আমরা ‘বিষয়বিদ্যা’ গড়ে ওঠার গোড়ার ইতিহাস সম্পর্কে কিছু ধারণা দেবার চেষ্টা করছি। প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণের দ্বারা বিষয়বিদ্যা অনুপ্রাণিত, কিন্তু বিজ্ঞানের অধীনস্থ না থেকে চিন্তা নিজের সার্বভৌম ক্ষেত্র আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে কিভাবে বিজ্ঞানের বিজ্ঞান হয়ে ঊঠল -- বিষয়বিদ্যার এই হয়ে ওঠার ইতিহাসটাই আমরা বুঝবার চেষ্টা করছি। করছি এমন ভাবে যাতে বিদ্যায় দিগগজ না হয়েও পাশ্চাত্য দর্শন সম্পর্কে কিঞ্চিত আগ্রহীরা কিছুটা ধারণা অর্জন করতে পারেন।
দর্শন, ভাবুকতা, চিন্তা ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের সাধারণ অনুমান হচ্ছে মানুষ যেসকল বিষয় নিয়ে ভাবে, চিন্তা করে সেই সকল বিষয় বুঝি পরস্পর থেকে একদমই আলাদা। যেমন, বিজ্ঞান, ধর্মশাস্ত্র, শিল্পকলা, ইতিহাস, ইত্যাদি। যাদের মাথা থেকে এই ধরণের বিভিন্ন শাস্ত্রের জন্ম হোল তাদের মাথা কিম্বা মগজ ভিন্ন ভিন ভিন্ন বস্তুতে গঠিত, নাকি একই ধরণের মাথা থেকেই এই শাস্ত্রগুলোর পয়দা – এই প্রশ্ন নতুন নয়। যদি অনুমান করি মানুষের জৈবিক গঠনে মৌলিক কোন পার্থক্য নাই আর মানুষের চিন্তার ভেতর থেকেই বিভিন্ন শাস্ত্র বা বিজ্ঞানের আবির্ভাব ও কালক্রমে বিভাজন ও পার্থক্য -- তাহলে চিন্তার সেই প্রক্রিয়া নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করলে চিন্তার ‘একাকার’ অবস্থাটা বোঝা যেমন সম্ভব, তেমনি তার নানান ‘প্রকার’ কিভাবে ঘটে এবং ঘটেছে সেই ইতিহাসও বর্ণনা করতে পারা উচিত। বিষয়বিদ্যার আবির্ভাবের পেছনে এই অনুমান কাজ করেছে, এটা বোঝা যায়।
আমাদের আরেক প্রায়-বদ্ধমূল অনুমান হচ্ছে দর্শন বা ভাবুকতার মানে বুঝি শুধু চিন্তা করা, উদাসী হওয়া ইত্যাদি। ভাব বা ভাবুকতার অর্থ তো উদাস বা উদাসীনতা নয়, বরং বিষয়ে একনিষ্ঠতা। নিষ্ঠা ছাড়া বিষয় নিজেকে খোলাসা করেনা। আমরা ধারণা করি, ভাবুক হওয়ার সঙ্গে বুঝি বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নাই! ভাবুক হওয়ার অর্থ বাস্তবতা বিবর্জিত হওয়া। অথচ উল্টাটাই বরং সঠিক।
এটাও ঠিক যে চিন্তা নিজের চিন্তা থেকেই নতুন নতুন বিষয় ভাবতে সক্ষম। কল্পনাও চিন্তার একটি ধরণ। ভাবুকতা বা ভাবের নিজের কিছু স্বভাব আছে যাতে সে নিজেকে নিয়ে নিজে ব্যস্ত থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবতার অর্থও স্রেফ বাস্তবতা নয়। চিন্তার বাইরে বাস্তবে কী আছে কিম্বা কি নাই তা নির্ণয় করা চিন্তার কাজ যেমন, তেমনি আদৌ চিন্তার বাইরে ‘বস্তু’ বা ‘বাস্তবতা’ নামক কিছু আছে কিনা এই গোড়ার জটিল প্রশ্ন নিয়ে ভাবাও চিন্তার কাজ। শুধু তাই নয়, বাস্তবকে প্রত্যক্ষ দেখে তার অর্থ কি হতে পারে তা চিন্তা করে বের করাও চিন্তার কাজ। বাস্তবতা এবং বাস্তবতার অর্থ একরকম নাও হতে পারে।
চিন্তা প্রত্যক্ষকে প্রকাশ ও অর্থ দান করে, এই প্রত্যক্ষবাদও আমাদের চিন্তা অধিকার করে থাকে। ইন্দ্রিয়োপলব্ধির মধ্য দিয়ে জগৎ যেভাবে আমাদের ‘কাঁচা’ ধরা দেয় তাকে চিন্তার কারখানায় পাঠিয়ে পাকা করে নেওয়া, কিম্বা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে তাকে প্রকাশ করা ও প্রকাশ থেকে নানান অর্থ বের করা ইত্যাদি কেন ঘটে, কিভাবে ঘটে সবই চিন্তার বিষয়। না নিলে বাস্তবকে বুঝি কি করে? বাস্তবের বিশ্লেষণ ও বিচার তো এর প্রের ব্যাপার। সেই কাজও করে চিন্তা।
