বললেন, একদম বোকা ছেলে! কিচ্ছু বলতে চায় না। আচ্ছা চলি... দেখা হবে, কেমন?
আমি হাসিনা আপুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আপুকে আমার কী যে ভালো লাগে! আমার কত সাধ হয়, যদি আমার এমন একটা আপু থাকতো, একদম আমার মায়ের পেটের আপু, তা হলে সে আমাকে কত্ত আদর করতো- হাসিনা আপুর মতো। হাসিনা আপুর মতো আমার আপুটি স্কুলে পড়তো, হাসিনা আপুর মতো তারও ক্লাসে রোল নম্বর হতো এক এবং আমারও যাতে রোল নম্বর এক হয় সেজন্য সেই আপুটি আমাকে অনেক অনেক উপদেশ দিত- আমার রোল নম্বর এক হতো- তখন আমাদের গ্রামের নামডাক চারদিকে ছড়িতে পড়তো।
এইডা কী রে?
সাইফুলের কথায় ওর দিকে ফিরে তাকাই। দেখি সাইফুল উপুড় হয়ে মাটি থেকে একটা সাদা মতো ভাঁজ করা কাপড়ের টুকরো তুলে আনছে। ওটি তুলেই সে ঝাড়া দিয়ে ভাঁজ খুলে ফেলে। দেখি চারদিকে সুন্দর আলপনা আঁকা, মাঝখানে রঙিন ফুলতোলা একটি সুন্দর রুমাল।
হাসিনা আপুর রুমাল। সাইফুল বলে।
এখানে আসলো কই থেকে? আমি বলি।
মনে হয় কথা বলার সময় পইড়া গেছিল। সাইফুল বলে।
রুমালটা খুব সুন্দর রে! বলেই সাইফুলের হাত থেকে রুমালটা আমার হাতে নিয়ে আমি নেড়ে চেড়ে দেখি- আর অকস্মাৎ আমার নাকের মধ্যে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগে- আমার মনে হলো এমন স্বর্গীয় ঘ্রাণ বোধ হয় ত্রিভুবনের অন্য কোথাও নেই। আমি রুমালটি নাকের কাছে নিয়ে দীর্ঘ টান দিয়ে দিশেহারা হয়ে যাই...
এবার সাইফুলের মুগ্ধ হবার পালা। আমার হাত থেকে ফেরত নিয়ে সে ওটা ওর নাকের কাছে ধরে তেমনি দীর্ঘ এক টান দিয়ে বলে, ইশ, কী সুন্দর খুশবো রে?
সাইফুল বলে, বাড়িতে যাইয়া আপু রুমাল না পাইলে খুঁজবো না?
আমি বলি, এক কাজ কর, এক দৌড়ে আপুকে রুমালটা দিয়া আয়।
সাইফুল চিন্তিত ভাবে বলে, তুই যা। আমি তো আর তোর মতো দৌড়াইতে পারি না।
আমার বই ধর। আমি বলি।
সাইফুলের হাতে আমার বই গছিয়ে দিয়ে রুমালটি নিয়ে ভোঁ ভোঁ করে হাসিনা আপুর দিকে ছুটলাম।
আপুকে পেয়ে তাঁর হাতে যখন রুমালটি দিলাম আপু ওটা হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, তুমি তো দেখি আস্ত পাগল ছেলে! একটা রুমাল দিবার জন্য কেউ এতখানি দৌড়ে আসে?
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, এত সুন্দর একটা রুমাল হারাইয়া গেলে আপনার মন খারাপ হইব না? তাই সাইফুল বললো দিয়া আসতে।
আপু হেসে দিয়ে বললেন, পাগল! তারপর রুমালটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, এত কষ্ট করে তুমি রুমালটা ফেরত দিতে এসেছ, আমি খুবই খুশি হয়েছি। খুশি হয়েই এটা তোমাকে আমি উপহার দিলাম, কেমন?
আমি বিস্মিত হয়ে বলি, এত সুন্দর একটা রুমাল আপনি দিয়া দিবেন? কী দারুণ ঘ্রাণ রুমালটার মধ্যে!
আপু খিল খিল করে হেসে উঠে বলেন, এটা তো দিলামই, যদি এবার ফার্স্ট হতে পারো তাহলে তোমাকে এর চেয়েও সুন্দর একটা রুমাল দিব। এখন যাও, অ্যাসেম্বলি তো পাবে না, তাড়াতাড়ি যাও।
আমি রুমালটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আবার বলি, আপু, এটা নিয়া যান। আমারে পরে দিলেই হইব।
আরে ধূর বোকা- যাও- বলেই আপু চলে গেলেন।
স্কুলে এসে দেখি অ্যাসেম্বলি প্যারেড শুরু হয়ে গেছে। সবাই স্থির দণ্ডায়মান। কেউ একচুল নড়ছে না। এ অবস্থায় ঢোকা যায় না। অ্যাসেম্বলি প্যারেডে অনুপস্থিত- শাস্তি অবধারিত।
অবধারিত শাস্তি ভোগ শেষে ক্লাসে ঢুকলাম। বসলাম সাইফুলের পাশেই। বসতে না বসতেই সাইফুল আমার দিকে করুণ চোখে তাকালো, তারপর আরো করুণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, রুমালটা ফেরত দেস নাই?
জানলি ক্যামনে?
দেখছিস না কত ঘ্রাণ!
আপু ওটা আমাকে উপহার দিছে।
সাইফুলের মুখটা ম্লান অন্ধকার হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর প্রায় কাঁদ-কাঁদ হয়ে সে বলে বসলো, রুমালটা আমাকে দিয়া দে না!
আমি পকেটের ভিতর থেকে বের করে রুমালটা সাইফুলের হাতে দিয়ে দিলাম। কৃতজ্ঞতায় সাইফুল এতই বিহ্বল হয়ে পড়লো যে আমার মনে হলো ওর যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে এই একটা সুগন্ধি রুমালের বিনিময়ে সে আমাকে তামাম পৃথিবী দান করে দিত।
পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট হতে পারলাম না। নয়ন নামক একটা ছেলে মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য আমাকে ডিঙ্গিয়ে ফার্স্ট হয়ে গেছে। হাসিনা আপু আমার ওপর কী যে অভিমান করলেন- প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম হলো। বললেন, তোমার সাথে আমি আর কোনোদিনই কথা বলবো না।
আমারও সেদিন খুব কান্না পেয়েছিল। হাসিনা আপু যদি আমার সাথে জীবনে আর কথা না বলেন তাহলে আমিও বাঁচবো না। এই বেঁচে থাকা আমি চাই না।
এসএসসি পরীক্ষায় হাসিনা আপু খুব ভলো রেজাল্ট করলেন। প্রথম বিভাগ তো পেলেনই, পুরো সেন্টারের মধ্যে প্রায় পাঁচশত ছাত্রীর মধ্যে তিনি প্রথম হলেন। রেজাল্ট বের হবার পর আপু স্কুলে এলেন সবার সাথে দেখা করতে। আপুর সাথে কথা বলার জন্য ছাত্রছাত্রীরা ভিড় করে ফেললো। কিন্তু আমি আপুর সাথে কথা বলতে গেলাম না। আপু বলেছিলেন তিনি আর আমার সাথে কথা বলবেন না।
আমারও ক্রমশ জেদ চাপতে থাকলো। আমাকে ফার্স্ট হতেই হবে।
কিন্তু পরের বারও আমি ফার্স্ট হতে পারলাম না। অন্য কোনো বারও না। ক্লাসে আমার অংশগ্রহণ ও পারফরম্যান্স দেখে বরাবরই সবাই নিশ্চিত থাকে পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট না হয়ে যাই না। কিন্তু রেজাল্ট বের হলে দেখা যায় খুব অল্প নম্বরের জন্য আমি নয়নের পেছনে পড়ে গেছি। এজন্য নয়নও খুব কম ব্যথিত নয়। পরীক্ষার ফল বের হলে আমি যখন খুব ম্লানমুখো হয়ে থাকতাম, তখন নয়ন আমাকে প্রচুর সান্ত্বনা আর অনুপ্রেরণা দিত। সাইফুল আর নুরুর পরে হাইস্কুলের জীবনে একমাত্র নয়নই ছিল আমার ‘প্রাণের বন্ধু’। ও জানতো আমি কীভাবে লেখাপড়া করি। আসলে আমার জন্য লেখাপড়া করাটা ছিল বাড়ির আসল কাজের বাইরে একটি অতিরিক্ত কাজ। বাড়িতে পড়ার জন্য তো সময়ই জুটতো না। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে ঘাস কাটতে যাই, গরু চড়াতে যাই, কখনো বাবার সাথে ক্ষেতে লাঙ্গল চষি, জমিতে শক্ত ইটা ভাঙ্গি। মাঠ থেকে ফিরে তাড়াতাড়ি গোসল সেড়ে হাতেমুখে দু’মুঠো পান্তা গুঁজে স্কুলের দিকে ছুটি; সাইফুল আর নুরু আমার জন্য রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরেই আবার মাঠে যাই গরু নিয়ে। ঘাস কাটি। ক্ষেত নিড়াই। ইটামুগুড়ে ইটা ভাঙ্গি। কেরোসিনের অভাবে রাতে বেশি সময় ধরে বাতি জ্বেলে পড়তে পারি না।
মাঝে মাঝে নয়ন শখ করে আমার সাথে গরু চড়াতে যেত। আমার হাত থেকে কাঁচি নিয়ে ঘাস কাটতে চেষ্টা করতো, মুগুড় কেড়ে নিয়ে ইটা ভাঙতো। কিন্তু পারতো না, যা-ও পারতো তাতে ওর হাত ফুলে লাল হয়ে যেত। আমি ঘাস কাটতাম, ক্ষেত নিড়াতাম, নয়ন আমার পাশে পাশে বসে থেকে আমার জন্য আফসোস করতো। বলতো, তুই আমার চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী রে! আমি সারা দিনরাত পড়ি, তুই তো দেখি পড়বার সময়ই পাস না। তারপরও তোর রেজাল্ট কত ভালো!
হাসিনা আপুর সাথে দেখা করতে সাধ হয়। কিন্তু আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারি নি আজও। তাঁকে মুখ দেখাবার আমার কোনো পথই নেই।
হাসিনা আপুর সাথে তারপর আমার আর কোনো যোগাযোগই রইল না। এসএসসি’র পর আপু শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হলেন, এইচএসসিতে যথারীতি ভালো রেজাল্ট করলেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। আমি তাঁর সব খোঁজখবর রাখি, শুধু হাসিনা আপুই আমাকে ভুলে গেছেন।
মাঝে মাঝে আপুর কথা মনে করে আমি খুব কাঁদতাম। আপুকে কতদিন দেখি না, দেখতে খুব সাধ হয়। দেখবোই বা কীভাবে, আপু থাকেন শহরে শহরে, কালেভদ্রে বাড়িতে আসেন খবর পাই, আমি তাঁর সাথে দেখা করতে যেতে পারি না। আর কেনই বা দেখা করতে যাব, আমার কথা কি আপুর মনে আছে? মনে থাকলে তো অন্তত একবার আমাকে খবর দিতেন, আবু, আমাকে এসে দেখে যাও। খবরই বা দিবেন কেন? আপু কি আমাদের বাড়িতে এসে একবার আমাকে দেখে যেতে পারতেন না? আমি তাঁকে দেখার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে আছি!
