বিচারক আসামীকে ভর্তসনা করছেন তার অপরাধের জন্য। সাজা ঘোষনার সময় বিচারক সবাইকে চমকে দিয়ে রায় দিলেন,"তোমার ফাঁসি হবে পরবর্তী সপ্তাহের যেকোনো কর্মদিবসের দুপুরবেলা। কোনদিন হবে তা তুমি জানবে ফাঁসির কয়েক মিনিট আগে, এটা তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ।" এই বলেই ফাঁসীর কাগজে সই করে কলম ভেঙ্গে ফেললেন।
সবার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো যখন দেখা গেলো আসামী রায় শুনে হাসছে। আসামী প্রায় ধরেই নিলো যে তার ফাঁসি হচ্ছে না। কেন? ধরা যাক আজকে বৃহস্পতিবার। কাল শেষ কর্মদিবস। আর তাই যদি হয়, তাহলে কাল শুক্রবার তার ফাঁসি হলে সেটা সারপ্রাইজ থাকছে না। আবার আজ যদি বুধবার হয় তাহলে কাল বৃহস্পতিবার। সেক্ষেত্রে কাল ফাঁসি হলে সেটাও সারপ্রাইজ থাকছে না কারন সে অলরেডী জেনে ফেলেছে যে কাল বৃহস্পতিবার এবং তার পরের দিন শুক্রবার, সপ্তাহের শেষ দিন। ঠিক এমনিভাবে মঙ্গলবার সোমবারও ফাঁসি হবার সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়া যায় এবং জেল খানায় নিজের সেলে ঢুকে সে দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে লাগলো। পরবর্তী সপ্তাহের বুধবার তাকে অবাক করে দিয়ে ঠিক দুপুর বেলা ফাঁসি হয়ে গেলো। সেক্ষেত্রে বিচারকের কথা আক্ষরিকভাবেই সত্য হলো। কারন বুধবার দুপুর বেলা কর্মদিবস ছিলো এবং সেটা তার জন্য আসলেই সারপ্রাইজ ছিলো যেটা কিনা আগে থেকে সে বুঝতে পারেনি।
আসলে যুক্তিটি আসামীর ক্ষেত্রে সত্য প্রমানিত হয়নি কারন তার জ্ঞানের পরিমন্ডল নির্দিস্ট দিকে ধাবিত করার জন্য বিচারক সাহেব একটা হেয়ালী পূর্ন বাক্য তৈরী করেছেন। সেক্ষেত্রে তার ফাঁসি কবে হবে সেটা তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছেন কিন্তু আসামীকে দ্বন্ধে ফেলার জন্য সাংঘর্ষিক বাক্যের ব্যাবহার করেছেন। যেহেতু আসামী খুব করেই চাচ্ছিলেন ফাঁসি থেকে বাচতে, তাই তার অবচেতন মন এমন একটা সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত করতে অনুপ্রানিত করেছে।
অবচেতন মনের কার্যপ্রক্রিয়া বড়ই আজব যার সাথে বিশ্বাস কথাটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরেকটা উদাহরন দেয়া যেতে পারে। ধরা যাক রহিম মিয়াকে একটা জানালা বিহীন সাউন্ডপ্রুফ ঘরে বসিয়ে রাখা হলো। বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো এবং রহিম সাহেব ঘুনাক্ষরেও টের পেলো না বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। এখন আপনাকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে রহিম সাহেবকে ঘর থেকে বের করে আপনাকে ঘরের ভেতর রাখা হলো। আপনার জ্ঞান ফিরলে মনে হবে বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু ঠিক যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না। আবার রহিম সাহেব বাইরে এসে ভাবতে শুরু করলেন, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু তিনি যখন ভেতর ছিলেন তখন তিনি বিশ্বাস করেছিলেন বাইরে আদৌ বৃষ্টি হচ্ছে না, আদতে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।