কিন্তু ভাবুকতা বা চিন্তা সম্পর্কে আমাদের সাধারণ অনুমানের ভিত্তিও আছে। আসলে ভাব বা চিন্তাকে সক্রিয় করা বা সক্রিয় রাখাইতো চিন্তা বা ভাবুকতা। বাস্তব আছে কি নাই সেটা চিন্তার দিক থেকে গৌণ হতেই পারে। কিন্তু প্রকৃতি বিজ্ঞান দাপটের সঙ্গে যখন তার পদ্ধতি ও প্রকরণ নিয়ে চিন্তার জগতে হাজির হোল, তখন চিন্তার এই আলস্য টিকল না। যতোই প্রতিভাবান মনে হোক চিন্তা যা কিছু চিন্তা করবে – যতোই ভাল আর প্রতিভাদীপ্ত হোক -- তাই গৃহীত হবে, সেই সুবিধা দর্শন হারাতে থাকল। চিন্তার শৃংখলা ও যুক্তির পরম্পরা দেখিয়ে গ্রিক দর্শনের মধ্য দিয়ে চিন্তা নানান ক্ষেত্রে যে শক্তি প্রদর্শন করে আসছিল আধুনিক বিজ্ঞান গড়ে ওঠার পর সেই শক্তি পুরাপুরি টিকলো না। যুক্তির শৃংখলাও যথেষ্ট নয় বলে প্রতিভাত হতে শুরু করল। এমনকি আধুনিক কালে গণিতজ্ঞরাও যখন যুক্তির শৃংখলার দোহাই দিয়ে গণিতের সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন তখনও প্রশ্ন উঠল গণিতের জগত আদৌ বাস্তবের জগত কিনা? জগত কি ইউক্লিডের জ্যামিতির নিয়ম মেনে চলে, নাকি নন-ইউক্লিডিয় জ্যামিতি। প্রকৃতিবিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণের কাছে তাকে হার মানতে হোল। যা প্রত্যক্ষ নয়, সামনে হাজির নাই তাকে বাস্তব বা সত্য বলতে বিজ্ঞান ও দর্শন উভয়েই গররাজি হোল। বাস্তবকে ঘনিষ্ঠ ভাবে নিরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণের যে পদ্ধতি ও প্রকরণ প্রকৃতি বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠছিল তাকে এড়িয়ে যাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠল।
আমরা ইম্মেনুয়েল কাণ্টের ‘বিশুদ্ধ বুদ্ধির পর্যালোচনা’ (Critique of Pure Reason) গ্রন্থটি মনে রেখে কথাটা আরও খানিকটা স্পষ্ট করবার চেষ্টা করি। বিজ্ঞানের দর্শন বলতে আমরা এখন যা বুঝি তারই খুব প্রাথমিক দিকের প্রয়াস হিসাবে কাণ্টের অসামান্য গ্রন্থটিকে গণ্য করা যেতে পারে। কান্ট তার সময়ের নিউটনীয় বিজ্ঞান – বিশেষত গণিত, জ্যামিতি ও পদার্থ বিজ্ঞানের যথার্থতা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। এর বিরুদ্ধে আক্রমণ এসেছিল ডেভিড হিউমের (১৭১১ -১৭৭৬) কাছ থেকে। হিউম দাবি করেছিলেন নিশ্চিত জ্ঞান কখনই সম্ভব নয়, কারণ আমরা যাকে ‘জানি’ বলে গণ্য করি সেটা নিছকই ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞত। ওর অতিরিক্ত কিছু নয়।
ধরা যাক আমরা একটি কেরাম খেলা দেখছি। দেখছি একটি গোল চাকতি দিয়ে আরেকটি গোল গুটির দিকে আঙ্গুল দিয়ে টোকা মেরে পাঠানো হচ্ছে। ধেয়ে যাচ্ছে চাকতি গুটিটির দিকে। চাকতিটা গিয়ে গুটিতে লাগল। গুটি চলতে শুরু করল। এই ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা থেকে কি বলা যায় যে চাকতিটি গুটিতে ধাক্কা দেবার কারণেই গুটি চলতে শুরু করেছে। কিন্তু ‘কারণ’ বলে কিছু তো আমরা দেখছি না। যা দেখছি তার বাইরে একটা ‘কারন’ নামক ধারনা আমরা আমদানি করছি। কেরাম বোর্ডের কোথাও তো ‘কারণ’ দেখা যাচ্ছে না। এক ‘কারন’ এলো কোত্থেকে?
