ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে গেছে। শুভ পাশে ঘুমিয়ে আছে। আজ একটা বিশেষ দিন তবে শুভর মনে হয় সেটা মনেই নেই। মনে থাকবেই বা কি করে, সারাদিন তো অফিস নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আমার জন্য তার সময় কোথায় ? কেন যেন কান্না পাচ্ছে আমার একটু একটু। আজকের মত এরকমি একদিনে জিবনে অনেক কিছু ঘটেছিল আমার। কিন্তু এসব শুধুই এখন কল্পনা। কাল ভার্সিটিতে ক্লাস আছে তাই সবকিছু ভুলে ঘুমানোর চিন্তা করলাম। ঘুমানোর চিন্তা করতেই মনে হল, আসলেই কি সব কল্পনা ছিল?
সকালে উঠেই নিয়ম মত নাস্তা বানালাম। শুভ আমি একসাথে নাস্তা করে ও অফিসে চলে গেল। আর আমি রেডি হয়ে ভার্সিটিতে আসলাম। আমি তাসফিয়া জাহান তৃনা। একটা বেসরকারী ভাসিটিতে অধ্যাপনা করি। শুভর সাথে বিয়ের অনেক আগে থেকেই আমি এখানে আছি। শুভকে বিয়ের পর নিয়েও এসেছিলাম অনেকবার। সে অনেক বেশি খুশি হত আমার সাথে ভার্সিটিতে আসতে পারলে। কিন্তু শুভ কখনই আমার জন্মদিনের কথা ভোলেনা। তবে আজ কেন ভুলে গেল? তবেকি সে আমাকে আর আগের মত ভালবাসে না? এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতেই আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবুও মনের মাঝে কষ্ট নিয়েই অফিস কক্ষে গেলাম। সাইন করে ক্লাস নিতে গেলাম। এমনি ভাবেই দুটো ক্লাস নিলাম। শেষ ক্লাসটা নিচ্ছিলাম বিবিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের। ক্লাস শেষ হওয়ার আগ মুহুর্তে একজন ছাত্রী না বলেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। আমি কিছু বললাম না। এর কিছু পরে আরও কিছু ছাত্র ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। আমি এবার বললাম, কি ব্যপার, তোমরা এভাবে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছ কেন? কেউ কিছু বলছেনা যখন, তখন আমি ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসব বলে যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখনি দেখলাম সামনে সবাই বসা থেকে দাড়িয়ে গেল। আমি সামনে প্রশ্নবোধক চোখে দাড়িয়ে আছি। মনে মনে ভাবছি আগে তো এরকমটা হয় নি। তখনি বেরিয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা একে একে সবাই ভেতরে ঢুকলো। সাথে ফুল, বেলুন আরও অনেক কিছু। তখনি আবার সবাই একসাথে বলে উঠল , শুভ জন্মদিন ম্যাম। অনেক বড় একটা কেক নিয়ে এসে সামনের টেবিলে রাখল তারা। আমি তো ভাবতেই পারছিনা,আমার সামনে এসব কি হচ্ছে? অজান্তেই মুখে হাত চলে আসে আমার সাথে চোখ দিয়ে কিছু নোনাজল। সবাই মিলে কতকিছুর আয়োজন করেছে। তাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা জানলে কিভাবে আজ আমার জন্মদিন? তখন ওরা সবাই বলল, জেনেছি কোনভাবে। তারপর একসাথে সবাই কেক কাটলাম। এরমাঝে আবার অন্যান্য বর্ষের ছাত্রছাত্রীরাও এসেছে ক্লাসে। সবাই আমার জন্য এত কিছু করেছে তাই আমিও ভাবলাম সবাইকে আজ লান্ঞ্চ করাই। আমি যখন এটা সবাইকে জানালাম তখন সবাই অবাক করে দিয়ে বলল, ম্যাম খাওয়া দাওয়া পরে হবে। আগে আসুন আমরা গল্প করি কিছুক্ষন। আমি হেসে বললাম, কিসের গল্প করবে? একজন মেয়ে বলল, ম্যাম, আপনার জিবনে ঘটে যাওয়া এমন কোন আকর্ষনীয় গল্প আমাদের জানান যেটা দ্বারা আমরা কিছু শিখতে পারব। মেয়েটার কথায় কি ছিল জানি না তবে মনে হল কয়েকবছর আগে এই দিনে আমার সাথে কি ঘটেছিল সেটাই জানাই তাদের। খুব বেশি মনে পড়ছে এখন শুভর কথা সাথে সেই মানুষটিও। একটু চিন্তা করে আমি বললাম, একটা গল্প আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে তবে সেটা আকর্ষনীয় হবে কিনা বলতে পারছিনা। কয়েকজন বলল, ম্যাম বলুন আমরা শুনছি। আমি বলতে শুরু করলাম।
