পাহাড়ের সন্ধ্যা গুলা বরাবর ই একটু অন্যরকম হয়। বিশেষ করে যেদিন আকাশে তারা থাকে সেদিন। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে রিচেলের রোজদিন চোখভেঙ্গে ঘুম চলে এলেও কেন জানি তারাভরা আকাশ দেখলে সেদিন রিচেলের ঘুম আসতে দেরী হয়। মন উদাস করে ঘরের সামনের মাচার উপর বসেই অর্ধেক রাত পার করে দেয় সে। অভ্যাস টা ছোটকালের কিন্তু বয়স আশির কোটায় চলে আসার পর ও অভ্যাস টা যায় নি তার মাঝ থেকে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম বউ খুব মন খারাপ করত, পরের দিকে রাগ ই করত শেষ পর্যন্ত একটা সময়ে হতাশ হয়ে কিছু বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। ছোট মেয়ের জন্মের সময় বউটা মরে যায় রিচেলের । মাঝরাতে পাহাড় থেকে নেমে হাসপাতালে নেওয়ার সময় সুযোগ কোনটাই হয়ে ওঠে নাই সেদিন। তারপরে রিচেলের দিনগুলা আর ৫ টা জুমচাষীদের মতই ছিল। ৩ সন্তানকে একা হাতেই বড় করেছিল সে, বিয়েটা আর করে নাই অনেকটা নিজের ইচ্ছাতেই। একা থাকার মধ্যে রিচেল অন্যরকম সুখ পায়। কষ্টেশিষ্টে বাজারে ছোট একটা দোকান নিয়েছিল, পরে জায়গা দখল নিয়ে কি জানি একটা সমস্যা হলো তাই দোকানগুলা ঊঠায়ে দিতে বাধ্য হলো সবাই এক পর্যায়ে। ওখানে নাকি বড় হোটেল হবে! ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু টাকা দিয়েছিল অবশ্য। সেই টাকা দিয়ে মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিল রিচেল, ছেলে দুইটা বড় হয়ে শহরে চলে গেল, বউ বাচ্চা নিয়ে সেখানেই থাকে নিজেদের মত। মেয়েটা মাঝেসাঝে আসে বুড়া বাপটাকে দেখতে, সকালে কাজে যাওয়া, ঘরে ফিরে দুমুঠো ভাত মাছ রান্না করে হয় ঘুমানো নাহয় আকাশ দেখা! এই করে চলে গেল রিচেলের জীবনটা! গ্রামের সবাই শান্ত চুপচাপ বয়স্ক মানুষটাকে বেশ সমীহই করে।
আজো আকাশের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে রিচেল। যদিও আজ আকাশে কোন তারা নেই। নীকষ কালো অমাবস্যার আকাশ। তবু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। গত ২ দিন না খেয়ে থাকার ফলে হুট করে পেটের মাঝে ক্ষুধা মোচড় দিয়ে উঠছে। একটূ আগে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ফলে আশেপাশের মাটিতে এখনো বৃষ্টির প্রমাণস্বরূপ হাটু কাদা ! পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে দুই তিন জন মানুষের অবয়ব দেখতে পায় সে। পাশের বাড়ির সবুজ কে অন্ধকারের মধ্যে ঠাওড় করতে পারে সে।
- রিচেল চাচা!
- বল বাবা!
- কি করা যায় এখন ?
- জানি না বাবা!
- চাচা, আপনিই তো এখন আমাদের ভরসা! কিছু একটা করেন চাচা! বাচ্চাগুলার মুখের দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না আর !
উত্তরে কিছু না বলে দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে রিচেল। পাশের ছেলেটা বলে উঠে- এভাবে তো চলতে পারে না !২ দিন তো হয়েই গেল ! গভার্মেন্ট থেকে কি কিছুই করবে না ?
তার গলার মাঝে ঝাঝ টা টের পাওয়া যায় ভালো ভাবে !
- ধৈর্য ধর রে বাবা ! এছাড়া আমাদের আর কি বা করার আছে ??
রিচেলের ক্লান্ত গলার স্বরে ছেলেটার একটু থিতিয়ে যায়।
- চল দেখি, তোর বাবার সাথে একটু কথা বলি !