প্রতিদিন সাতটায় সময় ইস্কুলের গাড়ি সামনের বাসার সামনে দাঁড়ায়, একটি শিশু তার বইখাতা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তাহলে গাড়ি আসাটাই তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার ‘কারন’। তাই কি?
এবার অন্য উদাহরণে যাওয়া যাক।
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি। দেখছি গাছ, বাড়ি, রাস্তায় গাড়ী ইত্যাদি? আসলে কি তাই? আমি তো দেখছি পাতা, ডাল, ফুল বা ফল। সমগ্র ভাবে এই দেখাগুলোকে ‘গাছ’ বলছি কিসের ভিত্তিতে? চৌকানো ইঁটপাথরে তৈরী বাক্সের মতো কিছু নানান আয়ত ক্ষেত্র। সেগুলোকে ‘বাড়ি’ বলছি কিভাবে? লোহা বা ধাতব পদার্থে তৈরী চাকা বসানো চলমান বস্তুই যে ‘গাড়ি’ নিশ্চিত হবো কি করে? ‘গাছ’, ‘বাড়ী’, ‘গাড়ী’ নামক আদতে কিছু কি আছে? নাকি এগুলো নিছকই আমাদের মনগড়া জিনিস। যদি না থাকে তাহলে ‘গাছ’, ‘বাড়ী’, ‘গাড়ি’ সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান কি করে সম্ভব? আমাদের এক দলা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা থাকতে পারে, কিন্তু একটা ধারণার মধ্যে তাদের ধরা ও সেই ধারণাকেই বাস্তব বা সত্য জ্ঞান গণ্য করা মুশকিল। ভুল। তাই কি?
আমি আম খাচ্ছি। হাতে ধরছি, এক ধরণের স্পর্শের অনুভুতি হচ্ছে। মুখে নিচ্ছি, স্বাদের উপলব্ধি ঘটছে। আমের রঙ দেখছি, চামড়ার এবং ভেতরের রঙের উপলব্ধি ঘটছে। সবই তো আলাদা আলাদাই উপলব্ধি করছি। এর মধ্যে ‘আম’ কই? কি করে জানি এই সব উপলব্ধির যোগফলই ‘আম’। নাকি বুঝবার অন্য কোন তরিকা আছে?
আমরা কোন বস্তু যখন দেখি বা উপলব্ধি করি তখন বুঝতে পারি তাদের কিছু গুণ আছে। যেমন, রঙ, গন্ধ, স্বাদ ইত্যাদি। আরও একটু গভীর গেলে আমরা বুঝতে পারি যে বস্তু ও বস্তুর গুণ আলাদা। গুণের ইন্দ্রিয়োপলব্ধি ঘটে, কিন্তু বস্তুর? বস্তু ব্যাপারটা কোথা থেকে এল? যা উপলব্ধি করি সেটা তো নানান গুণের উপলব্ধি মাত্র। তাদের একত্র করে কোন বিশেষ বস্তু হিসাবে গণ্য তো ইন্দ্রিয়োপলব্ধির স্তরে ঘটে না। তাহলে বস্তু বললে বড়োজোর এতোটুকুই বলা যায় সেটা ইন্দ্রিয়োপলব্ধির যোগফল। বস্তুর সত্যতা এতে কিভাবে প্রমাণিত হয়? যাকে ‘আম’ বলি তা আমের নানান গু্ণের সমগ্রতা। এতে আমের গুণাবলীর সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হোল, কারণ গুণসকল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। কিন্তু সব মিলিয়ে তাকে ‘আম’ বলবার সত্য নির্ণয় করবার পথ কি? 'আম' কি তাহলে বুদ্ধির নির্মাণ'?
