somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশ কি এখন পেডোফাইল বা শিশুকামীদের দেশ? আমরা কি জাতী হিসেবে বর্বর শিশুকামী, পেডোফাইল?

১৩ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ৮:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের দিকে সামরিক ক্যুএর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর অনেক কর্মসূচীর মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রনের প্রকল্পও হাতে নেন। এই কর্মসূচি হাতে নিয়ে তিনি বলেন যে একসময় পাকিস্থানীরাই পাকিস্থানীদের খাবে। তখন শেখ মুজিবর রহমান ঢাকার একটা ভাষনে এর বিরুদ্ধাচারন করে বলেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্থানীদের সংখ্যা কমানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে এই পরিবার পরিকল্পনে চালু করেছে। তিনি একে প্রত্যাখ্যানের ডাক দেন। যদিও তখন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক দলই বিরুদ্ধাচারন করছিলেন কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন ও পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতি সেই থেকে শুরু।


কিছু দিন আগে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল-২০১৭ সংসদে পাশ হলো। বাল্যবিবাহ নিয়ে আসলে খুব বেশী কিছু বলার নেই। এর আগে তিনটি পোস্টে এ নিয়ে বিষদ আলোচনা করেছিলাম। সেই পোস্ট গুলোর লিংক দিলাম।
১) বাল্যবিবাহ -১: ইসলামে কি সত্যি বাল্যবিবাহ জায়েজ? একটা উন্মুক্ত আলোচনা
২) বাল্যবিবাহ-২: সমাজ, রাস্ট্রের ওপর এর কি প্রভাব? বিজ্ঞান কি বলে?
৩) বাল্যবিবাহ-৩: ইসলামে এটা কি সুন্নত না শুধুই জায়েজ (অথবা স্বতঃস্ফূর্ত)?

উপরোক্ত পোস্টগুলোর কমেন্টে পক্ষে বিপক্ষে নানা আলোচনা করা হয়েছে এবং এই আলোচনা সমূহ এখনো চলমান। চাইলে যে কেউ আলোচনায় অংশ নিতে পারেন। নিজের অজ্ঞতা দূর করে সঠিক জিনিসটা জানা এবং সেটাকে জীবনে মেনে নেয়া আসলেই জরূরি। অন্ধবিশ্বাস, গোড়ামী আমাদেরকে দারিদ্র, দুঃখ, কষ্ট, জরা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। যে মিথ্যা অলৌকিক প্রলোভনে আমরা এসব ক্ষতিকর প্রথা মেনে নিয়ে শুধু নিজের নয়, পুরো জাতীর সর্বনাশ করেছি। বাল্যবিবাহ যে আসলেই ক্ষতিকার একজন নারীর জন্য, একটা জাতীর জন্য এটা অস্বীকার করার মতো বালখিল্যতা একজন আলোকিত শিক্ষিত মানুষের মধ্যে দেখতে পাওয়া হতাশাজনক।

এখন আসি বাংলাদেশ বাল্যবিবাহ আইন-২০১৬ তে কি আছে?

স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে এতদিন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯ কে অনুসরন করা হতো। এই লিংকে ক্লিক করলে ইংলিশে এর পুরোটা পাবেন। তাও এই পোস্টে এর সারাংশ বর্ননা করছি আইনী ভাষায় নয়, নিজের ভাষায়

*এই আইনের আওতায় একজন পুরুষ ২১ বছরের নীচে এবং একজন নারী ১৮ বছরের নীচে হলে তাকে বিয়ের অনুপযুক্ত মানে নাবালক/নাবালিকা বা শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আর যদি বিয়ের সময় যেকোনো একজনের বয়স এই নির্দিষ্ট সীমার নীচে থাকে তাহলে সেটা বাল্যবিবাহ হিসেবে বিবেচিত হবে।
*এই আইন অনুসারে নির্দিস্ট বয়সের অধিক যিনি একজন নাবালিকা বা নাবালক কে বিয়ে করছেন সে এই আইনানুসারে শাস্তির আওতায় পড়বেন এবং যিনি বিয়ে পড়াচ্ছেন তিনিও এই শাস্তির আওতায় পড়বেন। বিয়ে যিনি করছেন তার ১ মাসের জেল অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
*এই একই দন্ড তার গার্জিয়ানদের ওপরও বর্তায় তবে এই আইনে কোনো মহিলাকে এসব দন্ড থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।

