(ব্যপারটা সবার জানা উচিৎ!)
আমার একমাত্র ১১ বছরের ভাগিনাটা মেসিমুগ্ধ; ক্লাব ফুটবলের অনেককেই চেনে, কে কোন পজিশনে খেলে সব তার ঠোঁটস্থ। ঐ রাতে ইউরো কাপ ফাইনাল খেলা হচ্ছিল।
আমাকে জিজ্ঞেস করলো কোন দল সাপোর্ট করি।
বললাম, আমি তো খেলা দেখিনা খোঁজখবর ও
তেমন রাখিনা। আচ্ছা বাংলাদেশ খেলেনা ফুটবল?
ভাগ্নের সে কী মু হা হা হা তাচ্ছিল্যের সিনবাদীয় হাসি!
হুপ বেটা! ধমক দিয়ে হাসি থামিয়ে বললাম একটা সত্যিকার রূপকথা শুনবা?
একটা ভুলে যাওয়া তারার গল্প?
একটা জাদুকরের?
-কি গল্প?
শোনো , শত বছর আগের কথা। দিনাজপুরের পার্বতী রেলওয়ে কলোনিতে একজন লোকের জন্ম হয়েছিল।
লোকটার নাম সৈয়দ আব্দুস সামাদ।
পুরো ভারতবর্ষে যাদুকর সামাদ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। আর ইউরোপে তাকে চিনতো দি ম্যাজিশান সামাদ নামে!
সমগ্র ভারত এমনকি দেশ বিদেশ থেকে মানুষ রেলওয়ে কলোনিতে এসে ভিড় জমাতো কেতাদুরস্ত আকর্ষণীয় গোঁফওয়ালা ৬ ফুট লম্বা আর জাঁদরেলি ব্যক্তিত্বের এই যাদুকরকে একনজর দেখতে,
আর তার এপয়েন্টমেন্ট নিতে!
- সামাদ কিসের জাদু দেখাতো?
এটা ছিল সেই যুগ যখন পেলে সবেমাত্র দৌড়াতে শেখা শিশু। ম্যারাডোনা দুগ্ধপোষ্য বাবু আর জিদান তো জন্মায়ই নি!
বিশ্ব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ফুটবলারদের মধ্যে অন্যতম এই জাদুকর সামাদ তখন দুর্দান্ত দাপটে মাঠ কাঁপাতেন!
বিপক্ষদল এর এগারোজন নিতান্ত অসহায় হয়ে যেতো কোনভাবে সামাদের পায়ে বল আটকালে! বল তো নয় যেন কোন প্রশিক্ষিত সেন্ট বার্নার্ড ডগ, যে কেবল তার মনিবের চোখ দেখেই সব বুঝে নিয়ে অসামান্য ক্ষিপ্রতায় লক্ষ্যে আঘাত হানে!
খুব রোমাঞ্চ জাগানিয়া একটা ঘটনা আছে তাকে নিয়ে।
১৯৩৪ সাল। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় মাঠে খেলা চলছে।
সামাদের পায়ে বল। এক সামাদকে ডিফেন্ড করতে ৬ ইন্দোনেশিয়ান জাতীয় দলের খেলোয়াড় প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তবু যেন এ এক অসম লড়াই!
ইন্দোনেশীয় সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে গোলপোস্ট এর কাছে গিয়ে চৌকশ শট খেললেন জাদুকর!
কিন্তু না!
গোলবার এর একেবারে কোনায় লেগে বল ফেরত চলে গেল, গোল হয়েও হলনা।
পাঁচ মিনিট পর প্রায় একইভাবে আক্রমণে সামাদ। এবার আরেক জাদুকরী শট খেললেন। অর্ধবৃত্তের মতো ঘুরে বল আবারও গোলবারের ঠিক একই যায়গায় লেগে ফেরত চলে এলো!
সামাদ খেলা থামিয়ে দিলেন!
