ছোট গল্প: কথপোকথন
ফয়সাল রকি
: রফিক, দেখো তো ছবিগুলো কেমন এসেছে।
সংগীতা হ্যান্ডব্যাগ থেকে ছবির অ্যালবামটা বের করতেই রফিক হাত বাড়িয়ে নিল।
: ছবি দেখে মন্তব্য করবে না কিন্তু।
: মন্তব্য করবো না। কেন? সুন্দর না পচা সেটাও বলবো না?
: আচ্ছা বাবা, হার মানছি।
প্রথম ছবিটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রফিক।
: কী ব্যাপার, স্ট্যাচু হয়ে গেলে যে!
: নাহ্ দেখছি। ছবিটা সুন্দর। তোমার রূপসী চেহারাকে কে খারাপ বলবে বলো তো। তবে তোমার পায়ে জুতো নেই কেন এই শীতে, গায়ে তো আবার ঠিকই চাদর জড়িয়েছো!
: দেখছো না ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছি।
: তা তো দেখছি। আমি এতদিন শুনেছি মেয়েরা হাতের নখ বড় রাখে। কিন্তু তোমার দেখছি পায়ের নখ বড়। বিশ্রী লাগছে।
সংগীতা কোন উত্তর করলো না। রফিক অ্যালবামের পরের ছবিটা দেখছে।
: ফটোগ্রাফি ভাল না।
সংগীতা এবারো কোন উত্তর করলো না, শূণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রফিকের দিকে।
কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর পরের ছবিতে চলে গেল রফিক। এই ছবিগুলো তোলা হয়েছে হিমালয়ের খুব কাছাকাছি। গতমাসে নেপাল থেকে ছোট্ট একটা ফ্যামিলী ট্যুর দিয়ে এসেছে সংগীতা। বেশির ভাগ ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডই তুষার শুভ্র পাহাড়-পর্বত।
একবার চোখ তুলে পাশের সঙ্গীনীর দিকে তাকালো রফিক। সংগীতা চায়ের খালি কাপে চুমুক দিয়েই চলেছে।
: তোমার অভ্যাসটা গেলো না।
: কোনটা? সুধালো সংগীতা।
: এই যে খালি কাপে চুমুক দেয়া।
: ও, তাই তো!
: ঠিক আছে, আরেক কাপের অর্ডার দিচ্ছি।
সংগীতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানানোর খানিকক্ষণের মাঝেই এক ক্যান্টিন বয় এসে চায়ের অর্ডার নিয়ে গেল।
: তোমার এ ছবিটা তো চমৎকার এসেছে। কে তুলেছে?
: রাশেদী।
: রাশেদী নিশ্চয়ই সব ছবিগুলো তুলেনি?
: না, শুধু ওটাই তুলেছে।
: ছবিটার সঙ্গে তোমার বাস্তব চেহারার অনেক মিল।
: মানে?
: মানে তুমি দেখতে চমৎকার। না না মচৎকার।
: ইয়ার্কি করবে না।
: উহু, আমি ইয়ার্কি করছি না। তুমি নিজেই দেখ। ছবিটা সংগীতার দিকে বাড়িয়ে দিল রফিক। আবার শুরু করলো, চোখ দুটো দেখো। মনে হচ্ছে এক্ষুণি রেগে যাবে। দাঁত বের করে হাসছো। দাঁতগুলো দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি কামড়ে দেবে; অবশ্য এই দাঁতে টুথপেস্টওয়ালাদের বিজ্ঞাপনের জন্য ভাল একজন দাঁত-মডেলও হতে পারো। ঠোঁটদুটো আবার কমলা রঙের। অবশ্য তুমি সবসময় কমলা লিপস্টিক ব্যবহার করো কিনা। আর কান দুটো দেখো, একেবারেই বিস্কুটের মতো। মিষ্টি বিস্কুট। আর গলায়-
: এজন্যই মন্তব্য করতে না করেছিলাম। তোমার স্বভাব তো আমার ভালই জানা।
: রাজকুমারী কি রাগ করলেন?
: না, রাজকুমারী যখন রাগ করাও নিষেধ।
: তার মানে, তুমি নিজেকে রাজকুমারী মেনে নিচ্ছো!
: কেন খুব রাজকুমার হতে ইচ্ছে হচ্ছে তোমার? একটা ঢাউস মার্কা চেহারা। দেখে মনে হয়, সারাদিন খেয়ে সারারাত ঘুমাও। শরীর বানিয়েছো একটা! মাত্র এইটটি ফাইভ কেজি!
: তবুও ভাল ঢাউস বলেছো। আমি তো ভেবেছিলাম না জানি কী বলবে। আর পঁচাশি কেজি, তোমার মত শুটকি হবো নাকি?
: কী বললে? ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।
: কেন, শুটকি বললাম। তোমার আবার মুটকি শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে নাকি?
: রফিক, আমি চলে যাচ্ছি।
কথা শেষ করেই সংগীতা উঠে দাঁড়ালো। সংগীতার শেষ কথাগুলো একটু জোড়ে শোনা গেল। আশেপাশের টেবিলের কয়েকজন ওদের দিকে তাকিয়ে নিল এক নজর, পরক্ষণেই আবার নিজেদের কাজে মন দিল তারা।
: এবার দেখি সত্যি রাগ করেছো। সরি বাবা। বসে পড়ো। লোকজন দেখছে।
সংগীতা বসে পড়লো।
: আর কিছু খাবে?