এই আইনে কোনো মহিলাকে শাস্তির এখতিয়ারের ব্যাপার ছাড়া অন্য কোনো বিশেষ ছাড় নেই।

এখন দেখি বাল্যবিবাহ আইন নিরোধ, ২০১৭ তে কি আছে:
* বাল্যবিবাহ নিরোধ বিলটি, ১৯২৯ এর সংজ্ঞাকে পরিবর্তিত করে শিশু এবং নাবালক/নাবালিকার সংজ্ঞার সাথে সামন্জ্ঞস্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে এবং সেই সাথে শাস্তির পরিমান বাড়িয়ে দুই বৎসর বিনাশ্রম কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।
* এই আইনের ১৮ ধারার ৪ নম্বরে বলা হয়েছে যে "এই আইনের সাধারন কার্যকারিতা ক্ষুন্ন না করিয়া বিশেষ পরিস্থিতিতে উভয়পক্ষের পিতামাতার সম্মতি এবং আদালতের অনুমোদনক্রমে অন্যূন ১৮ বৎসর বয়স্ক ছেলে ও অন্যূন ১৬ বৎসর বয়স্ক কন্যার সহিত বিবাহ অনুষ্ঠান হইতে পারিবে।"

কিছু কথা:

এ আইনের ১৮ ধারার শিরোনাম "কতিপয় ক্ষেত্রে বিবাহ বাতিল বা বাতিলযোগ্য হবে সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য সংযোজন:" এর সাথে সাংঘর্ষিক একটি বিধান উপধারা ৪এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ নেতিবাচক সংযোজন হলো:(৪) এই আইনের সাধারণ কার্যকারিতা ক্ষুন্ন না করে বিশেষ পরিস্থিতিতে উভয়পক্ষের পিতামাতার সম্মতি এবং আদালতের অনুমোদনক্রমে অন্যূন ১৮ (আঠার) বৎসর বয়স্ক ছেলে ও অন্যূন ১৬ (ষোল) বৎসর বয়স্ক কন্যার সহিত বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে পারবে।
এ অন্তর্ভুক্তি সকলকে হতাশা এবং উদ্বিগ্নতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিয়ের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত এ বয়স ইতোমধ্যে সমাজে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করার কাজ শুরু করেছে। এ বয়স জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ এবং একই সাথে আমাদের দেশে প্রচলিত ২০১৩ সালের শিশু আইন, জাতীয় শিশু নীতির বিরোধী, অসঙ্গতিপূর্ণ এবং সাংঘর্ষিক। এ সাংঘর্ষিক অন্তর্ভুক্তি ইতোমধ্যে সরকার কর্তৃক গৃহিত কন্যা শিশুর বিয়ে প্রতিরোধে আইন প্রণয়ণের মত একাধিক ইতিবাচক পদক্ষেপকে সম্পূর্ণভাবে ম্লান করে দিতে যথেষ্ঠ। মনে রাখা আবশ্যক যে, বিয়ের বয়স কমিয়ে সরকার কাগজে কলমে বাল্যবিবাহের হার কম দেখাতে পারলেও এর ফলে নারীর স্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। খসড়া আইনের শর্তসাপেক্ষে প্রদত্ত বিয়ের বয়স প্রচলিত জাতীয় ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনসমূহের সাথে সাংঘর্ষিক এবং বাংলাদেশের আর্থ- সামাজিক প্রেক্ষাপটে বৈবাহিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অসঙ্গতিপূর্ণ। শর্তসাপেক্ষে প্রদত্ত এ বয়স বাল্যবিবাহের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করবে, বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি, শিক্ষা গ্রহণ, আত্মনির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরী করবে। যা ইতোমধ্যেই সমাজে নেতিবাচক প্রভাব তৈরী করেছে।


বিশ্লেষনটি ফরিদা ইয়াসমিনের যিনি সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবি।

উল্লেখ্য বিলটি সংসদে পাশ হবার পর এখন রাস্ট্রপতির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। নিয়মানুসারে রাস্ট্রপতি যদি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কোনো কিছু জানান তাহলে বিলটি আইনে পরিনত হয়ে যাবে এবং এর কার্যকারিতা পুরো দেশময় চালু হবে। আর যদি রাস্ট্রপতি অপরাগতা প্রকাশ করেন তাহলে এটা পুনরায় নীরিক্ষার জন্য দেয়া হতে পারে।