কয়েক বছর আগের কথা। ভার্সিটিতে আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষে। আমার হাসবেন্ড মানে তোমাদের স্যার তখন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। বরাবরের মতই আমি আশা করেছিলাম আমার জন্মদিনে সে স্পেশাল কিছু করবে। কিন্তু না। সেদিন সব বন্ধুরা মিলে অনেক মজা করলেও তোমাদের স্যার সেখানে আসেই নি। দুপুরের পর সে আমাকে একটা অনাথ আশ্রমের ঠিকানা পাঠিয়ে বলে, জলদি চলে আয়। আমিও কিছু না বলেই চলে আসি। তখন অবশ্য তোমাদের স্যার আমার শুধুই বন্ধু ছিল। আশ্রমের সামনে গিয়ে দেখি শুভ বসে আছে সেখানে। আমি তার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে কিছু বলব কিন্তু তার আগেই সে বলল, আমি চাই তোর এই জন্মদিনটা একটু অন্যরকম হোক। একটা বার এই আশ্রমের অনাথ বাচ্চাদের সাথে কাটিয়ে দেখ। খারাপ লাগবে না এটুকু বলতে পারি। আমি চুপ থেকে সম্মতি জানালাম। শুভ তখন আশ্রমের বাচ্চাদের জন্য কিছু কাপড় আর খাবার আমাকে দিয়ে বলল, চল ভেতরে। শুভর সাথেই ভেতরে আসলাম। কিন্তু ভেতরে এসেই দেখি আশ্রমটা যেন নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। একজন মধ্যবয়স্ক লোক এগিয়ে এসে বলল, আপনাদের কিভাবে সাহায্য করতে পারি? শুভ বলল, আমরা কিছু খাবার আর কাপড় বাচ্চাদের জন্য এনেছিলাম। এসব তাদেরকে দিতে চাই। আমার বন্ধুর আজ জন্মদিন। তাই এদের সাথেই দিনটা কাটাতে চায়। লোকটা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, কি চাচা কোন সমস্যা করলাম নাতো? চাচা বলল, আসলে কয়েকবছর আগে এক আপামনি এখানে প্রায় আসত। বাচ্চাদের অনেক কিছু দিত। বিয়ের পর তার সাথে তার স্বামীও আসত। কিন্তু একদিন এই আশ্রমেরই এক বাচ্চা রাস্তা পার হচ্ছিল। একটা মালবাহী ট্রাক দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছিল। সেই বাচ্চাটিকে বাচাতে গিয়ে আপামনি তার নিজের জিবনের মায়া ত্যাগ করে বাচ্চাটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন কিন্তু নিজে ট্রাকের নিচে পড়ে গেলেন। আমি আর তার স্বামী তখন সবাইকে খাওয়াচ্ছিলাম। চোখের সামনে এটা দেখার পর তার স্বামী দৌড়ে রাস্তায় এলো। কিন্তু ট্রাকের সামনের চাকাটা তার তলপেট দিয়ে চলে যায় তাই সেখানেই সে মারা যায়। তার স্বামী রাস্তার ঐ দৃশ্য দেখে সেখানেই জ্ঞান হারায়। কিন্তু তবুও সব মেনে নিয়ে আজও সে এখানে আসে। আশ্রমের এমন কোন বাচ্চা ছিলনা যে সেদিন কাঁদেনি। কারও মুখে ভাত তুলে দিতে পারছিলাম না আমি। প্রতিবছর এই দিনে তাই সবাই একটু সেঁজে থাকে। আশ্রমটাকেও সাজানো হয়। আজ সেই আপামনিরও জন্মদিন। এতক্ষন কথা বলতে বলতে চাচার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমারও চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এলো। শুভ বলল, চাচা, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবেকি আমরা আজকে এই জন্মদিনে থাকতে পারি। চাচা এবার চোখের পানিটা মুছু হেসে বলল, কেন থাকবানা অবশ্যই থাকবা। তবে তোমরা নাহয় আগে বাচ্চাদের সাথে দেখা করে আসো। আর কিছুক্ষন পর সেই আপামনির স্বামী চলে আসবে। শুভ আর আমি কিছু না বলে এগিয়ে গেলাম। বাচ্চাদের সবাইকে কাপড় দিলাম সাথে খাবার গুলোও দিলাম। তাদের ছোট ছোট মুখের নিষ্পাপ হাসিটা যেন হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মনে হয় এই হাসি আর খুশিগুলো সাথে নিয়েই সারাজিবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। সবকিছু দেওয়া হয়ে গেলে আমরা আশ্রমের এক পাশে দাড়িয়ে আছি। কিছুক্ষন পরে এক লোককে ভেতরে ঢুকতে দেখেই আশ্রমের সব বাচ্চারা দৌড়ে তার কাছে গেল ভাইয়া এসেছে ভাইয়া এসেছে বলে। লোকটি সেই চাচাকে বলল, চাচা সবকিছু ঠিক আছে তো? চাচা বললেন হ্যা বাবাজি সব ঠিক আছে। বাচ্চাদের সাথে অনেক কথার পর হঠাত লোকটি আমাদের দিকে তাকালো। তাকিয়ে কেন যেন দেখেই থাকলো। আমি বুঝতে পারলাম এই লোকটিই সেই মেয়ের স্বামী। তখন লোকটি কেকটা চাচাকে দিয়ে আমাদের কাছে আসল। শুভ লোকটির দিকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, আমি শুভ। লোকটি মৃদু গলায় বলল, আমি মামুন। লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও লোকটির দিকেই তাকিয়ে আছি। কি সুন্দর চোখ লোকটির। এই চোখের গভীরতা মাপার কোন যন্ত্র এখনো আবিষ্কার