রিচেল আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে সবুজকে বলে হাটা দেয় গ্রামের দিকে। অবশ্য ওটাকে এখন গ্রাম বলা চলে কিনা সেটা রিচেলের জানা নাই ! ২ দিন আগের হঠাত করে আসা ঝড়ের মত পাহাড়ধ্বস টা ও তাদের জীবনে একটা ধ্বস নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে ! গ্রাম বলতে যেটুকু আছে সেটা আসলে দুই চারটা ভাঙা ঘর ছাড়া আর কিছুই না ! পাথর আর মাটির আড়ালে এখনো অনেকের লাশ পরে আছে, ব্যাবস্থা নেওয়ার মত ব্যাবস্থাও গ্রামবাসীদের কাছে নেই। কপালগূণে যারা বেচে গিয়েছে তাদের কপালেও এখন দুশ্চিন্তার ভাজ ! কি খাবে, কি ভাবে বাচবে এই দুশ্চিন্তা এখন মৃতদের সৎকার এর চেয়েও মুখ্য এখন !
রিচেলদের পাহাড় টা লোকালয় থেকে বেশ অনেকটা দূরে বলে বেশ অনেকটা সভ্যতা বিবর্জিত। এনজিও পরিচালিত একমাত্র স্কুলঘর টাই এখন বেচে যাওয়া মানুষগুলার একমাত্র আশ্রয়! ছোট্ট ঘরটাতে প্রায় ৫০ জন মানুষ একে অন্যকে আকড়ে বসে আছে। ভবিষ্যতের চিন্তা তাদের সব হারানোর পর ও বিলাপ করতে সাহস যোগাচ্ছে না !
খোজখবর বলতে, সংবাদপত্র থেকে কয়েকজন ছেলে এসেছিল! কি জানি রিপোর্ট করবে !! তাতে হয়ত সাহায্য আসলেও আসতে পারে, এই আশার বাণী শুনিয়ে গতকাল বিকালে বিদায় নিয়েছে তারা!
ত্রাণ মন্ত্রাণলায়লের অফিসে খবর দেওয়ার জন্য রিচেল শহরে ২ টা ছেলেকে পাঠিয়েছিল ! হতাশ মুখে শুধু আশার বাণী শুনে ফিরে এসেছে তারাও।
আকশে হুট করে মেঘ ডেকে উঠে ! অজানা আশঙ্কায় সবাই স্কুলঘরে আশ্রয় নিতে ছুটে যায়। রিচেল বারান্দায় উঠে সবুজের বাবার পাশে বসে আস্তে করে তার কাধে হাত রাখে। ছোটবেলার বন্ধুর ছোয়া পেয়ে ডুকরে কেদে ওঠে সবুজের বাবা কারামত। পরিবারের সবাই কে হারানোর কষ্টে একেবারে দূর্বল হয়ে গেছে ৬ ফুট লম্বা চওড়া মানুষটা।
ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে আবার ! বৃষ্টির শব্দ আর কারামতের চাপা কান্নার শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে মিশে যায় রাতের অন্ধকারের মাঝে।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবার মাঝে একটা হুলস্থুল ভাব দেখতে পায় রিচেল। যার যেটুকু সম্বল বেচে গিয়েছে খোজাখুজি করে সেগুলাই গুছিয়ে নিচ্ছে গ্রামের মেয়ে বউ রা। রাতের অন্ধকার কেটে সবার মাঝে কেমন জানি নিশ্চিন্ত খুশীর আভাস!
কি হয়েছে জানতে কাছাকাছি গিয়ে রিচেল জানতে পারে, পাহাড় থেকে লেকের ধারে ক্যাম্প বসেছে ! অনেক তাবু, অনেক মানুষ এসেছে শহর থেকে। অনেক পুলিশ ও !ট্রাকভরে চাল ডাল আলু পেয়াজের বস্তা এসেছে ! একটা হেলিকপ্টারের ও নাকি আওয়াজ পাওয়া গিয়েছে !
হুট করে মনের মাঝে পাথরভাব টা অনেক হালকা হয়ে যায় রিচেলের। সাহায্য এলো তাহলে !!
সবুজের বাবা কে দেখতে পায় রিচেল। সবাই কে তাড়া দিচ্ছে জলদি করার জন্য!
বেলা বাড়লে কাদা মাখা , আহত -ক্ষুধায় ক্লান্ত জীবিত মানুষের একটা দল রওনা দেয় ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে দলটা পৌছে যায় ক্যাম্পের কাছে। দূর থেকে এরকম একটা দল দেখতে পেয়ে ২ জন পুলিশ এগিয়ে আসে , আটকে ফেলে ওদের পথ!
-কোথায় যাচ্ছেন ?
- ত্রাণ নিতে ভাই ! সবুজ উত্তর দেয়
- কিসের ত্রাণ ?? বাইরের মানুষ দেখতে পারলো না ! সাহায্যের জন্য হাজির ?? এইখানে কোন সাহায্য হবে না , যা এখান থেকে !
