১
“ওফফ..তাড়াতাড়ি হাট,বাসটা চলে যাচ্ছে.. “””
“তুই তাড়াতাড়ি গিয়ে বাসটা থামা,আমার পায়ে ব্যাথা,এর চেয়ে জোরে হাটতে পারবো না.”
“ইশ!আসছে নবাবজাদা!ওনার জন্য বাস দাড়িয়ে থাকবে..তাড়াতাড়ি আয়”
সাবিতকে তাড়া দিতে দিতে প্রায় দৌড়ানো শুরু করল সাব্বির।কমলাপুর ফুটওভারব্রীজের ওপর থেকে দৌড়ে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলো সে ..কিন্তু ততক্ষণে বাস লাপাত্তা…
একই কলেজে পড়ে সাবিত আর সাব্বির..একই সাথে আসা -যাওয়া করে।বাসাও প্রায় কাছাকাছি দুইজনের।ঐদিন সকালে বাসে ওঠতে গিয়ে হাটুতে কিসের সাথে যেন ধাক্কা খেয়েছিল সাবিত..ঢাকা শহরের লোকাল বাসগুলোর যা অবস্থা.. তাই ফেরার সময়ও তাড়াতাড়ি হাটতে পারছিলো না..ফুটওভারব্রীজের গোড়া থেকেই বাসে ওঠে ওরা..কলেজ থেকে ফিরতে একটু তাড়াই করে ওরা .. বিকালে আবার সুমন স্যারের কাছে হায়ার ম্যাথ পড়তে যেতে হবে।।
সাব্বির এবার মোটামোটি চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো
“তোর জন্য বাসটা মিস করলাম,এখনও আরও দশ মিনিট দাড়ায়ে থাকতে হবে”,রাগে কিটমিট করছে সাব্বিরের চেহারা..
সাবিত বরাবরই শান্ত প্রকৃতির, তাই কথা না বাড়িয়ে রাগ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। রাগ করলেই সম্ভবত মানুষ নিজের অজান্তে আনমনা হয়ে যায় এবং নিজেকে একপাশে রেখে চারপাশের হারিয়ের মধ্যে হারিয়ে যায়।সাবিতও কিছুটা আনমনেই রাস্তা, ফুটপাথের চারপাশটা দোখতে লাগলো..একটা খাবারের দোকান,পাশেই একটা কোচিং সেন্টারের সাইনর্বোড,একটা মুদি দোকান।
চোখ ফিরিয়ে ফুটওভারব্রীজের নিচটায় আনতেই দেখতে পেলো, এক বৃদ্ধ একটা জীর্ণ সেলাই মেশিন নিয়ে বসে আছে। ইদানীং অদ্ভুত এক নস্টালজিয়ায় ভোগে সে..দাদু চলে যাবার পর থেকেই আশেপাশে বৃদ্ধ কোন মানুষ দেখলেই বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। সম্ভবত একটা বয়সের পর সব মানুষের চেহারা মাঝেই অদ্ভুত এক মিল খুজে পাওয়া যায়, কি জানি! হয়তবা তারই শুধু এমন মনে হয়।।
আনমনেই দেখতে লাগলো সে বৃদ্ধ লোকটাকে..অদ্ভুত মিল চেহারায়, তার দাদুর সাথে! সময়টা প্রায় ভরদুপুর।সেই জন্যই কিনা লোকটা সেলাই মেশিনটার ওপর মাথাটা রেখে ঘুমে ঢলে পরছে। এবার লোকটাকে আরও ভালোভাবে লক্ষ করলো সাবিত।সময়ের পরিক্রমায় কুচকে যাওয়া হাত,হাতের শিরায় শিরায় স্ফীত রক্তনালী.