হাসিনা আপুর গায়েহলুদের দিন আমার দশম শ্রেণির প্রি-টেস্টের রেজাল্ট বের হলো। নয়নের চেয়ে ৮০ নম্বর বেশি পেয়ে আমি প্রি-টেস্টে ফার্স্ট হয়েছি। আমাকে কেউ অতিক্রম করে ফার্স্ট হলে আমি তার সাথে সহজভাবে মিশতে পারতাম না। কিন্তু নয়নই সর্বাগ্রে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালো। বললো, তুই দেখিস, এসএসসিতে তুই অনেক বড় রেজাল্ট করবি। আমার জন্য শুধু এতটুকু দোয়া রাখিস আমি যেন তোর পিছে পিছে থাকতে পারি। আমার প্রতি সেদিন নয়নের যে অভিব্যক্তি দেখেছি সেজন্য আমি সারাজীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ।
রেজাল্ট পেয়েই আমি ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠলাম, আমি আজ আপুর সাথে দেখা করবোই। আমি আজ আপুর সামনে সগর্বে দাঁড়িয়ে বলবো, আপু, আমি এবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি। বলুন, আমি কি একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র নই? আমার জন্য কি আপনার একটুও গর্ববোধ হয় না?
আমি সারাদিন দোটানার মধ্যে থাকলাম - আপুর সাথে দেখা করবো কী করবো না। আমার মনে একবার অভিমান দেখা দিল, আমি নিজে থেকে আপুর সাথে দেখা করতে যাব না। আমার রেজাল্টের খবর নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপুর কানে পৌঁছে গেছে। আমার ফার্স্ট হওয়ার সংবাদে আপু খুব আনন্দিত হবেন। সাথে সাথে আমাকে ডেকে পাঠাবেন।
পরে আমার ভুল ভাঙলো, আপুর আজ গায়েহলুদ। বাড়িময় কত ব্যস্ততা। এতকিছুর মধ্যে আমার পরীক্ষা আর ফলাফলের ব্যাপারে ভাববার কোনো ফুরসৎ কি আপু পাবেন? তাঁকে কে-ই বা দিবে এই খবর? আরো একটা জিনিস অবশ্য আমি ভাবলাম, আমার কথা আপুর মনে আছে কিনা তা-ই বা কে জানে? তার চেয়ে বরং আমি নিজে থেকেই তাঁদের বাড়িতে গিয়ে উঠি। একেবারে সামনে গিয়ে যখন দাঁড়াবো - আপু খুশিতে অভিভূত হবেন।
আমার মনের মধ্যে আরো একটা ব্যাপারে ক্রমশ অভিমান ঘনীভূত হতে থাকলো। একদিন আপু আমাকে অনেক ভালোবাসতেন, আমি জানি। সেই আপু আজ কী করে আমার কথা এভাবে ভুলে যেতে পারলেন? আজ তাঁর গায়েহলুদ, তাঁর জীবনের সবচাইতে মধুর সময়, আনন্দের ঘটনা, আপুর জীবনের এমন একটা আনন্দঘন সময়ে আমাকে কি আমন্ত্রণ করা উচিত ছিল না? আমি হাসিনা আপুদের কোনো কুটুম্ব নই, তাতে কী? কিন্তু আপু যে আমার কতখানি অন্তর জুড়ে আছেন আর কেউ না জানুক, তিনি নিজে তো সেই কথা জানেন। তারপরও আপু কীভাবে আমার কথাটা একেবারে ভুলে থাকতে পারলেন? এতটা নির্দয় হলেন কীভাবে আমার হাসিনা আপু?
অবশ্য এরও একটা ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করিয়ে ফেললাম। হয়তো আপু ঠিকই আমার খোঁজখবর করেছিলেন। কে জানে, হয়তো কাউকে দিয়ে আমার জন্য খবরও পাঠিয়ে থাকবেন, হয়তো মনের ভুলে আমাকে আর সেই খবরটা কেউ পৌঁছে দিতে পারে নি।
সকল ভাবনার অবসান ঘটিয়ে সন্ধ্যার দিকে হাসিনা আপুদের বাড়িতে গেলাম। সারা বাড়ি সরগরম, আলোতে ঝলমল। মেয়েদের ছুটোছুটি, কলকল খলখল হাসি। দুয়ারের এক কোণে গায়েহলুদ অনুষ্ঠানের মঞ্চ করা হয়েছে। কিছু পরে আপুকে ওখানে এনে বসানো হবে। বরপক্ষের মানুষ এসেছে কন্যার ‘সাজনি’ নিয়ে। তা দেখতে দক্ষিণের ঘরে মহিলাদের উপচে-পড়া ভিড়। ঐ ঘরে কেবিনের ভিতরে নাকি হাসিনা আপু তাঁর বান্ধবীদের সাথে গল্প করছেন, সেই সঙ্গে বরের বাড়িরও কয়েকটা মেয়ে যোগ হয়েছে। এত মানুষের ভিড় ঠেলে আমি ভিতরে কী করে যাই?
আরে আবু যে, কেমন আছ?
আলমগীর ভাই, হাসিনা আপুর বড় ভাই আমাকে দেখে সহাস্যে কলকলিয়ে উঠলেন। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ভাবে কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, খুব খুশি হলাম ফার্স্ট হয়েছ শুনে।
আলমগীর ভাই কারো লেখাপড়ার ব্যাপারে খোঁজখবর রাখবেন এতটা আশা আমরা কখনো কেউ করি না। এসব ব্যাপারে তিনি খুব উদাসীন মানুষ। তাই আমি মনে মনে নিশ্চিত হলাম, সেই আলমগীর ভাইও যেহেতু আমার রেজাল্ট জেনে গেছেন, হাসিনা আপুও নিশ্চিত এটা জানেন। আমি ঠিক বুঝে নিলাম, আমার রেজাল্টের ব্যাপারে হাসিনা আপু বাড়িময় সবাইকে বলে বেড়িয়েছেন, আলমগীর ভাই হয়তো তাঁর কাছ থেকেই এটা জানতে পেরেছেন। আমার অভিমান পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে জেগে উঠতে থাকলো, জানা সত্ত্বেও আমাকে আপু খবর দিলেন না? তাহলে আর তাঁর সাথে দেখা করা যায় না।
আলমগীর ভাই আমার সাথে আলাপ শুরু করলেন। ভিতরে ভিতরে আমি অভিমানে ফুঁসে উঠছিলাম, এখনই, এ মুহূর্তেই এ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যাব। আর কোনোদিনই আপুকে দেখা দিব না। কেউ যদি আমাকে দেখার জন্য পাগলও হয়ে যায়, তবুও না।
আলমগীর ভাইয়ের আলাপ শেষ হয় না, আমিও ছুটে পালাতে পারি না।
কী একটা কাজের জন্য আলমগীর ভাই একবার উঠে গেলেন, আমিও সুযোগ পেয়ে কেটে পড়লাম।
এরপর কয়েকটা দিন আমার মন খুব খারাপ ছিল। তিন সপ্তাহের জন্য স্কুল ছুটি। কোনো কিছুতেই মন বসে না। বইখাতা ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। ঘুড়ি ওড়ানো আমার চিরকালের শখ। বড় একটা ধাউস ঘুড়ি বানালাম। ঘুড়িতেও মজা নেই। পোলো নিয়ে আড়িয়াল বিলে মাছ ধরতে যাই, বড়শিতে মাছ ধরি - কোনোকিছু আমার ভালো লাগে না। এভাবে দশ-বারো দিন কেটে যায়।
পড়ার চেয়ারে হেলান দিয়ে একদিন দুপুরে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমের মধ্যে দেখি আমি মেঘের দেশে চলে এসেছি। কত উঁচু-নীচু পাহাড়ের মতো এই মেঘের দেশ! সূর্যের আলোতে মেঘগুলো কত যে সাদা বলার মতো না। আশ্চর্য, আমি দেখি আমার একটা ছোট নৌকা আছে - সেই নৌকায় বৈঠা বেয়ে বড় বড় ঢেউয়ের ওপর দিয়ে আমি মেঘের ওপর ছুটে বেড়াচ্ছি।
সহসা আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, কে যেন আমার নাক ধরে টানছে। প্রথমে ঝাপসা চোখে তার চেহারা চেনা যায় না। চোখ ডলে পরিষ্কার করে আমি অবাক হয়ে যাই - এ যে হাসিনা আপু! হাসিনা আপু গত পাঁচ বছরে আরো কত সুন্দর হয়েছেন!
আমি ধড়ফড় করে উঠে বসি।
আপুর চেহারায় দারুণ অভিমান ভেসে ওঠে। তিনি বলেন, আমাকে চেনো? বলো তো কে?
হাসিনা আপু - আমি একেবারে সরল ভাবে জবাব দিই।
তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ?
না।
তাহলে আমার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করো না কেন?
আপনি তো দেশেই থাকেন না।
মিথ্যা কথা।
সত্যি।
আমার বিয়েতে গেলে না কেন? আমি হাজারটা খবর পাঠালাম, তোমার কোনো পাত্তা নেই। পরে শুনলাম এক মুহূর্তের জন্য গিয়েছিলে। দেখা করলে না কেন? সময়ের অভাব ছিল? তোমার কি এতই সময়ের অভাব? বলতে বলতে আপুর কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ে। আমি চুপ করে থাকি। মনে মনে বলি, আপু, আমি জানতাম আপনি আমার খবর নেবেন। কিন্তু আমাকে কেউ বলে নি আপনি আমাকে হাজারটি বার খবর পাঠিয়েছেন।
আমার পড়ার ঘরটি খুবই ছোটো। বসার জন্য একটিমাত্র চেয়ার। খুব লজ্জা এবং বিব্রতবোধ হচ্ছিল। আপুকে কোথায় যে বসতে দিই! মাকে ডাকার উদ্দেশ্যে বাইরের দিকে তাকাতেই দেখি দরজার সামনে দুয়ারে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক। তাঁকে দেখিয়ে আপু বললেন, তোমার দুলাভাই।
আমি দুলাভাইকে সালাম দিতেই তিনি সহাস্যে সামনে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, তোমার আপুর কাছে শুনেছি তুমি খুব ব্রিলিয়ান্ট বয়।
আমি বলি, কিন্তু আপুর মতো অত নই।
নো নো ম্যান, তুমি তোমার আপুর চেয়েও ব্রিলিয়ান্ট। তোমার আপু ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পায় নি, তুমি পেয়েছ। তোমার আপু ক্লাস এইটে বৃত্তি পায় নি, তুমি মাশা’আল্লাহ ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়েছ।
কিন্তু আপুর রোল নম্বর বরাবরই ছিল এক-
আরে বুঝলে না, সে তো ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছে। তোমার বেলায় তো আর তা নয়। তোমাকে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে আসতে হচ্ছে। তুমি দেখো, তোমার এসএসসি’র রেজাল্ট আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
আপু আর দুলাভাই আমাকে এরূপ প্রচুর উৎসাহ অনুপ্রেরণা দিলেন। আমি ভীষণ উদ্বুদ্ধ হলাম। আমি আমার আত্মবিশ্বাসে দৃঢ়তা পাচ্ছি ক্রমশ।
বিদায়ের বেলা আপু আমার হাতে একটা জিনিস গুঁজে দিলেন। চেয়ে দেখি একটা রুমাল।
রুমালটা বেশি সুন্দর হলো না। খুব তাড়াহুড়ো করে বুনেছি তো! আপু বললেন।
রুমালটা খুলতেই একটা আশ্চর্য মিষ্টি গন্ধে চারদিক ছেয়ে গেল-
আপু বলেন, পছন্দ হয় নি, তাই না? দেখো, যদি স্ট্যান্ড করতে পারো, আমি পুরো একমাস পর্যন্ত বুনে তোমাকে একটা রুমাল বানিয়ে দিব- ।
আমি বললাম, আপু, এই রুমালটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এর ঘ্রাণটা কী যে ভালো!