হুট করে এমন ব্যাবহার পেয়ে অবাক হয়ে সবুজ জানতে চাইলো- তাহলে কি হচ্ছে এখানে ??? এত মানুষ কেন ???
- আরে গাধা, শুটিং হচ্ছে, শুটিং ! শহর থেকে বড় বড় নায়ক নায়িকারা এসেছে ! সিনেমার শুটিং হচ্ছে !!
- ওহ ! , বলে ঘাড় নামিয়ে ফেলে সবুজ। কি বলবে ভেবে পায় না আর !!!
সাহায্য আসেনি, কথাটা সবার মাঝে চাউর হইতে সময় লাগে না বেশি। বাচ্চাগুলা কি বুঝলো কে জানে ? চিৎকার দিয়ে সবাই মিলে একসুরে কান্নাকাটি শুরু করলো। পুলিশগুলা এবার বিরক্ত হয়ে সবাইকে সরানোর উদ্যোগ নেয়। পুলিশের দাপটে পিছিয়ে আসে দলটা। কিছুটা দূরে গিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না রিচেল। একটা উচু ঢিবির উপর বসে পরে ক্লান্ত হয়ে !
গ্রামের মানুষ আস্তে আস্তে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সবুজ এসে বলে, চাচা, যাবেন না ??
- তোরা আগা, আমি আসছি ! ক্লান্ত গলায় উত্তর দেয় রিচেল।
ঘাড় ঝাকিয়ে চলে যায় সবুজ।
দুপুরের কড়া রোদ উপেক্ষা করে রিচেল দূরের লেক আর আর সেজেগুজে থাকা ব্যাতিব্যাস্ত মানুষগুলার দিকে তাকায়, হুট করে তার চোখ পরে লেকের ধারে মুঠোফোনের বিরাট বিজ্ঞাপনসহ রঙিন বিলবোর্ডটার উপরে বসা কাকটার উপর ... কাকটাও একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে ।
হয়ত এক উপেক্ষিত পাখি আর এক উপেক্ষিত মানুষ একে অন্যের চোখের মাঝে কষ্ট মেপে নিচ্ছে ......
পাহাড়ের সন্ধ্যা গুলা বরাবর ই একটু অন্যরকম হয়। বিশেষ করে যেদিন আকাশে তারা থাকে সেদিন। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে রিচেলের রোজদিন চোখভেঙ্গে ঘুম চলে এলেও কেন জানি তারাভরা আকাশ দেখলে সেদিন রিচেলের ঘুম আসতে দেরী হয়। মন উদাস করে ঘরের সামনের মাচার উপর বসেই অর্ধেক রাত পার করে দেয় সে। অভ্যাস টা ছোটকালের কিন্তু বয়স আশির কোটায় চলে আসার পর ও অভ্যাস টা যায় নি তার মাঝ থেকে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম বউ খুব মন খারাপ করত, পরের দিকে রাগ ই করত শেষ পর্যন্ত একটা সময়ে হতাশ হয়ে কিছু বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। ছোট মেয়ের জন্মের সময় বউটা মরে যায় রিচেলের । মাঝরাতে পাহাড় থেকে নেমে হাসপাতালে নেওয়ার সময় সুযোগ কোনটাই হয়ে ওঠে নাই সেদিন। তারপরে রিচেলের দিনগুলা আর ৫ টা জুমচাষীদের মতই ছিল। ৩ সন্তানকে একা হাতেই বড় করেছিল সে, বিয়েটা আর করে নাই অনেকটা নিজের ইচ্ছাতেই। একা থাকার মধ্যে রিচেল অন্যরকম সুখ পায়। কষ্টেশিষ্টে বাজারে ছোট একটা দোকান নিয়েছিল, পরে জায়গা দখল নিয়ে কি জানি একটা সমস্যা হলো তাই দোকানগুলা ঊঠায়ে দিতে বাধ্য হলো সবাই এক পর্যায়ে। ওখানে নাকি বড় হোটেল হবে! ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু টাকা দিয়েছিল অবশ্য। সেই টাকা দিয়ে মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিল রিচেল, ছেলে দুইটা বড় হয়ে শহরে চলে গেল, বউ বাচ্চা নিয়ে সেখানেই থাকে নিজেদের মত। মেয়েটা মাঝেসাঝে আসে বুড়া বাপটাকে দেখতে, সকালে কাজে যাওয়া, ঘরে ফিরে দুমুঠো ভাত মাছ রান্না করে হয় ঘুমানো নাহয় আকাশ দেখা! এই করে চলে গেল রিচেলের জীবনটা! গ্রামের সবাই শান্ত চুপচাপ বয়স্ক মানুষটাকে বেশ সমীহই করে।
আজো আকাশের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে রিচেল। যদিও আজ আকাশে কোন তারা নেই। নীকষ কালো অমাবস্যার আকাশ। তবু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। গত ২ দিন না খেয়ে থাকার ফলে হুট করে পেটের মাঝে ক্ষুধা মোচড় দিয়ে উঠছে। একটূ আগে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ফলে আশেপাশের মাটিতে এখনো বৃষ্টির প্রমাণস্বরূপ হাটু কাদা ! পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে দুই তিন জন মানুষের অবয়ব দেখতে পায় সে। পাশের বাড়ির সবুজ কে অন্ধকারের মধ্যে ঠাওড় করতে পারে সে।
- রিচেল চাচা!
