১
:মোটামোটি দু'কাপ কফি শেষের দিকে আসতেই,তিন নম্বার কফির জন্য মন স্থির করলাম!!
:আপাতত কফি খেয়ে খেয়ে আকাশ-পাতাল দেখা আর মনে মনে শব্দগুলো গুছিয়ে নেয়ার অনবরত চেষ্টা আর ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু করার নেই।আমি জানি, সায়মার আসতে আরও পাক্কা চল্লিশ মিনিট পচিশ সেকেন্ড বাকি।।
:ক্যাফেটেরিয়াটা আসলেই বেশ অদ্ভুত।দুনিয়া জুড়ে এত রঙের, এত বর্ণের মানুষ আর তাদের এত্ত বৈচিত্র্যতা!!
:আমার মতে,আপনার আস্তিক কিংবা নাস্তিক হতে হবে না,একটু সূক্ষ্মদর্শী কিংবা চিন্তা শক্তিসম্পন্ন মানুষ হলেই আপনি এই উপসংহারে যেতে বাধ্য হবেন যে, কোন এক মহান সত্তা প্রতিনিয়ত এই সব বৈচিত্রতার মধ্যে তার অস্তিতের জানান দিয়ে যাচ্ছে।।
২.
:এই চার বছরের ইস্তাম্বুলের রাস্তাঘাটে,পথে-প্রান্তরে,জীবনের এত এত সব নতুনত্ব সাথে সাক্ষাত আর পরিচয় হয়েছে, মনের অজান্তেই চোখের কোণে অব্যক্ত এক কৃতজ্ঞতার অশ্রু জমা হয়।।
:জীবনের এই ছুটে চলার নতুন আঙ্গিনায় রাব্বাুল আলামীন না নিয়ে আসলে কখনোই এত কিছু দেখার বা জানার সৌভাগ্য হত না!!
:সেটাই তো... আমার রবের নিয়ামতের কোন বিষয়টাই বা উপেক্ষা করবো.. যারিফাকে নিয়ে ভাবনার বিষয়টাই ভাবা যাক..তাকেই বা আমার জীবনের জন্য কম মীরাকেল ভাববার সুযোগ কোথায়!!
৩
:আপাতত সায়মাকে নিয়ে ভাবা দরকার..কিভাবে যে ওর সাথে এপ্রোচ করবো,কোনভাবেই মাথায় আসছে না..সাদমান ভাই যে কি বিপদে ফেললেন।।
:কিভাবে যে এই বিপদ থেকে উদ্ধার হবো।
আচ্ছা, আমি এই সিটিংটাকে বিপদ ভাবছি কেন..??
:
: নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিতে লাগলাম "কা'মন সালমান..ইয়ু আর দ্য মোস্ট কনফিডেন্ট গা'ই ন দিজ ওয়ার্ল্ড "
: আপাতত এই সিটিংয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য এটাই- কোনভাবেই সায়মার সামনে নার্ভাস হওয়া চলবে না..
ভাবতে ভাবতে তৃতীয়বার কফির জন্য কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম।কাউন্টার থেকে ঘুরতেই ছোটভাই হামাদের সাথে দেখা।।
:আবারো স্বস্থানে এসে বসলাম।
কোন এক অদ্ভুত কারণে শেষের এই কর্ণারটার প্রতি অন্য রকম এক মায়া কাজ করে। যারিফাকে বেশিরভাগ সময়ই এই জায়গাটাতেই দেখা যেত।।
:কাচের জগত থেকে পৃথিবীটাকে এত মায়াময় লাগে,এই জায়গা না বসলে সেটা জানাই হতো না।
কাচের এই অর্ধস্বচ্ছ জগত থেকে বাহিরের এই রূপালি জগতটাকে বৃথা স্পর্শ করার চেষ্টা কিংবা একটু দূর থেকে কাছের জগত বা মানুষগুলোকে দেখা...ভারী অন্যরকম এক অনুভূতির জানান দেয়!!
