প্রতিদিনের মত রোজকার কাজগুলার করার মধ্যে একটা স্থিরতা কাজ করে ইউশার। নতুন আর কি! রোজদিন একই কাজ, ঘুরায়ে ফিরায়ে করা ঘরের কাজ, সকাল থেকে প্রতিটা সেকেন্ডের হিসাব আছে ইউশার কাছে। কোন সেকেন্ডে কোন কাজের মধ্যে থাকবে সে সেটাও তার খুব ভালো করে জানা। মাঝে মাঝে হাপিয়ে ওঠে সে। জীবনের ২৫ টা বছরের মধ্যে গত ১৫ বছর সে ঘুরে ফিরে এই একই রুটিনে অভস্ত্য। বাড়ির আঙিনা টা যদিও বেশ বড়। মস্ত বড় প্রাসাদের মত বাড়িটার মাঝে মন ভালো করার মত সব কিছুর ই আয়োজন করে রেখেছে তার বাবা। কিন্তু তবু সে হাপিয়ে ওঠে।
প্রতিদন সন্ধ্যায় বাবা ইউশাকে গল্প শোনায়। বাইরের পৃথিবীর গল্প। হাসির গল্প, আনন্দের গল্প, ভালোবাসার গল্প, মানুষের অনুভূতির গল্প, প্রতিটা পার্বনের গল্প, বাইরের মানুষের জীবনের গল্প। বাড়ির সব থেকে উচূ টাওয়ারে বসে হালকা একটা মোমবাতির আলোয় বাবা তাকে গল্প শোনায়। বাবা বলেন, বাইরের পৃথিবীর মতন তারা না, ইউশা অন্যরকম এজন্যৈ তো তাকে কোনদিন ও বাবা বাইরে যেতে দেয় নাই। ইউশা কষ্ট পায় তবু বাবার কথা ভেবে কোনদিন কিছু বলে না।
উচু টাওয়ার থেকে বসে বাইরের পৃথিবীর কথা ভাবতে ভাবতে সে একসময় ঘুমিয়েও পরে। পরের দিন আবার সেই একই কাজ, একই রুটিন, সন্ধ্যাবেলার একই গল্প এরই মাঝে ইউশা ভাল থাকার চেষ্টা করে।
মাঝে মাঝে ইউশার নিজেকে রূপকথার সেই লম্বা চুলের মেয়েটার মতন মনে হয় যাকে এক দুষ্টু রাক্ষসী একটা টাওয়ারে আটকে রেখেছিল।
বাবার কথাও ভাবে সে মাঝে মাঝে। এই যে বাবাও তারমতন ই সারাটা জীবন এই একই জায়গায় আটকে আছে, একই রুটিনে প্রতিটা দিন পার করে। এত বিশাল বাড়িতে শুধু সে আর বাবা ! তবু তো বাবা বছরে একবার বাইরে যায় যেদিন সবাই মিলে পৃথিবীর জন্মদিন পালন করে, অনেক আলো জ্বালায়,আনন্দ করে, আতশবাজি পুড়ায়, গান গায়, একসাথে নাচে। বাবাকেও সেদিন যেতে হয়, তাই বাবা যায় কিন্তু ইউশার বয়স হয়নাই সেই ছুতো দিয়ে বাবা কখনো তাকে সাথে নেয়না।
আজ সেই দিন, আজ পৃথিবীর জন্মদিন। বাবা গতদিন সন্ধ্যাতেই চলে গেছেন। ইউশার আজকের দিনটা বড্ড অন্যরকম থাকে প্রতি বছর। সকাল সকাল জলদি ঘুম থেকে উঠেই সে হাতের কাজ সেরে দুপুর থেকে সাজতে বসে। নিজের প্রিয় পোষাকটা পরে খুব সুন্দর করে চুলটা বাধে, আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হয়। তারপর বিকাল থেকে উঁচু টাওয়ারের সব থেকে উঁচু জানালাটার কাছে বসে সে অপেক্ষা করে। সন্ধ্যা মিলিয়ে যেতে না যেতেই শুরু হয় আতশবাজির খেলা। লাল নীল সবুজ হলুদ নানা রঙের আলোয় আকাশ ছেয়ে যায়। মনে হতে থাকে হাজার হাজার জোনাকি একসাথে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই আতশবাজিগুলা ইউশার খুব পছন্দের সেই ছোট বেলা থেকেই। আলোর খেলা দেখতে দেখতে ইউশা কল্পনার চোখে পুরা পৃথিবীটা দেখতে থাকে। স্বপ্ন দেখতে থাকে যে একদিন সেও বাবার সাথে পুরা পৃথিবীর সাথে আনন্দে মেতে উঠতে পারবে, হাসতে পারবে, মন খুলে কথা বলতে পারবে, বাইরের পৃথিবীকে ছুতে পারবে। এই চিন্তাটা চোখে পানি এনে দেয় ইউশার, আস্তে করে বলে ওঠে- শুভ জন্মদিন পৃথিবী!
(ইউশার বাবার ডায়েরী থেকে ...... )
১৮ আগস্ট ৫০৭৮,
রাত ১১,৫৩
আরেকটি বছর পার করে ফেলল আমার মেয়েটা। দেখতে দেখতে চোখের সামনে বেড়ে উঠছে সে। পুরাপুরি একটা তাজা গোলাপে পরিণত হয়েছে সে। সব কিছু ঠিক থাকলে হয়ত এই সময়েই আমি ওর বিয়ের কথা ভাবতাম, ধুমধাম করে ওর বিয়ে দিতাম ওর স্বপ্নের রাজকুমারের সাথে। ওদের স্বপ্নীল চোখের মাঝে নতুন করে বাচার আশা খুজে পেতাম। কিন্তু কেন এমন হল আমার মেয়েটার সাথে ??
কতদিন ওকে মিথ্যা আশা দেখায়ে যাব আমি ? কতদিন পারব আর সবকিছু লুকিয়ে রাখতে। কিংবা যদি আমার কিছু হয়ে যায় কোনদিন কিংবা আজ রাতেই, ওকে কি জানতে পারবে সব কিছু ? ও কি টের পাবে বাস্তব সম্পর্কে ?
আজ যদি ও আমাকে প্রশ্ন করে, কি উত্তর দিব আমি? যে নিজের হাতে নিজেদের পৃথিবীটা ধ্বংস করে ফেলেছি আমরা, কেউ নেই আর! কেউ আর বেচে নেই! আর যে কয়জন আছে তারা তো আর মানুষ নেই, জীবান্মৃত। তাদের মাঝে কিভাবে বাচবে আমার এই ফুলের মত মেয়েটা ?
নাহ, থাক, যতদিন বেচে আছি, এইভাবেই মিথ্যা আতশবাজির ঝলক দেখিয়ে যাব আমি ওকে। অন্তত আমার মেয়েটা বেঁচে থাকার আশা তো পাচ্ছে, কল্পনা করছে, স্বপ্ন দেখছে।
কাল ও আসার পথে একদল জীবান্মৃতের সামনে পরেছিলাম, কপাল গূনে বেঁচে গেছি। আগে ওরা বেশ দূরেই থাকত। ইদানীং বড্ড কাছাকাছি চলে এসেছে আমাদের। আমাকে আরো সাবধান হতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে, আমার ইউশার জন্য ই .........
ফিরতে পারব তো ঠিকভাবে আজ রাতে ?????
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ২:০১