২০০৬ সালের শেষদিক। প্রথমবারের মত কুলিয়ারচর থেকে ইঞ্জিনের ট্রলারে করে অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চল) যাচ্ছি। ঘন্টাখানিক পাড়ি দেয়ার পর হাউরের মাঝের দিকে যে যায়গাটা পার হয়ে যেতে হয় সেখানটা সম্পর্কে অদ্ভুত কিছু কথা প্রচলিত আছে। বলা হয় বর্ষাকালে যায়গাটায় আশ্চর্য সব চক্রবান দেখা যায় যা নৌকা-মানুষ সব-কিছুই উড়িয়ে দুর গ্রামে নিয়ে ফেলে দেয় নয়তো পানিতে ডুবিয়ে দেয়! যেটা আমার কাছে এর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর লাগতো তা হচ্ছে জলদস্যু'র উপদ্রবের কথা। প্রায়ই নৌ-ডাকাতি হয় ঐ যায়গাটায়। সুযোগ পেলে বনিক নৌকা থেকে বরযাত্রী কিংবা সাধারন যাত্রীবাহী কোনোটাই বাদ যায় না ওদের আক্রমণ থেকে।
বর্ষার সময় এখানটা আক্ষরিক অর্থেই অতল দরিয়া হয়ে যায়। গত শীতে যা ছিল পুকুর-বিল, উচু-নিচু জমি কিম্বা দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত; আজ তার পুরোটাই মিলেমিশে একাকার হয়ে তীরহারা সাগরে রূপ নিয়েছে; নিজ চোখে না দেখলে ভাটির এই সৌন্দর্যের সরূপ বুঝা একপ্রকার অসম্ভব।
ইঞ্জিনের টানা ঘটঘট শব্দে ঢেউ কেঁটে আমাদের নৌকা এগুচ্ছে। চোখের সীমানায় কোন দ্রুতগামী নৌকা দেখলেই যাত্রীদের সবাই চমকে উঠে সাবধানী হয়ে যাচ্ছে। বিরবির মুখে সবাই প্রার্থনায় ব্যস্ত যেন ঠিকঠাক পৌছে যায় এ'যাত্রায়।
আচমকা পিছন থেকে আশা শোরগোলে সবাই চমকে উঠি। ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হয়, ধীরে নৌকার গতি কমে আসে। দ্রুতগামী ষ্টিলের নৌকা থেকে পাঁচ-ছয় জন হ্যাংলা ধরনের লোক আমাদের নৌকায় ওঠে আসে।
কারো হাতে রড কারো হাতে চাপাতি আর একজনের হাতে পিতলের পুরোনো পিস্তল। পিস্তলওলা স্থানীয় ভাষায় অন্যদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাকি সবাই তার নির্দেশনা অনুযায়ী লুট করছে। কেউ কেউ নৌকার পাটাতনের নীচে মূল্যবান জিনিস ফেলে দিয়েছিলা, ভাগ্যক্রমে দস্যুদের নজরে যদি না পড়ে ভেবে....শেষরক্ষে হয় নি। দুয়েকজন ক্ষীণ আপত্তি জানানোয় তাদের বুকের উপর উপর্যপুরি ধুরুম ধারাম লাথি....
অবস্থা বেগতিক দেখে সবাই নীরব আত্মসমর্পণ করে যার যার জিনিস দিয়ে দিচ্ছে; ঝামেলা বাঁধলো এক বুড়োর কাছে এসে। বেচারার লুঙি তে টাকা গুঁজা আছে, সে তা কোন ভাবেই দিতে রাজী নয়। জোরাজোরি'র পর দেখা গেল তার কাছে মোট তিনশো পঞ্চাস না কতো যেন টাকা আছে! অথচ এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা/মুল্যবান জিনিস সবাই বিনাবাক্যে দিয়ে দিয়েছে।
ডাকাতেরা চলে গেল। সবাই বোকার মতো বসে আছে। বয়স্ক কেউ কেউ বলছেন "আল্লাহ্ যা করেন ভালো'র জন্যই করেন/মালের উপর দিয়ে আপদ চলে গেছে......
সবাই বিষন্ন, স্তব্ধ সাথে কিছুটা আনন্দিতও -শারীরিক কোন ক্ষয়ক্ষতি যেহেতু হয় নি।
শুধু এক জনের চোখেই পানি____বুড়োর অসহায় ছলছল চোখ দেখে প্রচন্ড বিরক্ত আর অবাক হয়েছিলাম সেদিন.....শালা প্রানে মরস নাই, শুকরিয়া না করে সামান্য তিন'শো টাকা হারায়ে কান্দোস(!)
এখন বুঝি ঐ তিনশো টাকা আমার-আপনার কাছে শুধু তিনশো হলেও বুড়োর কাছে এর মূল্য-প্রয়োজনীয়তা ছিল অনেক বেশি। হয়তো এই তিনশো টাকার জন্য দুই বেলা না খেয়ে থাকা স্ত্রী -কন্যাকে আরো কয়েক বেলা অভুক্ত থাকতে হয়েছিল অথবা আমাদের ধারনারও বাইরের কিছু কষ্টের ফর্দ।
সেদিন মন্দের ভিতরও কিছু ভালো দেখেছিলাম। ছাত্র হওয়ার দরূন ডাকাতেরা আমি সহ আরো চার পাঁচজনের কাছেও আসেনি, কোন বাজে আচরন করে নি। ডাকাতের মধ্যেও সেদিন নীতি দেখেছিলাম।
অসংখ্য ছাত্রছাত্রী মেধাবী হওয়া সত্বেও প্রতিবছর সীমিত আসনের কারনে কাঙ্ক্ষিত পাবিলিক ভার্সিটিতে সুযোগ না পেয়ে ব্যয়বহুল নন গভঃ ভার্সিটিতে বাধ্য হয়ে ভর্তি হয়।
গ্রামের জমি বেঁচে শহরে এসে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার আশায় বুক বেঁধে প্রাইভেটে ভর্তি হওয়া অনেক ছেলে আমি নিজে দেখেছি।
দেশ-উপার্জন-জীবনযাত্রা' নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত করার সহস্র প্রতিশ্রুতি, টকশো কাঁপানো বক্তৃতা দিয়ে আর রূপরেখা (আমি রূপকথা বলি) এঁকে তারপর ভারী বাজেট বানিয়ে তা গরীবের রক্তের টাকা দিয়ে বাস্তবায়ন করা.......
আপনি কী মনে করেন দেশের বেসরকারী ভার্সিটির সব ছেলেমেয়েই এয়ার্টেলে দেখানো বিজ্ঞাপনের মতো দিনে লাইক-কমেন্ট-শেয়ার আর রাতভর লংড্রাইভ-বনফায়ারে মেতে থাকে?
কী ধারনা আপনার, সবার কাছেই চার হাজার কোটি টাকা সামান্য? আপনি সম্ভবত এখনো রংয়ের দুনিয়ার আছেন।
স্যার, শিক্ষার উপর খাজনা বসালেন কেন? ডাকাতের নূন্যতম নীতিও তো মানলেন না আপনি!
কেন এই অযাচার? কেন এই অত্যাচার?
এতো ঘৃনা রাখবেন কোথায়? কোন জবাব দিতে পারবেন আপনি?
হে মহারাজ এসো আমাদের সমতলে
পাবে জীবন যাকে বহুদুর গেছো ফেলে
হে মহারাজ!!!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৫১