বস্তু মানে কিছু গুণের যোগফল বললেও মুশকিল ঘটে। যদি আমের সমস্ত গুণকে আমরা একত্র করি তাহলে কি সেটা আম হবে? গাছের গুণ একসঙ্গে করলে সেটা কি গাছ হয়ে যাবে। কিন্তু গাছকে তো সমগ্র ভাবে আমরা উপলব্ধি করি না, করি শাখা, প্রশাখা, কাণ্ড, শেকড়, ইত্যাদি হিসাবে। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে।
‘গুণ’ মানে কোন না কোন বস্তুর গুণ। গুণকে বস্তু থেকে আলাদা করা সম্ভব না। যদি তাই হয়, তাহলে ‘গুণ’ নামক ধারণারও মুশকিল আছে। কারণ বস্তু ছাড়া গুণের বিচার চলে না।
ফ্রিজে রাখলে পানি ঠাণ্ডা বরফ হয়ে যায়, তার গুণ পরিবর্তিত হয়। তরল থেকে শক্ত। গরম করলে বাষ্প হয়। শক্ত, তরল আর বাষ্প তো তিন রকম গুণ। কি করে তাহলে বলি এই তিন স্তরের জিনিস একটাই, পানি।
আমরা বস্তু বললে অনুমান করি আমরা এমন এক কিছুর কথা বলছি যার বিভিন্ন গুণ রয়েছে। আমরা বিভিন্ন গুণকে ইন্দ্রিয় দ্বারা ফারাক করতে পারি। যাকে সেই বিশেষ বস্তু বলছি, যেমন ‘আম’ – তাকেও তার গুণ থেকে আলাদা করতে পারি।
কারনের ক্ষেত্রে কি করি? কোন কিছু সময়ের বিচারে আগে ঘটে এমন কিছুকে আমরা কারণ মনে করি না। যেমন ইস্কুলের গাড়ি আসার পরে ইস্কুলে যাবার জন্য শিশুটি বেরিয়ে এল। বরং অনুমান করি, কারণ মানে এমন একটা ব্যপার যার পরিণতি অনিবার্য। যাতে কী ঘটবে তা আমরা আগেই আন্দাজ করতে পারি। অনিবার্য ভাবেই সেটা ঘটে। স্ট্রাইকার চাকতি দিয়ে গুটিকে আঘাত করলে গুটি চলতে শুরু করে। এটা অনিবার্য ঘটবে সেটা জানি বলেই কেরাম কিভাবে খেলতে হয় আমরা বুঝি।
এখন ডেভিড হিউম বলছেন এই অনুমান করবার কোন দরকার নাই। কারন ইন্দ্রিয়োপলব্ধির জগতে তাদের কোন ভিত্তি নাই। হিউম বলছেন না যে যেভাবে আমরা এখন বাস্তবে খাই, দাই, চলাফেরা করি সেই বাস্তব জীবনে এই অনুমানগুলোর প্রয়োগ আমরা করব না। বা করলে কোন কাজ হবে না। কিন্তু এই অনুমানগুলোকে সার্বজনীন ও অনিবার্য সত্য গণ্য করবার কোন ভিত্তি নাই।
হিউমের এই ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষবাদিতার ফল দাঁড়ায় এই যে ‘জ্ঞান’ বলতে আমরা যা বুঝি তা নিছকই ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, এর বেশি কিছু নয়। তাদের সত্য সার্বজনীন ও অনিবার্য নয়। তাহলে যে সকল ধারণা, প্রত্যয় বা প্রতিজ্ঞার ভিত্তিতে আমরা জগতকে ব্যাখ্যা করি এবং সার্বজনীন ও অনিবার্য সত্যের দাবি করি তার আর কোন ভিত্তি থাকে না। ইম্মেনুয়েল কান্ট এই চ্যালেঞ্জের উত্তর দিতে গিয়েই তাঁর ‘ক্রিটিক অব পিউর রিজন’ গ্রন্থটি লিখেছেন।
