মিস্টার রাহাত সাহেব এবং মিসেস রাহাত দুজনে স্বামী স্ত্রী। দুজনই সরকারি চাকরী করেন। দাম্পত্য জীবনের ৫বছর পর তারা একটি সন্তান নেয়ার চিন্তা করলেন।
এতদিন সন্তান নেননি মিসেসের ফিটনেস নষ্ট হয়ে যাবে বলে। এখন একটি সন্তানই নেয়ার চিন্তা করলেন শুধু একটি সন্তান। কারণ তাদের ভাবনা মতে এমনিতে দেশে জনগণ বেড়েই যাচ্ছে দিনদিন। আর তারা দুজনে সরকারি চাকরি করেন বিধায় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী একটি বা দুটি সন্তানই নিবেন। তবে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যদি ১ম সন্তান ছেলে হয় তাহলে আর কোন সন্তান নিবেন না।
মিসেস রাহাত সন্তান নিলেন। তাদের মতে তাদের ভাগ্য প্রসন্ন কারণ ডাক্তার বলেছে উনার গর্ভে ছেলে সন্তান আছে। জনাব রাহাত সাহেব এবং উনার স্ত্রী খুব খুশি। তাছাড়া তারা এজন্যও খুশি যে আর সন্তান নিতে হবেনা।
কয়েক মাস পর-
রাহাত সাহেবের স্ত্রীর আজ ডেলিভারি ডেট। আজই উনাদের কাংখিত সেই দিন। আজই উনাদের কোল জুড়ে আসবে উনাদের সারাজীবনের ভবিষ্যৎ। মিসেস রাহাত এটাও সিদ্ধান্ত নিলেন উনি প্রসব বেদনায় অযথা কাতরাবেন না। সিজার করে সন্তান বের করে নিবেন। যেহেতু একটি সন্তানই নিবেন সেহেতু অযথা কেন প্রসব বেদনায় কাতরাবেন! তাছাড়া প্রসব বেদনার কারণে যদি উনার কিছু হয়ে যায়!
অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো মিসেস রাহাতকে। সিজার করার জন্য ডাক্তাররাও রেডি। একসময় সিজারও শেষ হলো । উনার ছেলে-ই হয়েছে।
♦♦
রাহাত সাহেব অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে পায়চারি করছিলেন। উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল আনন্দ এবং টেনশন দুনুটা একসঙ্গে বিদ্যমান রয়েছে উনার মাঝে। আনন্দের কারণ উনি বাবা হবেন আর টেনশনের কারণ হলো উনার স্ত্রী অপারেশন থিয়েটারে।
রাহাত সাহেব হঠাৎ দেখতে পেলেন অপারেশন রুমের দরজা খুলছে। দৌড়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। নার্স এসে জানালো উনার একটি ছেলে হয়েছে এবং মা ছেলে দুজনই ভালো আছে। একটু পরই উনি তাদের কাছে যেতে পারবেন। রাহাত সাহেব খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন। উনি বাবা হয়েছেন এটা অবশ্যই অনেক আনন্দের।
রাহাত সাহেব হাসতে হাসতে ফোন বের করলেন। সবাইকে জানানো দরকার। একে একে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাইকেই জানালেন। ফোব করতে করতে নিচে চলে গেছিলেন। এসে দেখলেন উনার স্ত্রী সন্তানকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হয়েছে। উনি গেলেন সেখানে। সন্তানকে দেখে আরো খুশি হলেন। উনার একমাত্র ভবিষ্যৎ। একমাত্র সন্তান।
সন্তানের নাম আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। নাম "রাফাত"। রাহাত সাহেব নিজের নামের সাথে মিলিয়েই রেখেছেন ছেলের নাম। রাফাতকে নিয়ে আনন্দেই যাচ্ছে দিন। এরই মধ্যে আবার মিস্টার রাহাত এবং মিসেস রাহাত ফাইনালি ডিসিশন নিলেন আর কোন সন্তান নিবেন না ।
তাদের এক রাফাতই যথেষ্ট। আর কোন সন্তান দরকার নেই। কেন অযথা দেশের জনসংখ্যা বাড়াবেন! তাছাড়া আর সন্তান নিলে তো উনাদেরও চাকরীতে জামেলা হবে। রাফাতকে দেখাশোনা করার জন্য একজন মহিলাও রেখেছেন। অফিস টাইমে সেই মহিলাই রাফাতের দেখাশোনা করে। রাফাতের বয়স যখন ২ মাস তখন থেকেই সে অন্য মহিলার দ্বারা লালিত পালিত হচ্ছে। মা আর অন্য মহিলা কি কখনো এক??