- বল বাবা!
- কি করা যায় এখন ?
- জানি না বাবা!
- চাচা, আপনিই তো এখন আমাদের ভরসা! কিছু একটা করেন চাচা! বাচ্চাগুলার মুখের দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না আর !
উত্তরে কিছু না বলে দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে রিচেল। পাশের ছেলেটা বলে উঠে- এভাবে তো চলতে পারে না !২ দিন তো হয়েই গেল ! গভার্মেন্ট থেকে কি কিছুই করবে না ?
তার গলার মাঝে ঝাঝ টা টের পাওয়া যায় ভালো ভাবে !
- ধৈর্য ধর রে বাবা ! এছাড়া আমাদের আর কি বা করার আছে ??
রিচেলের ক্লান্ত গলার স্বরে ছেলেটার একটু থিতিয়ে যায়।
- চল দেখি, তোর বাবার সাথে একটু কথা বলি !
রিচেল আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে সবুজকে বলে হাটা দেয় গ্রামের দিকে। অবশ্য ওটাকে এখন গ্রাম বলা চলে কিনা সেটা রিচেলের জানা নাই ! ২ দিন আগের হঠাত করে আসা ঝড়ের মত পাহাড়ধ্বস টা ও তাদের জীবনে একটা ধ্বস নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে ! গ্রাম বলতে যেটুকু আছে সেটা আসলে দুই চারটা ভাঙা ঘর ছাড়া আর কিছুই না ! পাথর আর মাটির আড়ালে এখনো অনেকের লাশ পরে আছে, ব্যাবস্থা নেওয়ার মত ব্যাবস্থাও গ্রামবাসীদের কাছে নেই। কপালগূণে যারা বেচে গিয়েছে তাদের কপালেও এখন দুশ্চিন্তার ভাজ ! কি খাবে, কি ভাবে বাচবে এই দুশ্চিন্তা এখন মৃতদের সৎকার এর চেয়েও মুখ্য এখন !
রিচেলদের পাহাড় টা লোকালয় থেকে বেশ অনেকটা দূরে বলে বেশ অনেকটা সভ্যতা বিবর্জিত। এনজিও পরিচালিত একমাত্র স্কুলঘর টাই এখন বেচে যাওয়া মানুষগুলার একমাত্র আশ্রয়! ছোট্ট ঘরটাতে প্রায় ৫০ জন মানুষ একে অন্যকে আকড়ে বসে আছে। ভবিষ্যতের চিন্তা তাদের সব হারানোর পর ও বিলাপ করতে সাহস যোগাচ্ছে না !
খোজখবর বলতে, সংবাদপত্র থেকে কয়েকজন ছেলে এসেছিল! কি জানি রিপোর্ট করবে !! তাতে হয়ত সাহায্য আসলেও আসতে পারে, এই আশার বাণী শুনিয়ে গতকাল বিকালে বিদায় নিয়েছে তারা!