আগেই বলেছি, কাণ্ট প্রমাণ করে দেখাতে চেয়েছেন নিউটনীয় বিজ্ঞান সার্বজনীন (universal) এবং অনিবার্য (necessary) সত্য। শুধু ইন্দ্রিয়োপলব্ধি নয়, তিনি হিউমের বিপরীতে দেখাতে চেয়েছেন সার্বজনীন ও অনিবার্য জ্ঞান মানুষের পক্ষে লাভ সম্ভব। জ্ঞান বা জানার অর্থ শুধু ইন্দ্রিয়োপলব্ধি বা ইন্দ্রিয়ের অভ্যাস মাত্র নয় – হিউম যে কথা বলতে চাইছেন। ইন্দ্রিয়োপলব্ধিকে যদি শুধু ইন্দ্রিয়োপলব্ধিও হতে হয় তাহলেও তাকে কিছু শর্তের অধীন হয়েই ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধি হয়ে পরিগঠিত হতে হয়। যসেই গঠনের উৎপত্তি শুধু ইন্দ্রিয়ের স্তরে নয়, বুদ্ধির স্তরেও। বুদ্ধির শর্তগুলো যদি পালন না হয় তাহলে ইন্দ্রিয়োপলব্ধিও অসম্ভব। কোন অর্থে শর্তগুলোর সার্বজনীনতা ও অনিবার্যতা আমরা মেনে নেব, কান্ট সেই মানামানির দিকগুলোই তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন।
যে উদাহরনগুলো দিয়েছি সেগুলো বিচার করলে দুভাগে শর্তগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমে সেই সব শর্ত যার কারণে ইন্দ্রিয়োপলব্ধির ইন্দ্রিয়োপলব্ধি হয়ে উঠতে পারা নির্ভর করে। যেমন দেশকাল। কোন কিছু যদি ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধ হতে হয় তাহলে তাকে দেশে ও কালে হাজির থাকতে হবে। কোন না কোন জায়গায় এবং কোন না কোন সময়ে। কিন্তু দেশ বা কাল কোনটাই ইন্দ্রিয় থেকে জাত নয়, বুদ্ধিই সেটা সরবরাহ করে। আর এই শর্তেই দেশকালিক সত্তা হয়ে ইন্দ্রিয়ে তারা ধরা দেয়।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে কোন একটি একক ইন্দ্রিয়োপলব্ধি শুধু একক ভাবে বা বিচ্ছিন্ন হয়ে না থেকে অন্যান্য ইন্দ্রিয়োপলব্ধির সঙ্গে একত্রিত বা সমন্বিত হয়ে যখন হাজির হয়, তখন তারা যে একই বস্তুর গুণ, এক দলা উপলব্ধি মাত্র নয়, তা বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। আমের উদাহরণ নেওয়া যাক আবার। আম হাতে নিয়ে দেখে, ঘ্রাণ নিয়ে, স্বাদ নিয়ে যে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়োপলব্ধি ঘটে সবকিছু মিলিয়ে তাকে ‘আম’ বলে বুঝতে হলে বস্তুর আগাম ধারণা দরকার। একক বস্তু হিসাবে আমরা ‘আম’কে উপলব্ধি করি না, বরং বিভিন্ন ইন্দ্রিয়োপলব্ধিকে বুদ্ধি ‘আম’-এর ধারণার অধীনস্থ করতে সক্ষম বলেই তাকে ‘আম’ বলে বিচার করতে পারি। চাকতি ঠুকে কেরাম খেলতে গিয়ে বুঝি ‘কারণ’ নামক একটি ধারণা আছে আমাদের, তাকে ইন্দ্রিয়োপ্লব্ধির জগত থেকে নয়, বুদ্ধির জগত থেকে আরোপ করি। সে কারণে আগাম বুঝতে পারি চাকতি দিয়ে কেরমের গুটিকে ধাক্কা দিলে সেটা চলতে শুরু করবে। চাকতির আঘাত সেই ক্ষেত্রে কেরমের গুটি চলবার কারণ। উভয়ের মধ্যে একটা কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে। এই সম্বন্ধ সার্বজনীন ও অনিবার্য। কিন্তু স্কুলের বাস এলে একটি বাচ্চা ঘর থেকে বের হয়ে আসবে এমন কোন কথা নাই। সে অসুস্থ থাকতে পারে, ইস্কুলে নাও যেতে পারে, কিম্বা বাস ছাড়াও সে ইস্কুলে যেতে পারে। উভয়ের মধ্যে কোন কার্যকারণ সম্বন্ধ নাই।