আপু রুমালটার মিষ্টি ঘ্রাণের মতো খুব মিষ্টি করে হাসলেন, তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
আমি রুমালটা দু’হাতে নাকের কাছে ধরে লম্বা টান দিলাম - প্রায় পাঁচটি বছর আগে একবার আপুর আরেকটি সুগন্ধি রুমাল আমার হাতে এসেছিল, সেটিতে এমন ঘ্রাণ ছিল। আমি নাকের কাছে রুমালটি ধরে রেখে ভাবতে লাগলাম, হাসিনা আপু, তুমি চলে গেলে, কিন্তু আমার কাছে রয়ে গেলে। তুমি ঠিক দেখে নিও আগামী পরীক্ষায় আমি স্ট্যান্ড করবোই। যদি না করতে পারি, তোমার এই রুমালের কসম - জীবনেও তোমার কথাটি আর ভাববো না - কক্ষণো না।
আমি জানি না হাসিনা আপু আমার কথাটি আর মনে রেখেছেন কিনা। এখন তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন তা-ও জানি না। এসএসসিতে স্ট্যান্ড করতে না পেরে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। স্ট্যান্ড করতে পারলে আপু হয়তো আমাকে আরো একটি সুদৃশ্য, সুগন্ধযুক্ত রুমাল দিতেন, কিন্তু সহসাই একটা রুমালের প্রতি আমার অতিশয় আবেগ কেটে গিয়েছিল। তবে আমি যে-কারণে মর্মাহত হয়েছিলাম তা হলো, স্ট্যান্ড করতে পারলে আমি আপুর কাছ থেকে অশেষ বাহবা, স্নেহ ও ভালোবাসা পেতাম - স্ট্যান্ড করতে না পেরে তা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলাম। যদিও কিছুদিন এ নিয়ে বিষম মন খারাপ করেছিলাম, পরে সব ভুলে যাই।
ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে তখন হোস্টেলে থাকি। ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে আমার টিউশনিটা বন্ধ হয়ে গেলে খুব অর্থকষ্টে পড়ে যাই। সৌভাগ্যবশত সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরপরই একটা ভালো টিউশনি পেয়ে গেলাম। আমার এক রুমমেটের বদৌলতে আজিমপুরের এক পুরোনো ধনী বাড়িতে টিউশনিটা জুটলো। রুমমেট আমাকে সে বাড়িতে নিয়ে বাড়িওয়ালা ও তাঁর স্ত্রী এবং দু মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ছোটো মেয়ে টিনা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী এবং বড়ো মেয়ে হেনা বদরুন্নেছাতে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। অর্থাৎ হেনা এবং আমি একই শ্রেণিতে পড়ি। বলে রাখি, হেনা কিন্তু আমার ছাত্রী নয়, আমাকে পড়াতে হবে টিনাকে।
বাড়িওয়ালাকে পুরোনো জমিদারের মতো মনে হয়; কিন্তু তিনি বিশেষ শিক্ষিত নন, তেমনি তাঁর স্ত্রীও। তারপরও যখন টিনাকে পড়াতে বসি, দেখি বাড়িওয়ালা অথবা তাঁর স্ত্রী পাশে বসে থাকেন। আমি খুব বিব্রত বোধ করি। পড়ানোর সময় কেউ সামনে বসে থাকলে কি সহজভাবে পড়ানো যায়? এঁরা কেন যে খামোখা সামনে বসে থাকেন তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
মেয়েটি পঞ্চম শ্রেণির একটি পুঁচকে মেয়ে, পড়াতে পড়াতে যুগপৎ তার সাথে যাতে আবার প্রেম গড়ে না ওঠে, এঁরা কি সে জন্য পাহারায় থাকেন? আমি ঘৃণাবোধ করতে থাকি।
মেয়েটি পড়াশুনায় বিশেষ মনোযোগী নয়। এর মা-বাবার কাছ থেকেই কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম। আগের শিক্ষকগণ একে পড়িয়ে খুব একটা স্বস্তি পান নি। অতএব, আমার ধারণা হলো আমার সাথেও টিনা অবাধ্যপনা করছে কিনা তা দেখার জন্যই এবং প্রয়োজনে মেয়েকে চোখ রাঙাবার জন্যই পড়ানোর সময় এঁরা সামনে বসে থাকেন। এ ধারণা হওয়ার পর থেকেই আমার মধ্যে সহজ ভাব চলে আসতে থাকে।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমি নিশ্চিত হতে পারলাম যে আমার পারদর্শিতায় টিনার মা-বাবা আমার ওপর বেজায় সন্তুষ্ট। টিনা অবশ্য এতদিন আমার সাথে বেয়াদবিও করে নি, পড়াশুনার প্রতিও তেমন অমনোযোগিতা ও অবহেলা প্রদর্শন করে নি।
একদিন আমি আঁতকে উঠলাম। টিনার পাশে ওর মা কিংবা বাবা নয়, হেনা বসে আছে। হেনার দিকে তাকিয়ে আমি স্মিত হাসলাম, হেনার মুখটি ততখানি স্মিত হলো না যতখানি আমি আশা করেছিলাম; অর্থাৎ সৌজন্য প্রকাশের জন্য মুখে যতখানি হাসি থাকা প্রয়োজন ছিল, হেনার চেহারায় সেরকম প্রসন্নতার কোনো দ্যুতি নেই, কেমন সূক্ষ্ম একটুখানি কাঠিন্য তাতে প্রচ্ছন্ন ছায়ার মতো ভেসে আছে।
প্রতিদিন টিনাকে দু-ঘণ্টা পড়াই। স্কুলের সব পড়া শেষ করে দিতে হয়।
প্রথমে বাংলা। আজ স্কুলে ওদের ‘পল্লীস্মৃতি’ কবিতা পড়ানো হয়েছে। আমি পুরো কবিতাটি লাইন বাই লাইন গদ্যাকারে সাজিয়ে ব্যাখ্যা করে পড়াতে শুরু করলাম। ঝাঁউশাখে, বনলতা, দোল, আম কুড়ানো, সুয়োরানি-দুয়োরানি, শীতের সকালে ভিজনে পিঠে খাওয়া, ইত্যাদি কথাগুলো যখন ব্যাখ্যা করছিলাম টিনা অভিভূত হয়ে সেসব শুনছিল। মাঝে মাঝে সে নিজের থেকেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করলো।
কিন্তু হেনা সেই যে কঠিন দৃষ্টিতে একধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তার চেহারায় আর কোনো পরিবর্তন নেই। তা দেখে আমি আবারও লজ্জিত এবং বিব্রত হই।
এরপর ইংরেজি ধরি। ছোটো ছোটো বাক্যের অতি সহজবোধ্য ইংরেজি। টিনাকে পড়তে বললাম। টিনা বেশ সুন্দরভাবে অর্থসহ পড়তে লাগলো। এক জায়গায় গিয়ে সে থেমে গেল। বললো, স্যার, এই শব্দটার উচ্চারণ কী হবে?
আমি বইটি আমার দিকে টেনে নিই। লাইনটি – Ali is frightened. ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। Frightened শব্দটা আমার ভোকাবিউলারিতে নতুন। প্রথমত এর উচ্চারণ জানা নেই, দ্বিতীয়ত, উচ্চারণটা কাকতালে সঠিক ভাবে করতে পারলেও এর অর্থটা জনবো কার কাছ থেকে? হেনা যেভাবে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে, কোনো কথা নেই, বার্তা নেই, কী জন্য বসে আছে তার কারণও জানা নেই, এ অবস্থায় টিনাকে বলতে পারছি না একটা ডিকশনারি নিয়ে এসো, খুঁজে বের করি। পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি পড়াতে যদি ডিকশনারি লাগে তাহলে আমার বিদ্যার দৌড় সম্পর্কে কি কারো জানতে বাকি থাকবে?
চ্যাপ্টারের ওপরের অংশ থেকে পড়ে আমি যেটা আন্দাজ করলাম তাতে frightened শব্দটার অর্থ হয় ‘বিব্রত’। আমি সাহস করে বলে ফেললাম, শব্দটার উচ্চারণ ‘ফ্রিঘটেনড’। অর্থ হলো ‘বিব্রত’। ‘আলী ইজ ফ্রিঘ্টেনড - আলী বিব্রত’।
টিনা জিজ্ঞাসা করে, স্যার ‘বিব্রত’ কী জিনিস?
‘বিব্রত’ অর্থ বুঝলে না? খুবই লজ্জার মধ্যে পড়া, এত লজ্জা যে বলার মতো না।
টিনা খুব সন্তুষ্ট হলো। সে পড়তে লাগলো - আলী ইজ ফ্রিঘটেনড। আলী খুবই লজ্জার মধ্যে আছে।
আমি বলি, ওভাবে বলবে না, বলবে আলী খুবই বিব্রত।
টিনা বলে, কিন্তু ‘খুবই’ ইংরেজি তো ‘ভেরি’। এই সেনটেন্সে ‘ভেরি’ কোথায়?
আমি বলি ‘ভেরি’ না থাকলেও উচ্চতর ইংরেজিতে বাংলা করলে মাঝে মাঝে ‘খুবই’ যোগ করা যায়।
টিনা বলে ‘উচ্চতর’ কাকে বলে?
আমি বলি, ‘উচ্চতর’ হলো ওপরের দিকের ক্লাস।
‘ও’ শব্দ করে টিনা খুশি মনে পুনরায় পড়তে শুরু করে ।
আমি হাঁফ ছাড়ি।
টিনাকে অঙ্ক করানোর সময় প্রথম বারের মতো লক্ষ করি যে হেনার মুখাবয়ব বেশ সদাশয়। ওর হাতে একখানা বই, বইটি বন্ধ করে আঙুলের ফাঁকে পৃষ্ঠা খুলে ধরে রেখে সে টেবিলের ওপর ভর করে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। সে সর্বপ্রথমে যে কথাটি উচ্চারণ করলো তা হলো, টিনা অঙ্কে একেবারে কাঁচা।
আমার কী যে স্বস্তি লাগলো, অঙ্কে কাঁচা এ মেয়েটির পড়াশুনার ব্যাপারে এ বাড়ির সবাই খুব উদ্বিগ্ন। হেনার কথায় স্পষ্ট ফুটে উঠলো, টিনার জন্য আমার ওপরে তারা খুবই ভরসা করে আছে।
পরের দিন পড়াতে গিয়ে দেখি টিনা একা, ওর মা কিংবা বাবা, কিংবা হেনা কেউ নেই।
টিনাকে জিজ্ঞাসা করি, কী ব্যাপার, আজ তুমি একা কেন?
