স্রষ্টা ও সৃষ্টি দ্বৈত ধারণা; স্রষ্টা থেকে সৃষ্টিকে আলাদা করিয়া দেখা’ই দ্বৈতবাদ। ইহাকে বলা হয়ে থাকে ওয়াহেদাতুল সহুদ। ওয়াহেদ মানে এক, সহুদ মানে সাক্ষী- একের সাক্ষী অর্থাৎ আমি একটি সৃষ্টি আমার একজন স্রষ্টা আছে। এই ধারণার সংখ্যাই অধিকতর। ‘সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে আলাদা করিয়া ভাবিলে বা দেখ অস্তিত্বের বাইরে আমার নিজের একটি আলাদা অস্তিত্ব রহিয়াছে বলিয়া মনে করিলে তাহাকে দ্বৈত দৃষ্টি বলে। মন সেই অবস্থায় সৃষ্টির একজন অদৃশ্য স্রষ্টা কল্পনা করিয়া দুইয়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের ধারণা গ্রহণ করে- ইহাই মনের সকল অংশীবাদের (শেরেকের) ও অপরাধের মূল।’
সৃষ্টি তাহার আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বলিয়া মনে হইলেও স্রষ্টার গুণের বাইরে তাহার আপন বা নিজস্ব কোন গুণ (সেফাত) নাই। অপরদিকে ‘অজুদ’ অর্থ দেহ। সুতারাং ‘ওয়াহেদাতুল অজুদ’ বলিতে সবকিছু এক দেহের অন্তর্গত বা একাঙ্গীভূত বুঝায়। ওয়াহেদাতুল অজুদের ধারণাকে অদ্বৈতবাদ বা সর্বেশ্বরবাদ (Pantheism) বলা হয়।
ওয়াহেদাতুল অজুদ তত্ত্বের মূল কথা হইলঃ সকল অস্তিত্বশীল সত্ত্বার মূল সত্ত্বা— এক। তাঁহা হইতে সকল সত্ত্বার আগমন। সকলই মূলত এক এবং সকল কিছুই এক ঐশী পদার্থের বিভিন্ন রূপ মাত্র। বিশ্বজগত আল্লাহ্র বিকাশিত রূপ, সেইজন্য আল্লাহই সব এবং সবই আল্লাহ্র প্রকাশ অর্থাৎ এই বিশ্বজগত আল্লাহ-সত্ত্বাময়। আল্লাহ্ ব্যতীত দ্বিতীয় কোন সত্ত্বা নাই। আল্লাহ্ নিজেকে প্রলম্বিত করিয়াই এই জগত বানাইয়াছেন। এই দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জগতের সব কিছুই তাঁহারই শরীর। তাঁহার বাইরে কিছুই নাই। এই জগত তাঁহার সৃষ্ট নয় বরং তাঁহার নিজের প্রলম্বিত শরীর। মহাবিশ্বে মহিমান্বিত আল্লাহ্ নিজেকে তাঁহার মর্যাদা অনুযায়ী তিনটি স্তরে পরিব্যপ্তি ঘটাইয়া যথা— ১. আহাদ আল্লাহ্, ২. সামাদ আল্লাহ্ এবং ৩. লা-শারিক বা নিরাকার আল্লাহ্।
আহাদ আল্লাহঃ আল্লাহ্র প্রকাশিত রূপের মধ্যে ইহা নিম্নমানের দুর্বল স্তর। ‘আহাদ’ শব্দটি মূলতই বহুবচন। যেমন ইংরেজি শব্দ ‘আর্মি’ তেমনই আহাদ শব্দটিও। একজনকে লইয়া ‘আর্মি’ হয় না। ‘আহাদ’ শব্দটি অর্থ এক বলিলে ভুল হইবে। ইহার অর্থ একক বলা-ই উত্তম। এককের সংজ্ঞা এমনভাবে দেওয়া যাইতে পরে যে, যে-বহুর সমষ্টি এক মূলের সহিত যুক্ত তাহাই একক। এই দৃশ্যমান জগতে জীব, জড় ও শক্তিরূপে আল্লাহ্ নিজেই বহুরূপে রূপায়িত। তাঁহার বাহিরে কোন অস্তিত্ব নাই। সমগ্র সৃষ্টি তাঁহার সেফাত হইতে আগত এবং তাঁহা হইতে প্রাপ্ত সেফাত সাময়িক। সৃষ্টি তাহার আলাদা অস্তিত্ব লইয়া দাঁড়াইয়া আছে বলিয়া মনে হইলেও স্রষ্টার সেফাতের বাহিরে তাহার আপন বা নিজস্ব কোন সেফাত নাই।