শুধু ইন্দ্রিয়োপলব্ধির দ্বারা জ্ঞান সম্ভব কান্ট এটা মনে করতেন না। বুদ্ধির যোগ ছাড়া সার্বজনীন ও অনিবার্য সত্য প্রমাণ সম্ভব নয়। তবে স্রেফ বিশুদ্ধ বুদ্ধি থেকেও মানুষ সার্বজনীন ও অনিবার্য সত্য নির্ণয় করতে সক্ষম। শুধু বিশুদ্ধ বুদ্ধিকে কি জ্ঞান বলা যায়। জ্ঞান অর্থ তো নতুন কোন অভিজ্ঞতা, নতুন কিছু জানা। সেটা কিভাবে সম্ভব? উদাহরণ দিয়েই কথা বলা যাক।
ধরা যাক ৭+৫ =১২ একটি গাণিতিক বাক্য। ৫টি জিনিসের সঙ্গে সাতটি জিনিস এনে যুক্ত করলে ১২টি জিনিস হয়। জিনিসগুলো কেমন তাতে কিছুই আসে যায় না। সাত এবং পাঁচের যোগফল হচ্ছে ১২ এই বাক্যটি যে সত্য এটা আমরা আগেই বুঝতে পারি। ‘৭+৫’ বলা আর ‘১২’ বলা একই কথা। এই বাক্য প্রমাণ করবার জন্য আমাদের কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। যে সত্য কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধু বুদ্ধির জোরেই আগে বুঝতে পারা যায় তাকে কাণ্ট আগাম সিদ্ধ বা a prior judgement বলে পরিচয় করিয়েছেন। এই অংকমূলক বাক্য সত্য কিনা সেটা প্রমাণ করবার জন্য আমাদের বার বার সাতের সঙ্গে পাঁচের যোগ দিয়ে ফলাফল দেখবার দরকার নাই। আমরা আগেই জানি ফল হবে বারো। এর বিপরীতে রয়েছে সেইসব সত্য যাদের সত্যতা শুধু অভিজ্ঞতা দিয়ে নিশ্চিত করা যায়। দুটি ঝুড়িতে বারটি ল্যাঙড়া আম আছে বললে ঝুড়ির আমগুলো গণনা করেই কেবল আমরা বলতে পারব, সব মিলিয়ে আসলে কয়টি আম রয়েছে। ঝুড়িতে কয়টা করে আম রয়েছে তা যেমন আমরা জানি না, কিম্বা তারা আদৌ ল্যাংড়া আম কিনা তাও আমরা আগাম জানি না। এ কারনে এই জানাকে বলা হয় অভিজ্ঞতার পরে সিদ্ধ বা অভিজ্ঞতা-সিদ্ধ বাক্য a posterior judgement -- যে বাক্য সম্পর্কে সত্য কি মিথ্যা সিদ্ধান্ত নিতে হয় অভিজ্ঞতার পরে -- দেখে, গুণে, নিরীক্ষণ করে, অভিজ্ঞতা দিয়ে ইত্যাদি।
আগাম সিদ্ধ বাক্য কি করে সম্ভব? কান্টের কাছে এটা একটা প্রশ্ন। কিন্তু একই কথা যদি আমরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলি তাকে তো আর জ্ঞান বলা যায় না। জ্ঞান মানেই তো অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান। যদি বলি, ‘যে ছেলে বিয়ে করে নি তার কোন স্ত্রী নাই’। তাহলে এই বাক্যের সঙ্গে ৭+৫ = ১২ বাক্যের একটা মিল আছে। যে ছেলে বিয়ে করে না তার যে কোন স্ত্রী থাকে না সেটা তো আমরা অবিবাহিত থাকার ধারণা দিয়েই বুঝি। অবিবাহিত ছেলেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখার দরকার নাই, কিম্বা জিজ্ঞাসা করলে মার খাবার ভয় আছে যদি বলি, আপনার কি কোন স্ত্রী আছে, নাকি নাই? এই ধরণের বাক্য – ‘যে ছেলে বিয়ে করে নি তার কোন স্ত্রী নাই’ -- কান্টের কাছে বিশ্লেষণাত্মক (analytical)। সে কারণে আগাম সিদ্ধ। অর্থাৎ তার সত্যতা নিশ্চিত করাটা শুধু ব্যাখ্যার ওপর নির্ভরশীল। ঠিক তেমনি ১২র ধারণা ৭+৫-এর ধারনার মধ্যে নিহিত। আমাদের তাই পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় না যে দুয়ে মিলে বারো হয়। ব্যাখ্যা করলেই চলে।
