সবার কথাই অবিশ্বাস করা যায়, কিন্তু মা-দাদির কথা কিভাবে অবিশ্বাস করি ? তাই, তারা যখন বললেন যে, অমাবশ্যার রাতে এ বাড়িতে গরু হাতে অশরীরী নামে, তখন বিশ্বাস না-করে পারতাম না। বলতে বাধ্য হচ্ছি— ভীষণ দুরন্ত আমার কিছুটা ভয় ভয়ও করতো।
অশরীরীর ব্যাপারটা খুলে বলি। মা-দাদির ভাষ্যমতে— মাঝেমাঝে অমাবশ্যার গভীর রাতে বাড়ির উঠানে একটা গরুকে ছুটতে দেখেছেন তারা। গরুটা দশঘর বাড়ির বিশাল উঠানটাকে বারকয় প্রদক্ষিণ করে বাড়ির দরজা দিয়ে কবরস্থানের দিকে উধাও হয়ে যেত। গরুর গলার দড়ি হাতে কেউ একজন গরুর সাথে ছুটছে বোঝা যেত, কিন্তু মাথা নয়, শুধু ধড়টাই। তাদের বিশ্বাস— গরুটা ছুটতেও শুরু করে ওই কবরস্থান থেকেই। চেরাগের আলোয় মোস্তাকের ( মোস্তাক এক প্রকার ছোট গাছ । এটি মুর্তা নামেও পরিচিত । বৈজ্ঞানিক নাম: Schumannianthus dichotomus । এর ছাল দিয়ে শীতল পাটি তৈরি হয়। ) বেতি তুলতে তুলতে তারা অন্যন্য দাদি-চাচিদের সাথে এসব গল্প করতেন, আর আমি ভয়ে কাঁথার ভেতর কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে ‘ঘুম আয় আয়’ করতাম। ভয় কেটে যেত দিনের আলো ফুটলেই ।
দিনের আলোয় রাতের গল্পকে খেলো মনে হতো। তাছাড়া, ভয় কে জয় করেছি ক্লাস থ্রিতে থাকতে, এখন ক্লাস ফোর। ক্লাস থ্রিতে ইলেক্ট্রিসিটিহীন গ্রামে সাবেক ইউপি-মেম্বারের ইট-বাঁধানো কবরে দু-রাত কাটাবার অভিজ্ঞতা আছে। অভিজ্ঞতাটা হয়েছিলো ঠেলায় পড়ে। দুষ্টুমি করি, পড়ায় মন নেই দেখে থ্রিতে উঠতেই আমাকে নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে মামা স্কুল-টিচার, নানাও। পড়ায় ফাঁকি দিতে পারবো না, এমন মত সবার। কিন্তু আমি তো যাবো না, যাবোই না। তবু জোর করে পাঠানো হলো। সেখানে নানু-খালারা বোঝালেন— তোমাকে আমরা কত আদর করি, এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। যাই হোক, স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো। সেই স্কুলের অংক-শিক্ষক মামা।
স্কুলের প্রথম দিন মামাকে মামার মতই লাগলো। ক্লাসে এসে সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর অংক বোঝালেন এবং শেষে বাড়ির কাজ দিয়ে ক্লাস শেষ করলেন। আমিও বেজায় খুশী তার আচরণে। সেই মামাই কিনা দ্বিতীয় দিন বাড়ির কাজ না-করে আনায় আমাকে দু-ঘা বেত মারলেন ? বাঁদরের দল ক্লাসের অন্যরা আবার সেটা দেখে মুচকি হেসে মজাও নিচ্ছিলো। সাথেসাথে ‘তুই আমার মামা না’ বলে কাঁদতে কাঁদতে বই ফেলেই ছুট লাগালাম। ছুট নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি অনেক দূর। অনেকটা হেঁটে বাজার পর্যন্ত পৌছালাম। তখন সন্ধ্যা। বাজারে আটরশির জিকির হচ্ছে। জিকিরের শেষে ভালো খাবার দেয় বলে শুনেছি। ক্ষুধাও পেয়েছে ভালোই। জিকিরে সামিল হলাম। এক জিকিরে রাত দশটা। যদিও বিরিয়ানি পেয়েছি, কিন্তু বাড়ি যাবো কিভাবে ? বাড়িতেও তো যাওয়া যাবে না, মা মারবে নানাবাড়ি থেকে পালানোর অপরাধে। অনেক ভেবে যা থাকে কপালে বলে আমাদের গ্রামের দিকে যাওয়া একটা রিকশার পেছনে ঝুলে পড়লাম। হালকা হাওয়াই শরীর আমার, রিকশাওয়ালা টের পেলো না। রিকশা থেকে নেমে অন্ধকারে নারকেল-সুপুরি গাছে দু-তিন বাড়ি খেয়ে ঘরের কাছে এসে কান পাতলাম। শুনি, মামা উপস্থিত, মা আমাকে পেলে কী কী করবেন তার তালিকা শানাচ্ছেন। ভয়ে বাইরেই রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু ঘুমাবো কোথায় ? বাড়ির কারো ঘরে থাকতে গেলে মায়ের হাতে ধরিয়ে দেবে। অগত্যা ঢুকে পড়লাম বাড়ির পাশের কবরস্থানে। এদিকে কেউ আসে না, ধরা পড়ার ভয় নেই। কবরস্থানে একটাই ইট-বাঁধানো কবর ইউ-পি মেম্বারের। লাফিয়ে তার ভেতরে নামলাম। কিসের ভয়, আমাকে কেউ খুঁজে পাবে না, এই খুশিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সেই আমিই কিনা পাবো ভূতের ভয় ? একটা প্রেস্টিজ আছে না আমার ! কবরে রাত-কাটাবার পর ‘মাগো মা, ছেলের কী সাহস, কী সাহস’ করে কম বাহবা দিয়েছিলো লোকে ? সুতরাং, ভয় পাওয়া চলবে না। বরং একবার ভূতের মুখোমুখি হয়ে আরও কিছু বাহবা পাওয়া যাক। কিন্তু, এতে তো প্রাণ-সংশয়ও হতে পারে। ধুর, এই রাতদিন পড়ো রে, লেখো রের চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