তার আগে জেনে নেই বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নামক মহামারী কতটা ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে:

গার্লস নট ব্রাইডের তথ্যমতে ২০১০ সালে বিশ্বে ১ কোটি ৩৫ লক্ষ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের নীচে। এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৮ বছরের আগে শিশুদের বিয়ের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৫৪ লক্ষ। ১৮ বছরের নীচে কন্যাসন্তানের বেশি বিয়ে হয়, এমন ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। অর্থাৎ আফ্রিকার চাদ ও মালির সঙ্গে আমাদের অবস্থান। যা মোটেই সম্মানজনক নয়। কারণ এসব দেশ আমাদের তুলনায় সবদিক থেকে পিছিয়ে। আমাদের দেশে এখনও ১৮ বছরের নীচে ৬৬ শতাংশ এবং ১৫ বছরের নীচে ৩২ শতাংশ কন্যা সন্তানের বিয়ে হচ্ছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) এর এ বছর জুলাই মাসে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক বাংলাদেশে ৭৪% মেয়ের ১৮ বছরের নীচে এবং আশঙ্কাজনকভাবে ৩৯% মেয়ের ১৫ বছরের নীচে বিয়ে হচ্ছে। এ রিপোর্ট অনুসারে পৃথিবীর যে সকল দেশে মেয়েদের ১৫ বছরের নীচে বিয়ে তার মধ্যে বাংলাদেশও সর্বাধিকের মধ্যে গণ্য। এ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, ২০% মেয়েদের বিয়ে হয় তাদের ১৫তম জন্মদিনের মধ্যে এবং তিনটি কিংবা এর অধিক সন্তানের মা হয় তাদের ২৪তম জন্মদিনে পৌছানোর পূর্বে। ২০১১ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কতৃর্ক নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাবিষয়ক জরিপ অনুযায়ী ২০-২৪ বছর বয়সী নারীর ১৮ বছর পূর্ণ হবার পূর্বেই বিয়ে হয় ৬৫% নারীর । ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ প্রমম আলোয় প্রকাশিত মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, গত এক বছরে বাল্যবিবাহের শিকার ১ হাজার ২৩৭ জনের বিয়ের গড় বয়স ছিল সাড়ে ১৫ বছর। বিয়ের পর এ সকল মেয়ে প্রেগন্যান্সি সময়ে খুব কমই মেডিকেল সেবা ভোগ করতে পারে এবং তারা সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য যথেষ্ট পরিপক্ক নয় এবং তারা বয়ঃসন্ধিকালের প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে না জেনেই প্রবেশ করে বিবাহিত জীবনে যা মা ও সন্তানের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ।আমরা জানি বর্তমান সরকার কর্তৃক ২০১৩ সালে পাশকৃত শিশু আইন মোতাবেক “বিদ্যমান অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন এ আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে অনুর্ধ্ব ১৮ (আঠার) বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য হবে”। শিশুবিবাহ জাতি, রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও শিশুর শত্রু। এটা শিশুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন। শিশুবিবাহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিশুবিবাহ স্বাস্থ্যগত দিক একটি কিশোরী বা ষোড়শী নারীকে অন্ধকার বা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সেইভ দা চিলড্রেনের এর একটি রিপোর্ট মোতাবেক রাজধানীর বস্তি এলাকার প্রায় ৮০% মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার এবং ৪৬% ছেলে ১৮বছর পূর্ণ করার পূর্বেই বিবাহ করে। ঢাকার ১০টি বস্তির ৪২২ টি বাড়ীতে ডিসেম্বর ২০১৩ থেকে জানুয়ারী ২০১৪ পর্যন্ত জরিপটি পরিচালনা করা হয়।

সূত্র:

১) গবেষণা মতে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী অন্তঃসত্ত্বা নারীদের তুলনায় ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মৃত্যুঝুঁকি থাকে পাঁচগুণ বেশী।
২) সেইভ দা চিলড্রেনের দুটি রিপোর্ট: Urbanization Trends and Implications for Children” and “Situation Analysis of Selected Slums in Dhaka City।