কিন্তু কান্ট মানতে নারাজ যে ৭+৫ = ১২ একটি বিশ্লেষণ নির্ভর আগাম সিদ্ধ বাক্য (a prior analytical judgement)।৭+ ৫ কথাটার মধ্যে এটাই শুধু বলা হচ্ছে যে সাতের সঙ্গে ৫ যোগ দেওয়া হোক। এই কথা ১২র ধারণার মধ্যে নাই। বারো একটি স্বাধীন সংখ্যা। ফলে দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে, মানতেই হবে। তাহলে পাঁচের সঙ্গে সাত যোগ করা হলে সেটা বারো হয় বললে সেখানে নতুন কথা বলা হয়। নতুন অভিজ্ঞতা হয়। এর ফলে যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় সেটা সার্বজনীন ও অনিবার্য। অর্থাৎ সাত আর পাঁচ যোগ করলে তা সবসময়ই ১২ হবে। এই সিদ্ধান্ত শুধু বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করা হয় নি, যেহেতু দুটি সংখ্যাকে যোগ দিয়ে তাদের ফল নির্ণয়ের অভিজ্ঞতা এখানে রয়েছে কান্টের কাছে এই বাক্য হচ্ছে আগাম সিদ্ধ সংশ্লেষিত বাক্য (a prior synthetic judgement)। গণিত, জ্যামিতি ও পদার্থ বিজ্ঞান আগাম সিদ্ধ সংশ্লেষত বাক্য উৎপাদন করে বলে তারা সার্বজনীন ও অনস্বীকার্য জ্ঞান দিতে সক্ষম।
বিশুদ্ধ বুদ্ধির পর্যালোচনা গ্রন্থে কান্টের মূল প্রশ্ন হোল এই ধরণের আগাম সিদ্ধ সংশ্লেষিত বাক্য কিভাবে সম্ভব? যদি সরলীকরণের দোষে অভিযুক্ত হতে না হয়, তাহলে আরও সহজ ভাবে বলা যায় কিভাবে বিজ্ঞান বুদ্ধির ব্যবহার দিয়ে জগত সম্পর্কে এমন সব বাক্য নির্মান করতে পারে যেগুলো তথ্যবহুল, অথচ সত্য, অন্যদিকে অভিজ্ঞতা থেকে মুক্ত বা স্বাধীন? অর্থাৎ বিজ্ঞানের সত্যতা কেন সার্বজনীন (universal) ও অনিবার্য (necessary)? কান্টের উত্তর হচ্ছে বুদ্ধি কিম্বা বুদ্ধিবৃত্তিক জানার যে বৃত্তি মানুষের মধ্যে রয়েছে সেটা অনেকটা আগাম তৈয়ারি খাপের মতো। যার মধ্যে ইন্দ্রিয়োপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাকে মানুষ আত্মস্থ করে। জগতের ওপর বুদ্ধি তার নিজের ছাপ ফেলে ঠিক যেমন মোমের ওপর ছাপ দিয়ে তাকে ভিন্ন ভিন্ন আকারের মোমবাতি তৈয়ার করা হয়।
জগত সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতার দুটো সূত্র আছে। এক হচ্ছে কাঁচা উপলব্ধি – ইন্দ্রিয়ের মারফত আমরা যা পাই আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সম্ভাব্য যতোরকম অভিজ্ঞতা মানুষের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব বুদ্ধির দ্বারা তার কাঠামো আগেই নির্ণয়ের বৃত্তি। বুদ্ধি আমাদের সঠিক ও নিশ্চিত জ্ঞান দিতে সম্ভব কারণ বুদ্ধি নিজেই আমাদের ইন্দ্রিয়োপলব্ধ জগতের ওপর একটি বুদ্ধির ছক কেটে দেয়। ইন্দ্রিয়োপলব্ধ জগতের ওপর বুদ্ধির এই স্বতঃস্ফূর্ত নকশা এঁকে বা সেঁটে রাখবার কারণে, জগতের যে-রূপ আমাদের কাছে ধরা পড়ে সেটা বুদ্ধিরই নিজের রূপ। জগতের ঘটনাঘটন বুদ্ধির নিয়মে (rational) একটা যুক্তি পরম্পরা মেনে ঘটছে বলে আমাদের মনে হয়।