এখানে আপনার বিশ্বাস পুরোপুরি ভ্রান্তির ভেতর ঘুরপাক খাওয়া শুরু করেছে। মানুষের বিশ্বাসকে দ্বন্ধে ফেলা খুবই সহজ ব্যাপার যদি আপনি তার দৃষ্টিগ্রাহ্য বা ইন্দ্রিয়গত চেতনাকে দ্বন্ধে ফেলতে পারেন। এর সবচেয়ে সুন্দর উদাহরন ছোটবেলায় স্কুল থেকে বিনে পয়সায় বোর্ডের বই দেয়া হতো তখন সকল বইয়ের সাইজ একই রকম একই পৃষ্ঠার একই ছাপার অক্ষরে। আমরা একেকটা বেঞ্চে ৫ জন বসতাম। ৫ জন ৫ টা বই পেয়ে নিজেদের নাম লিখে রাখতাম। কিন্তু অনেকেই নাম লিখতো না। যারা নাম লিখতো না তাদের মধ্যে বই অদল বদল হলে ধরার উপায় নাই। সন্দেহ তখন চরমে হবে যখন সে বলবে এটা বাংলা বই কিন্তু আমার বিশ্বাস এটা তার নিজের বাংলা বই না। অথচ সকল বাংলা বই একই।
মানুষের বিশ্বাস যদি আগে থেকেই কোনো কিছুর ওপর ঝুঁকে থাকে অথবা অতি শৈশব থেকেই নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক ধারনা শেখানো হয়, তাহলে সেই ধারনা বা ঐ ঝোঁকের ওপর নির্ভর করেই বিশ্বাসী হবার সিদ্ধান্ত নয়। সেক্ষেত্রে যুক্তি খুব বেশী প্রাধান্য পায় না এবং যুক্তিবোধ কাজে লাগানোর মতো ধৈর্য্য ও স্পৃহা থাকে না। যেহেতু যুক্তিবোধের ব্যাবহার অদক্ষ ভাবে ব্যাবহৃত হয় তাহলে ধরেই নেয়া যায় তার মস্তিস্কের ব্যাবহার ততটা বিস্তৃতি লাভ করবে না।
এক্ষেত্রেও একটা উদাহরন দেয়া যেতে পারে। ধরেন আপনি ক্রীড়া সংস্থার ৪০ লাখ টাকার লটারী কিনলেন। আপনি জানেন যে বিন্যাস সমাবেশ ও প্রোবাবিলিটির হিসাব অনুযায়ী ১০ মিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ চান্স আছে আপনার ঐ লটারী জেতার। তার মানে এটাও সত্য যে আপনি যদি ১০ মিলিয়ন লটারী কেনেন তাহলে আপনার ভাগ্যের শিকে ছিড়তে পারে যদিও এটা খুব একটা লাভ জনক ব্যাপার হবে না। আর যেহেতু ১০ মিলিয়ন সংখ্যক লটারী বিক্রি হলে কেবল মাত্রা একজন প্রথম পুরষ্কার পাবে সেহেতু আপনি এটাও বুঝে গেছেন যে আপনার প্রতিবেশী যে লটারীটা কিনেছেন তার জেতার সম্ভাবনা ততটাই ক্ষীন। এমন করে লাইনে আপনার আগে যে ১০ জন লটারী কিনেছিলো তাদের সম্ভাবনাও আপনার মতো ক্ষীন অতএব কেউ লটারী জিতছে না। এমন করে পুরো মহল্লা যেখানে কিনা মাত্র ৩৫ হাজার লোক বাস করে তারাও কেউ এই লটারী জিতবে না। এমন করে আপনি বিশ্বাস করা শুরু করবেন যে এই লটারীর টিকেট যতজন কিনেছেন তাদের কেউ প্রথম পুরস্কার জিতবে না কারন সবার জেতার সম্ভাবনা ১০ মিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ। এই ভেবে আপনি মনে খানিক স্বস্তি পাবেন যতক্ষন না লটারীর ড্র হচ্ছে। এবং এটাও সত্য যে লটারীর ড্র হলে অবশ্যই একজন না একজন প্রথম পুরস্কার পাবেন সেক্ষেত্রে আপনার বিশ্বাসটাও ভুল প্রমানিত হচ্ছে।
