..... শেষ বিকেলের নরম আলো ঝিকমিক করছিল ক্যাপ্টেন টনি স্যামুয়েলসেনের ব্যাজ এ। ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ২৫০ মিটার লম্বা বিশাল কমার্শিয়াল ফ্রেইটার এমভি কলম্বাসের ব্রিজে দাঁড়িয়ে কফির মগে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছিলেন তিনি। শক্তপোক্ত নরওয়েজিয়ান লোকটার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, আর কয়েক সপ্তাহ পরই অবসর নিচ্ছেন। এটাই ক্যাপ্টেন হিসেবে স্যামুয়েলসেনের শেষ ভয়েজ। নাবিক হিসেবে বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়েছেন। ডেক ক্যাডেট হিসেবে জীবন শুরু করে ধাপে ধাপে ক্যাপ্টেন হয়েছেন। জীবনের মহামুল্যবান ত্রিশটি বছর সাগরে কেটে গেছে। পোড় খাওয়া লোক, দেখলেই বোঝা যায়।
সাগরের এক ধরনের নেশা আছে। যৌবনে এই নেশায় আকৃষ্ট হয়েই জাহাজে চাকরি নিয়েছিলেন। ইদানিং তার খুব ক্লান্ত লাগে। বন্দরে বন্দরে ঘুরতে মন টানে না। নরওয়ের দক্ষিণে ছোট্ট শহর গ্রিমস্টাডে ফেলে আসা পরিবারের কথা মনে পরে। স্ত্রী লিন্ডি, একমাত্র মেয়ে লিনা আর মাত্র হাঁটতে শেখা নাতনী এমিলি - তার শেষ জীবনের ভালবাসা।
- তোমাকে ভালবেসে আমি কিছুই দিতে পারিনি লিন্ডি ...। শেষবার ছুটিতে যখন বাড়ি গিয়েছিলেন, বলেছিলেন স্যামুয়েলসেন।
- পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনের বেশিরভাগটাই তুমি আমাকে মিস করে কাটিয়েছ টনি। আমার কাছে এটা কম কিছু নয়। হেসে বলেছিল লিন্ডি।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ফার্স্ট মেট তার দায়িত্ব বুঝে নিতে এসেছে।
- হ্যালো রবিন, স্টারবোর্ডে কি অবস্থা? হেসে ফার্স্ট মেটকে বললেন স্যামুয়েলসেন।
- হ্যালো স্যার! ওদিকটাতে সব গোছানো আছে। কয়েকজন এশিয়ান ডেক ক্যাডেট গিটার বাজিয়ে এরই মধ্যে হেরে গলায় গান জুড়েছে। সারাদিন পর ওরা এতো এনার্জি কোত্থেকে পায় ঈশ্বর জানেন।
- ওরা তরুন, রবিন। ওদের রক্তই আলাদা। ওরা আমাদের মত বুড়িয়ে যায়নি। দেখি আজ একবার ওদিকে যাব।
- আমি কি আসব স্যার?
- না না। আমি শুধু একটু ঘুরে আসব।
মেইন ডেক থেকে স্টারবোর্ড প্রায় দুশো মিটার। ইদানিং অনেকটা দূর মনে হয়। ধীরে ধীরে যাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন। হঠাৎ টানা টানা সুরের একটি গান তাঁকে থামিয়ে দিল। গানের কথা বোঝা যাচ্ছেনা, গায়কের গলাও আহামরি ভাল না, কিন্তু কি ভীষণ আকুতি ঝরে পরছে সুর থেকে! আহা! কি অনির্বচনীয় বিষাদ! যেকোনো মহান সঙ্গীতের কি ভীষণ আকৃষ্ট করার ক্ষমতা!
গান গাইছিল ডেক ক্যাডেট আনিস। বাংলাদেশের ছেলে। ওকে রিক্রুট করার একমাত্র কারন ওই দেশের মানুষ পিপড়াদের মত কর্মঠ। এও ব্যাতিক্রম নয়। সন্ধ্যায় সমবয়েসি আরও কয়েকজন ক্যাডেটকে নিয়ে ওই গান গায়। মাঝে মাঝে রাম খেয়ে পাগলামি করে। নাবিকদের জীবনে এসব স্বাভাবিক। ডিউটির পর জুনিয়রদের পাগলামি বানিজ্যিক জাহাজে প্রশ্রয়ের চোখেই দেখা হয়। এরা যে অমানুষিক পরিশ্রম করে তাতে এটুকু প্রশ্রয় না দিয়ে চলে না।
- হ্যালো ক্যাডেট! কি গান গাচ্ছিলে?
পেছনে স্বয়ং ক্যাপ্টেনকে দেখে ধরমর করে উঠে দাঁড়ায় আনিস।
- সরি স্যার। এই এমনিতেই। আর গাইবো না স্যার। কোনমতে জবাব দেয় সে।
- না না, ভাল গান।
- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আপনার ভাল লেগেছে?
- সুরটা চমৎকার, কিন্তু কথা গুলো বুঝিনি। একটু বুঝিয়ে বলবে, সান?
- আসলে স্যার এটা নাবিকদেরই গান। একজন সেইলর নীল সাগরকে ডেকে বলছে তাকে মুক্তি দিতে। তার বন্দরে বন্দরে ঘুরতে মন টানছে না। বাড়ির কথা মনে পরছে। একলা বাড়িতে তার স্ত্রী তার পথ চেয়ে আছে। টিপিক্যাল সেইলর'স সং, স্যার।
- ও, তাই? বাহ বেশ বেশ। ক্যারি অন।
- ইয়েস স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।
সন্ধ্যা মিলিয়েছে। পোর্ট সাইড হয়ে মেইন ডেকে ফিরে যাচ্ছেন স্যামুয়েলসেন। অনেকদিন আগে শোনা একটা গান মনে পরছে তার। কি যেন নাম গানটার? Jamaica Farewell ! নাকি Kingston Town? বয়স হয়েছে। স্মৃতি আজকাল লুকোচুরি খেলতে পছন্দ করে।
- বয়স টনি, বয়স। বয়স আমাদের কাছে আনবে। দেখে নিও। বলেছিল লিন্ডি।
গানের কথা গুলো মনে পরেছে। কি আশ্চর্য মিল গান দুটোর মাঝে। দূর দেশের দুই মানুষ একই আবেগ নিয়ে একই রকম দুটো গান লিখে ফেলেছে। কি অদ্ভুত। ভালবাসার প্রকাশে বোধ হয় সবাই এক হয়ে যায় ...
গুন গুন করে গান গাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন টনি স্যামুয়েলসেন। -
...... I'm sad to say I'm on my way
Won't be back for many a day
My heart is down
My head is turning around
I had to leave a little girl in Kingston town......
তোমাকে ভালবাসি লিন্ডি। আমি আসছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৬ রাত ১২:৩৯