somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফ্রানৎজ ব্রেনতানো (১৮১৩ -১৯১৭)

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফ্রানৎজ ব্রেনতানো (১৮৩৮ – ১৯১৭) মনোবিদ্যায় অবদানের জন্য স্বনামে খ্যাত। তবে দার্শনিকদের কাছে তাঁর খ্যাতি অন্তত দুইজন বিখ্যাত ব্যাক্তির কারণে। একজন মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড আর অন্যজন বিষয়বিদ্যার গোড়াপত্তনকারী দার্শনিক এডমুন্ড হুসার্ল। দুজনেই ব্রেনতানোর ছাত্র ছিলেন। দুইজনের ওপর ব্রেনতানোর প্রভাব গভীর। চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেবার ক্ষেত্রে ব্রেনতানো ছিলেন নির্ধারক -- হুসার্লের ক্ষেত্রে একথা অনায়াসেই বলা যায়।

তাঁর গড়ে ওঠা রোমান ক্যাথলিক যাজক হিসাবে, অভিষিক্ত হন ১৮৬৪ সালে। উরজবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হিসাবে যোগ দেন ১৮৭২ সালে। ক্যাথলিক চার্চের নিয়মানুযায়ী পোপ কোন ভুল করতে পারেন না। যীশুর অনুসারীদের রাখাল ও শিক্ষক হিসাবে পোপের যে ভূমিকা সেই ক্ষেত্রে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা ও বক্তব্যই চূড়ান্ত। চার্চের প্রধান হিসাবে তিনি ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত দেবেন সকল খ্রিস্টানের তা মানা বাধ্যতামূলক। পোপ কখনই কোন ভুল করেন না এই আপ্ত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ব্রেনতানোর মনে সংশয় দেখা দিলে একে মেনে নেওয়া তাঁর জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। তাই প্রফেসরের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। যাজকতাও ত্যাগ করেন ১৮৭৩ সালে। খ্রিস্টিয় ধর্মে ‘ট্রিনিটি’র ধারণার মধ্যে তাঁর চিন্তার দিগন্তকে আটকে রাখাও তাঁর জন্য কঠিন হয়ে উঠেছিল। যাজকবৃত্তি ত্যাগ করেছেন বলে ধর্ম বিশ্বাসের তাৎপর্য তিনি হারান নি, কিন্তু সেই বদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছেন যা চিন্তাকে কোন একটা আগাম তৈরি রাখা খাপে আটকে রাখতে চায়। যাজকবৃত্তির সীমার মধ্যে দার্শনিক চর্চার বৃত্ত ছেড়ে এলেও ব্রেনতানো সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন চিন্তার নতুন একটা দিগন্ত। মুক্ত চিন্তার মধ্য দিয়ে যে-দিগন্তকে তিনি আরো স্পষ্ট, গভীর ও বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন। আগের তুলনায় আরও অনায়াসে ও অনেক পরিচ্ছন্ন ভাবে।

আমরা এর আগে বলছিলাম প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণ অনুসরণ করে মন কিম্বা চিন্তাচেতনা কি জিনিস তা বোঝা ও বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতায় বিষয়বিদ্যার আবির্ভাব। এই কথার ওপর জোর দেবার কারন আছে। দর্শন বললে ভাবুকতা বা ভাবচর্চার ধারণা আমাদের মাথায় আসে। আমরা ধরে নেই এর সঙ্গে পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রত্যক্ষ গবেষণার কোন সম্পর্ক নাই। সোজা কথায় ভাব বা দর্শনে বিজ্ঞানের স্থান নাই, কিম্বা বিজ্ঞানের মধ্যে দর্শনের। এই অনুমাঙ্গুলো মাথায় থাকার কারনে ভাব বা দর্শন বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি বিষয়বিদ্যা সেই ধারা থেকে গড়ে ওঠে নি। বরং তার আবির্ভাব ঘটেছে বিজ্ঞান হিসাবে। প্রকৃতি বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চেতনা চিন্তা ইচ্ছা সংকল্প ইত্যাদির প্রত্যক্ষ গবেষণার মধ্য দিয়ে বোঝার আকুতি ও চর্চা থেকে গড়ে উঠেছে বিষয়বিদ্যা । ফলে পদ্ধতি ও প্রকরণের দিক থেকে বিষয়বিদ্যা বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্যের লক্ষণাক্রান্ত। আমাদের চেতনা কিভাবে কাজ করে, মনের স্বভাব কেমন, কিম্বা তার অবস্থান্তর কিভাবে ঘটে, ইন্দ্রিয়োপলব্ধি কিভাবে জ্ঞান হয়, ইচ্ছা সংকল্প কল্পনা আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয় কিভাবে, কিভাবে তারা কাজ করে – ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়কে প্রকৃতি বিজ্ঞানের মতো নিরীক্ষন ও পর্যবেক্ষণ করে যে বিজ্ঞান সেটাই বিষয়বিদ্যা হিসাবে গড়ে উঠেছে।