এখন ঘটনাটা একটু অন্যভাবে বলি। একজন বিশ্বাস করা শুরু করলেন যে অমুক ঘটনা ঘটছে এবং তমুক ঘটনা ঘটছে, তাহলে তার পক্ষে বিশ্বাস করাটা যুক্তিযুক্ত হবে অমুক ঘটনা থেকে তমুক ঘটনা ঘটছে। কথাটা অমুক তমুক হেয়ালীর মধ্যে না ফেলে সাধারন ভাবে বুঝিয়ে বলি, আপনি বিশ্বাস করা শুরু করলেন যে আপনার লটারীর টিকেটটি একটা এনভেলপে ভরেছেন (কারন আপনার স্পষ্টতই মনে আছে আপনি নিজে টিকিটটি এনভেলপে ভরেছেন) এবং যদি আপনি নিজেকে এই ভেবে আশ্বস্ত করেন যে এনভেলপটি পেপার শ্রেডারে ঢুকিয়েছেন (কারন আপনি সেটি নিজে পেপার শ্রেডারে ঢুকিয়েছেন), তাহলে আপনি এই ভেবে আশ্বস্ত হবেন যে আপনার টিকিট টিও পেপার শ্রেডারে চলে গেছে।
লটারী নিয়ে দুটো ঘটনার মধ্যে দু ধরনের বিশ্বাস কাজ করছে। প্রথম বিশ্বাসে ঘটনার একটি অংশে আপনার অংশগ্রহন বাকিটা আপনি নিজের ধারনার ওপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। পরের বিশ্বাসের ঘটনায় আপনার অংশগ্রহন ছিলো পুরো ঘটনা জুড়ে। সেক্ষেত্রে ফলাফল দুরকম ছিলো। একটা হলো ধারনা আরেকটা আপনার বাস্তবিক উপস্থিত অথবা সামগ্রীক অংশগ্রহন। সেক্ষেত্রে আপনার বাস্তবিক কার্যকারন একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে সহায়তা করেছে।
আমি এই পোস্টে দেখিয়েছিলাম রনে দেকার্তে কিভাবে তার নিজের অস্তিত্ব দিয়ে মৌলিক এবং আদি সত্যকে খুজে পেয়েছেন এবং সেভাবে তিনি জাগতিক অন্যান্য পরম সত্য জেনেছেন। কিন্তু এই পোস্টে দেখলাম আমাদের সাবকনশাস মাইন্ড বা অবচেতন মন কিভাবে একটা ভুল ধারনায় পৌছাতে পারে ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নিয়েও। সেক্ষেত্রে রনে দেকার্তের কগিটো এরগো সাম কথাটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে তিনি নিজের অস্তিত্বের সত্যতার প্রমানের ওপর নির্ভর করে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে পরবর্তী সত্য বলে ধরে নিলেন সেটাও নড়বড়ে হয়ে গেলো।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে যত দার্শনিক ডিবেট হয়েছে সবগুলোতেই নেতিবাচক ধারনা অর্থাৎ বস্তুজগতে ঈশ্বরের অবস্থান বরাবরই অযৌক্তিক। কিন্তু তখন স্বভাবতই এই প্রশ্ন আসতে পারে এত বড় মহাবিশ্ব এবং এত সব নিয়ম কানুন কি এমনি এমনি সৃষ্টি হলো?
ফুড ফর থট.............................
রেফারেন্স:
১) জি ই মুর: সিলেক্টেড রাইটিং ১৯৯৩
২) ওলফ্রামের ম্যাথ সাইট
৩) লটারী প্যারাডক্স