ত্রাণ মন্ত্রাণলায়লের অফিসে খবর দেওয়ার জন্য রিচেল শহরে ২ টা ছেলেকে পাঠিয়েছিল ! হতাশ মুখে শুধু আশার বাণী শুনে ফিরে এসেছে তারাও।
আকশে হুট করে মেঘ ডেকে উঠে ! অজানা আশঙ্কায় সবাই স্কুলঘরে আশ্রয় নিতে ছুটে যায়। রিচেল বারান্দায় উঠে সবুজের বাবার পাশে বসে আস্তে করে তার কাধে হাত রাখে। ছোটবেলার বন্ধুর ছোয়া পেয়ে ডুকরে কেদে ওঠে সবুজের বাবা কারামত। পরিবারের সবাই কে হারানোর কষ্টে একেবারে দূর্বল হয়ে গেছে ৬ ফুট লম্বা চওড়া মানুষটা।
ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে আবার ! বৃষ্টির শব্দ আর কারামতের চাপা কান্নার শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে মিশে যায় রাতের অন্ধকারের মাঝে।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবার মাঝে একটা হুলস্থুল ভাব দেখতে পায় রিচেল। যার যেটুকু সম্বল বেচে গিয়েছে খোজাখুজি করে সেগুলাই গুছিয়ে নিচ্ছে গ্রামের মেয়ে বউ রা। রাতের অন্ধকার কেটে সবার মাঝে কেমন জানি নিশ্চিন্ত খুশীর আভাস!
কি হয়েছে জানতে কাছাকাছি গিয়ে রিচেল জানতে পারে, পাহাড় থেকে লেকের ধারে ক্যাম্প বসেছে ! অনেক তাবু, অনেক মানুষ এসেছে শহর থেকে। অনেক পুলিশ ও !ট্রাকভরে চাল ডাল আলু পেয়াজের বস্তা এসেছে ! একটা হেলিকপ্টারের ও নাকি আওয়াজ পাওয়া গিয়েছে !
হুট করে মনের মাঝে পাথরভাব টা অনেক হালকা হয়ে যায় রিচেলের। সাহায্য এলো তাহলে !!
সবুজের বাবা কে দেখতে পায় রিচেল। সবাই কে তাড়া দিচ্ছে জলদি করার জন্য!
বেলা বাড়লে কাদা মাখা , আহত -ক্ষুধায় ক্লান্ত জীবিত মানুষের একটা দল রওনা দেয় ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে দলটা পৌছে যায় ক্যাম্পের কাছে। দূর থেকে এরকম একটা দল দেখতে পেয়ে ২ জন পুলিশ এগিয়ে আসে , আটকে ফেলে ওদের পথ!
-কোথায় যাচ্ছেন ?
- ত্রাণ নিতে ভাই ! সবুজ উত্তর দেয়
- কিসের ত্রাণ ?? বাইরের মানুষ দেখতে পারলো না ! সাহায্যের জন্য হাজির ?? এইখানে কোন সাহায্য হবে না , যা এখান থেকে !
হুট করে এমন ব্যাবহার পেয়ে অবাক হয়ে সবুজ জানতে চাইলো- তাহলে কি হচ্ছে এখানে ??? এত মানুষ কেন ???
- আরে গাধা, শুটিং হচ্ছে, শুটিং ! শহর থেকে বড় বড় নায়ক নায়িকারা এসেছে ! সিনেমার শুটিং হচ্ছে !!
- ওহ ! , বলে ঘাড় নামিয়ে ফেলে সবুজ। কি বলবে ভেবে পায় না আর !!!
সাহায্য আসেনি, কথাটা সবার মাঝে চাউর হইতে সময় লাগে না বেশি। বাচ্চাগুলা কি বুঝলো কে জানে ? চিৎকার দিয়ে সবাই মিলে একসুরে কান্নাকাটি শুরু করলো। পুলিশগুলা এবার বিরক্ত হয়ে সবাইকে সরানোর উদ্যোগ নেয়। পুলিশের দাপটে পিছিয়ে আসে দলটা। কিছুটা দূরে গিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না রিচেল। একটা উচু ঢিবির উপর বসে পরে ক্লান্ত হয়ে !
গ্রামের মানুষ আস্তে আস্তে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সবুজ এসে বলে, চাচা, যাবেন না ??
- তোরা আগা, আমি আসছি ! ক্লান্ত গলায় উত্তর দেয় রিচেল।
ঘাড় ঝাকিয়ে চলে যায় সবুজ।
দুপুরের কড়া রোদ উপেক্ষা করে রিচেল দূরের লেক আর আর সেজেগুজে থাকা ব্যাতিব্যাস্ত মানুষগুলার দিকে তাকায়, হুট করে তার চোখ পরে লেকের ধারে মুঠোফোনের বিরাট বিজ্ঞাপনসহ রঙিন বিলবোর্ডটার উপরে বসা কাকটার উপর ... কাকটাও একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে ।
হয়ত এক উপেক্ষিত পাখি আর এক উপেক্ষিত মানুষ একে অন্যের চোখের মাঝে কষ্ট মেপে নিচ্ছে ......
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১০:২৪