তবে মন, চেতনা, চৈতন্য বা জ্ঞান প্রক্রিয়া তো মানুষের বাইরের কোন জিনিস নয়। এইসব তো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ও নয়। 'মন' বললে এই ধরণের কর্তাগুণ সম্পন্ন একটা কিছুর অস্তিত্ব বোঝায় যাকে আমরা নানান ভাবে উপলব্ধি করি। এটা আজগবি কিছু নয়। মন নিয়ে গবেষণা, নিরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণ করব কিভাবে? প্রকৃতিবিজ্ঞানের মতো তাদের নিরীক্ষণ করবার অর্থ হচ্ছে কোন অনুমানের ওপর নির্ভর না করে কিভাবে মন চেতনা চৈতন্য বা চিন্তা প্রক্রিয়া কাজ করে তাকে ঘনিষ্ঠ ভাবে নিজের মধ্যে নিজে পর্যবেক্ষণ করা। ব্রেনতানোর বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মনোবিদ্যা’ (Psychology from an Empirical Standpoint) । কিভাবে এই পর্যবেক্ষণ করতে হবে ব্রেনতানোর এই বইটিতে তার হদিস মেলে। এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে ব্রেনতানো নিজেকে মনোবিদ হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে ব্রেনতানো চেতনা, চৈতন্য বা চিন্তা যে নামেই বলি, কিভাবে মনকে নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে তা দেখিয়ে দিয়ে মনোবিজ্ঞানের নতুন ও স্বাধীন ধারার সূচনা করেছিলেন।

ব্রেনতানোর প্রথম কাজ এরিস্টটল নিয়ে। মধ্যযুগের দর্শন – বিশেষত টমাস একুইনার (১২২২৫ – ১২৭৪) বিপরীতে তিনি এরিস্টটলকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। এই সময়ে লেখা তার বিখ্যাত গ্রন্থ হছে ‘কত রকম অর্থে এরিস্টটল ‘আছে’ কথাটা ব্যখ্যা করেছেন’ (‘On the Several Senses of Being in Aristotle’)। এই ব্যখ্যার মধ্যে তাঁর দার্শনিক মনের খবর মেলে। তবে তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মার্টিন হেইডেগার গ্রিক দর্শনকে যেভাবে বুঝবার নতুন পথ বেঁধে দিয়েছেন তাতে আমরা বুঝি ব্রেনতানোই এরিস্টটলকে বুঝবার একমাত্র পথ নয়। কিন্তু এরিস্টটল নিয়ে কাজের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ব্রেনতানোর নিজের ওপরেই পড়েছিল। এরিস্টটলকে তিনি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁকে নতুন ভাবে হাজির করেছেন ঠিকই, কিন্তু দর্শনের দিক থেকে মৌলিক ঘটনাটি ঘটেছে তার নিজের চিন্তার অভিমুখ আবিষ্কারে। দর্শনের দিক থেকে চিন্তার এক নতুন দিগন্ত তিনি উন্মোচন করেছেন যার কারনে সম্প্রতি কালের দর্শনের ওপর ছাপ ফেলে যেতে পেরেছেন তিনি।