হয় নি। আমিও হাত বাড়িয়ে বললাম, আমি তৃনা। লোকটি যেন এবার থমকে গেল। কিছু না বলেই সে বাচ্চাদের নিয়ে ভেতরে গেল। কিছু পরে চাচা এলো এখানে। আমাকে বলল, আসলে তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা তবে তুমি দেখতে অনেকটাই তৃনা মামনির মত। তোমাকে তুমি করে বললাম কিছু মনে করনি তো? আসলে তৃনাকে সবসময় তুমি করেই বলতাম তো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ মেয়ের নামও কি তৃনা ছিল? চাচা এবার চোখদুটো ছোট করে জিজ্ঞেস করল, তোমারও নাম কি তৃনা? আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়ালাম। একটু পরে সেই লোকটি এসে বলল, আপনারা সবাই আসুন। আজ একজনের জন্মদিন তাই কেক কাটতে হবে। চাচা সেই লোকটিকে বলল, মামুন বাবাজি, আজ এই মামনিরও জন্মদিন। লোকটি আবারও স্থির হয়ে গেল। কিছু সময় কেউ কিছু বলছে না তাই বুঝি শুভ বলল, চলুন তবে কেক কাটি। লোকটি সহ সবাই ভেতরে গেলাম। কেক কাটার সময় লোকটি ছুরি টা আমার হাতে দিয়ে বলল, আজ আপনিই কেক কাটুন। আমি একটু ইতস্তত বোধ করছিলাম কিন্তু তখনি লোকটি আবারও বলল, আপনার নিজের এবং আমার তৃনার হয়ে কাটুন প্লিজ। আমি তখন বাচ্চাদের সাথে নিয়ে কেকটা কাটলাম। কেকের মাঝে তৃনা ইংলিশ অক্ষরে এত সুন্দরভাবে লিখা ছিল যে আমি ঐ লিখাটির মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কিছু জিনিস সময়ের অগোচরে হয় এরকম৷ তাই বলে এতটা নাট্যকর না হলেও হত। কেকটা কেটে লোকটিকে আমি কেক খাওয়ানোর জন্য একটু কেক নিয়ে তার দিকে ধরলাম। লোকটি মৃদু হেসে আমার হাত থেকেই একটু কেক ভেঙ্গে নিয়ে আমাকে খাইয়ে দিল তারপর আমার হাতে খেল। এরপর সবাইকে কেক খাওয়ালাম। সবকিছু শেষ হলে লোকটি আমাদের কফি খাওয়ার কথা বললেন। কিন্তু সময় ছিল না বলে সেদিন আর হল না। সবাইকে বিদায় জানিয়ে শুভ আর আমি চলে আসি।
সেদিন শুভকে কোন প্রকার ধন্যবাদ জানাইনি। আমার জিবনে এরকম কোন জন্মদিন পালন করব এটা আমি ভাবিনি। সত্যি একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে কয়েকটা দিন। সবসময় ভেবেছি ঐ লোকটির কথা। মামুন সাহেব। তৃনার কথা। মেয়েটি নাকি আমার মত দেখতে কিছুটা। আমার নামেই নাম। আর জন্মদিনও একই দিনে। ভাবতেই কতটা অবাক লাগে। এসব ভাবতেই তৃনাকে দেখার খুব ইচ্ছে হল। তাই আবার সেই আশ্রমে চলে আসি। চাচাকে জিজ্ঞেস করি মামুন সাহেবের কথা। চাচা তখন উনার অফিসের ঠিকানা দিলেন আমাকে। আমি তখনি মামুন সাহেবের অফিসে চলে আসি। অফিসে এসেই একজনকে জিজ্ঞেস করতেই উনি মামুন সাহেবের রুম দেখিয়ে দিলেন। আমি উনার রুমে গিয়ে নক করলাম।
- আসতে পারি?
- (এদিকে তাকিয়ে) আরে আপনি, আসুন আসুন।(মামুন)
- কেমন আছেন আপনি?
- এইতো আছি। বসুন না।(মামুন)
- আসলে আমি আপনার কাছে একটা জরুরী দরকারে এসেছি। আমি বেশ কয়েকদিন থেকে নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। আপনি কি একটা বারের জন্য আমাকে সবটা বলবেন।
মামুন সাহেব একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু চিন্তা করে উনি বললেন, আজ কফি খাবেন তো? আমি হাসলাম। দুজনে একটা রেষ্টুরেন্টে বসলাম। কফি অর্ডার করেই উনি বলতে শুরু করলেন,
আমরা তখন ভার্সিটিতে ছিলাম। স্কলারশীপের জন্য পরীক্ষা হয়েছিল সে পরীক্ষায় আমরা দুজন টিকেছিলাম। স্যার এসে নাম বলল, তৃনা রহমান এবং আল মামুন। আমার জন্য স্কলারশীপটা অনেক দরকার ছিল তাই খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু ক্লাস শেষে যখন তৃনাকে প্রাইভেট কারে বাসায় যেতে দেখেছিলাম তখন মনে হয়েছিল যে বড়লোকের মেয়ে হয়েও কেন স্কলারশীপ নিল। এটা তো অন্য কেউও নিতে পারত। এসব চিন্তা করেই সেদিন চলে এলাম। প্রতিদিন ক্লাস করতাম কিন্তু তৃনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হত না আমার। মাথায় শুধু ঘুরত এরা বড়লোক হলেও, এদের মানবতা একটু অন্যরকম। মধ্যবিত্ত ঘরের ছিলাম বলে সবসময় অনেক হিসেব করে চলতে হত। সেমিস্টার ফাইনাল এর শেষে ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে বাসের জন্য দাড়িয়ে আছি। তখন একটা গোলগাল, মায়াময়ী বাচ্চা ছেলে পেছনে এসে দাড়ালো। ভালভাবে লক্ষ করে দেখলাম তার পড়োনের গেন্জিটা ছেড়া আর খালি পায়ে। মায়াময়ী দুটি চোখ দিয়ে করুন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা অনেক সুন্দর কিন্তু এই ছেলেকে এখানে কোনভাবেই আশা করছি না। তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম এই বাবু তোমার নাম কি? পায়ে স্যান্ডেল নেই কেনো? ছেলেটি নির্ভয়ে বলল, আমারে কয়টা টাকা দিবেন? আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, তোমার বাসা কথায়? ও বলল, পাশের অনাথ আশ্রমে থাকি। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। এইটুকু বাচ্চা এতিম ভাবতেই কেমন লাগে। পকেটে যা টাকা ছিল তার কিছুটা দিয়েই ছেলেটাকে একটা পাউরুটি আর কিছু কলা কিনে দিলাম। ছেলেটা সেগুলো নিয়ে আশ্রমে চলে গেল। আমি তার পেছন পেছন গিয়ে দেখলাম একটা পাউরুটিই তারা সবাই একটু একটু করে খাচ্ছে। এই ছোট ছোট বাচ্চাদের মানবতা দেখে আমি হতভম্ব। তারপর আরও দুটো পাউরুটি কিনে তাদের দিয়ে আসলাম। এখন বাসায় ফেরার মত টাকা নেই। তাই হেঁটেই পথ ধরলাম। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছি এর কিছু পরেই একটা গাড়ি পাশে এসে থামলো। আমি দাড়িয়ে গেলাম। উইন্ডো গ্লাসটা নামিয়ে তৃনাকে দেখতে পেলাম। মাথাটা বের করে বলল, এই মামুন ,হেঁটে হেঁটে কোথায় যাচ্ছ? আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম এইতো সামনে। ও বলল, গাড়িতে উঠে এসো। আমি বললাম, আমিতো সামনেই যাব তাই আজ থাক অন্যদিন। ধন্যবাদ তোমাকে। ও এবার গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো। বলল, তুমি থাকো নুরজাহান রোডে। কারওয়ান বাজার থেকে হেঁটেই যাবে আর বলছো সামনে? তাছাড়া বাসের ভাড়াও তো আজ শেষ করে ফেলেছো। আমি এবার তার দিকে তাকালাম। আমি বললাম, মানে বুঝলাম না, কি বলতে চাচ্ছ তুমি? ও বলল, আমি দেখেছি সবটা। এবার আসো তোমাকে নামিয়ে দেই। আমি বললাম, আমি যেতে পারবো হেঁটে। ও তখন আমার দিকে তাকিয়ে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে কি যেন বলল। গাড়িটি চলে গেল। আমি বললাম, তুমি যাবে কিভাবে? ও বলল, হেঁটে যাব তোমার সাথে। আমি বললাম, পাগলামী কেন করছো? তুমি এই রোদ্রে রাস্তায় হেঁটে অভ্যস্ত নও। তোমার শরীর খারাপ করবে। ও বলল, এসব বাদ দাও, আমার কিছু হবে না। এখন বল, কেমন লাগলো আজ কিছু অনাথের ক্ষুধার্ত মুখে খাবার তুলে দিয়ে? ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, বাসে গেলে হয়তবা একটু ছায়ার মধ্যে বসে শান্তিতে যেতে পারতাম। তবে এখন এই কড়া রোদটাকে অনেক শীতল মনে হচ্ছে। প্রথম মনে হচ্ছে কিছু করেছি আমি। নিষ্পাপ সেই মুখগুলোর তৃপ্ত হাসি আর মানবতার বহিঃপ্রকাশে আমি এখন পরিপুর্ন। তাই আজ হাঁটতেও ভাল লাগছে। ও বলল, এজন্যই তোমাকে সঙ্গ দিতে আমি এলাম। আমি হাসলাম। বললাম, একটা কথা জিজ্ঞেস করব তোমায়? ও বলল, স্কলারশীপের ব্যপারে কিছু বলবে? আমি অবাক হলাম। বললাম, কিভাবে বুঝলে? ও বলল, আসলে তুমি একদিন এটা নিয়েই গল্প করছিলে তোমার বন্ধুদের সাথে, তখনই শুনেছি। তুমি হয়ত ভেবেছিলে আমার মত মানুষদের স্কলারশীপ কেন দরকার হয়? কিন্তু আমি স্কলারশীপটা নিয়েছি যে স্কলারশীপ পাওয়ার যোগ্য তার জন্যই। প্রতিবারেই স্কলারশীপ এমন কেউ পায় যাদের এটার কোন দরকার হয় না। তাই আমি এই স্কলারশীপটা নিয়ে নিম্মমানের ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করা চেষ্টা করি এই আরকি। যেমন এবার ফর্ম পুরোনের জন্য আসিফের কাছে টাকা ছিল না। আমি স্কলারশীপের টাকাটা তাকে দিয়ে দিই। এরকমি কিছুটা উদ্দেশ্য আমার। তাই আশা করি আমাকে এসব নিয়ে আর খারাপ ভাববে না। আমি বললাম, আমি কখনও খারাপ ভাবিনি তোমাকে। ও বলল, আমি জানি মামুন। সেদিনের সেই আড্ডা থেকেই আমি তোমাকে লক্ষ করছি। তুমি মানুষ হিসেবে অনেক ভাল যে কারনে আজ তোমার মানবতা এতো উপরে। অন্য কেউ হলে দেখতে যে সেই ছেলেটিকে তারা থাপ্পর দিয়ে সরিয়ে দিত। কিন্তু তুমি সেটা করোনি। কিন্তু তাই বলে সব বড়োলোকেরাই যে মানবতা বোঝেনা এমনটা নয়। আমি বললাম, সরি, আসলে তোমার ব্যপারে এসব ভাবা ঠিক হয়নি। আর কি বলব বুঝতে পারছি না। অনেকটা সময় নিয়ে হাঁটছি আমরা। চুপচাপ হয়ে আছি দুজনেই। হঠাত ও বলল, আইসক্রীম খাবে? আমার হাত পকেটে চলে গেল। এটা দেখে ও আমার হাত ধরে কনফেকশনারীর দোকানে নিয়ে এলো। দুজনে দুটো আইসক্রীম নিলাম। তৃনা আরও দুটো কিটকাট নিলো। আইসক্রীম খেতে খেতে আমরা সামনে হাঁটছি। মেয়েটার প্রতি হঠাত করেই কেন জানি একটা ভাললাগা কাজ করল। আমি তাকালাম ওর দিকে। ও যে এতটা সুন্দর সেটা আমি কখনও লক্ষ করি নি। বাচ্চাদের মত করে আইসক্রীমটা খাচ্ছে সে। আমি হেসে ফেলি ওর খাওয়ার স্টাইল দেখে। আমি হাসাতে ও অনেক লজ্জা পেল। এবার তার দিকে তাকিয়ে আমি নির্বাক। লজ্জাবতী কোন মেয়েকে এত সুন্দর লাগে দেখতে আগে জানতাম না। এজন্যই বলে, লজ্জা নারীর ভূষন। মনে মনে ভাবছি, প্রেমে পরে যাব না তো আবার। কিছু পরে মনে হল, অনেক আগেই প্রেমে পড়ে গেছি আমি। যাই হোক সেদিন ও আমার বাসা পর্যন্ত এসেছিল। তারপর তাকে একটা সিএনজি ঠিক করে দেই আমি। অনেক জোর করেছিলাম বাসায় আসার জন্য কিন্তু সে বলল অন্য কোন দিন আসবে। তবে যাওয়ার সময় হাতে একটা কিটকাট দিয়ে সে বলল, এটা আমার অনেক পছন্দের। এর পরেরদিন ভার্সিটিতে এসে আমি তাকে খুজলাম কিন্তু পেলাম না। দুদিন পর ও ভার্সিটিতে আসলো। আমি তার কাছে গিয়ে হায় হ্যালো বাদ দিয়েই বললাম, গত দুদিন আসনি কেন? ও আস্তে করে বলল, একটু সমস্যা হয়েছিল। আমি বললাম, তুমি অসুস্থ হয়েছিলে তাই না? ও কিছু না বলে মাথা নিচু করে আছে। আমি আবারও বললাম, তোমায় নিষেধ করেছিলাম আমি সেদিন আমার সাথে হাঁটতে। তারপরও শুনলেনা। এখন কি হল এসব? আরও কিছু বলতে যাব তখন ও বলল, চল ঐ আশ্রমে যাই, সবাইকে একটু দেখে আসি। আমি কিছু বলতে পারলাম না। ওর সাথে চলে গেলাম আশ্রমে। আশ্রমে ঢুকতেই সবাই আপু বলে দৌড়ে তৃনাকে ঘিরে ধরল। আমি শুধু অবাক হয়ে আছি। হঠাত একজন মধ্যবয়স্ক লোক বেরিয়ে এলো। লোকটা এসে তৃনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর আমার দিকে তাকালো। আমি সালাম দিয়ে বললাম, আমি ওর বন্ধু। লোকটি মৃদু হেসে চলে গেল। বাচ্চারা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাত একজন বলল, আপু ইনি কে? তৃনা বলল, এটা তোমাদের ভাইয়া। একজন বলে উঠল, শুধু ভাইয়া না দুলাভাই বলে হাসতে শুরু করল। তৃনা কেমন যেন লজ্জা পেল। ওদেরকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে তৃনা আমাকে বলল, ওদের কথায় কিছু মনে করিও না প্লিজ। ওরা ছোট তো তাই হয়ত দুষ্টুমি করেছে। আমি মজা করার জন্য রাগের ভাব নিয়ে বললাম, এখানে তোমার সাথে আসাটাই ঠিক হয়নি বলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ও এবার আমার সামনে এসে বলল, সরি বললাম তো আমি। ওরা ছোট তাই হয়ত বুঝে নি। প্লিজ রাগ করিও না। সরি আমি। এভাবে রিকুয়েস্ট করতে দেখে আমি আর থাকতে পারলাম না। হেসে দিয়ে বললাম, এইটুক একটা ব্যপারে কেউ রাগ করে। তুমি এতো পাগলি কেন? এবার ও হাসলো। আমি বললাম, এরা সবাই তোমাকে কিভাবে চেনে? ও বলল, এমনিতেই চেনে। কিন্ত কথাটি আমার বিশ্বাস হল না। তাই সেদিন তাকে বিদায় দিয়ে আমি আবার আশ্রমে আসি। এসে সেই মধ্যবয়স্ক লোকটিকে তৃনার ব্যপারে জিজ্ঞেস করি। জানতে পারি, তৃনা অনেক আগে থেকেই এই বাচ্চাদের অনেক কিছু দেয়। বিভিন্ন সময় কাপড় থেকে শুরু করে খাবার সবকিছুই দেয়। শুধু এই আশ্রমেই নয় অন্যান্য আশ্রম গুলোতেও এসব করে। এসব শোনার পর তৃনার প্রতি আমার সম্মান অনেক বেড়ে যায়।