এছাড়া পুরো বিশ্বে বাংলাদেশ শিশুবিবাহে ৪র্থ এবং দক্ষিন এশিয়ায় চ্যাম্পিয়ন। সুত্র: উইকি। যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত প্রতিবেশী দেশ ভারতকে গালি দেই ধর্ষনের দেশ হিসেবে সেখানে আমরা কি করছি? একটা ভিডিও শেয়ার করলাম বাল্যবিবাহ আমাদের দেশটাকে কিভাবে পেছাচ্ছে।


আর বাল্যবিবাহের সাথে মাতৃমৃত্যুর হার কি পরিমান জড়িত সেটা এই আর্টিক্যালটা পড়লে জানতে পারবেন। ৪০ ভাগ মায়ের মৃত্যু কমে গেছে এই একমাত্র বাল্যবিবাহের হার কমানোর জন্য।

নতুন আইনের "বিশেষ পরিস্থিতি":

এই বিশেষ পরিস্থিতির ব্যাপারটা আইনটিতে সংজ্ঞায়িত না করলেও আমাদের রাজনীতিবদেরা এই সংজ্ঞায়নে এক কাঠি এগিয়ে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দাড়িয়ে বলেছেন:

সমাজের প্রতি দায়দায়িত্ব তাদের খুবই কম। কারণ তারা দুটো এনজিও করে পয়সা কামায়, কিন্তু দায়িত্বটা নেয় না।বাল্যবিবাহ নিয়ে ঘাবড়ানো বা চিন্তা করার কিছুই নেই। আমাদের আর্থ-সামাজিক বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।যারা আজ এটা নিয়ে কথা বলছেন তারা কোনো দিন গ্রামে বাস করেনি। গ্রামের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। শুধু একবার গেলাম দেখলাম আর মুখের কথা শুনলাম, তাতে সব কিছু জানা হয় না। গ্রামের পারিবারিক মূল সমস্যা সম্পর্কে উনাদের কোনো ধারণা নেই। এছাড়া আমাদের দেশে কিছু বিষয় রয়েছে সে সম্পর্কে তাদের কোনো চিন্তা নেই। সেই কারণে তাদের অনেক বড় বড় কথা।আমরা ‘তবে’ কেন লাগালাম, এটা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন উঠছে। যেহেতু তারা বাস্তবতার অনেক উর্ধ্বে রাজধানীতে বসবাস করছে। রাজধানীর পরিবেশটাই তারা দেখে। বাস্তব অর্থে গ্রামীণ পরিবেশ সম্পর্কে তারা কিছু জানেন না। কোনো আইন ‘রিজিড’ হতে পারে না বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রত্যেক আইনেই তো বিশেষ বা অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে তার ক্ষেত্রে একটা সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে। না হলে সমাজের জন্য অনেক বড় একটা বিপর্যয় নেমে আসবে।...আমরা ১৮ বছর পর্যন্ত বিয়ের বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছি। কিন্তু একটি মেয়ে যদি… যে কোনো কারণে ১২-১৩ বা ১৪-১৫ বছরের সময়ে গর্ভবতী হয়ে যায়- তাকে গর্ভপাত করানো গেল না। তাহলে যে শিশুটি জন্ম নেবে তার অবস্থান কী হবে? তাকে কী সমাজ গ্রহণ করবে? তাহলে এই বাচ্চাটির ভবিষ্যৎ কী হবে? তার ভাগ্য কী হবে? এ রকম যদি কোনো ঘটনা ঘটে তাহলে কী হবে? যদি অ্যাবরশনের বিষয়টি আইনে থাকে, তাহলে সমস্যা নেই। অ্যাবরশন করিয়ে নেবে। আর যদি না হয় তাহলে যে মেয়েটি সন্তান জন্ম দিল তার ভবিষ্যৎ কী আর সন্তানটিরও ভবিষ্যত কী হবে?