তার, অভিযোগ - এই গোল পোষ্টের উচ্চতা আন্তর্জাতিক মাপের চাইতে ৪ ইঞ্চি খাটো!
টিম ম্যানেজমেন্ট কমিটি সাথেসাথে মেপে দেখলেন আসলেই গোলপোস্ট ৪ ইঞ্চি খাটো!
ম্যাচ শেষে গোলবার থেকে ফিরে আসা দুই গোলও মূল স্কোরের সাথে যোগ করা হয়েছিল। সবাই চোখ ফাটা বিস্ময়ে এই বাঙ্গালী ছেলের দিকে হতবিহ্বল তাকিয়ে রইলেন......
-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*
ভাগিনা আমার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। ইউরো ফাইনালের প্রতি কোন আকর্ষণই তার নেই। আর ওমনি টিভিতে দেখাচ্ছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ইনজার্ড হয়ে মাঠের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি বললাম আজকে আরও গল্প শুনবা নাকি কাল?
- আজকেই শুনবো, বলো..
শোনো,
সামাদকে ধরে নিয়ে ১৯২৬ সালে তৎকালীন ভারতবর্ষের জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন বানিয়ে দেয়া হয়।
ভারতের হয়ে চীনদেশের পেকিং রাজ্যে খেলছে সে। খেলার একদম প্রথমেই খুব ব্যথা পেয়ে মাঠ থেকে বের হয়ে গেল সামাদ। চীনাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধই কাজ করছিলোনা ভারতের। প্রথমার্ধ শেষে চায়না ৩:০ গোলে এগিয়ে। ভারতের হার নিশ্চিত।
আহত সামাদ কোচের কাছে গিয়ে ঠিক এভাবে বললেন, "আমি নামতে চাই, এক হালি গোল করা কোন ব্যপার না"
প্রবল আত্মবিশ্বাসী চোখে কোচকে অভয় দিলেন সামাদ; যেন গোল করা আর বাদাম খাওয়ায় বিশেষ কোন তফাৎ নেই।
অনুমতি পেয়ে মাঠে নেমেই পরপর ৪ গোল করে ৩:৪ স্কোরে খেলা জিতে ফিরেছিল ভারতীয় দল!
ও হ্যা, খেলার চলাকালীন সময়ে নাকি মাঠে উদাসভাব দাঁড়িয়ে বাদাম খেতো সামাদ। লোকমুখে এমন অনেক শ্রুতি আছে। (কাকতালীয় ভাবে এই ব্লগ লিখার সময় আমিও বাদাম খাচ্ছি :p )
জাতীয় দলের হয়ে মিয়ানমার, শ্রীলংকা, হংকং, চায়না, জাভা, সুমাত্রা, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, সিঙ্গাপুর, এবং ব্রিটেনে একাধিকার খেলতে গিয়েছিলেন এবং প্রায় সব ম্যাচেই জয়ী হয়েছিল তার দল।
সম্ভবত অভিন্ন সম্রাজ্ঞীর অধীনস্থ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হবার কারণে অথবা পীতবর্ণ ভারতীয় (তৎকালীন) হবার দরুন আলাদা ফোকাস পায়নি ফুটবলে ইউরোপিয়ানদের হারিয়ে দেওয়া এই যাদুকর।
-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*
আরও কিছু তথ্য:
-----------------------
১৮৯৫ সালে জন্মানো আব্দুস সামাদের ফুটবল ক্যারিয়ার ছিল ২৩ বছরের (১৯১৫-১৯৩৮ ইং)।
সেই সময় ফুটবল কেবল ভারতে অবস্থিত কিছু ব্রিটিশ নাগরিক আর সেনাবাহিনীতে চাকরী করা কতিপয় ভারতীয়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
তখনো ফুটবল তেমন জনপ্রিয় ছিলনা ভারতে। ছোটবেলা থেকে সম্পূর্ণ নিজ স্পৃহায় তিনি ফুটবল খেলতেন।
ড্রিব্লিং ও ট্যাকলিং আর কম্পিউটারের মতো মাপা শট খেলতে পারা ছিল সামাদের খেলার সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক।
পূর্ব ভারতে ফুটবল জনপ্রিয় করনের ওয়ান ম্যান আর্মি বলা যায় তাকে।
১৯১২ সালে সামাদ কলকাতা মেইনটাউন ক্লাবে খেলা শুরু করে। পরের বছর তাজহাট ফুটবল ক্লাবের হয়ে কলকাতায় খেলতে গেলে তৎকালীন গভর্নর তার খেলা দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে যান এবং জাদুকর সামাদ খেতাব দেন।
আরিয়ানস নামে একটা সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাব ছিল কলকাতার। ১৯১৫ সালে সামাদ ঢুকে আর এক বছরের মাথায় সেই আরিরিয়ানস প্রথম ডিভিশন ক্লাব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়!