টিনা একেবারে ইনোসেন্টভাবে তাকিয়ে বলে, আমি তো একাই পড়ি।
তোমার আপু আসে নি আজ?
আপুর আলাদা স্যার আছেন। চারজন। আপু আপনার কাছে পড়বে না।
টিনা আমার কথা ধরতে পারে না বলে এ ব্যাপারে আমি আর কথা বাড়াই না।
কথা প্রসঙ্গে এক ফাঁকে টিনা আমাকে দারুণ একটা সুখবর দিল। বললো, আপনি খুব ভালো টিচার।
ধূর, কী যে বলো?
হ্যাঁ, আপু বলেছে।
ওর আপুর কথায় আমার প্রাণ উদ্বেলিত হয়। কঠিন চেহারার মেয়েটি যে শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যিই আমার ওপর প্রসন্ন হয়েছে তাতেই আমার বেজায় খুশি লাগতে লাগলো।
তবে ইংরেজি পড়ানো শেষ হওয়ার সাথে সাথেই টিনা পুনরায় ইংরেজি বইয়ের পাতা খুলে বলে, দাঁড়ান স্যার, গতকাল একটা ভুল পড়িয়েছিলেন।
ভুল পড়ানোর কথায় আমি চমকে ওঠি। টিনা ইংরেজি বইয়ের পাতা খুলে বের করে - আলী ইজ ফ্রাইটেন্ড। তারপর বলে, স্যার, আপু বলেছে ‘ফ্রিঘটেন্ড’ শব্দটার উচ্চারণ হবে ফ্রাইটেন্ড। এটার অর্থ হলো ভীত।
ভাগ্যিস আজ ওরা কেউ সামনে নেই। তারপরও আমি টিনার কাছে লজ্জায় মিইয়ে গেলাম। এ বাড়িতে ভুল পড়িয়ে পার পাওয়ার উপায় নেই। হেনা মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতী বটে। গতকাল পড়ানোর সময় সে এটা লক্ষ করেছিল, সঙ্গে সঙ্গে আমার ভুল শুধরে দিতে পারতো, কিন্তু ছাত্রীর সামনে আমাকে সে অপ্রস্তুত করে নি। অবশ্য সে আরো বুদ্ধিমতী হলে এ ভুলটি টিনাকে না বলে আমাকেই শুধরে দিতে পারতো। কিন্তু আমি তাতে আরো বেশি বিব্রতবোধ করতাম সন্দেহ নেই, যদিও সেটিই হতো তার জন্য সর্বোত্তম পন্থা।
আমি টিনাকে জিজ্ঞাসা করি, ভীত শব্দটার অর্থ বোঝো তো?
হ্যাঁ, টিনা টেনে টেনে হ্যাঁ শব্দটা উচ্চারণ করে বলে, ভীত শব্দটার অর্থ হলো ভয় পেয়ে যাওয়া। হয়েছে না, স্যার?
হ্যাঁ হয়েছে । ভেরি গুড।
টিনা বলে, স্যার, আমাদের বাসায় চারটি ইংলিশ ডিকশনারি আছে। আপু বলেছে, ইচ্ছে করলে আপনি যে কোনো একটা ডিকশনারি আপনার হোস্টেলে নিয়ে যেতে পারেন।
আমি একটা সূক্ষ্ম ইঙ্গিত বুঝতে পারলাম। আমি যে ইংরেজিতে কাঁচা হেনা তাই বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু হেনা আমার একদিনের ইংরেজি পড়ানো থেকে আমার ওপর এমন একটা নেগেটিভ ইম্প্রেশন নিয়ে ঠিক করে নি। আমি মনে করি ইংরেজিতে আমি ততটা দুর্বল নই, যতটা সে ভাবছে।
টিনাকে পড়ানোর শেষ পর্যায়ে হেনা ঘরে ঢুকলো। তার চেহারায় গতকালের কাঠিন্য নেই, তবে হাসি হাসি ভাবটা কেবল অনুভব করা যায়, সুস্পষ্ট নয়।
হেনা টেবিলে ঠেঁস দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি যেহেতু ঢাকা কলেজের ছাত্র, মাস্ট বি ভেরি ব্রিলিয়ান্ট!
আমি সলজ্জ হেসে বলি, মোটেও না।
বাহ্। ভারি বিনয়ী তো আপনি! বলেই সে প্রথম বারের মতো মিষ্টি করে হাসলো।
আমি বললাম, আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি ব্রিলিয়ান্ট। বদরুন্নেসা কলেজে পড়েন। বদরুন্নেসা কলেজ মেয়েদের জন্য শ্রেষ্ঠ কলেজে। এ কলেজে তো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী না হলে ভর্তি হওয়া যায় না।
শাট আপ। হেনা কৃত্রিম ভর্ৎসনা করে সলজ্জ হাসতে থাকে। ওর হাসিতে মুক্তা ঝরে।
একটু থেমে হেনা বলে, একটা কাজের কথা বলি?
আমি ভয়ে নড়েচড়ে বসি। হেনা বলে, ‘রক্তাক্ত প্রান্তরের’ নোট করেছেন?
আমি অবাক হয়ে বলি, সেকেন্ড ইয়ার তো সবে শুরু। এত আগে রক্তাক্ত প্রান্তরের নোট করবো কেন?
ও-মা, নোট না করেল পড়বেন কী? নোট করার তো এখনই সময়। এরপর শুধু মুখস্থ করবেন। হেনা বলে।
আমি বলি, আমার নোট করার তেমন একটা অভ্যাস নেই। সত্যি বলতে কী, বাংলা ইংরেজির জন্য আমি কোনো নোট করি না। বাজারের নোট মুখস্থ করে পরীক্ষা দিই।
হেনা অবাক হয়ে বলে, ও আল্লাহ, বলেন কী! ঢাকা কলেজের ছাত্রের এই কথা? আমার তো ধারণা ছিল ঢাকা কলেজের প্রত্যেকটা ছাত্র অত্যন্ত পরিশ্রমী, তারা প্রত্যেকে নিজে নিজে নোট করে পড়ে। আপনি বেশ অলস তো! বলে হেনা আরো কৌতুককর হাসি হাসতে থাকে।
আমি দু’দিকে মাথা নেড়ে বলি, স্যরি, আই কা’ন্ট হেল্প ইট।
আচ্ছা বাবা, আমি বুঝতে পারছি যে আপনি আমাকে নোট করে দিবেন না। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্ররা ইউজুয়ালি এ রকম সেলফিশই হয়ে থাকে। তবে আমাকে কিন্তু আপনাকে অবশ্যই একটা কাজ করে দিতে হবে। হেনা হেসে হেসে বলতে থাকলো।
বলুন কী কাজ করতে হবে।
আমার কাছে চার-পাঁচটা নোট আছে। আমার বান্ধবীদের কাছ থেকে ফটোকপি করে এনেছি। আপনি ও-গুলো কনসাল্ট করে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে নোট তৈরি করবেন। এবং অবশ্যই সেটা আপনার জন্য, আমি শুধু তার ফটোকপিটা চাইছি। কোনো অসুবিধা আছে?
আমাকে তো দেখছি না খাটিয়ে ছাড়ছেন না!
অন্তত আমার জন্যও কি একটু কষ্ট করা যায় না? বলতে বলতে হেনার কণ্ঠস্বর নরম ও গাঢ় হয়ে আসে।
হেনা আমাকে একগাদা হাতে-লেখা নোট ধরিয়ে দিল। ও-গুলো ঘেঁটে ওর জন্য নতুন নোট তৈরি করতে হবে। আমার জন্য এ কাজটি নিতান্ত বিরক্তিকর ও কষ্টদায়ক। এর আগে পরের জন্য কেন, আমার নিজের জন্যও কোনো নোট করি নি। তাই বলে যে আমি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাই নি তা কিন্তু নয়। বাজারের বই থেকে মুখস্থ করা উত্তর প্রশ্নপত্রের প্রয়োজন অনুযায়ী লিখে দিয়েছি। সামান্য বুদ্ধি খাটাতে হয়েছে তা স্বীকার করছি। কিন্তু একেবারে ভরাডুবি হয় নি।
কিন্তু হেনার জন্য আমাকে কষ্ট করতে হবে বইকি। কাজটা যে একটুখানি নয় তা হেনা নিজেও বোঝে।
সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরুর আগেই আমি বাংলা দ্বিতীয় পত্রের সিলেবাসভুক্ত নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। নোট বানানোর খাতিরে পুরো বইটা আমাকে হৃদয়ঙ্গম করতে হলো; বইয়ের ভিতরে দেয়া পটভূমিকা, সমালোচনা, চরিত্র-আলোচনা সব কিছু আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে হলো। তারপর হেনার দেয়া নোটগুলো পড়তে শুরু করলাম। সবসুদ্ধ আমার পড়াশুনার ব্যাপ্তি এতখানি হলো যে ‘রক্তাক্ত প্রান্তরের’ ওপর একটা ডিগ্রি পাবার মতো যোগ্যতা অর্জন হয়ে গেলো।
এই এক ‘রক্তাক্ত প্রান্তরের’ ওপর নোট করতে আমার একটানা দু’সপ্তাহের মতো লেগে গেল। ইতোমধ্যে সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। হেনাদের বাসায় যাই। টিনাকে পড়াই। হেনার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই দেখা হয়। তবে আজকাল ওরা কেউ টিনাকে পড়াবার সময় সামনে বসে পাহারায় থাকে না। আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো প্রথম সপ্তাহটি আমার জন্য ‘প্রবেশনারি পিরিয়ড’ ছিল। তাতে যে আমি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে উতরে গেছি আমার প্রতি আজকাল এ বাড়ির সবার মনোভাব দেখেই তা বুঝতে পারি।
হেনা খুব বুদ্ধিমতী। আমি বিব্রত হবো ভেবে সে মাঝখানে নোটগুলোর ব্যাপারে কোনো খোঁজখবর করে নি। সপ্তাহ দুয়েক পর যখন ওর হাতে নতুন-পুরোনো সবগুলো নোট একসঙ্গে দিয়ে দিলাম, হেনা আনন্দ ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। খুব আশ্চর্য হয়ে বললো, সবগুলোর নোটই করে ফেলেছেন?
আমি বলি, সময়টা একটু বেশি নিয়ে ফেললাম নাকি?