অথচ ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে এই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই বলেছিলেন যে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ১৮ বছরের নিচে বাল্যবিবাহ বন্ধের ব্যবস্থা করবেন।

অথচ আশ্চর্য্যের বিষয় আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল মেয়েদের বিয়ের বয়স ন্যুনতম ২০ করার জন্য আইন প্রনয়ন করছে।

এদিকে আমাদের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন:

এই আইনটির বিশেষ ক্ষেত্রে বোঝানো হয়েছে যে, যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে অভিভাবক আদালতের কাছে গিয়ে আর্জি দিবেন। বিচারক যদি অনুমতি দেন, তবে কেবল কাজী সাহেব বিবাহ দিতে পারবেন।...একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর সে যদি অন্তঃসত্ত্বা হয়, তখন মেয়েটির কী করবে। এ রকম ক্ষেত্রে আদালতের আদেশে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়েই সমাধান।...কোনো মেয়ে প্রেম করে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে, এদিকে ছেলেও ১৮ বছরের নিচে। তখন কী করবেন আপনি? তখন ছেলের পরিবার যদি বাচ্চাসহ মেয়েটিকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয় তবে তাদের তো বিয়ে দিতে হবে।...১৮ বছরের নিচে বিবাহ নিষিদ্ধ, আপনারা মূল শিরোনামের উপরই গুরুত্ব দিলেন না, আপনারা বললেন বিশেষ দ্রষ্টব্য ‘যদি’, ‘তবে’ তুলে দিলেই না কি নারীর ক্ষমতায়ন হবে, নইলে নারীকূল পিছিয়ে যাবে। আমি পিছিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।

মাঝে মাঝে মনে হয় এদের কথা শুনে যে এরা কি শফি হুজুরের চেলা না ইয়েমেন তথা মধ্যপ্রাচ্যের সেই শিশুকামী দেশগুলোর কোনো প্রতিনিধি কিনা!

তবে জাতীয় পার্টির এক এমপি সুন্দর একটা বক্তব্য দিয়েছেন:

কোনো ব্যক্তি অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু আইনে অনুমতি দেয় না। এক্ষেত্রে ওই লোকটি ফুসলিয়ে কোনো মেয়ের সঙ্গে অবৈধ মেলামেশার মাধ্যমে যদি তাকে গর্ভবতী করে, তাহলে ওই লোক তো ওই বিশেষ বিধানের সুযোগ নিতে পারবে।


২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্কের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি। তুরস্কের পার্লামেন্টে একটা বিল ওঠে যে কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু বা বা নাবালিকা মেয়েকে জোরপূর্বক ধর্ষন করলে ঐ অপরাধীকে অভিযুক্ত করা যাবে না যদি সে ঐ ধর্ষিতাকে বিয়ে করে। এই বিলটি উঠিয়েছিলেন আমাদের মুসলিম বিশ্বের সুলতান এরদোগানের ইসলামপন্থি একেপি দলটি। এই বিলের বিরুদ্ধে নারী অধিকার আন্দোলন কর্মী সহ সর্বসাধারন যুব সমাজ রাস্তায় নেমে আসলে সরকার পিছুটান নেয় এবং এই বিলটিকে পরিত্যাগ করে। যদিও তুর্কি আইনমন্ত্রী বেকির বোজদাগ আইনটির পক্ষে তাঁর যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাল্যবিবাহ আমাদের দেশের বাস্তবতা এবং যেসব পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা ধর্ষক বা যৌন আগ্রাসী নন। এই আইনটি পাশ হলে যেটা হতো সেটা হলো পূর্বেকার আইন মতে সাজাপ্রাপ্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার অপরাধী দায়মুক্তি পেতো। ভাবতে অবাক লাগে শুধু মাত্র বাল্যবিবাহকে হ্যা বলার জন্য সাড়ে তিনহাজার শিশুকামী ধর্ষক মুক্তি পেতো। উল্লেখ্য তুরস্কে মেয়েদের বিয়ের ন্যুনতম ১৮। এখন একটু ভেবে দেখেন তুরস্ক যেখানে সামনে আগায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশটাকে কোথায় টেনে নিচ্ছেন!