সেই থেকে দাদিকে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতাম অমাবশ্যা কবে। আর লুকিয়ে লুকিয়ে চালাচ্ছিলাম প্রস্তুতি। এ-গ্রামের বড়বাড়িতে একটাই ব্যাটারীচালিত টিভি। প্রতি শুক্রবার বিকেল তিনটে থেকে সেটা চালানো হতো। বিটিভিতে বাংলা ছায়াছবি দিতো তখন। সিনেমা থেকে শিখেছি— এসব অপারেশনে অনেক কিছুর দরকার হয়। অস্র, দূরবীন, রশি। দূরবীন আমার আছে। রাস্তায় একবার একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। ১০০ টাকা ছিলো ভিতরে। সে টাকা দিয়েই দূরবীনটা কিনেছিলাম বাজার থেকে। দাম নিয়েছিলো ৬০ টাকা। দূরবীনের গায়ে আমার নামের প্রথম অক্ষর লিখে দিয়েছি ব্লেড দিয়ে আঁচড়ে। অস্র হিসেবে আমার পছন্দ গুলতি। কিন্তু, শত্রু যেহেতু ভূত, আরেকটু ভারি কিছু দরকার। ঘরে বাঁকানো একটি রড ছিলো, তার দু-মাথায় লাগিয়ে নিলাম লম্বালম্বি গুলতির রাবার। ব্যাস হয়ে গেলো ধনুক। তীর হলো শান দেয়া সাইকেলের স্পোক।
রশিও ঘরেই ছিলো। সরঞ্জাম তৈরি।
দেখতে দেখতে অমাবশ্যা চলে এলো। অমাবস্যা নিয়ে অনেক বাজে গল্প শুনেছি, তাই সন্ধ্যা থেকেই ভয় ভয় করতে লাগলো। কিন্তু বাহবার লোভও সামলানো দায়। রাতের খাবার শেষে সবাই ঘুমিয়ে গেলে বেরিয়ে পড়লাম তাই। ঘুটঘুটে অন্ধকার, গলায় দূরবীন, কাঁধে রশি, হাতে তীর-ধনুক। এসে দাঁড়ালাম বাড়ির দরজা আর কবরস্থানের সংযোগ স্থানে। সবার ভাষ্যমতে গরুভূত এখান দিয়েই ঢোকে। তীর-ধনুক তাক করে বসে আছি গাছের আড়ালে। চারদিক অস্বাভাবিক স্তব্ধ। রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। হঠাৎ ক্র্যাওক্র্যাও শব্দের টানা চিৎকারে বুকটা ধড়াস্ করে উঠলো। না ভূত নয়, রাতজাগা পাখি এক। কিন্তু ভূত কই ? ভয় আর উত্তেজনায় ঘামছিই খালি। অন্যমনস্ক হয়ে যখন এসব ভাবছিলাম, তখনি পিঠের দিকে একটা গরম নিশ্বাস ফেললো যেন কেউ। ঘুরে পেছনে তাকাতেই দেখি —গরু বেরিয়ে যাচ্ছে আমার পিঠ ঘেঁষে, সাথে সেই লোক, সাদা পাঞ্জাবী, মাথা নেই। কিসের তীর ছোড়াছুড়ি, আমি এক চিৎকারে অজ্ঞান।
সকালে নিজেকে উদ্ধার করলাম বিছানায় । জ্বর চলে এসেছে, মা মাথায় পানি দেয়ার পর এখন মাথা মুচছেন। ঘরের বাইরে রিকশা দাঁড়ানো। আমি বলতে পারছি না, শুনছি— আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে আমাদের গ্রাম থেকে এক-গ্রাম পরের আরেক গ্রামের খোনকারের বাড়ি। আমাদের ওদিকে ওঝা কে খোনকার বলা হয়। তারা কুফরি কালাম জানেন। কুফরি কালাম যদ্দুর জানি—কোরানের আয়াত উল্টো পড়াকে বলা হয়। যাই হোক, আমরা খোনকারের বাড়ি পৌছালাম। তিনি ঘুমঘুম চোখে আমাকে টিপেটুপে পরীক্ষা করলেন। মাকে বললেন— শক্ত আছর, ছেলেরে ঝাড়া লাগবে, তাবিজ লাগবে আর পুরো বাড়ি মন্ত্র পড়ে বাঁধা লাগবে। টাকা লাগবে তিন হাজার। বাবা শহর থেকে মাসেই পাঠায় দুহাজার। তবু, মা তিন-হাজারেই রাজি। খোনকার তার মাথার কাছে দড়িতে মেলে দেয়া একটি সাদা পাঞ্জাবী ও বোরখার উপরের অংশ তুলতে তুলতে বললো-- তাহলে আপনারা যান, আমি জিনিসপত্র নিয়া আসতাছি। মা আমার হাত ধরে বেরিয়ে আসছেন, কিন্তু আমার দৃষ্টি খোনকারের ছেলের দিকে। ছেলেটা বারান্দায় খেলছে। হাতে আমার দূরবীন, ব্লেডের আঁচড়ে লেখা নামের প্রথম অক্ষর সমেত।