: কি জানি,যারিফারও সম্ভবত এই ব্যাপারটা অনুভব করেই এই জায়গায় বসে থাকতো!"
৪
:আচ্ছা,এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন আর কষ্টকর বিষয়টা আসলে কি
...???
:নিজের মনের কথাটা ঠিক মতো বলতে না পারা নাকি নিজের মনের কথাগুলো গুছিয়ে বলার সঠিক শব্দগুলো খুঁজে না পাওয়া, যার ফলশ্রুতিতে অপরজনকে বুঝিয়ে বলতে ব্যর্থ হওয়া..???
:সম্ভবত সায়মার সাথে কথা বলার সময় এই দু'টোই ঘটেছিল। কিছু কথা বলতে পারি নি আর যতটুকুই বা বলেছি তা ঠিক মতো বোঝাতে পারি নি..হায়রে কপাল।আমার এই গুবলেট মার্কা কথার শেষমেষ যে কি উত্তর নিয়ে হাজির হয়..!!!
:যারিফার ব্যাপারটা নিয়ে মোটামোটি খোলাখোলিই কথা বলার চেষ্টা করেছি সায়মার সাথে, জানি না সে কতটুকু বুঝতে পেরেছে।।
৫
:যারিফাকে সংজ্ঞায়িত করার প্রান্তকর চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হওয়াটাকে আমি আমার নিয়তি ধরে নিয়েছি।তা না হলে এই অর্ধ বয়সে কবিতার খাতাই বা হাতে নিলাম কেন!! কেইবা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষ করার পরও, কেন তাকে সংজ্ঞায়িত করার আগেই কলমের কালিটা ফুরিয়ে গেলো!!
:তার পরেও বলবো ও যেন আমায়, নিজের চেনা রূপের অচেনা ঝলক দেখিয়ে স্তম্ভিত করেছিলো বারবার!!আকাশ ছোয়া স্বপ্নের কাছে বন্দী হয়েছি স্বপ্নহীন বেদনায়!!
:আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গায়টা হচ্ছে 'ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটি'র এই লাইব্রেরিটা।
প্রথম যে দিন লাইব্রেরি সিড়িটায় পা রেখেছিলাম, ঢোকার জায়গাটার ওপরে অদ্ভূত সুন্দর করে লেখা তুমি এখন আছ.. "দ্বার আল -হিকমা", লেখাটা দেখে মন জুড়িয়ে গিয়েছিল।এই রকম কিছুর জন্যই সম্ভবত অপেক্ষায় ছিলাম।তখনও জানা ছিল আরও অনেক কিছুই অপেক্ষা করেছে।
কোন এক শ্লান্তিময় সকালে গ্রাষ্মের প্রথম পলশা বৃষ্টির মতো, যারিফাকে প্রথম দেখেছিলাম এখানেই।।
: ওকে দেখার মুর্হুতগুলোকেই বা কি রূপে সংজ্ঞিত করা যেতে পারে....???
:হুম,সম্ভবত শরতের জোৎস্না আর গাছের পাতার লুকোচুরি খেলায়।হয়তোবা অচেনা শুকনো বেলি ফুলের মায়াহীন সুবাস।অথবা এক চিলতে রোদের মাঝে দাড়িয়ে শিশিরের স্বপ্ন দেখার সাথে!!
৬
:যারিফা সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায় ছিল হামাদ।আমার আর যারিফার দু বছরের জুনিয়ার সে।দু'জনই আজাদ কাশ্মীর থেকে এসেছে। যারিফা চলে যাওয়ার পর তাই, একদিন আট-গাট বেঁধে বসে পরলাম হামাদের সামনে।মোটামোটি যা শুনলাম, তাতে শিরদাঁড় বেয়ে দরদর করে ঘাম পরতে লাগলো।।
: যারিফা চলে যাওয়ার পর নিজেকে নিয়ে নতুন আঙ্গিকে ভাবতে শুরু করলাম। এই কাচের দেয়াল অথবা সেলুকাস পৃথিবী নতুন করে ধরা দিতে থাকে আমার চোখে।মনের বাড়ির ঘুলঘুলিতে পথে সকালবেলার সূর্যের আলোটার বাকা পথও নতুন করে ধরা দিতে থাকে আমার চোখে।অতদিন শুধু আলোটাই চোখে ধরা দিতো আর এখন আলোর ভিতরে উড়ন্ত ধূলোটাও চোখে পড়ে!!
