কিছু দিন আগে, মোশাররফ করিমের অভিনয় নিয়ে মামার সাথে আলাপ হচ্ছিল। মামা বলছিলো, মোশাররফ করিম খুব ভালো অভিনয় করে। আমি ওনার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করলাম। কারণ মোশাররফ করিমের অভিনয়ে আমি কখনো মূল ধারার কিছু খুঁজে পাই নি। উনি শুধু এমন কিছু করেছেন যেটা বাংলার দর্শক আগে দেখেনি এবং দর্শক যেটা খাবে। যেমন, ব্যতিক্রমী কান্না, উদ্ভট আচরণ, হাস্যকর অঙ্গভঙ্গী এবং ব্যতিক্রমী পোশাক। এই জিনিসগুলোর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে উনি ভালো খ্যাতি অর্জন করেছেন। তবে যাই হোক, এগুলো নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। আমার কাছে উনি ভালো অভিনেতা না হলেও অনেকের জন্য আদর্শ অভিনেতা।
কিন্তু সম্প্রতি ওনার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া ব্যাপারে গুঞ্জন শুনছিলাম। তাই যাচাই বাছাই করার পর আমি থ। অনেক দিন আগের একটি অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে গেলো। যেখানে মোশাররফ করিম তার নিজের লেখা একটি গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। গানটি অনেকটা বাউল সংগীতের মত। তখন আমি ভেবেছিলাম, লোকটা এত ব্যস্ততার মাঝেও গান লেখার জন্য সময় কিকরে বেড় করে নেয়। ওনার এই দিকটা আমার ভালো লেগেছিলো। অন্তত উনি একজন ভালো চরিত্রের এবং ব্যাক্তিত্বের মানুষ (বাস্তব জীবনে। অভিনয়ে যাই হোক)। উনি আসলে এমন কি বলেছিলেন যে, তাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলো?
‘জাগো বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানটি মূলত সাধারণ জনগণকে নানান সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার প্লাটফর্ম। ইউটিউব ঘেঁটে মোশাররফ করিমের উক্ত কথাগুলোর একটি ভিডিও পেলাম। সাথে দুবাই প্রবাসী কোন একজনের নিজস্ব বক্তব্য। মোশাররফ করিম যা বলেছিলেন তা হুবহু আমি এখানে কোট করলাম।
"কি মনে হয় তোমার? একটা মেয়ে তার পছন্দমত পোশাক পড়বে না? আচ্ছা, পোশাক পড়লেই যদি প্রবলেম হয়, তাহলে ঐ ৭ বছরের মেয়েটির ক্ষেত্রে কি যুক্তি দেবো আমরা? যিনি বোরখা পরে ছিলেন তার ক্ষেত্রে কি যুক্তি দেবো? কোনও যুক্তি আছে? না। …………… এটুকু আমরা বলতে পারি, যে সমস্যা ওখানে, তো সেই যায়গাটা আমরা ঠিক করি। আমরা শ্লীল হয়ে উঠি। আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতে শিখি। সেটা না শিখলে আমি আসলে পুরুষ হয়ে উঠবো না।"
এরপর মোশাররফ করিম ইমাম গাজ্জালী (র) এর একটি উক্তি তুলে ধরেন। “There are 13 enemies inside you that you cannot see”।
তো পুরো ব্যাপারটিই এটা। শুধুমাত্র সামাজিক সচেতনতা। তারপর আবার তিনি ইমাম গাজ্জালীর একটি উক্তিও তুলে ধরেন। তারপরেও নাকি এই কথাগুলো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে!
বাহ! যেখানে সমাজকে সচেতন করতে চলেছিলেন মোশাররফ করিম, সেখানে তাকেই সচেতন হয়ে যেতে হলো। এর কারণে তাকে নাস্তিক বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভিডিওর শেষেই দেখতে পারেন। তার গ্রামের বাড়িতে হামলাও নাকি চালানো হয়েছে।
যেখানে মোশাররফ করিম শুধু সত্যটুকু তুলে ধরেছেন। যারা আজকে মোশাররফ করিমের বিরুদ্ধে চিল্লাপাল্লা করে নিজেদের মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছেন তারাই একবার চিন্তা করুন, ৭ বছরের মেয়ে, তার পোশাকে কি অশ্লীলতা ছিলো? ৫ বছরের হিন্দু মেয়ে পূজা, যে কিনা এক মুসলমান কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছিলো, তার পোশাকে কি অশ্লীলতা ছিলো? এমনকি পূজাকে ধর্ষণ করতে অসুবিধে হচ্ছিলো বলে তার যৌনাঙ্গে ব্লেড ব্যবহার করা হয়।
তারপরেও আপনারা কথা বলছেন! কোন যুক্তিতে, কোন সাহসে? লজ্জা বলে কোনও জিনিস কি আপনার ধর্মীয় অনুভূতি আপনাকে শিক্ষা দেয় নি?
মোশাররফ করিম শুধু সত্য বলেছেন। নিজের কুরুচিপূর্ণ মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, দোষ পোশাকের? নিজের লালসা, কামনার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না, দোষ পোশাকের? আমার জানামতে আপনার ধর্মে তো মনের কুচিন্তার সাথে যুদ্ধকেও জিহাদের মর্যাদা দেয়া হয়েছে, আপনি ধার্মিক আপনি জানেন না? দোষ পোশাকের!?
PDF টি দেখুন, বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের পুরো বৃত্তান্ত আছে এখানে, আর তারপর নিজেকে প্রশ্ন করুন, কারণ কি? আসুন, একটু পর্যালোচনা করি।
রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের দেশে ধর্ষণের একমাত্র কারণ হলো ধর্ষক নিজে। না পোশাকের জন্য, না মদ্যপানের জন্য, না ফ্লার্টিং অথবা কথাবার্তার মাধ্যমে উৎসাহ দেয়ার জন্য।
আপনার কাছে কি যুক্তি আছে যে আপনি ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করেন। সাউথ আফ্রিকা ধর্ষণের জন্য বিখ্যাত একটি দেশ। এই লিস্ট ধরে পরপর আছে Botswana, Lesotho, Sweden, Nicaragua, Grenada, Australia, Germany, Saint Kitts and Nevis, Panama, Belgium, United States of America. মূলত আফ্রিকা এবং ক্যারাবিয়ান এর অন্তর্ভূক্ত দেশগুলোতে ধর্ষণের পরিমাণ বেশি। লিস্ট থেকে যেসব দেশ বাদ পড়লো তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, Canada, Croatia, Denmark, Finland, Italy, Moldova, Netherlands, Norway, Russia, Poland, Spain, Switzerland যেগুলোর সবগুলোই ইউরোপিয়ান কান্ট্রি এবং এসব দেশে মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে রাস্তা-ঘাটে এবং বিকিনি পরে সৈকতে ঘুরে বেড়ায়। এবং আশ্চর্যজনকভাবে এইসব দেশে ধর্ষণের পরিমাণ তুলনামূলক কম। তারপরেও আপনি বলে চলেছেন, ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী। মস্তিষ্ক খুলে আলমারিতে বন্ধ করে রেখেছেন নিশ্চয় এই কথা বলার আগে।
মোশাররফ করিম ক্ষমা চেয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছেন, যে পরিবর্তন সাধন করার জন্য আপনি ‘জাগো বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানটি করছিলেন, সে পরিবর্তন আপনার দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ আপনি মিথ্যে দেখে ভয় পেয়েছেন। আপনি সত্য বলেছিলেন, কিন্তু তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেন নি।
Major Sources: Academia, TrendRR and Wikipedia | Also Facebook, Youtube
PDF copyright credit: Yeasir Yunus | University Of Dhaka, Department of Population Sciences, Undergraduate
Featured Image from প্রথম আলো
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ৭:৩৭