এরপর তৃনা আমার অনেক ভাল বন্ধু হয়ে যায়। একসাথে নোট করি। বিভিন্ন আশ্রমে গিয়ে অনাথ বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাই। সব কিছুর পরেও সে আমার কথা ভুলত না। যথেষ্ঠ কেয়ার করত আমার।এভাবেই অনেক ভালভাবেই কেটে যাচ্ছিল আমাদের। দেখতে দেখতে ভার্সিটি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এলো। যদিও আমি তাকে ভালবাসি কিন্তু কখনও তাকে বলিনি। তাই ভার্সিটির শেষ কয়েকদিন আমি খুবই বিচলিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই একদিন তাকে একটা পার্কে আসতে বলি আমি। ও আসার পর ওর সাথে কথা বলতেও কেমন যেন লাগছিল। কিন্তু মনে শুধু একটাই কথা, আজ যদি বলতে না পারি তবে আর কোনদিন পারব না। সেও চুপ হয়েই আছে। কিছু বলছে না। মনে হয় কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে। আমি কিছু বলতে যাব তখনি ও বলল, মামুন আমি জানি তুমি কি বলবে। আমিও অনেকদিন ধরেই তোমাকে এটা বলতে চাচ্ছি কিন্তু একটা বিশেষ কারনে আমি তা বলতে পারছি না। আমি অবাক হয়ে বললাম, কি সেই বিশেষ কারন? ও আমার হাত দুটো ধরে বলল, সেটা বলার জন্যই এসেছি আমি তবে কথা দাও আমাকে ছেড়ে যাবে না। অন্তত বন্ধুত্বটা রাখবে। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি বল কি সেই কারন? ও একটু চুপ থেকে বলল, আমি জানি না আমার বাবা মা কে? আমার বর্তমান যে বাবা মা আছে তারা আমার আসল বাবা মা নয়। যদিও কখনই তারা আমাকে এটা মনে করতেই দেয় নি। কিন্তু আমি তা জেনেছি। আমাকে এরকমি এক অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। হঠাত যেদিন আমি মা বাবার রুমের আলমারীতে এসব দত্তকের কাগজ দেখতে পাই সেদিন আমার দিকবিদিক শুন্য হয়ে যায়। বাবা মাকে এসব বললে তারা আমাকে নিয়ে অনেক কান্না করেন। বলেন, কখনও যেন এসব নিয়ে না ভাবি। আমি জানিনা আমার জন্ম কিভাবে কোথায় হয়েছে? আমিও একজন অনাথ বাচ্চা ছিলাম। আর ঠিক একারনেই আমি তোমাকে কিছু বলতে পারছিলাম না। একজন অনাথকে তো কেউ মেনে নেয় না তাই না? এসব বলে ও থামলো। সবটা শুনে আমি ওর দিকে তাকালাম। ও অঝোরে এসব বলে কাঁদছে। আমি বললাম, তুমি ঠিক বলেছো। একজন অনাথকে আর কেই বা মেনে নেয়। ওখান থেকে উঠে চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি তখন পেছন থেকে কান্নার আওয়াজটা বেড়ে গেল। নাহ এই মেয়ের একটুও ধর্য নেই। সামনে গিয়ে চেচিয়ে বললাম, এই মেয়ে এই, কান্না কর কেন হুম? একটুও ধর্য নেই। সামনে ফুল কিনতে যাচ্ছিলাম। প্রোপজ করতে ফুল লাগে তো নাকি? এটুকু সময় একটু চুপচাপ থাকা যায় না? ও এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল। ওর শরীর কান্নার কারনে মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছে। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, পাগলি আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি কি ছিলে আর এখন কি আছো এসব দেখে নয়। আমি শুধুই তোমার জন্য তেমাকে ভালবাসি। আর কিছুক্ষন পর ও একটু শান্ত হল। এরপর কয়েকদিন বাদে আমার একটা চাকরী হল। পরিবারের সবাই মিলে আমাদের দুজনের বিয়ে ঠিক করল। তৃনার বাবা মা তৃনাকে অনেক বেশিই ভালবাসে তাই তারাও না করে নি। বিয়ে হওয়ার পর আমাদের অনেক সুখেই দিন কাটছিল। তৃনার ছোট ছোট পাগলামি আর ভালবাসার মধ্যে দিয়ে আমার ভালই চলছিল। আগের মত আশ্রমেও সবাই আমাদের সাথে অনেক মজা করত। যেদিন তৃনা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তার আগের রাতে ও বলেছিল,আমি যদি না থাকি তবে তুৃমি কি মিস করবে আমায়? এরকম কথায় আমি সেদিন অনেক অবাক হয়েছিলাম। পরোক্ষনে ও আবার বলল, একদম মিস করবে না আমায়। আশ্রমের সেই সকল বাচ্চাগুলোর মাঝে তুমি আমাকে খুজে নিও। ওদের সবার মাঝে আমি লুকিয়ে তোমাকে দেখব। আর বলা যায় না, কিছু পোলকের জন্য তোমাকেও দেখা দিতে পারি। আমার মন খারাপ হয়েছিল অনেক এসব শুনে। তাই আমিও এরকম কিছু বলতে যাব যখনি, তখনি ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। একটু চুপ থেকে বলল, আমি মজা করছিলাম কিন্তু তুমি এসব বলবে না। আমাকে সে কতটা ভালবাসে সেটা সেদিন বুঝেছিলাম আমি। এই একজন মেয়েকে দেখেই আমি কতবার অবাক হয়েছি তা বলতে পারব না। তারপর তো পরেরদিন আশ্রমের এক বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে.......