৭
: আজকের এই চেম্বারের চেয়ারটায় বসে তাই যারিফাকে নিয়ে ভাবনার শুরুটা বেশ মিরাকেলই মনে হয়।না হলে কেনোই বা নিজেকে নিয়ে নতুন এই পথে পা বাড়াতাম আর কিভাবেই বা সায়মার সাথে এই পথে আবারো দেখা হয়ে যেত!!
: সাইক্রিয়াটিক হবার এই কঠিন পথে বারবার যে যারিফকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে খুৃঁজে নিয়েছি।যারিফা আর তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানার পর এর সত্যতা আর আমার করণীতা সম্পর্কে বাররবার চিন্তা করেছি।শেষমেষ এই পথে নতুন করে হাটতে শুরু করলাম।।
:যারিফার মতো এতিম মেয়েদের সাইকোলজিক্যাল ইমব্যালেন্স সিচুয়েশন আর তাদের সেই স্বপ্নময় জগতে পরিবারের সাথে বিচরণ নিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম।।
: মানুষ সম্ভবত এই কারণেই দিন শেষে বারবার আপন মানুষ-কাছের মানুষ খুঁজে বেড়ায়। বারবার এমন কাউকে খুঁজে নেয়,যাকে সে নিজের বা কাছের মানুষ বলতে পারে। যারিফাও তার সেই মতো জাগতিক নিজের পরিবার বিশেষ করে তার ভাইকে নিয়েই সর্বদা কল্পনায় বসবাস করে।শুনছে বেশ ছোটবেলা থেকেই সে তার পরিবার আর ভাইকে চিঠি লিখতে লিখতে বড় হয়েছ। আর সে কখনো বিশ্বাস করে একদিন না একদিন তার সেই চিঠিগুলোর উত্তর আসবেই।এইভাবেই বছরের পর বছর এই ইল্যুশন নিয়েই বড় হতে থাকে যারিফা।বাস্তবতা থেকে পালিয়ে অলীকতার মাঝে।।
৮
: যারিফা সাথে আমার প্রথম এবং শেষ সিটিংয়ের দিন, যখন চোখ -মুখ বন্ধ করে গড়গড় করে মনের সব কথাগুলো বলে দিয়েছিলাম এবং তৃষ্ণার্ত চোখে ওর উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম এবং সে একবারো আমার দিকে না তাকিয়ে, ওর ভাইয়ের সম্মতি ছাড়া, সে কিছুই বলতে পারবে না বলে ওঠে চলে গেল,সে আসলে তার কল্প জগতের ভাই।।
: তারপরও বহুদিন না চাইতেও যারিফাকে নিয়ে প্রচুর ভেবেছি।তার লেখা প্রথম ও শেষ চিঠিটার প্রতিটি শব্দের অর্থ তার সম্পর্কে পুরোপুরি জানার পরই বুঝতে পারলাম। এক শিক্ষা অর্থায়ন সংস্থার মাধ্যমে যারিফা এখানে পড়তে এসেছিেলো। তাই মাস্টার্স শেষেই যারিফা তার সেই এতিমখানায় ফিরে গেছে।তবে যাওয়ার আগে আমাকে একটা ছোট চিঠি দিয়ে যায়।তবে সেই চিঠিই যে আমার আশার যবনিকা ছিলো, তা বুঝতে বেশ দেরী করে ফেলি।।
৯