হেনা বলে, আমি তো ভেবেছিলাম তিন-চার মাসের আগে এগুলো শেষই করতে পারবেন না।
আমি তৃপ্তির হাসি হাসতে থাকি।
অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই হেনা জানালো, আমি যে নোটগুলো বানিয়েছি সেগুলো অসম্ভব ভালো নোট হয়েছে। হেনার প্রশংসায় আমি ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকি। আকাশে উড়াল দিতে সাধ হয়।
মাস তিনেক কেটে যায়। ইতোমধ্যে হেনাকে ফার্স্ট ইয়ারের বাংলা-ইংরেজির ইম্পর্টেন্ট নোটগুলো করে দিতে হয়েছে। সেকেণ্ড ইয়ারের লিটারেচারের নোটগুলো প্রস্তুত করার জন্যও ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ হই।
এরপর হেনা একদিন হঠাৎ করে একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলো।
বললো, স্যার, আমাকে পড়াতে কি আপনার কোনো আপত্তি আছে?
আমি দুটি কারণে ভীষণ লজ্জা পাই। প্রথমত, হেনা প্রথমবারের মতো আমাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করলো। এতদিন কথা হয়েছে কিন্তু তাতে কোনো সম্বোধন ছিল না। দ্বিতীয়ত, আমি আর সে একই ক্লাসে পড়ি, তাকে আমি কীভাবে প্রাইভেট পড়াই? মাঝে মাঝে একত্রে বসে আলোচনা করা যেতে পারে। তবে পড়ানোর সাথে টিউশনির সম্পর্ক আছে, টাকা-পয়সার লেনদেনের প্রশ্ন জড়িত। হেনাকে পড়ালে বেশ লজ্জায় পড়তে হবে।
হেনা কী বুঝে সঙ্গে সঙ্গে বলে বসলো, নিয়মিত না। এই ধরেন মাঝে মাঝে আমরা দু-একটা সাবজেক্ট নিয়ে টিউটরিয়াল ডিসকাশন করলাম। তাতে আমার যেমন লাভ হবে আশা করি আপনার তেমন ক্ষতি হবে না।
আমি বললাম, আসলে আপনাকে পড়াবার মতো যোগ্যতা কি আমার আছে? আপনি একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। আপনিই বরং আমাকে পড়াতে পারলে আমার খুব ভালো হতো।
হেনা সঙ্গে সঙ্গে আজও বলে উঠলো, শাট আপ। খালি দুষ্টুমির কথা!
হেনাকে পড়াতে আমার কোনো আপত্তি নেই - আমি এই মর্মে তাকে কোনো আশ্বাস না দিলেও সে মাঝেমধ্যেই বই নিয়ে চলে আসে। তবে সে খুব বুদ্ধিমতী, টিনাকে পড়ানো শেষ হলেই সে আসে। টিনা ছুটি নিয়ে চলে যায়, হেনা পড়তে শুরু করে।
হেনার প্রথম পাঠটি ছিল ফিজিক্সের চৌম্বক ক্ষেত্রের ওপর একটা গাণিতিক সমস্যা। ঐ সাবজেক্টটা আমি কয়েকদিন আগে পড়া শেষ করেছি, অতএব সমাধান বের করাটা সহজ হবে বলেই আশা করলাম।
হেনা বললো, আজ সারাটা দিন এই অঙ্কটার ওপর মাথা ক্ষয় করলাম। কিচ্ছুতেই হচ্ছে না।
আমি সমস্যাটা পড়লাম। আমার বইয়ে এ অঙ্কটা নেই। তবে এটা যে অত্যন্ত কঠিন একটা অঙ্ক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করলাম। এত বড় সমাধান আমি ফিজিক্সে এর আগে করি নি। আমার কলম ছুটে চলছে। হেনা গালে হাত দিয়ে একধ্যানে খাতার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর হাতের কাছে বইটি। মাঝে মাঝে বইয়ের দিকে তাকায়, ওখানে উত্তর দেয়া আছে।
প্রায় চল্লিশ মিনিট পর অঙ্ক কষা শেষ করে মাথা সোজা করে বসলাম। হেনা মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, স্যার, আপনি যে কত ব্রিলিয়ান্ট তা আপনি জানেন না। আমার ফিজিক্সের টিউটর গত তিনদিন ধরে ঘাঁটাঘাঁটি করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। জেদ করে আমি নিজেই আজ সারাদিন কমপক্ষে বিশ বার এটা করার জন্য অ্যাটেম্প নিয়েছি। আর আপনি মাত্র একবারের মাথায়ই...
আমি যদিও খুব গদগদ হয়ে উঠি, কিন্তু বলি, একটা অঙ্ক নিয়ে এত যুদ্ধ করার কারণ কী? তাছাড়া এটা পরীক্ষায় আসবেও না; এত বড়ো অঙ্ক পরীক্ষায় আসে না।
হেনা আভিভূতের মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
এরপর থেকে আমার কাছে হেনার পড়ার কৌশলটা পালটে গেল। ওর যখন আমার সাহায্যের প্রয়োজন পড়তো সে আমাকে বলে দিত, স্যার, আগামীকাল অমুক সাবজেক্টের তমুক চ্যাপ্টারটা আমাকে বোঝাবেন। একটু প্লিজ প্রিপারেশন নিয়ে আসবেন। আমি যথা আজ্ঞা কাজ করতাম।
দিন চলতে থাকে। হেনা আমাকে নিয়মিত কষ্ট দেয় না, মাঝে মাঝে দেয়।
এভাবে একদিন পড়ানোর সময় হেনা প্রশ্ন করে বসে, স্যার, আপনি এত ভালো বাংলা শিখলেন কোত্থেকে? আপনার বাংলা নোটগুলো পড়ে মনে হয় যে, আপনার লেখাগুলোই অরিজিনাল, আর অরিজিনাল লেখাগুলো আপনার নোট। বলে সে মুগ্ধ চোখে মিষ্টি হাসে।
আমি বলি, আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
যেমন ধরুন ‘১৪০০ সাল’ কবিতাটি। আপনার নোট পড়ে যতটা মজা পাই, অরিজিনাল কবিতাটা পড়ে ততখানি পাই না।
আমি হেনাকে থামিয়ে দিয়ে বলি, খবরদার, এ কথা যেন আর কেউ না শোনে। তাহলে রবীন্দ্রনাথকে অপমান করার দায়ে আপনার জেল হয়ে যাবে।
হেনা খুব বিগলিত হয়। অত্যন্ত নিগূঢ় স্বরে সে বলে ওঠে, স্যার, আপনাকে আমার কী যে ভালো লাগে!
আমি থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিই। এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখি কেউ শুনলো কিনা।
তবে মনে মনে আজ সত্যিই আকাশে উড়াল দিলাম। হেনার মতো একটি মেয়ে, যাকে দেখলে একটা অনুপম কবিতার মতো মনে হয়, যাকে কেবল স্বপ্নে পাওয়া যেতে পারে, কল্পনায় ভাবা যেতে পারে (অন্তত আমার জন্য), আমাকে নাকি সেই মেয়েটির খুব ভালো লাগে! আমি বার বার হেনার এই কথাটি বলবার ভঙ্গি মনের পর্দায় উদ্ভাসিত দেখতে পেলাম। আমার মনের মধ্যে বিপুল আবেগ আর আনন্দ সঞ্চারিত হতে থাকলো। জীবনে প্রথম বারের মতো একটি মেয়ে আমার প্রতি অকৃত্রিম ভাবাবেগ প্রকাশ করেছে। আমি ধন্য।
হেনার জন্মদিনে নিমন্ত্রণ পেলাম যথারীতি। সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকেই দেখি বাড়িটি আলোতে ঝলমল করছে, আমন্ত্রিত অতিথিদের হাস্যকোলাহলে সরগরম।
হেনাদের পুরোনো একতলা বাড়িটি পুরোনো জমিদার বাড়ির মতোই। বোধহয় মাত্র বছরখানেক হয়েছে বাড়িটির সংস্কার করা হয়েছে। রঙের চকমকি না থাকলেও বাড়িটিতে বেশ আভিজাত্যের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
বাড়ির মাঝখানে উঠোন। উত্তরের দিকে তিনটি কক্ষ, পশ্চিমেও তিনটি, দক্ষিণ দিকের বিশাল ঘরটি ড্রইং রুম।
সদর দরজায় দাঁড়িয়ে হেনার বাবা আমাকে হাসি মুখে স্বাগত জানালেন। সালাম বিনিময়ের কালেই হেনাকে দেখতে পেলাম। অতিশয় ধবধবে ফরসা একটা শাড়ি পরেছে হেনা, তার চুলের বেণিতে একগুচ্ছ রজনিগন্ধা দারুণ মানিয়েছে। সে যখন মিষ্টি হেসে সামনে এসে দাঁড়ালো, আমার মনে হলো এ কোনো মানবী নয়, একটা জলজ্যান্ত পরী, যার রূপের ছটায় চারদিক আলোকোজ্জ্বল হয়ে আছে।
ভালো আছেন? আমি জড়তাগ্রস্ত স্বরে হেনাকে জিজ্ঞাসা করি। সে তেমনি হেসে জবাব দেয়।
আমার পেছনে আরো কয়েকজন মেহমান এলেন। তাঁরা খুব মিষ্টি সুরে হেনাকে বলতে লাগলেন, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
হেনাও ততোধিক মিষ্টি সুরে বলে, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।
আমি হঠাৎ খুব লজ্জা পেতে শুরু করি। হেনাকে উইশ করি নি সেজন্য নয়, অন্য একটা কারণ আছে। সদ্য যে মেহমানগণ এলেন, তাঁদের প্রত্যেকের হাতে উপহার। এক মহিলা তাঁর উপহারটা হেনার হাতে তুলে দিতেই সে খুব সুন্দর করে ‘থ্যাংক ইউ’ বলে ওঠে। আমি লজ্জা পেতে থাকি, পেতেই থাকি। আমার হাতে কোনো উপহার নেই। উপহারের কথা আমার মনের মধ্যেই আসে নি।
হেনা অপরাপর মেহমানদের দিকে চলে যায়।
হেনার বাবা আমাকে নিয়ে ড্র্রইং রুমের দিকে রওনা হলেন। উঠোনের এক পাশে, প্রবেশপথের কিনারে একটি টেবিল রঙিন চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা আছে। তার ওপর সুদৃশ্য মোড়কে রং বেরঙের নানা উপঢৌকন। একটা উঠতি বয়সী তরুণ চেয়ার নিয়ে পাশে বসে উপহার আর উপহার প্রদানকারীদের নামের তালিকা প্রস্তুত করছে। আমি লজ্জা পাচ্ছি, কারণ আমি ছেলেটির পাশ দিয়ে ড্রইং রুমের দিকে যাচ্ছি, সে আমার দিকে তাকালো, আমি তাকে কোনো উপঢৌকন হস্তান্তর করি নি। সে কি আমার নামও লিপিবদ্ধ করে রাখছে? কারা কারা উপহার দিল না তাদেরও একটা হিসাব রাখা জরুরি। তা থেকে বিনে পয়সায় খাওয়া অতিথিদের পরিচয় পাওয়া যায়। হেনা মেহমানদের সাথে হেসে হেসে কুশলাদি বিনিময় করতে লাগলো।
হেনাকে আজ দারুণ সুন্দর লাগছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে ওর সাথে কথা বলতে, গল্প করতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়, এত মানুষের ভিড়ে হেনাকে একা নিরিবিলিতে পাওয়া সম্ভব নয়। আমার মনে হলো, আজ যদি হেনা আমাকে বলে, স্যার, আসুন আমাকে কয়েকটা অঙ্ক কষে দিয়ে যান, আমি তাকে আজ খুব যত্ন করে অঙ্ক করাবো। ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ যে একটা সার্থক ট্র্যাজেডি এ ব্যাপারে এখন আমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী কোনো ছাত্র-শিক্ষক নেই। এটা নিয়ে আমার মতো এত পড়াশুনা কেউ করেন নি। আমি যখন অতি প্রাঞ্জল ভাষায় হেনাকে এসব ব্যাখ্যা করে বোঝাব সে তখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। এক সময় অস্ফুট স্বরে বলবে, ‘আপনাকে আমার কী যে ভালো লাগে স্যার! আচ্ছা, আপনি এত ভালো কেন?’