আহাদ জগত নারী প্রকৃতি। যাহা উৎপাদনশীল তাহাই প্রকৃতি। তবে যে-সত্ত্বা মহিমান্বিত আল্লাহ্র শক্তিতে শক্তিমান হইয়া সৃজনী শক্তির অধিকারী হইয়াছেন, তিনি উৎপাদনশীলতার সহিত জড়িত থাকা সত্ত্বেও আহাদ জগতের অন্তর্ভুক্ত নন। তিনি যদি আহাদ জগতের বাসিন্দা তবুও সামাদ জগতের ব্যক্তিত্ব। আহাদ জগতের প্রতিটি সত্ত্বা দুর্বল, অস্থায়ী, অধম, মন্দ। জড় জগত, জীব জগত, মনুষ্য জগত এবং মনুষ্য জগতের মধ্যকার জাহান্নাম ও জান্নাত সকলই আহাদ জগতের অন্তর্ভুক্ত। আহাদ জগতের প্রতিটি সত্ত্বা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। পরস্পরের নির্ভরশীলতায় আহাদের সবাই একধর্মী। একজনকে ব্যতিরেকে অপরজন অচল। তাই আহাদ জগত দুঃখময়। বস্তুজগতের যাহা কিছু আমরা দেখি, শুনি ও অনুভব করি তাহা আহাদ আল্লাহর অন্তর্ভুক্ত। জন্ম, মৃত্যু, জরা, রোগ, শোক, আনন্দ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি এই আহাদ জগতের উপাদান ও গুণাবলী। কোরানে আল্লাহ্র এই স্তরকে তাই বলা হইয়াছে ‘দুনাল্লাহ’ অর্থাৎ দুর্বল বা মন্দ আল্লাহ্। সুতারাং মানুষের মুক্তি পথে দুর্বল আল্লাহ্ হইতে কোন অভিভাবক বন্ধু এবং সাহায্যকারী নাই।
জীব সত্ত্বা ক্রমোন্নতি প্রাপ্ত হইয়া বুদ্ধিমত্তায় উন্নত পর্যায়ে অর্থাৎ মানব-রূপে আসে। মানব হইতে ক্রমশ আত্মোন্নতির সাহায্যে সামাদিয়াত অর্জন করিতে পারে। আহাদ জগতের দুর্বল সত্ত্বা কর্তৃক দুর্বল সত্ত্বার বা দুর্বল আল্লাহ্র উপর আজীবন নির্ভরতা বা দাসত্বের পরিনাম— জাহান্নাম। অপর পক্ষে দুর্বল সত্ত্বা কর্তৃক কোন শক্তিশালী সত্ত্বা অর্থাৎ সামাদ আল্লাহ্র উপর নির্ভরতা ও দাসত্বের ফল — প্রাথমিক পর্যায় জান্নাত এবং তদ্পরবর্তীতে মুক্তি। এই মুক্তি জাহান্নাম হইতে মুক্তি, এই মুক্তি সৃষ্টির বন্ধন হইতে মুক্তি।
সামাদ আল্লাহঃ আল্লাহ্র প্রকাশিত রূপের মধ্যে ইহা শক্তিশালী স্তর। কোরানে আল্লাহ্র যত গুণাবলী ও শক্তির বর্ণনা আছে তাহা ‘সামাদ আল্লাহ্’ স্তরের গুণাবলী ও শক্তি। কোরানে সামাদ আল্লাহ্ ‘আমরা’ সম্বোধন করিয়া কথা বলিয়াছেন। বিশ্বের যত নবি, রসুল, উলিল-আমর মহাপুরুষ, অলি-আউলিয়া আছেন— তাঁহারা এই ‘আমরা (নাহানু)’ দলের সদস্য। তাঁহারাই এই জগতের লালন-পালন ও হরণকারী। আহাদ জগতের জ্বিন ও ইনসানকে সালাত শিক্ষা তথা ধ্যান শিক্ষা দিয়া হেদায়েত করার জন্য নবি, রসুল, অলি-আউলিয়া ও আধ্যাত্মিক গুরু রূপে আল্লাহ্ নিজেই নর-মাংসের দেহে অবতীর্ণ হন। তাঁহারাই হইতেছেন সামাদ আল্লাহ্।