এই ছিল তৃনা রহমান আর মামুন সাহেবের কাহিনি। এরপর মামুন সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না। তার চোখ এখন পানিপুর্ন। আমিও এসব শুনে কেঁদেই ফেলেছি। একটু পরে শান্ত হয়ে উনি আমাকে বিদায় দিয়ে চলে গেলেন। আশ্চর্য হলেও দুজনের কফির কাপে কেউই হাত দেই নি। পুরোটাই পরে ছিল। রাতে বাসায় ফিরে আমি এসবি ভাবছিলাম। তার জিবনের কাহিনী শুনেই আমি আবেগের বসে তার প্রেমে পরে যাই। তাই কিছুদিন পর আমি আবার তার কাছে এলাম। মামুন সাহেব আমাকে একটা গোরস্থানের পাশের খোলা মাঠে নিয়ে এলেন৷ আমাকে তৃনার ছবি দেখালেন। সত্যিই মেয়েটা দেখতে কিছুটা আমার মতই। আমি তৎক্ষনাত তাকে আমার ভালবাসার কথা জানাই। আমাকে আশ্চর্য কর উনি হাসতে শুরু করলেন। বললেন, জিবনে কখনও কাউকে সত্যিকারের ভালবেসেছেন? আমি কিছু বলতে পারি না তাকে। উনি আবারও বললেন, আপনি তৃনার মত দেখতে কিছুটা কিন্তু তৃনা নন। আমি তৃনাকে ভালবাসি এখনোও আর সেটা দিনদিন বেড়ে চলেছে। আমি আশ্রমে কেন যাই জানেন? শুধু তৃনাকে এক পোলক দেখার জন্য। ঐ ছোট ছোট বাচ্চাদের হাসিতে আমি তৃনাকে দেখতে পাই। যখন একা বসে থাকি তখন মনে হয় তৃনা পাশে বসে আছে। আমি শুধু যে তৃনাতেই আবদ্ধ। তাহলে বলুন আমি কিভাবে আপনাকে ভালবাসব? আর আপনি যেই ভালবাসার কথা বলছেন সেটা ভালবাসা নয়। এট শুধুই একজন মানুষের জন্য কিছু মনে হওয়া। আসলে কি জানেন আমরা যারা ভাল কাজগুলোকে করতে ভালবাসি তারা অন্য কোন ভাল কাজ করা মানুষগুলোকেও ভালবাসি। তবে এটা মানবতার খাতিরে। এই ভালবাসা ঐ ভালবাসার কাছে কিছুই না। তৃনার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই আমি তার কাছে যাই। মৃদু কন্ঠে শুধু এটুকু বলেছিল, নিজের খেয়াল রেখো। তারপর আমি জ্ঞান হারাই। মামুন সাহেব আরও বললেন, মজার ছলে বলা তার সেই রাতের কথাটার কত শক্তি ছিল জানি না তবে আজিবন একটা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম। যেমনটা আমি। আমি কিছু বলতে পারছিনা আর। মামুন সাহেব বলল, তবে আপনি চাইলে আমরা বন্ধু হতে পারি। বলতে গেলে বন্ধু হিসেবে কিন্তু আমি খারাপ নই। আমি হেসেছিলাম তখন৷ আরও কিছু কথা বলে আমি চলে আসি সেদিন। তবে সত্যি বলতে তার ভালবাসা গুলোই আমাকে তার প্রতি ভালবাসতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু বন্ধু হয়ে আমি তার পাশে থাকতে চাই তাই তাকে এখনো বন্ধু হয়েই অনেক বেশি ভালবাসি। শেষ বিকেল তার বলা এই কথাগুলোই আমাকে ভালবাসতে শিখিয়েছিল।
অনেকক্ষন ছাত্রছাত্রীদের সামনে এসব বলছিলাম। সামনে খেয়ালি করিনি যে অনেকে কাঁদছে। আমারও চোখে পানি। তাই সবার উদ্দেশ্যে বললাম, তোমাদের স্যার মানে আমার হাসবেন্ড কই? সবাই অবাক হওয়ার ভান করল। বলল, স্যার এখানে কেন আসবে? আমি হেসে বললাম, কেকের ওপর যে তৃনার "T" লিখাটা ছিল ওটা কেবল দুজনই ওই স্টাইলে লিখত। এক হল মামুন সাহেব আর একজন হলেন আমার হাসবেন্ড। এই লিখাটাকে আমি চিনি তারপরও কেন যে দিল বুঝলাম না। তখনি ভেতর থেকে শুভ উঠে এলো। সবাই হেসে উঠল তখন।প্রথম কাটা কেকটা আমি রেখে দিয়েছিলাম সেটা তাকে খাইয়ে দিলাম। আমার পাশেই সে বসল। একজন বলল, ম্যাম ,স্যার কি জানত এসব? আমি বললাম, হুম সবি জানত। একজন বলল, তাহলে আপনাদের কিভাবে কি হল? আমি বললাম, ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পর তোমাদের স্যার চাকরী পেয়ে মিস্টি দিতে আমার বাড়িতে এসেছিল। সেদিনই সে প্রোপজ করে আমাকে। শুভ বলল, উত্তরে তোমাদের ম্যাম আমাকে থাপ্পর মেড়েছিল আর বলেছিল এটা আগে বললাম না কেন? আমাকেও কি সবার মত স্বার্থপর মনে হয় যে চাকরী পাওয়ার পর প্রোপজ করতে হবে? আমি বললাম, তা নয় তো কি? হঠাত শুভ বলল, আজ এখানেই উটতে হচ্ছে। আমাদের আশ্রমে যেতে হবে। তবে কাল সবারই দুপুরে