অমায়িক স্বভাবের ভদ্রলোক হলেন হেনার বাবা। বাড়ির গেইট থেকে আমাকে ইস্কর্ট করে একেবারে ড্রইং রুমের ভিতর পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। সেখানে আরো অনেক নামিদামি, অভিজাত শ্রেণির অতিথিবর্গ উপবিষ্ট ছিলেন। আমি যাঁর পাশে বসলাম হেনার বাবা আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন - ইনি হেনার জুলুজির টিচার। গাজী আজমল সাহেব।
তাঁকে মুহূর্তে চিনে ফেললাম এবং সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে সঙ্কুচিত হয়ে গেলাম। তাঁকে সালাম দিয়ে বললাম, স্যার, আমার নাম আবুল হাসনাত। ঢাকা কলেজে পড়ি, সেকেন্ড ইয়ার সায়েন্স। হেনার ছোটোবোন টিনাকে পড়াই।
গাজী আজমল সাহেব, সারা দেশ জুড়ে ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণির জন্য অনিবার্য এবং বিখ্যাত বিরাটাকৃতির বায়োলজি পাঠ্যপুস্তকটির যিনি সহোদর গাজী আজমত সাহেবের সাথে যুগ্মভাবে প্রণেতা, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অমায়িক ভঙ্গিতে মধুর হাস্যে যখন আমার সাথে করমর্দন করলেন, আমি ধন্য হয়ে গেলাম। আমরা তাঁর কত নাম শুনেছি। আরো অসংখ্য বড় বড় বই হয়তো তিনি লিখে থাকবেন যার সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই নেই। আমি তাঁর পাশে বসে থেকে যদিও গর্ববোধ করছিলাম, আবার ক্রমশ ছোটো থেকে ছোটোতর হচ্ছিলাম। কী ব্যাপক বিষয় নিয়ে তাঁরা আলোচনায় মগ্ন হলেন - ওয়ার্ল্ড অর্ডার, মিডল ইস্ট পিস প্রসেস, প্রসপেক্টস্ অব সার্ক, ফরেইন রিলেশনস অব বাংলাদেশ, পোভার্টি এলিভিয়েশন, ওয়াটার শেয়ারিং প্রবলেম উইথ ইন্ডিয়া, ইত্যাদি। এসব বিষয়ে আমার জ্ঞান থাকা তো দূরের কথা, এর অনেকগুলো বিষয়ই আমি জীবনে প্রথম শুনলাম। আস্তে আস্তে আরো জানতে পারলাম, এর মধ্যে ঢাকা ভার্সিটির এক প্রফেসর আছেন, বদরুন্নেছা কলেজের এক প্রভাষক। এক কোণে অবশ্য একটি তরুণ ছেলে, আমার মতো গোবেচারা নয়, মাঝেমধ্যে সেও আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। এক পর্যায়ে আমি বুঝতে পারলাম সে বুয়েটের ছাত্র।
ঝলমল রূপে হেনা প্রবেশ করলো। খুব সাধারণ কয়েকটা অলঙ্কার সে পরেছে - এতেই মনে হলো হেনা একটা অসাধারণ রূপসী মেয়ে, স্বপ্নে একে দেখলে ভাবতাম সে একটা পরী, যে এখনই হাত এগিয়ে দিয়ে বলবে, আমার হাত ধরো। তার হাত ধরলে সে আমাকে নিয়ে মেঘের রাজ্যে পাড়ি দিয়ে পরীর দেশে গিয়ে নামবে।
হাস্যোচ্ছল হেনা সালাম জানিয়ে সবার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলো। আমি আজমল স্যারের পাশে বসা। হেনা তাঁকে অভিমানী সুরে বললো, ম্যাডামকে নিয়ে এলেন না কেন স্যার? ম্যাডামকে কতদিন দেখি না।
আরেক স্যারকে সে বললো, স্যার, আপনার শরীরটা কিন্তু শুকিয়ে যাচ্ছে।
কথা অবশ্য বেশিদূর এগুলো না। হেনার বাবা এসে বললেন, মা, সবাইকে নিয়ে চলো। সব রেডি।
হেনা উজ্জ্বল হেসে আজমল স্যারের হাত ধরে বললো, স্যার আসেন।
প্রকাণ্ড একটা কেক বানানো হয়েছে। কেকের চারপাশে অনেকগুলো মোমাবাতি জ্বলছে। পেছনে দেয়ালে চমৎকার শৈল্পিক অক্ষরে লেখা আছে - Happy Birth Day to Hena.
কেকের পেছনে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে হেনা। ওর একপাশে আজমল স্যার। আরেক পাশে ওর বাবা। হেনা ডাকলো, সজল স্যার - সজল স্যার - সজল স্যার, এখানে আসুন প্লিজ। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সজল স্যার ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। হেনা চারদিকে তাকিয়ে আরো কয়েকজনকে ডাকলো। আসলে সবার নাম ধরে ডেকে সে নিশ্চিত হচ্ছে তাঁরা এখানে উপস্থিত আছেন কিনা। কিন্তু যাঁকেই ডাকা হচ্ছে না কেন, তাঁরা কিন্তু সবাই হেনার ঠিক চোখের সামনে দাঁড়ানো। তারপরও তাঁদেরকেই সম্বোধন করার অর্থ হলো- সে যে তাঁদেরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে এটাই বুঝিয়ে দেয়া।
আজমল স্যার বললেন, এবার কেক কাটো। উপবিষ্ট সবাই সুর করে গেয়ে উঠলেন,
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ হেনা
হেনা বললো, বাবা, স্যার আমার সাথে ছুরি ধরুন। তাঁরা হেনার হাতের ওপর হাত রেখে আবার গেয়ে উঠলেন, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ - সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও।
কেক কাটা হলে প্রথমে হেনা স্যারের মুখে কেক তুলে দিল। স্যার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন। তারপর বাবার মুখে, মার মুখে, আরো কয়েকজন স্যার ও আত্মীয়ের মুখে সে কেক তুলে দিল। তারপর কেটে কেটে প্লেটে তুলে একেক জনের হাতে কেক তুলে দিতে থাকলো।
হেনা একেকটা প্লেটে কেক তোলে আর একেক জনের নাম সম্বোধন করে। আমার দিকে চোখ পড়ে, মাঝে মাঝেই পড়ে। আমি আঁতকে ওঠি, এই বুঝি সে আমাকে ডাকে।
অনেক পরে, যখন আমি মনের সাথে প্রবল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলাম, ঠিক তখনই হেনা ডাকলো, আরে হাসনাত স্যার, চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? সামনে আসুন।
মুহূর্তে আমার চোখ ফেটে অশ্রু বের হবার উপক্রম হলো। অনেক কষ্টে অশ্রু সংবরণ করে আমি হেনার দিকে এগিয়ে যাই। হেনা আমার হাতে প্লেটটি তুলে দেয়ার মুহূর্তেই তার দৃষ্টি পড়ে সজল স্যারের দিকে, স্যারের প্লেট খালি হয়ে গেছে। আমার হাতে প্লেট তুলে দিয়েই সে সহাস্যে সজল স্যারের সামনে গিয়ে হাজির হয়; বলে, স্যার, প্লেট দিন, আরো কেক দিই।
সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট পরীক্ষার আগের মাস থেকে আমি টিউশনি বন্ধ করে দিলাম। এখন আমার নিজের পড়ার দিকে নজর দিতে হবে।
এইচএসসি’র পর আবার টিনাকে পড়ানো শুরু করলাম। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। মাঝখানে হেনাকে প্র্যাকটিক্যাল খাতায় সচিত্র নোট করে দিতে হয়েছিল। এগুলো করতে হেনার বেশ বিরক্ত লাগে, সময়ের অপচয় হয়। তাই সে ওগুলো আমাকে দিয়ে করিয়েছিল।
টিনাকে পড়ানো ছাড়া আপাতত আমার হাতে অন্য কোনো কাজ নেই। দু’ঘণ্টার বদলে কখনো কখনো প্রায় চার ঘণ্টার মতো সময় দিয়ে ফেলি টিনাকে।
আরেকটি কথা না বললেই নয়। পড়াশুনার প্রতি টিনার আকর্ষণ পূর্বাপেক্ষা বহুগুণ বেড়েছে। পঞ্চম শ্রেণিতে আগের তুলনায় অনেক বেশি ভালো রেজাল্ট করে সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। এর পেছনে যে একমাত্র আমার অবদান ও প্রচেষ্টা কাজ করেছে তা টিনার মা-বাবা বার বার বলে থাকেন।
টিনাকে পড়ানোর সময় হেনা খুব একটা সামনে আসে না। যদিও বা কখনো আসে, সে একবার উঁকি দিয়ে এক-ঝলক হেসে চলে যায়। মাঝেমধ্যে আবার হয়তো একটা বই হাতে ঢুকে পড়ে। সে একমনে কিছুক্ষণ হাতের বইটি পড়ে, আবার বের হয়ে যায়। টুকিটাকি ছোটোখাটো যে দু-চারটা কথা হয় তা মনে ধরে রাখার মতো নয়।
একদিন অবশ্য পরীক্ষার ব্যাপারস্যাপার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।
হেনা বলেছিল, পরীক্ষা কেমন হলো আপনার?
ভালো। আপনার?
ভালো নয়।
কেন?
ম্যাথ্স ফার্স্ট পেপারে ৫ নম্বরের একটা অঙ্ক কাটা গেছে।
মাত্র একটা?
এখনো পর্যন্ত তাই মনে হচ্ছে। আপনার?
আমার যে কতগুলো সঠিক হয়েছে আমি তার হিসাবও রাখি নি। আমি হাসতে হাসতে বলি।
হেনা বলে, আপনি তো একজন ব্রিলিয়ান্ট বয়, এ স্টুডেন্ট অব ঢাকা কলেজ, রেজাল্ট বের হবার পর দেখা যাবে স্ট্যান্ড করে বসে আছেন।
আমি দাঁতে জিভ কেটে বলি, সর্বনাশ। আমার তো দেখি পালাতে হবে।
কেন?
আপনি আশা করে আছেন আমি স্ট্যান্ড করবো, রেজাল্ট বের হলে দেখা গেল আমি ফেল করে বসে আছি। মুখ দেখানো যাবে?