এই আইনের কিছু ফাঁক ফোকড়:

১. আইনে উল্লেখিত “বিশেষ ক্ষেত্র”বা “বিশেষ প্রেক্ষাপট”কথাটি বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ বিরোধী। অনুচ্ছেদ-২৭ এ বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। অনুচ্ছেদ-২৮(১) এ বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।’উল্লেখিত দুইটি অনুচ্ছেদে নাগরিক হিসেবে নারীর যে অধিকার লাভের কথা বলা হয়েছে এই আইনের বিশেষ বিধান তাকে খর্ব করেছে।
২. এই “বিশেষ ক্ষেত্র”কথাটি মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা ১৯৪৮, সিডও সনদ ১৯৭৯ ও শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ এর সাথেও সাংঘর্ষিক। শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের নিচে সকল মানব সন্তানকে “শিশু”হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
৩. জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ এবং শিশু আইন ২০১৩-এ ১৮ বছরের নিচের সকল ব্যক্তিকে “শিশু”বলে অভিহিত করা হয়েছে। “শিশু আইন ২০১৩”এর ৪ ধারায় উল্লেখ আছে ‘বিদ্যমান অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অনুর্ধ্ব ১৮ (আঠার) বৎসর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি “শিশু”হিসাবে গণ্য হবে।’
৪. পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ এ ১৮ বছরের নিচের মানব সন্তানকে “শিশু”বলে অভিহিত করা হয়েছে।
৫. মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুযায়ী, বিবাহের ৫টি শর্তের মধ্যে প্রথম শর্ত হলো বয়স, দ্বিতীয় শর্ত সম্মতি। “অপ্রাপ্তবয়স্ক”মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে এই প্রধান দুইটি শর্তকে উপেক্ষা করা হবে যা বিবাহ সংক্রান্ত আইনের লংঘন। কেননা এই আইন অনুযায়ী বিবাহ একটি সামাজিক ও দেওয়ানী চুক্তি। চুক্তি সম্পাদিত হয় মূলত প্রাপ্তবয়স্কসুস্থ মস্তিষ্কের দুইজন মানুষের মধ্যে। বাল্যবিবাহের বিশেষ বিধান চুক্তির এই শর্তকেও লংঘন করেছে।
৬. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (২০০৩ সালে সংশোধিত ) এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিবাহ ব্যতিত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার অসম্মতিতে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলক ভাবে সম্মতি আদায় করে অথবা ১৬ বছর বয়সের কম কোন নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সর্ম্পক স্থাপন করলে তা নারী ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে।’ফলে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বিশেষ বিধান বিবাহের মাধ্যমে শিশু ধর্ষণকে আইনসম্মত করেছে এবং অন্যদিকে ধর্ষকের অপরাধকেও আইনসিদ্ধ করেছে।
৭. সাবালকত্ব আইন ১৮৭৫ অনুযায়ী একজন ব্যক্তির বয়স ১৮ বছর হলেই সে সাবালক হয় এবং সে তার মতামত প্রকাশ ও প্রদান করতে পারে। বাল্যবিবাহের বিশেষ বিধান এই আইনেরও লংঘন।
স্পষ্টতই বোধগম্য “বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬”শীর্ষক খসড়া আইনটি জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন আইন ও সনদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

সুত্র:

‘বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল ২০১৭’ - একটি পর্যালোচনা: অনুপম সৈকত শান্ত।

আমার মনে হয় উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিস্কার যে যেখানে আমাদের দেশের অভিভাবকরা এখনো তাদের কন্য সন্তানকে ঘাড়ের বোঝা মনে করে সেখানে এই অসংজ্ঞায়িত "বিশেষ পরিস্থিতি" এর সুযোগ নিলে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনস শৃঙ্খলা বাহিনীর আর কোনো সুযোগ থাকবে না কোনো শিশুকে বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা করার। অনেকসময় দেখা যায় অতি দারিদ্র‌ এবং কুশিক্ষার কারনে পিতা মাতা জোর করে বিয়ে দিতে গেলে নাবালিকা কিশোরী স্বউদ্যোগে আইনের আশ্রয় নেয়, এই প্রচলিত আইনের ফাক ফোকড় গলে উল্টো সে আইনী এবং সামাজিক ভাবে বিপদে পড়বে। যেখানে রাস্ট্রের দায়িত্ব থাকে জন গনের অধিকার সংরক্ষনের সেখানে লিঙ্গগত বৈষম্যের সুযোগ নিয়ে এমন হঠকারী আইন সৃষ্টির জন্য উঠেপড়ে লাগা জাতীর জন্য অশনিসংকেত।

তার মানে বাংলাদেশ কি সত্যি শিশুকামী দেশে পরিণত হচ্ছে? আমরা কি শিশুকামী জাতি?
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৯ ভোর ৫:১৬
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×