লান্ঞ্চের দাওয়াত রইলো। তখনি একজন ছাত্রী উঠে এসে শুভকে একটা গিফ্ট করল। বলল, এটা শুধুই ম্যামকে এতটা ভালবাসার জন্য। দুদিন ধরে প্লান করে এসব করে ম্যামকে সারপ্রাইজ করার জন্য। শুভ ধন্যবাদ জানালো সবাইকে। আমিও সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আশ্রমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। সারাটা পথ আমি শুভর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছেলেটা এতটা ভালবাসে আমায়। আশ্রমে অনেক দিন পর মামুন সাহেবের সাথে দেখা হল। সেখানে বাচ্চাদের সাথে কিছুক্ষন কাটিয়ে আমরা বাসায় আসলাম। রাতে শুভ আর আমি ছাদে আসলাম। শুভ আগেই এসেছে আমি পরে এসেছি। তার হাতে একটা কফির মগ ধরিয়ে দিয়ে বললাম, মন খারাপ কি তোমার? ও বলল, কেন? আমি কিছু না বলেই তার একটা হাত জড়িয়ে ধরলাম। ও বলল, রাতে কি উইশ করিনি বলে মন খারাপ করেছিলে? আমি বললাম, একটু তবে। ও বলল, তবে? আমি বললাম তবে আজ তা পুরন হয়ে গেছে। আচ্ছা একটা কথা বলবে? শুভ বলল, বল। আমি বললাম, তুমি কি মামুন সাহেবের ব্যপারটা নিয়ে মন খারাপ করে আছো? ও মৃদু গলায় বলল, না। আমি এবার তার হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম, আমি তোমাকে সবথেকে বেশি ভালবাসি। কিন্তু তাকে ভালবাসি একজন বন্ধু হিসেবে। যার জন্য আমি ভালবাসতে শিখেছি। তোমাকে প্রানভরে ভালবাসতে পারছি আমি। আমি জানি এটা যেকোন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া খুব কঠিন যে তার স্ত্রী অন্য একজন মানুষকে ভালবাসে তবে তুমি তো জানও এটা কোন ভালবাসা। বলতে গেলে এটা একটা মানবতা। প্রতিদিন বাসস্টপে দাড়িয়ে থাকা লোকটিও অনেক সময় আপন হয়ে যায় তবে সেটা নিশ্চয়ই ভালবাসার মানুষটির থেকে বেশি নয়। আমি তাকে শুধুই বন্ধু ভাবি। কিন্তু তুমি আমার জিবন। এটুকু বলেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু ও জড়িয়ে ধরছে না। কেন জানি কান্না পাচ্ছে খুব। কেঁদেই ফেললাম। তখন শুভ একটা ধমক দিয়ে বলল, এই মেয়ে এই, কান্না করছো কেন? হাতে কফির মগটা আছে। গরম লাগতে পারে জড়িয়ে ধরলে তাই ধরছি না। তাতেই কাঁদতে হবে? ধর্য নেই একটুও? আমি এবার ক্রন্দনমুখে হাসছি। কফির মগটা রেখে ও আমার মুখের সামনের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলল, আমিও তো শুধু তোমাকেই ভালবাসি। আর আমি জানি সে তোমার বন্ধু। এটা নিয়ে আমি কোন সন্দেহ করি না। তুমি এতো পাগলি কেন বল তো? আমি বললাম, হ্যা আমি পাগলি। আর আমার পাগলামি গুলো তোমাকেই সহ্য করতে হবে। শুভ এবার হেসে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। দুজনে বসে চাঁদ দেখছি। শুভর হাতটা জড়িয়ে কাধে মাথা রেখে বললাম, ভালবাসি অনেক, বিনিময়ে একটুখানি ভালবেসো। হাতটা ঘুরিয়ে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ভালবেসো আর আমি ভালবাসি। কতটা তা আমি নিজেই জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি তোমার জন্য মৃত্যুকেও বরন করতে রাজি আছি। আমি তার মুখে হাত দিয়ে বললাম, আমি তোমার সাথেই বাঁচতে চাই।
দিন শেষে রাত তারপর আবার দিন। তবে ভাল মানুষগুলো একটুখানি ভালবাসা আর কল্পনার মধ্যেই অভাবের মাঝেও ভাল থাকতে পারে। এর জন্য শুধু ভাল মানুষ হতে হবে। অন্যদিকে মামুনরাও ভাল আছে তাদের কল্পনার প্রতিমায়ায়। সত্যিকারের ভালবাসা প্রিয় মানুষটির জন্য বাঁচতে শেখায়, মৃত্যুকে উপেক্ষা করেও..........
পুনশ্চঃ হোক না সামনে আসা জন্মদিন গুলো অনাথদের সাথে। থাকিনা কিছুক্ষন তাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে। ভাগ করে দেই না তাদের মাঝে সব আনন্দ গুলো। দেখি না সেই নিষ্পাপ মুখে তৃপ্তি হাসিটকু ...
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ১১:২৫