আপনি খুব বিনয়ী।
ইউ আর সো কাইন্ড।
নট মি, র্যা দার ইউ হ্যাড বিন সো কাইন্ড টু মি।
কেন, কীভাবে?
আপনার নোটগুলো আমাকে খুবই কাজে দিয়েছে।
আরেকদিন হেনার সাথে বহুক্ষণ বেশ অন্তরঙ্গ আলাপ হলো। পাঠ্যপুস্তকের পড়াশুনার বাইরে অন্য বিষয় নিয়ে। তবে নিশ্চয়ই প্রেম নিয়ে নয়।
এখন তো প্রচুর অবসর। কী করেন? হেনা জিজ্ঞাসা করে।
ছাত্রী পড়াই। বলেই দুজনে একত্রে হেসে উঠি।
বই পড়ার অভ্যাস নেই? গল্প-টল্প? হেনা জিজ্ঞাসা করে।
এককালে পড়তাম বইকি। এখন পড়তে ইচ্ছে করে না।
কার বই বেশি পড়েছেন?
শরৎচন্দ্রের।
সুনীল, বুদ্ধদেব গুহ, বৈমাত্রেয় দেবী, হুমায়ূন আহমেদ - এঁদের বই পড়েন নি?
মনে পড়ে না। আসলে বই পড়ার সময় লেখকের নামটা দেখে নেয়ার অভ্যাস আমার কখনো ছিল না।
হেনা হেসে দিল। বললো, খুব অদ্ভূত তো। আপনার মতো একটা মেধাবী ছাত্র এঁদের বই পড়ে নি শুনলে কেমন যেন খটকা লাগে। কোথায় আপনি ইংলিশ থ্রিলার পড়বেন, ওয়ার্ল্ড ফ্যামাস লিটারেচার পড়বেন, সেখানে আপনি বাংলা সাহিত্যই পড়েন না। আচ্ছা, আপনাকে দেখে তো এতখানি বেরসিক মনে হয় না। হাসতে হাসতে হেনা বলতে থাকে।
আমি কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে বলি, অবশ্য আশুতোষ, ফাল্গুনী, নীহার রঞ্জন গুপ্ত এঁদের লেখা বই কিছু কিছু পড়েছি।
আপনি ‘শাপমোচন’ পড়েছেন?
না, তবে ‘চিতা বহ্নিমান’ পড়েছি। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা। একটা চমৎকার বই।
‘শাপমোচন’ও কিন্তু একটা বিখ্যাত বই।
কিন্তু এত বই পড়বো কোত্থেকে? বই কিনতে টাকা লাগে না? টাকা দিয়ে কিনে কখনো বই পড়া হয় নি! যখন যারটা সামনে পেয়েছি, অমনি নিয়ে পড়েছি। বলেই আমি হেসে ফেলি। হাসে হেনাও।
হেনা বলে, আমার কাছে প্রচুর বই আছে। শখ থাকলে নিয়ে পড়তে পারেন। কয়েকটা এনে দিব?
আমাকে দেখি জোর করে পড়িয়ে ছাড়বেন। আপনার সাথে আর পারা গেল না। দিন, যতগুলো খুশি দিতে পারেন। আমি হাসতে হাসতে বলি।
হেনা আমার জন্য চার-পাঁচটা বই নিয়ে এলো। এর মধ্যে একটি হলো বিমল মিত্রের দুই খণ্ডের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘এখানে ওখানে সেখানে’, বাকিগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে গেলাম। এতগুলো বই যখন বগলদাবা করে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম তা দেখে আমার নিজের যেমন হাসি পাচ্ছিল, হেনাও তেমনি কৌতুকপূর্ণ চোখে মিটিমিটি হাসছিল।
আসলে বই পড়ার প্রতি আমার তেমন কোনো ঝোঁক নেই। কাজেই বইগুলো এনে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রেখে অন্য কাজে লেগে পড়ি।
দু-তিন দিন পর রাতে একটি বই পড়া শুরু করলাম। প্রথমে মজা পাই নি, তারপরও যেহেতু একটি মেয়ের হাত ছুঁয়ে বইগুলো আমার কাছে এসেছে তাই পড়তে শুরু করলাম, ধীরে ধীরে তাতে মগ্ন হতে চেষ্টা করলাম। এটি ‘শামোচন’। শেষ পর্যন্ত বেশ উৎসাহের সাথেই বইটি পড়া শেষ করলাম। তারপর আরেকটা শুরু করলাম, শেষও করলাম। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ একটি বৃহদাকার বই। ওটি সবার শেষে পড়বো বলে মনস্থির করলাম।
সপ্তাহ তিনেক পরে বিছানায় শুয়ে হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ বইটি টেনে নিলাম। দু’হাতে বইটি উঁচু করে ধরে পৃষ্ঠা খুলতে গেছি, অমনি ভিতর থেকে এক-টুকরো সাদা কাপড় আমার বুকের ওপর পড়লো- সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা মিষ্টি ঘ্রাণ আমার নাকে এসে লাগলো।
ওটি একটা সাদা রুমাল।
আমি বইটি পাশে নামিয়ে রেখে রুমালটি হাতে নিই। ভাঁজ খুলতেই ভূরভূর করে আরো ঘ্রাণ বেরুতে লাগলো। ভাঁজ খুলে দেখি চারদিকে আলপনা আঁকা সুদৃশ্য ধবধবে রুমালটির মাঝখানে একটি বৃন্তসহ রক্তজবা ফুল, তার ডান দিকে সুন্দর করে ইংরেজি অক্ষরে লেখা, I love you. সহসা আমার বুক ভরে যায়, বিপুল আবেগ আর আনন্দে আমার হৃদয় নেচে ওঠে। মনে মনে বলি, ‘আমি ইহাকে পাইয়াছি’।
হেনার বুদ্ধিমত্তায় আমি যারপরনাই চমৎকৃত হই। আমাকে সে ভালোবাসে এ কথাটি মুখ ফুটে সরাসরি খুলে বলতে লজ্জা পায়। তাই সে একটি কৌশল অবলম্বন করেছে, আমার জন্য একটি রুমাল বুনেছে। রুমালের গায়ে শৈল্পিক অক্ষরে সে তার ভালোবাসার কথাটি লিখে দিয়েছে। গুঁটি গুঁটি অক্ষরে লেখাগুলো খুব সুন্দর ফুটে আছে। অবশ্যই এটি হেনা নিজ হাতে বুনেছে। ওর মায়ের মতো গম্ভীর মহিলার দ্বারা এ যে অসম্ভব তা বলাই বাহুল্য। অন্য কাউকে দিয়েও লেখানো হয় নি, আমি নিশ্চিত। নিজের মনের ভালোবাসার কথাটি ‘আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে’ নিজেকেই রচনা করতে হয়, তাতেই সবচাইতে বেশি আনন্দ। এ থেকে হেনার একটা সুন্দর শিল্পী মনেরও পরিচয় মেলে। আমি শুনেছি, যাদের হাতের লেখা সুন্দর তাদের মনটাও তত সরল, তেমনি যাদের হাতে সুন্দর শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয় তাদের মনটাও হয় ততখানি সুন্দর আর অম্লান। হেনার মতো এমন একটা সুন্দর মনের মেয়ের সাথে প্রেমের সম্ভাবনা জাগ্রত হওয়ায় আনন্দ আর গর্বে আমার অন্তর ভরে উঠতে থাকে।
আমি ভাবলাম, এ রুমালটি প্রকাশ্যে আমার হাতে পৌঁছে দিতে হেনার খুব লজ্জা হয়। তাই সে বুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে আমাকে চার-পাঁচটি বই পড়তে দিয়েছে, বইয়ের ভিতরে লুকিয়ে রুমালটি গুঁজে দিয়েছে, যাতে বই পড়তে পড়তে আমি রুমালটি খুঁজে পাই, আর রুমালটি পেয়েই বুঝতে পারি যে আমাকে হেনা ভালোবাসে! হেনার বুদ্ধির কথা ভাবতে খুব আশ্চর্য লাগে।
আসলে হেনা যে আমার প্রতি একান্ত সদাশয় এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, তার বিভিন্ন কথাবার্তায়, আমার প্রতি আচরণে ও মনোভাবে। অথচ উলটো ওর জন্মদিনে ওর প্রতি আমি মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম আমার সঙ্গে ততটা অন্তরঙ্গ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলে নি বলে। এত মানুষের সামনে কি মেয়েরা প্রেমিকের সাথে অত খোলামেলা ভাবে কথা বলতে পারে? এটা আমার বোঝা উচিত ছিল।
হেনাকে নিয়ে আমি কল্পনার জাল বুনতে শুরু করি। হেনা আমার পাশে বসে আছে। আমার মুঠোর ভিতরে হেনার দুটি হাত। আমরা জোছনা রাতে ছাদের কিনারে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। ‘এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো, সে মরণ স্বরগ সমান।’
আমি আরো একটা বিষয় লক্ষ করি নি, হেনার কাছ থেকে বইগুলো আনার পর হেনা একদিনও আমার সামনে এসে দাঁড়ায় নি। এটাই স্বাভাবিক। মেয়েরা সচরাচর লজ্জাবতী। ভালোবাসার রুমালটি আমাকে দেয়ার পর ওর চোখেমুখে লজ্জা জেগে উঠেছে, তাই সামনে আসতে পারছে না।
আমি রুমালটি নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিতে থাকলাম। এত সুন্দর ঘ্রাণ! আচ্ছা, রুমালে এত সুগন্ধ আসে কোথা থেকে? মেয়েরা কোনো কিছু ছুঁয়ে দিলেই কি তাতে ঘ্রাণ লেগে যায়? আমার রুমমেট প্রায়ই একটা কবিতা আবৃত্তি করে, ‘বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে একদিন বরুণা বলেছিল......’। এটা নাকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা-‘কেউ কথা রাখে নি’। একই সুনীল একদিকে ঔপন্যাসিক, অন্যদিকে কী দারুণ কবি, যাঁর কবিতার টুকরোটি এখন আমাকে ভাবনার রাজ্যে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দ্বাদশ শ্রেণির এক বোবা প্রেমিক আমি এসব ভাবতে থাকি আর কবি হতে থাকি –‘বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে হেনা বলেছিল, আমি তোমাকে আজন্ম ভালোবাসি...’
হেনাদের বাড়িতে যাই। টিনাকে পড়াই। হেনা পড়ার ঘরে আসে না। আমার মনটা আনচান করতে থাকে । হেনা এত নিষ্ঠুর কেন?
টিনাকে জিজ্ঞাসা করি, হেনা কি বাড়িতে নেই?
হ্যাঁ, বাড়িতেই।
দেখি না যে, অসুস্থ নাকি?
আপু সুস্থ আছে। ডাকবো?
না, থাক।
পরদিন পড়াবার সময় হেনা এসে হাজির।
আমাকে নাকি খুঁজছিলেন? হেনা উজ্জ্বল হেসে জিজ্ঞাসা করে।
আমি ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠি, অথচ খুব স্বাভাবিক স্বরে বলি, আজকাল যে দেখাই যাচ্ছে না!