: না। সংক্ষেপে উত্তর দিল সংগীতা।
: আমাকে ক’টা ছবি দেবে?
: তোমার যেটা যেটা পছন্দ নেবে। তবে এখনো তো তোমাকে একটা ছবি দেখানোই হয়নি।
: কোন ছবিটা, দেখি।
বইয়ের ভেতরে সযতেœ রাখা একটি খাম বের কররো সংগীতা। খামটা এগিয়ে দিল রফিকের দিকে। খামের ভেতর থেকে একটা ছবি বের করলো রফিক, বললো, কিন্তু এ তো তোমার ছবি নয়। অপরিচিত ছেলের ছবি।
: তোমার অপরিচিত হলে আমার পরিচিত হতে পারে না?
: পারে। ছেলেটা কে? রফিকের চোখে দুষ্টুমি সন্দেহ।
: বাসা থেকে ঠিক করেছে, আমার বিয়ে দেবে। এ বেচারাকে পাত্র হিসেবে পছন্দ করা হয়েছে।
: তোমার বিয়ে? কবে? কবে ঠিক হলো? মানে, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।
: কি খুশি হওনি?
রফিক কোন উত্তর দিল না। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটা ফাজলামো করছে না তো? সময় নেবার জন্য পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটের কোণে নিয়ে আগুন জ্বাললো।
: ছেলেটা কেমন? আমার বেশ ভালই লেগেছে। মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরী করে। বছর খানেকের মধ্যেই বাইরে চলে যাবে; মানে আমিও যাব তার সাথে। ফ্যামিলি ভাল। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করো। প্লিজ রফিক।
এবারো কোন উত্তর এলো না ওদিক থেকে।
: কী ভাবছো, আমাদের বিয়েতে কী দেবে?
ও প্রান্ত নিরব। সংগীতা একটা মিরিন্ডা’র অর্ডার দিল। ঠান্ডা।
: এই শীতে মিরিন্ডা খাবে? কথা ফুটলো রফিকের মুখে।
: আমি না, তুমি খাবে। তোমার মনে হয় ‘জোড় কা ঝাটকা’ লাগতে শুরু করেছে, ওটা ধীরে ছে লাগানোর জন্য।
: ফান করছো? তুমি কেমন মেয়ে বলো তো? এতদিন তোমার সাথে সম্পর্ক, আর আজ অন্য কাউকে বিয়ে করার জন্য আমার কাছে সিদ্ধান্ত চাইছো। আমাকে অন্তত একটা সুযোগ তো দিতে পারো। সিগারেটে আরেকটা টান দিল রফিক।
: সম্পর্ক? কিসের সম্পর্ক? আমি তো জানি আমাদের সম্পর্ক শুধুই বন্ধুত্বের।
: আমি জানি প্রেমের, ভালবাসার, হৃদয়ের।
: হৃদয়ের তো বটেই। হৃদয়ের মিল না থাকলে তো বন্ধু হওয়া যায় না। আর তাছাড়া তুমি তো কোনদিন তোমার ভালবাসার কথা মুখ ফুটে বলোনি।
: না বলিনি। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রফিক।
ইতিমধ্যে ক্যান্টিন বয় মিরিন্ডা রেখে গেছে।
: নাও, মিরিন্ডা খাও।
: হোয়াট? তুমি আমাকে পাগল পেয়েছো? এতদিন তুমি আমাকে শুধুই ব্যবহার করেছো। একটুও ভালবাসোনি। অভিনয় করেছো আমার সাথে, তাই না? কী ব্যাপার, বাংলা সিনেমার ডায়লগ হয়ে যাচ্ছে দেখি! বাদ দাও, ভালবাসা যখন তোমার মাঝে নেই, আমি আর কী করতে পারি। বিয়ের কার্ড পাঠিয়ে দিও। যাব তোমার বিয়েতে।
: এবার তোমাকে সত্যি পাগল মনে হচ্ছে।
: থাক, আর ঘাটাতে হবে না। আমি চললাম।
: যাবেই তো, আরেকটা কথা শুনে যাও।
: বলো। বিয়ের আগে শেষ কথা।
: তুমি যে দেখি রীতিমত টেনশনে পড়ে গেছো। হেসে উঠলো সংগীতা।
: হাসছো কেন?
: হাসছি তোমাকে দেখে। আমি বললাম আর তুমিও বিশ্বাস করে ফেললে। এই তোমার প্রেম?
: মানে?
: মানে, I love you. একটু ফাজলামো করলাম।
: ফাজলামো করলে? তাহলে ছেলেটা কে?
: ছেলেটা? একটা ছেলে। সুন্দর, হ্যান্ডসাম, কিউট একটা ছেলে।
: আবার রহস্য করছো! রফিকের চোখে মুখে বিরক্তি।
: যাও, আরেকটা স্ট্র নিয়ে এসো। একসঙ্গে দু’জন মিরিন্ডা খাই। নরমাল মিরিন্ডা। বুঝলে, জোড় কা ঝাটকা ধীরে ছে লাগে- মিরিন্ডা!
অন্যান্য গল্প:
- বৃষ্টিস্নান
- ভয়
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১০ রাত ১:১২