পুরানা চিন্তার ধারা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাঁর ওপর কাজ করেছে রেনে দেকার্তে (১৫৯৬ – ১৬৫০)। ইউরোপের ধর্মীয় আবহে মধ্য যুগে চার্চের বাইরে শিক্ষালয়গুলোর মধ্যে স্কলাস্টিক চিন্তার ধারার সঙ্গে দেকার্তীয় যুক্তির মিশ্রণে ব্রেনতানোর চিন্তা নতুন একটা রূপ নিয়ে দাঁড়ালো। এর লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চেতনা বা মনকে তার স্বরূপে বোঝার চেষ্টা। শরীরের গুণ বা রহস্যময় কোন বস্তু হিশাবে নয়। ‘প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মনোবিদ্যা’ বইটি বেরোয় ১৮৭৪ সালে। এই বইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি মন, চেতনা বা চৈতন্যকে প্রকৃতি বিজ্ঞান কিম্বা শরীবৃত্তীয় পদ্ধতি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন নি, কিম্বা হেগেলের মতোও নয়। উভয় ধারা বাদ দিয়ে মনের জগতকে তার স্বরূপে বোঝার প্রয়াস গ্রহণ করলেন। মার্টিন হেইডেগার ব্রেনতানোর এই দার্শনিক মোড় যেভাবে বুঝেছেন সেটা অনুসরণ করলে আমরা অনেক কথা সংক্ষেপে সেরে নিতে পারব।

হেইডেগার বলছেন, ১৮৬৬ সালে ব্রেনতানো বক্তব্য ছিল “সত্যকারের দার্শনিক পদ্ধতি প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়”। অর্থাৎ ব্রেনতানো দাবি করছেন, প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি আর দর্শনের পদ্ধতি অভিন্ন । কিন্তু পরে ১৮৭৪ সালে কিভাবে আবার বললেন দর্শনকে তার নিজের পদ্ধতির ওপর দাঁড়াতে হবে? দর্শনকে নিজের পদ্ধতির ওপর দাঁড়াতে হবে কথাটা তাহলে বুঝবো কিভাবে? প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতির বিকাশের মধ্য দিয়ে দর্শন কিভাবে নিজের পদ্ধতি নিজে নির্ণয় করতে চাইছে সেই দিকটা বোঝার জন্য হেইডেগারের তোলা এই প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