সামাদ সত্ত্বা— পুরুষ। যে মানব সত্ত্বার মন-মস্তিষ্কে কোন উৎপাদন নাই অর্থাৎ যাঁহার মন-মস্তিষ্কে মরুভূমির ন্যায়— যেখানে মোহ রূপ গাছ-পালা জন্মায় না অর্থাৎ যে মন-মস্তিষ্কে কেবলই মহাশূন্যতা সেইখানেই উচ্চ পর্যায়ের সামাদ সত্ত্বা কর্তৃক রুহ ফুঁৎকার করা হইলে তাঁহাকে সামাদ সত্ত্বার অন্তর্ভুক্ত করিয়া নেওয়া হয়। আহাদ ও সামাদ একে অপরের পরিপূরক। আহাদ নারী জগত। ইহার সাহায্য-সহযোগিতা দ্বারা এবং লালন পালনের সুষ্ঠু পরিচর্যা দ্বারা পরিপুষ্ট হইয়া স্বাধীন সামাদ সত্ত্বার উদ্ভব হয়। অপর পক্ষে, সামাদ সত্ত্বা আহাদ জগতের (সৃষ্টির) নিয়ন্ত্রক প্রভু হইয়া জাহান্নাম ও জান্নাতের উৎকর্ষ সাধন করেন এবং সমগ্র আহাদ জগতকে রূপে রসে লীলাময়, রহস্যময়, অর্থপূর্ণ এবং সার্থক করিয়া তুলেন, এবং নিরাকারের লীলা আকার সাকারে পরিপূর্ণ করিয়া তুলেন। মায়া বিজড়িত অখণ্ড নারীজগত আহাদ। ইহা হইতে বিখণ্ডিত, মোহবন্ধন মুক্ত, পুরুষ সত্ত্বা সামাদ। জান্নাতবাসীগণ সালাতকর্মের সাহায্যে সংস্কাররাশির উপর সম্পূর্ণরূপে ভাসমান থাকিয়া মুক্ত পুরুষ, তথা সামাদে পরিণত হন। জীবদ্দশায় তাঁহারা দেহ- মনের চাহিদা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া মরার আগে মরিয়া গিয়াছেন। সুতারাং তাঁহাদের কর্মকাণ্ডের তাঁহাদের নহে বরং দেহ-মনের। এই জন্যই সামাদ সত্ত্বা “লাম ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ”. তাঁহারা নিজেরা জন্ম দেন না, জন্ম লইবার কর্মও করেন না। বিষয় বাসনা হইতে মুক্ত।
সামাদ সত্ত্বা লা-শরিক, স্বাধীন, স্বনির্ভর, নিরপেক্ষ, মুক্ত, বন্ধনহীন, বেনেয়াজ। তাঁহারই সৃষ্টি পরিচালনা করিয়া থাকেন। এইজন্য লক্ষ করা যায়, কোরানে যেইক্ষেত্রে আল্লাহতা’য়লার শান-মানের কথা বলা হইয়াছে সেক্ষেত্রে এক বচনে ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করা হইয়াছে আবার যেইক্ষেত্রে রূপান্তর সৃষ্টি (খালাকা) করা, হেদায়েত দান করা, রিজিক বণ্টন করা, রুহ ফুঁৎকার করা, জীবন দান করা, মৃত্যু ঘটানো, তৈয়ার (জাআলনা) করা, সংহার করা, নাজেল (অবতীর্ণ, উদয়) করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের কথা বলা হইয়াছে সেইক্ষেত্রে বহুবচনে ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করা হইয়াছে।