সাত আর পাঁচ বারো হয় কেন? কেন সাতটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের সঙ্গে একত্র করলে তারা বারোই হবে। অন্য কোন সংখ্যা হবে না? কারণ আমাদের চিন্তার মধ্যে গণিতের একটা চরিত্র আছে যা আমরা বাইরের জগতের ওপর আরোপ করি। এটা আপনা আপনিই ঘটে, অসচেতন ভাবে। কান্টের কাছে জ্যামিতি হচ্ছে দেশ বা দৈশিকতাকে বিশুদ্ধ বুদ্ধির মধ্যে জানার চর্চা। আর গণিত হচ্ছে সময়ের নিয়ম নির্ণয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা। কারণ গণিতের সংখ্যার গঠন পর পর, ক্রমানুবর্তী, ইত্যাদি।
কিন্তু নিউটনীয় পদার্থ বিজ্ঞানের জগত অতিক্রম করে বিজ্ঞান যখন আইনস্টাইন কি হেইসেনবার্গের জগতে প্রবেশ করলো, জ্যামিতি যখন আর শুধু ইউক্লিডের জ্যামিতির মধ্যে আর আবদ্ধ রইল না -- তখন গণিত ও বিজ্ঞানের সার্বজনীন সত্যতা ও অনিবার্যতার তর্কটাও বদলে যেতে থাকল। আমরা সেই দীর্ঘ তর্কে এখানে প্রবেশ করবো না, আমাদের আলোচনার জন্য সেটা প্রাসঙ্গিক নয়। তবে এটা বোঝা দরকার যে বিশুদ্ধ বুদ্ধির বিচার দিয়ে সবকিছুর ব্যাখ্যা আর সম্ভব হোল না। তবে বিশুদ্ধ বুদ্ধির বিচার দিয়ে বিজ্ঞান তার ভিত্তির চরিত্র ব্যাখ্যা করতে পারছিল না, এই দিকতাই আমাদের আলোচনার জন্য বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানের সত্য নির্ণয়ের শেকড় আসলে কোথায় তার অনুসন্ধান এতে থেমে কোন কারণ ঘটে নি। যেটা ঘটল সেটা হোল প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণের দিকে ঝোঁক বাড়তে থাকল। বিজ্ঞানের সত্য নির্ণয়ের পেছনে চিন্তার শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক দিকটি নয়, সামগ্রিক ভাবে চিন্তার সকল কায়কারবার বোঝা জরুরী হয়ে পড়ল। মানুষের মন, চেতনা বা চৈতন্যকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিষয় হিসাবে বোঝার দিকে বিজ্ঞানী ও দার্শনিক উভয়েই ঝুঁকলেন। বিজ্ঞান ও দর্শনের উভয়েরই অনুসন্ধানের ক্ষেত্র হয়ে উঠল। সাইকোলজি বা মনোবিজ্ঞান
এই সন্ধিক্ষণেই ফ্রানৎস ব্রেনতানো ও এডমুণ্ড হুসার্লের আবির্ভাব। আগামি কিস্তিগুলোতে আমরা বিষয়বিদ্যার পরিগঠনে তাদের অবদান ধরিয়ে দেবার ওপর নজর রেখে আলোচনা করব।
ফরহাদ মজহার।
বিষয়বিদ্যা বিষয়ক আলাপগুলো:
ফ্রানৎজ ব্রেনতানো (১৮১৩ -১৯১৭)
এডমুন্ড হুসার্ল (১৮৫৯ – ১৯৩৮)
বিষয়বিদ্যাঃ বিজ্ঞানের বিজ্ঞান
বিষয়বিদ্যাঃ পেছনের কিছু কথা
বিষয়বিদ্যার ভূমিকা : শুরুর তিন
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৫৪