♦♦♦
কাজের বোয়ার হাতেই বড় হচ্ছিল রাফাত। মা আর কাজের বোয়া তো দিনরাত পার্থক্য। মিস্টার রাফাত এবং মিসেস রাফাত অফিসে যাওয়ার পরই কাজের বোয়া রাফাতকে নিয়ে বসে যায় সিরিয়াল দেখতে। কোথায় থাকে রাগাত কি করে না করে তার কোন পাত্তাই থাকেনা কাজের বোয়ার। একটু পর পর যখন রাফাত কাঁদে তখন শুধু ফিডারে কতটুকু দুধ ভরে সেটা রাফাতের মুখে ঢুকিয়ে দেয়।
মালিক আর মালকিন আসার আগে শুধু রান্নাবাড়া গুছিয়ে রাখে বোয়া। কারণ তারা এসেই খাবে। আবার তাদের যখন আসার টাইম হয় তখন রাফাতকে কোলে নিয়ে পায়চারি করে। যেন তারা এসে দেখে না ঠিক আছে। বোয়া রাফাতের যত্ন নেয়।
আমাদের এদেশেও বর্তমানে অধিকাংশ মডার্ন ফ্যামিলি ই নিজের বাচ্চার যত্ন নিজেরা না নিয়ে কাজের বোয়ার কাছে সপে দেয়। যার কারণে বাচ্চার প্রকৃত মাতৃত্বের স্বাদ না পেয়ে আগোচালো থেকে যায়। এই বাচ্চাগুলা মায়ের দুধও খেতে পারেনা যতটুকু দরকার ততটুকুও। মায়ের দুধ বাচ্চাকে যে প্রোটিন আর শক্তি দেয় তা দুনিয়ার অন্য কিছুতে বাচ্চারা পায়না।
এসব জানা সত্যেও আমাদের দেশের মডার্ন ফ্যামিলির মায়েরা নিজের ফিটনেস ঠিক রাখতে সর্বনিম্ন ৬মাসও বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ায় না। অন্তত এই ৬মাস বাচ্চার জন্য মায়ের বুকের দুধ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বাচ্চারা সেটা পায়না। সেটা তো পায়ই না সাথে মায়ের আদর যত্ন থেকেও বঞ্চিত হয়। যার ধরুন এসব বাচ্চাদের মস্তিষ্কও অন্যরকম হয়ে থাকে।
মিস্টার রাহাত এবং তার মিসেসও সেই ভুল করছিলেন। বাচ্চাকে বঞ্চিত করছিলেন নিজেদের আদর যত্ন থেকে । নিজেদের বাচ্চাকে সপে দিয়েছিলেন একজন কাজের বোয়ার হাতে । একটি মাত্র সন্তান নিয়েছেন তাও সেই একমাত্র সন্তানকে ঠিক মতো লালন পালন করছিলেন না নিজেরা।
যাইহোক এভাবেই বড় হচ্ছিল রাফাত। এক সময় একাডেমীতে ভর্তি করে দেয়া হলো তাকে "প্লে" তে। এভাবে একসময় স্কুলে গেল তারপর কলেজ তারপর ভার্সিটি। এখন সে প্রাইভেট ভার্সিটির ছাত্র। ২৫ বছরের যুবক।
ছেলে বড় হয়েছে। তাদেরও বয়স বেড়েছে। ভালোই যাচ্ছিল তাদের সংসার। কিন্তু হঠাৎ করেই ভয়ংকর একটা ঝড় নেমে আসলো তাদের পরিবারে। সেই ঝড়ই তাদের তছনছ করে দিল।
♦♦♦♦
ভালোই যাচ্ছিল রাহাত এবং মিসেস রাহাতের দিনকাল। কিন্তু হঠাৎ একটি ঝড় এসে তাদের পরিবারকে তছনছ করে দিল। তাদের পরিবার থেকে সুখগুলি হারিয়ে যেতে শুরু করলো।
রাফাত ভার্সিটিতে পড়ে। সেখান থেকেই এক মেয়ের সাথে সে রিলেশনে জড়িয়ে পড়ে। বড়লোক বাবার মেয়ে রাফিয়ার প্রেমেই হাবুডুবু খাচ্ছে রাফাত। আগের থেকে অনেক বদলে গেছে সে। এ যেন অন্য এক রাফাত। সারারাত ফোনে কথা বলে আর সারাদিন ঘুমায়। ব্যবহারও অনেক চেঞ্জ।
আগের থেকে অনেক বেশি টাকাও খরচ করে এখন সে। রাফাতকে নিয়ে তার মা-বাবা এখন খুবই চিন্তিত। কিন্তু আদরের ছেলেকে কখনো কিছুই বলেন না তারা। একটাই মাত্র ছেলে তাই যখন যা চায় তাই দেন রাহাত সাহেব। কোন আবদারই অপূর্ণ রাখেননি ছেলের। কয়েকদিন আগে বাইকও কিনে দিয়েছেন একটা।