: যারিফার দেশের প্রতি তার অনেক দায়,শত শত মানুষের গল্প এক নিমিষেই সে শুনিয়েছিলো আমায়। দায় থাকবে না কেনো,এক কাশ্মিরের জন্য যেই সমুদ্রসম রক্ত আর চোখের জল ঝরেছে,তার দায় শোধে করতে যারিফা মত মেয়ে পিছিয়ে থাকবে, সেটা ভাবাটাই অস্বাভাবিক।।
: তাই আমরা যারা নিজ দেশের প্রতি নির্লিপ্ত, তাদের তাই যারিফাদের স্বপ্ন আর ভালোবাসার মর্ম উপলদ্ধি করা সম্ভব না।আমরা যারা অনিয়মকেই নিয়ম জেনে বেড়ে ওঠেছি এবং আমরা যারা সুযোগ পেলেই শিকড়সমেত উপড়ে নিজ দেশ ছেড়ে পাড়ি জমানোর জন্য উন্মুখ হয়ে যাই,তাদের আসলেই যারিফার মনের আকুলতা অনুভব করা সম্ভব হবে না...আমিও সম্ভবত তাদের দলেই।।
: আমাদের মতো দেশের মানুষদের নিজ দেশের প্রতি এত দায় নেই, দায় নিয়ে বড় হতেও হয় নি কাউকে। আমাদের পূর্বসূরিরা বরং যতটুকু দায় ছিল, তাও নিঃশেষ করে দিয়ে গেছেন।আমাদের জন্য তাই দায় না থাকাটাই ভালো, দায় দেখিতে গেলেই বরং বিপদ।।
: তাই সম্ভবত আমিও তার স্বপ্নের যথার্থতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হতাম ... তাই সম্ভবত ওপরওয়ালা চান নি আমাদের আবারো দেখা হোক। আর তাই তো সে বার ফিরে যাওয়ার আগের যারিফার শেষ নিঅমন্ত্রণ আর গ্রহণ করতে পারি নি।।
১০
:আমি যতটুকু বুঝি,বৃষ্টির মাঝে হাটার আনন্দ সবাই উপভোগ করতে পারে না, কারণ সবাই বৃষ্টির ছন্দকে উপলদ্ধি করতে পারে না।।
: তাই সুযোগ পেলেই ব্যাগে ছাতা রেখে বৃষ্টির মাঝে দাড়িয়ে থাকার পুরোনো অভ্যাস থাকলেও, আজকে ছাতাটা খুলেই বৃষ্টিতে হাটতে লাগলাম।।
কারণ,বুক পকেটে সায়মার চিঠিটা নিয়ে ঘুরছি।এই চিঠি কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, সেই ধরণের কোন রিস্কেই যাওয়া যাবে না। ইদানিং চিঠিটা বুক পকেটে নিয়েই ঘোরাঘুরি করছি।বহুল অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু বিপুল প্রতিক্ষীত বস্তু পাওয়ার পর সম্ভবত সকলের এই অবস্থাই হয়!!
কি জানি..হয়তোবা, আমার সাথেই শুধু হচ্ছে..!!!
|| সামিয়া সুলতানা || ১৮-০৪-২০১৮ ||
[ উৎসর্গ: প্রিয় বান্ধুবী সায়মাক
( আমার লেখা প্রথম পাঁচ গল্পের মধ্যে অন্যতম পছন্দের গল্প ছিলো এটা।তখনও গল্প লেখা ব্যাপারটার সাথে আমার পরিচয় যৎ সামান্য।কোন এক অদ্ভুত ঘোরে শুধু বারবার মনে হতো লিখি।লেখালেখির ঘোর কিংবা ভালো লাগার দিনগুলো হারিয়েছে বহুদিন আগেই।তবুও বহুদিন পর স্থান-কাল-চরিত্র পরিবর্তন করে আবারো লিখলাম গল্পটা)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০২২ রাত ২:৩৬