ইংল্যান্ডের সামারসেট ফুটবল টিমের বিপক্ষে সেবছর আরিয়ান্স জয়লাভ করে।
এর মাঝে কলকাতা ওরিয়েন্টস ক্লাব ও ঈষ্ট বেঙ্গল রেলওয়ে টিমের হয়ে খেলেন তিনি।
১৯২৭ সালে ইংলেন্ডের শেরওড ফরেষ্ট্রী টিমের বিপক্ষে ফাইনালে ট্রফি জেতানো গোলটি করেছিলেন তিনি।
১৯৩৩ সালে সামাদ কলকাতা মোহামেডান ক্লাবে খেলা শুরু করেন। তার একান্ত কৃতিত্বে মোহামেডান একটানা ৫ বছর ফার্স্ট ডিভিশন লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ ও ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন শিল্ড টুর্নামেন্ট এ শিরোপাধারী হয়ে ছিল।
ঈষ্ট পাকিস্তান রেলওয়ে তাকে সম্মানপূর্বক প্ল্যাটফর্ম ইন্সপেক্টর পদ দিয়েছিল। যদিও তাকে কোন দায়িত্বপালন করতে হয়নি। একই পদে বহাল থেকে তার মৃত্যুও হয় পার্বতীপুর রেলওয়ে কলোনির টিএন-১৪৭ নম্বর বাড়িতে।
*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*
আমরা শুধু নিজেদের ব্যর্থতার গল্প শোনাই।
একজন ফুটবলার যে বিস্ময়বস্তু হতে পারে বিশ্ববাসীকে সর্বপ্রথম জানিয়েছিল আমাদের সামাদ।
বব ডিলান- বব মার্লের আলোচনা করতে পেরে আমরা গর্বিত বোধ করি
আমরা লালন - আব্দুল করিমের গান প্রকাশ্যে শুনতে বিব্রত হই!
চে গুয়েভারা দের ছবি বুকে দেয়ালে আঁকা থাকে আর
নজরুল তিতুমীরেরা বস্তাবন্দী ইতিহাস বই এর মাঝে ধুকে!
পৃথিবীবাসী সৈয়দ আব্দুস সামাদকে মনে রাখেনি। তার দেশও তাকে মনে রাখেনি। আর প্রজন্ম তো চিনেই নি!
মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালনে আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম ব্যর্থ হয়েছে।
হয়তো দুর্ভিক্ষ, বঙ্গভঙ্গ, দেশভাগ, ভাষা যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, আবার দুর্ভিক্ষ, নাটকীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এর মতো বড়বড় ইস্যুর আড়ালে হারিয়ে গেছে আমাদের সামাদেরা।
হাজার বছরের পুরানো প্রবাদ - Know thyself: নিজেকে চেন (তবেই সব চিনতে পারবে)
এই কিংবদন্তী সামাদদের চিনে নিজে অনুপ্রাণিত হবার আর অনুজদের অনুপ্রাণিত দায়িত্বটা আজ আমাদের ঘাড়ে বর্তেছে...
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৮:৪৯