হেনা বলে, অ্যাডমিশন টেস্টের প্রিপারেশন নিচ্ছি। সামনে সপ্তাহেই রেজাল্ট বের হচ্ছে, জানেন তো? রেজাল্ট বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাডমিশন টেস্টের হিড়িক পড়ে যাবে। তাই একটু রিভিশন দিচ্ছি। আসলে আপনার মতো ব্রিলিয়ান্ট নই তো, সব ভুলে গেছি।
আমি কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
হেনা চলে যায়, যাওয়ার সময় ওর ঠোঁটে একটু রহস্যময় হাসির রেখা ফুটে ওঠে, লাজরাঙা সেই হাসি।
কী সুন্দর একটা খেলা চলছে আমাদের মধ্যে। হেনা জানে তার রুমাল আমি পেয়ে গেছি। আমি জানি সে আমাকে ভালোবাসে। হেনাও নিশ্চিত আমি তাকে না ভালোবেসে পারি না। অথচ আমরা কেউ এ ভালোবাসার কথাটি প্রকাশ করছি না।
এক সপ্তাহ নয়, দু সপ্তাহ পরে রেজাল্ট বের হলো। আমি আমার রেজাল্টে সন্তুষ্ট। যেমন প্রস্তুতি, তেমন পরীক্ষা আর তেমন রেজাল্ট। আমি জানি, আমি আরেকটু চেষ্টা ও পরিশ্রম করতে পারলে মেধা তালিকায় হয়তো আমার স্থানটা হয়ে যেতে পারতো। যাকগে সেকথা। এটা আমার নিজের পরিশ্রমের ফল, ভাগ্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
পরদিন হেনাদের বাড়িতে গেলাম। হেনাদের বাড়িতে প্রচুর মেহমান। আজকে কোনো অনুষ্ঠানাদি আছে নাকি? থাকলে তো আমাকে জানানো হতো।
হেনা স্ট্যান্ড করেছে। সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চদশ স্থান অধিকার করেছে সে, মেয়েদের মধ্যে ষষ্ঠ। নিজের রেজাল্টে হেনা মোটেও সন্তুষ্ট না। তার কলেজের সহপাঠিনী ঋতু, এসএসসিতে তার অবস্থান ছিল সতের, হেনার ছিল বারোতম স্থান ছিল, সেই ঋতু হেনাকে ডিঙ্গিয়ে মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে উঠে গেছে। হেনার নাকি আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে।
হেনার একজন স্যার ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আরো কয়েকজন আত্মীয়স্বজন হেনাকে পরিবেষ্টন করে আছেন। আমি হেনাকে দেখতে পাচ্ছি না। ভিড় ঠেলে ভিতরে যাওয়া যায় না।
কিছুক্ষণ পর হেনার স্যার চলে গেলেন। আমার ওপর হেনার দৃষ্টি পড়ে, তৎক্ষণাৎ সে মুখে হাসি তুলে বলে, আরে কী খবর?
ভালো।
শুনেছেন তো আমার খবর। রেজাল্টটা খুব পঁচা হলো। মনের মতো হলো না। ইচ্ছে করছে নিজের মাথাটা নিজেই ফাটাই।
আমি হাসি।
হেনা বলে, স্টার পেয়েছেন তো?
মুহূর্তে আমার মুখটা ম্লান হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বলি, হ্যাঁ, স্টার অবশ্য পেয়েছি।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঢাকা কলেজের একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রের জন্য হেনার প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল, ‘আপনার পজিশন কত হয়েছে?’ কিংবা, ‘স্ট্যান্ড করেছেন তো?’ ও কি তাহলে জানতো যে স্ট্যান্ড করার কোনো ক্ষমতা আমার মধ্যে নেই? মনে পড়ে, হেনা একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার স্কুল, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, এসএসসি’র রেজাল্ট সম্বন্ধে অনেক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। এসএসসিতে আমি একটা সিম্পল স্টার মার্ক্স পেয়েছিলাম। তা নিয়ে এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা যায় না, এটা সে ভালো করেই জানতো। তাহলে প্রায় প্রতিটা কথায়ই কেন সে আমাকে ‘ব্রিলিয়ান্ট বয় অব ঢাকা কলেজ’, ‘ঢাকা কলেজের মেধাবী ছাত্র’- এসব বলতো? কেন বলতো? আমার মন খুব খারাপ হতে থাকে; আমাকে দিয়ে কষ্ট করিয়ে কত নোট লিখিয়ে নিয়েছে হেনা; আমি বুঝতে পারি, সে শুধু নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আমাকে এভাবে তোঁয়াজ ও তোষামুদি করতো। নিজেকেও খুব ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে- হেনার এসব কথায় ভিতরে ভিতরে আমিও যে খুব ফুলে-ফেঁপে উঠতাম, সেটা ঠিক।
সপ্তাহ খানেক পর যখন টিনাদের বাড়িতে গেলাম, টিনা এই প্রথম বললো, স্যার, আজ আর পড়বো না।
কেন?
শহীদ ভাইয়া এসেছেন।
শহীদ ভাইয়া কে?
আমাদের ফুফাতো ভাই।
বাড়ি কোথায়?
অস্ট্রেলিয়া।
মানে?
অস্ট্রেলিয়ায় চাকুরি করেন। বলে সে ভুলের জন্য লাজুক হাসি হাসে।
আমি বলি, পড়া মিস করাটা কি ঠিক হবে?
আমরা আজ বাইরে বেড়াতে যাব।
কোথায়?
বুড়িগঙ্গা নদীতে।
সাঁতার জানো?
না।
ভয় করবে না? যদি নৌকা ডুবে যায়?
ডুববে না, আমরা আগে কত গেছি!
কার সাথে যাবে?
শহীদ ভাইয়া নিয়ে যাবেন।
শহীদ ভাইয়াকে নিয়ে হেনার বাবা হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ গল্পগুজব হলো। শহীদ সাহেব বের হবার পর হেনার বাবা বললেন, ও আমার একমাত্র বোনের একমাত্র ছেলে। মাস তিনেকের মধ্যেই ওদের বিয়ের ব্যাপারটা সেরে ফেলবো ভাবছি।
আমি কিছু না বুঝে তাকিয়ে থাকি। হেনার বাবা বলেন, হেনার অ্যাডমিশনটা শেষ হলেই বিয়েটা সম্পন্ন করে ফেলবো।
আমার মাথা ঘুরে যায়, কিন্তু সামলে উঠি। আমি আজকাল যে কোনো পরিস্থিতিতে খুব দ্রুত সামলে উঠতে পারি।
হেনার বাবা উঠে চলে গেছেন খেয়াল করি নি। হঠাৎ দেখি সামনে দাঁড়িয়ে হেনা, সে সলজ্জ হাসছে।
আমি হেনার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি।
হেনা বসে দু-একটি টুকিটাকি কথা বলছে। সে কী যেন বলতে চায়, ইতস্তত করছে। সে খুব সাবধানী, তার শহীদ ভাইয়া সম্পর্কে কোনো কথাই সে তুলছে না। আমি হেনার মনের ব্যাপারটা সামান্য আঁচ করতে শুরু করি। বলি বলি করেও এতদিন যে কথাটি সরাসরি খুলে বলতে পারে নি, আজ কি হেনা তা-ই বলতে চায়? ভালোবাসা একটা কঠিন সমস্যা, সহজে বলা যায় না, অথচ খুব সহজেই তা অনুভব করা যায়। কবিতার মতো একটি মেয়ে হেনা, তাকে আমি কত আগে পেয়েছি, আমার সকল মনপ্রাণ তার জন্য উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত হয়ে বসে আছি, যেমন বসে আছে হেনা নিজেও, অথচ এ দুটি চোখে কী অপরিসীম লজ্জা এসে ভিড় করে আছে, না পারছি আমি বলতে, না পারছে হেনা। ভালোবাসা কেন এত বোবা হয়? ভালোবাসা কত অসহায়! শহীদ নামক এক অতি ভদ্রলোকের জন্য হেনা বাল্যকাল থেকে বাগদত্তা, অথচ মাত্র এক কিংবা দেড় বছরের মধ্যে নদীর স্রোতের মতো তার মনের গতিপথও ভিন্ন পথে বাঁক নিল।
হেনা খুব নরম স্বরে বলে, স্যার, কিছু মনে করবেন না, একটা কথা বলবো?
আবেগে আমার মাথায় ধরে না এখন হেনা কোন কথাটি বলতে পারে। আমাকে অহেতুক মিষ্টি কথায় ভিজিয়ে-ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে হেনা ওর নিজের স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে; ওর ওপর বেশ ক্ষোভ ও অভিমান জন্মেছিল; ওসব তিক্ততা এখন মাথা থেকে সরে যেতে থাকে। আমি ভাবতে থাকি, হেনা এখন আমাকে কোন কথাটি শোনাতে পারে। এক. হতে পারে হেনা বলবে, স্যার, শহীদ ভাইয়াকে আমি আর ভালোবাসি না, ভালোবাসি আপনাকে। আপনি আমাকে নিয়ে পরীর রাজ্যে উড়ে চলুন। দুই. হতে পারে হেনা বলবে,… নাহ্। আর কিছু ভাবতে পারি না।
হেনা খুব কাতর স্বরে বলে, শহীদ ভাইয়ার জন্য, অর্থাৎ আমার ফুফাতো ভাইয়ার জন্য একটা সুন্দর রুমাল বানিয়েছিলাম, ওটা পাচ্ছি না। আমার যদ্দূর মনে পড়ে আমার কোনো এক বইয়ের মধ্যে রেখেছিলাম। গতকাল থেকে খুঁজছি। কোথাও নেই- আপনাকে যে বইগুলো দিয়েছি, আজ হোস্টেলে গিয়ে একটু যদি ওগুলো খুঁজে দেখেন...
আমি দাঁড়িয়ে আমার ডান পকেটে হাত ঢুকাই। এই সুগন্ধি রুমালটি আমি প্রতিদিন পকেটে নিয়ে ঘুরেছি। আমি অনেক সুযোগ খুঁজেছি, কোনো এক ফাঁকে আমার পকেট থেকে এটি বের করে হেনাকে দেখাব, হেনা, এই দেখো, তোমার ভালোবাসা জড়ানো সুগন্ধি মাখানো রুমালটি আমার হস্তগত হয়েছে। তুমি আমাকে ভালোবাসো, ভালোবাসি আমিও তোমাকে।
আমি পকেট থেকে রুমালটি বের করে হেনার হাতে সঁপে দিই। হেনার মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ছলছল করে ওঠে। সে ওটি নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে।
আমি শূন্য হাতটি নাকের কাছে ধরি। গন্ধ শুঁকার চেষ্টা করি। কোনো গন্ধ নেই। বাতাসে সুগন্ধ মিলিয়ে গেছে।
ডিসেম্বর ২০০৩
**গল্পগ্রন্থ 'সুগন্ধি রুমাল', একুশে বইমেলা ২০০৪-এর অন্তর্ভুক্ত
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৫:০৯