.আনমনে আবারো দাদুর হাতের কথা মনে পড়ে গেল সাবিতের..দাদুর এই রকম হাতগুলো কত মসৃণই না ছিল..বাস্তবে ফিরে এলো সাবিত…লোকটার দিকে আবারো তাকাতেই লক্ষ করলো লোকটা বয়সের ভারে কিছুটা কুজোঁও হয়ে গেছে। একটু পরই ঝিমানো ছেড়ে দিয়ে বৃদ্ধ লোকটা সোজা হয়ে বসলো…সামনে থাকা সাদা কাপড়ের টুকরো গুলো একটার সাথে একটা জজোড়া দদিতে লাগলো।মায়া ভরা চোখে বৃদ্ধ লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকলো সাবিত।
সাব্বির হাতটা টান দিতেই বাস্তবে ফিরো এলো সে..দেখলো বাস এসে দাড়িয়েছে…সাব্বির তাকে টেনে বাসের দিকে ঠেলতে লাগলো আর বলতে লাগলো”ওঠ, খোড়া!বাসে ওঠ”।
কয়েকদিন পর… একসাথে আরও কিছু বন্ধুর সাথে বাসায় ফিরছিলওরা, ফুটওভারব্রীজের ওপর দিয়ে..কলেজ থেকে বের হওয়ার পর থেকেই লক্ষ করলো আকাশের “নীল নবঘনে আষাঢ় গগণে,তিলঠাই আর নাহিরে,ওগো আজ তোরা যাসনে কলেজের বাহিরে”টাইপের ভাব…মানে যে কোনসময় মাথায় পানি ঢালা শুরু করবে। গ্রাষ্মকালের এই অদ্ভুত স্বভাব সকালেও ঘামে ভিজে কলেজে আসলো আর এখন!!আনমনে এই সব কথা ভাবতে ভাবতে বন্ধুদের সাথে ফাজলামো করতে ককরতে পথ চলতে লাগলো।
ফুটওভারব্রীজের অর্ধেক যেতে না যেতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো।এবার যে যার মতো দিল দৌড়।যে যার মতো ফুটওভারব্রীজ থেকে নেমে রিকশা, বাসে করে বাসার দিকে ছুট লাগালো।শুধু সাব্বির আর সাবিত দাড়িয়ে রইল তাদের নিদিষ্ট বাসের জন্য। বৃষ্টি থেকে বাচার জন্য সিড়ির একদম নিচের জায়গাটায় দাড়ালো ওরা।রাস্তায় কাকপক্ষী বা বাস কোন কিছুরই দেখা নাই,সব ফাকা।বৃষ্টি যেন আরও জোরে ছন্দ তুলে ঝরতে লাগলো অবিরাম ধারায়।
সাবিতের অন্যমনস্কতা দেখে সাব্বির কিছুটা ধাক্কা দিয়েই বলল”কিরে, কৈ চলে গেলি?”।সাব্বিরের দিকে না ফিরেই,শুধু আঙ্গুল দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করলো সাবিত। সাব্বিরও এবার কৌতুহলী দৃষ্টি দিয়ে সাবিতের দেখিয়ে দেয়া দিকে তাকালো।,বৃদ্ধ লোকটাকে দেখতে লাগলো সেও এবার ..দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছটা পরতে লাগলো তাদের গায়ে।কোন এক অদ্ভুত মগ্নতা চারপাশকে আরও বেশি গুমোট করে তুললো।কোন এক ব্যথিত হৃদয়ের করুণ আর্তনাদ যেন শব্দ তরঙ্গের ইথারের করে ওদের কানে এসে পৌছতে লাগলো।
এবার কিছুটা অবচেতনেই সাবিত এগিয়ে গেল বৃদ্ধের দিকে।সাব্বিরও তার পিছন পিছন এগিয়ে গেল।বৃদ্ধের দিকে মাথা ঝুকিয়ে বলে ওঠল”দাদা”। বৃদ্ধ লোকটা কিছুটা টলতে টলতে ঘোলা ঘোলা চোখে সেলাই মেশিন থেকে মাথা তুলে সাবিতের মুখের দিকে তাকালো।তাঁর সেই অস্পষ্ট চাহনিতে কোন এক পরিচিত ভাষার জগত খুজে পেল সাবিত।এবার কিছুটা কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে ফেললো সাবিত”আপনার কে কে আছে?”
২
বাসে বসেই ঝাপসা চোখে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইল সাবিত।কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়েই সাবিতের টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল সাব্বির।পরম মমতায় বন্ধুর হাতের ওপর একটা রেখে শান্তনা দিতে চাইলো।
বৃষ্টিটা সম্ভবত আরও বাড়ছে।এবার বাসের জানালার ফাক গলিয়ে হুরহুর করে পানি ঢুকছে।পরন্ত দুপুরের কোন ঝুম বৃষ্টি এতটা ম্লান হয়ে কোনদিনই ধরা দেয়নি সাবিতের চোখে।তার প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধের সেই বাকহীন নিরুক্তের ভাষা, তাকে যেই নিষ্ঠুর বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়ে গেল, তাই যেন গুমরে গুমরে উঠছিল তার বুকে।বার বার সেই চাহনি তাই যেন চোখের সামনে ভাসতে লাগলো তার।
ঝাপসা জানালার কাঁচ দিয়ে বাহিরটা দেখার চেষ্টা করলো সে।আকাশটা আজ সত্যিই অনেক বেশি কালো।তার প্রশ্নের জবাবে যখন লোকটি কোন কথা না বলেই, বৃদ্ধের সেই জীর্ণ সেলাই মেশিনটার দিকে বার বার তাকায়ে,কি বোঝাতে চাচ্ছিল, তা বুঝতে সাবিতের একটু কষ্ট হয় নি।
৩
বাস থেকে নেমে মেঘের গুড়ুগুড়ু শব্দের মধ্যে দিয়েই বাসার রাস্তাটার পথ ধরলো সে।বৃষ্টিতে ফাকা রাস্তাটার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আর বেশি মৌনতার আবেশে হারিয়ে গেল সে।দিনান্তের অবলম্বনের জন্যই সম্ভবত প্রতিটা মমানুষ সারা জীবন ছুটে বেড়ায়। সেই হিসেবে জীবনের অবলম্বনের সংজ্ঞাটা আসলেই অনেক জটিল সমীকরনিক ব্যাপার।সম্বলের পিছনে ছুটতে থাকা মানুষগুলোর শেষ অবলম্বন হিসেবে কি থেকে যাবে সেটা মহাকালের বিবেচনাধীন!!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:১৬