তবুও এভাবে ভালোই যাচ্ছিল দিনকাল। ছেলে একটু অন্যরকম হলেও তারা হ্যাপিই আছেন। কিন্তু বিধিবাম, সেটাও থাকলোনা। হঠাৎ একদিন মিসেস রাহাত এর কাছে ফোন আসলো যে, রাহাত সাহেব এক্সিডেন্ট করে হসপিটালে আছেন। এটা শুনে মিসেস রাহাত হতভম্ব হয়ে ছেলেকে ফোন দিলেন কিন্তু রাফাত ফোন না ধরে বারবার কেটে দিচ্ছিল। কেননা সে তখন রাফিয়ার সাথে ক্যাফেতে ছিল তাই মায়ের ফোন কেটে দিচ্ছিল।
মিসেস রাহাত আর অপেক্ষা না করে একাই হাসপাতালে ছুটে গেলেন। গিয়ে দেখলেন তার স্বামীকে ইমার্জেন্সীতে রাখা হয়েছে। অপারেশনের প্রস্তুতি চলছে। মিসেস রাহাত বললেন যতো টাকাই লাগুক আমার স্বামীকে বাঁচান।
ডাক্তাররা টাকা জমা দিতে বললো। তিনি বেরিয়ে গেলেন টাকার জন্য ব্যাংকে। তখন ছেলের ফোন আসলো, তিনি রাফাতকে জানালেন খবর এবং বললেন তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসতে তিনি টাকা আনতে যাচ্ছেন।
♦♦♦♦♦
মায়ের ফোন পেয়েই রাফাত হসপিটালে গেল। একটু পর তার মাও আসলেন টাকা নিয়ে। কিন্তু এর ভিতরেই সব শেষ হয়ে গেল। রাহাত সাহেব এই ধরায় আর নেই। তিনি বিদায় জানিয়েছেন এই দুনিয়াকে। বিদায় জানিয়েছেন স্ত্রী এবং একমাত্র সন্তানকে।
মিসেস রাহাত বুক ফাঁটা কান্নায় ভেংগে পড়লেন। কিন্তু কান্না তো আর কাউকে ফিরিয়ে আনতে পারেনা। এদিকে রাফাতও অনুশোচনায় আর বাবা হারানোর ব্যথায় বোবা হয়ে গেছে যেন। অতি শোকে সে কাঁদতেও ভুলে গেছে। কিন্তু কিছুই করার নেই।
-
বাবার লাশ দাফন করে এসেছে রাফাত। এখন তার মাকে সেই সামলাতে হবে। আর মিসেস রাহাতেরও এখন একমাত্র অবলম্বন এই রাফাত। কারণ আধুনিক এই যুগের মডার্ন ফ্যামিলি হিসেবে এই একটাই সন্তান নিয়েছিলেন তারা। কিন্তু এটাও বেশিদিন টিকলো না। তার এই অবলম্বনও শেষ হয়ে গেল।
বাবা মারা যাওয়ার সপ্তাহ খানিক পরেই রাফাতও মারা গেল বাইক এক্সিডেন্ট এ। জায়গায়ই মারা গেছে সে । আর চিনারও উপায় নেই এটাই যে রাফাত। এতো আদরের এই সন্তানের এমন অবস্থা আর সহ্য করতে পারলেন না মিসেস রাফাত।
তিনি আফসোস করতে লাগলেন, হায়! যদি আজ আরো কয়েকটি সন্তান থাকতো তাহলে আমাকে এভাবে নিঃস্ব হতে হতোনা। অল্প সময়ে স্বামী আর সন্তান হারানোর শোক সইতে না পেরে তিনি এখন পাগল হয়ে গেছেন। তাদের এই মডার্ন সুখী ফ্যামিলি আজ একেবারেই শেষ।
মিসেস রাহাত এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেন আর বলেন -
একটি সন্তান নয়
বহু সন্তান যেন হয়।
আমার কথা-
বাস্তব ঘটনা থেকেই আমি এই গল্পের জন্ম দিয়েছি। আমি প্রতিটা সিরিজেই কোন একটা ভুল সিদ্ধান্তের দিকে ইংগিত করেছি। যারা ভালো করে পড়েছেন তারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন সেটা।
আমাদের সমাজে আধুনিকতা আর মডার্ন হওয়ার নামে আমরা এখন অহরহ ভুল করি। যেই ভুল গুলি একসময় আমাদেরকে শেষ করে দেয় একেবারেই। আমি গল্পটা আরো লম্বা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু অনেককিছু ভেবে করিনি। এখানেই শেষ করে দিয়েছি।
মোটকথাঃ- মডার্ন হওয়া ভালো কিন্তু আল্ট্রা মডার্ন হওয়া ভালোনা। আধুনিকতা ভালো কিন্তু অভার আধুনিকতা ভালোনা। কথায় আছে "অতিরিক্ত কিছুই ভালো না"।
ধন্যবাদ তাদেরকে যারা সবগুলি সিরিজ পড়েছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:২৬