লা-শারিক বা নিরাকার আল্লাহঃ মহিমান্বিত আল্লাহ্ পাকের তিনটি রূপের মধ্যে একটি হইলঃ তিনি লা-শারিক বা নিরাকার আল্লাহ্। তিনি নিরাকার কিন্তু অস্তিত্বহীন নহেন। নিরাকার রূপটিই রূপের মূলাধার, আদি ও মূল সত্ত্বা। এই সত্ত্বা আমাদের নিকট অপ্রকাশিত। কোরানে এই সত্ত্বা নিজেকে ‘আমি’ সম্বোধন করিয়া কথা বলিয়াছেন। যখন কিছুই ছিল না, যখন স্থান-কালেরও সৃষ্টি হয় নাই, তখনও তিনি ছিলেন, তিনি ছিলেন স্থান-কালের ঊর্ধ্বে। সৃষ্টির রূপ ধারণ করিয়া ইহাতে তিনি একক এবং অখণ্ডভাবে নূর- মোহাম্মদ রূপে আল্লাহ্ গায়েব হইয়া রহিয়াছেন। মানুষ-মোহাম্মদ, নূর-মোহাম্মদের চরম বিকাশ।
বিশ্বজগতে ক্ষুত্র-বৃহৎ অথবা অনু সদৃশ যাহা কিছু আছে, সবই তাঁহার অখণ্ড একক রূপ। তাঁহার নিরাকার রূপটি সেই একক রূপের মূল উৎস। যেইখানে কোন শরীক নাই। তাই তিনি লা-শারিক। অখণ্ড এককের সৃষ্টি হইয়াছে তাঁহার আহাদ ও সামাদ সত্ত্বায়। আহাদ সত্ত্বায়— দুর্বলরূপে এবং সামাদ সত্ত্বায়— শক্তিশালীরূপে। তাঁহার আদি নূর— নূরে- মোহাম্মদীর প্রলম্বন ঘটানো হইতে অখণ্ড এককের প্রকাশ। তাঁহার কোন শরীক নাই, তবে উত্তারাধিকারী আছেন। সামাদ সত্ত্বাগণ যাঁহারা সৃজনী শক্তির অধিকারী— তাঁহারা তাঁহার শক্তিতে শক্তিমান। এই শক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। তবে এই উত্তারাধিকারীত্ব বংশগত উত্তারাধিকারীত্ব নয়— এই উত্তারাধিকারীত্ব অর্জনীয় বিষয়। এই উত্তারাধিকারীগণ ই সৃষ্টি পরিচালনার কাজে ব্যাপ্ত। ‘ওয়ারেস’ বা উত্তারাধিকার বিষয়ে সূরা হিজরের তেইশ নম্বর বাক্যে বলা হইয়াছে, ‘ওয়া ইন্না লানাহানু নুহঈ ওয়া নাহনুল ওয়ারেসুন’ অর্থ ‘এবং নিশ্চয়ই আমরা জীবন দান করি এবং আমরাই মৃত্যু ঘটাই এবং আমরাই উত্তারাধিকারী’।
সৃষ্টি পরিচালনায় নিরাকার আল্লাহ্ কোন ভূমিকা নাই। নিরাকারে স্থিত অসীম নির্বিকার, নিরব, নিঃসঙ্গ এবং নিরপেক্ষ। সেফাতে বিকাশের পর তিনি যখন যাহা করিতে ইচ্ছা করেন তখন সাকার রূপের মধ্যেই তাহা সম্পাদন করিয়া থাকেন। তাঁহার সাকার রূপটিও চিরস্থায়ী নয়, কারণ সামাদ আল্লাহগণ সাকার ও নিরাকারের সমন্বয়। নিরাকার আল্লাহ্, আহাদ জগতের দুর্বল সত্ত্বাসমূহের ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে। আহাদ জগতের কোন দুর্বল সত্ত্বা নিরাকার বা লা-শারিক আল্লাহ্র সহিত যোগ লাগাইতে পারে না। কেবলমাত্র সামাদ আল্লাহগণ নিরাকার আল্লাহ সংযোগে আসিতে পারেন। অর্থাৎ সাকারে সামাদ আল্লাহ্ সাথে নিরাকার লা-শরীক আল্লাহ্ যোগাযোগ রক্ষা করেন বা করিয়া থাকেন।
তিনি আহাদ, তিনিই সামাদ এবং তিনিই লা-শারিক বা নিরাকার আল্লাহ্। একাধারে তিনি একের ভিতর তিন এবং তিনের ভিতর এক। তিনি এই তিনের মধ্যে অখণ্ড এককভাবে বিরাজিত থাকিয়া সৃষ্টিময় লীলা করিয়া যাইতেছেন। এই বিশ্ব জগত তাঁহার লীলাক্ষেত্র।--*
তথ্য সূত্রঃ কোরান দর্শন - মওলানা সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী।