মানবাধিকার শব্দটা নিয়েই সম্ভবত আজকাল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সবচেয়ে বেশি হৈচৈ ও আলোচনা হয়। এটা স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই যে, মানবাধিকার বিষয়ে কোন একাডেমিক শিক্ষা আমার নেই। কাজেই এ বিষয়ক আলোচনা অবতারণার জন্য কেউ যদি আমাকে অর্বাচীন হিসেবে আখ্যা দেন তাহলে তার প্রতিবাদ করার মতো অন্তত দালিলিক কোন প্রমাণপত্র আমার নেই। তারপরেও অনেকটা সাহস ও কিছুটা শখের বশে এ আলোচনায় নিজেকে সংশ্লিষ্ট করলাম এই ভেবে যে, এটাকে উপলক্ষ্য করে হয়তো মানবাধিকার সম্পর্কে কিছু শিখতে বা জানতে পারব।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করে (Click This Link)। মোট ৩০টি আর্টিকেল সম্বলিত এ ঘোষণায় মানুষের অনেক অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু আমার মতো আমজনতাদের এসব আর্টিকেল ঘেটে কিছু বুঝা দুঃসাধ্য ব্যাপার। আবার কিছু কিছু বুঝতে পারলেও যখন দেখি এসবের বাস্তব কোন প্রয়োগ নেই তখন ধরে নেই এগুলো শুধু তত্ত্বকথা। পুস্তকের ভাষার মতো কিছু সাজানো কথামালা, যার বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই, প্রয়োজনও নেই।
কাজেই জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদকে সার্বজনীন কোন আচরণীয় বিষয় বলে মনে করার কোন কারণ নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মানবাধিকার বিষয়টাকে আপেক্ষিক কোন বিষয় বলে মনে হয়। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে যার সংজ্ঞা পাল্টে যেতে পারে। আফ্রিকার যে মহিলাটি বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য দিনে কয়েক কিলোমিটার হাটে তাঁর কাছে বিশুদ্ধ জলের নিশ্চয়তাটাই মানবাধিকার। আফ্রিকার যে দেশগুলোর একটি প্রজন্ম হারিয়ে যাচ্ছে এইচআইভি/এইডস এর আক্রমণে তাদের কাছে একটু সুস্থ্যভাবে কোনরকমে বাঁচাটাই হচ্ছে মানবাধিকার। ইরাক, আফগানিস্তান, সোমালিয়ার যুদ্ধে জর্জরিত দেশের মানুষগুলোর কাছে আজকের পরের দিনটা বাঁচতে পারাটাই মানবাধিকার। ভদ্রলোকের দেশ বলে পরিচিত জাপানীদের নিকট আত্মসন্মান নিয়ে বাঁচাটাই হচ্ছে মানবাধিকার। সেখানে কোন ব্যক্তি তার কর্মচারীদের বেতন দিতে ব্যর্থ হলে বা সে যদি মনে করে সে রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে গেছে তখন সে আত্মহত্যা করে, যেটা আপনি আমাদের ভারতবর্ষ বা বাংলাদেশে পাবেন না। সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় মানুষের সমান অধিকার ও মৌলিক প্রয়োজনগুলো মিটানোই মানবাধিকার। ব্যক্তির ইচ্ছা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কোন স্থান সেখানে নেই। আর আমেরিকা বা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো যারা বিশ্বকে কব্জায় নিয়ে এসেছে, বিশ্ব যাদের হাতের মুঠোয়, মৌলিক প্রয়োজনগুলো যাদের না চাইতেই পুরণ হয়ে যায়, তাদের কাছে মানবাধিকার হচ্ছে সমকামিতা বা সমলিঙ্গের বিয়ে করার অধিকার।
কাজেই মানবাধিকার অবশ্যই আপেক্ষিক। এটা কোন একক বিষয়ও নয়। এর সাথে অবশ্যই অনেক পারিপার্শ্বিকতা ও শর্ত প্রযোজ্য। প্রধান পারিপার্শ্বিকতা বা শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, সমাজের শৃংখলা এবং সবার ( সম্ভব না হলে অন্তত বৃহৎ অংশের) স্বার্থ পূরণ। তিয়েনমেন স্কোয়ারে বিক্ষোভরত ছাত্রদের দমন করে চীন পশ্চিমাদের মতে মানবাধিকার লংঘন করেছে। কিন্তু চীনের দৃষ্টিতে সেটা সে করেছে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য। তিয়েনমেন স্কয়ারের বিক্ষোভ দমন করতে পেরেছে বলেই চীন পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার সমপর্যায়ে থাকতে পারছে, বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যদি চীনের নেতৃবৃন্দ সে বিক্ষোভের কাছে নতি স্বীকার করতেন তবে আজ চীন আমেরিকার বশংবদ একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হত।
সমাজের শৃংখলা ও চলমান নিয়ম (যা ইতিবাচক) বজায় রাখার সাথেও মানবাধিকার জড়িত ও শর্তযুক্ত। সনাতন ধর্মে রক্তের সম্পর্কের কারো সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষেধ। মাস কয়েক আগে ভারতে চাচাতো ভাই-বোন সম্পর্কের দু'জন সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে বিয়ে করতে না পেরে আদালতের আশ্রয় নেয়। আদালত তাঁদের এ বিবাহ-কে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করে। এখানে আদালত ধর্মীয় কোন কানুনের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছে বলেছে আমি মনে করিনা। বরং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলমান সামাজিক রীতি ও সামাজিক শৃংখলাকেই প্রাধিকার দিয়েছে। আজকে চাচাতো ভাই-বোন বিয়ে করতে চাচ্ছে (যা হিন্দু সমাজবিরুদ্ধ)। এখন মানবাধিকার বা ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে কেউ যদি এটাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন তবে কোনদিন আপন ভাই-বোনরাও যে বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িত হতে চাবেন না, তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? আর বিষয়টা যদি সে পর্যায়ে যায় তবে সামাজিক শৃংখলাটা কোন পর্যায়ে যেয়ে পৌছবে? সমাজ এবং রাষ্ট্রের অবশ্যই নিজের স্থিতিশীলতা, শৃংখলা রক্ষার অধিকার আছে। রাষ্ট্র ও সমাজ নিজ স্বার্থে ব্যক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
এখন আমাদের বাংলাদেশের মতো দেশে মানবাধিকারের পর্যায় বা অবস্থানটা কোথায় হওয়া উচিত? ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় এখানে মানুষের মৌলিক অধিকারের (খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য,বাসস্থান, শিক্ষা) প্রাপ্যতাই মানবাধিকার। আপামর জনসাধারণের জন্য এসবের নিশ্চয়তা বিধান করাটাই রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রধান দায়িত্ব। আমাদের রাষ্ট এখনও এসবের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেনি। রাষ্ট্র যখন এসবের নিশ্চয়তা দেওয়ার পর্যায়ে চলে যাবে তখন হয়তো ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো বা অন্যান্য বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া যাবে।
এখন যে রাষ্ট্রে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো পুরণ হয়নি তেমন একটি রাষ্ট্রে যখন সমকামিতার অনধিকার-কে মানবাধিকার লংঘনের পর্যায়ে কেউ ফেলেন তখন বিষয়টা নিয়ে হাসব না কষ্ট পাব তা বুঝে ওঠতে পারিনা। এক্ষেত্রে আমার অনুভুতি কাজ করেনা। তবে যারা সমকামিতার অনধিকার-কে মানবাধিকার লংঘন বলে মনে করেন আমি দুষ দেইনা। কারণ তাঁরা হয়তো সমাজের এমন একটা পর্যায় থেকে এসেছেন যেখানে মৌলিক প্রয়োজনগুলো অনেক আগেই তাদের কব্জায় চলে এসেছে। কাজেই অন্যান্য বাড়তি চাহিদাগুলোর দিকে তাঁরা স্বভাতই হাত বাড়াবেন। কিন্তু রাষ্ট্রের উচিত সমাজের বৃহৎ অংশের স্বার্থকে বিবেচনায় নেওয়া এবং এদেশের সাপেক্ষে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পুরণের দিকে নজর দেওয়া। সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্র হয়তো সেটাই করবে বা করার চেষ্টা করবে। এখন প্রশ্নটা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্যকে পাশ কাটিয়ে যারা সমকামিতার অনধিকার বা অস্বিকৃতীকে মানবাধিকার লংঘন বলে চেচামেচি করছেন তাঁরা কি সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তাকে তার সঠিক গন্তব্য থেকে চ্যুত করছেন না?