হেইডেহগার ব্যাখ্যা করে বলছেন, এর মানে মন, চেতনা বা চিন্তা নিয়ে গবেষণার সময় প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি হুবহু জবরদস্তি প্রয়োগ করতে হবে ব্রেনতানো কিন্তু সেকথা বলেন নি। বরং উল্টাটা বলছিলেন তিনি। প্রকৃতি বিজ্ঞান তার গবেষণার বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তার পদ্ধতি নির্ণয় করে ও বিষয়কে বিচারের জন্য বিভিন্ন ধারণা প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি তৈরী করে। মন, চেতনা বা চিন্তাকে বিশ্লেষণ করতে হলে সেই বিশেষ বিষয়ের প্রতি সম্পর্ক তৈরীর পদ্ধতিও প্রকৃতি বিজ্ঞানের মতোই হতে হবে। অর্থাৎ পদ্ধতি ও বিচার করবার ধারণাগুলোকেও বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। যাকে আমরা ‘মন’ বা ‘চিন্তা’ বলি তাকে তো উদ্ভিদ বা কোন জীব আকারে গণ্য করা যাবে না। উদ্ভিদ বা কোন জীবের ওপর গবেষণার জন্য তাদের সঙ্গে গবেষকের সম্পর্কের ধরণ, গবেষণা পদ্ধতি ও গবেষণার ফলাফল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ধারণা, প্রত্যয় বা বর্গাদি বিষয় অনুযায়ীই হতে হয়। গাছ নিয়ে গবেষণার পদ্ধতি জীবের পদ্ধতির অনুরূপ যেমন হবে না, তেমনি জীবের জন্যও পদ্ধতি, প্রকরণ ও প্রত্যয়াদিও উদ্ভিদ বিজ্ঞান থেকে আলাদা হবে। ঠিক তেমনি মন, চেতনা বা চিন্তা নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে যে বিষয় নিয়ে গবেষণা তার স্বভাব বিচার করেই পদ্ধতি, প্রকরণ, প্রত্যয়, প্রতিজ্ঞা ও বিভিন্ন বর্গ তৈরী করতে হবে। এই অর্থেই “সত্যকারের দার্শনিক পদ্ধতি প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়”। তার মানে আমরা “সত্যকারের দার্শনিক পদ্ধতি প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়” ঘোষণাটির যে-আক্ষরিক অর্থ করছি, ব্রেনতানো বরং তার উল্টাটাই বলছেন। প্রকৃতিবিজ্ঞানের পদ্ধতি নির্বিচারে প্রয়োগ নয়, বরং তাকে পরিহার করার কথা বলছেন তিনি। মন, চেতনা বা চিন্তা তো গাছপালা নয়, কিম্বা পাথরখণ্ড নয়, এমনকি জীব-অণুজীবও নয়। দর্শনের বষয় তো মনের স্বভাব বিচার করা। যাকে আমরা কখনও চেতনা কখনও চিন্তা নামে অভিহিত করি। বিষয়ের স্বভাব মেনে দর্শনের বিষয়ের প্রতি অগ্রসর হতে হবে ঠিক যেমন প্রকৃতি বিজ্ঞান তার বিষয়ের প্রতি অগ্রসর হয়। ব্রেনতানো এ জায়গায় দাঁড়িয়ে যেভাবে মনকে বস্তু বা শরীরের বিজ্ঞানের অধীনস্থ করবার বিপদ থেকে দর্শনকে রক্ষা করেছে হেইডেগার তাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে স্বীকার করেছেন। আসলেই তাই। কারণ বস্তু বা শরীর বিজ্ঞানের অধীনস্থতা এরাতে গিয়ে ব্রেনতানো প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণ ত্যাগ করে আসেন নি। বরং তা সঙ্গে রেখেই মনকে ‘মন’ হিসাবেই গবেষণার ক্ষেত্র উদ্বোধন করেছেন। দর্শনের জন্য এর ফল হয়েছে বৈপ্লবিক। এর ফলেই বিষয়বিদ্যার আবির্ভাব সম্ভব হয়েরছে।

এর মানে কি দাঁড়ায়? মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক, কিম্বা ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়োপলব্ধির সম্পর্ক নিয়ে যেকোন তত্ত্ব তৈয়ারের আগে মন, চেতনা, চৈতন্য বা বুদ্ধির কায়কারবার আমাদের কাছে সরাসরি যেভাবে হাজির হয় বা ধরা দেয় তাদের ঠিক সেভাবেই চেনা ও বোঝার চেষ্টা করা। সবার আগে দরকার মনের জগতে যে বিষয়গুলোর কায়কারবার ঘটে তাদের শ্রেণিকরণ। মানসিক ব্যাপারগুলো সুনির্দিষ্ট ভাবে চেনা এবং তাদের বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা। সেটা যেন মনগড়া না হয় সে চেষ্টা থাকতে হবে। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া আগাম ধারণা বা অনুমান দিয়ে মানসিক বা চিন্তার অভিজ্ঞতাকে স্বরূপে চেনা বা জানা যাবে না। শ্রেণিকরণ করতে হবে মন, চেতনা বা চিন্তার স্বভাব অনুযায়ী, এবং তারা যে ভাবে চিন্তায় নিজেদের উপস্থিতি ঘটায় ঠিক সেভাবেই। এভাবেই ব্রেনতানো মনোবিজ্ঞানকে এমন একটা ভিত্তির দাঁড় করালেন যার ফলে মনোবিজ্ঞান নতুন কিন্তু নিজেরই পথ ধরে দ্রুত বিকশিত হয়ে উঠতে পারল। কোন আগাম তত্ত্ববাগীশতা দিয়ে মনের, চেতনার বা চিন্তার জীবন্ত প্রক্রিয়াকে ধরা বা বোঝার চেষ্টা না করে তাদের স্বতস্ফূর্ত স্বভাব নিরীক্ষণ করে শ্রেণিকরণ ও বিশ্লেষণের বিজ্ঞান হিসাবে মনোবিজ্ঞান দাঁড়াবার সুবিধা লাভ করলো। হয়ে উঠল জীবন্ত অভিজ্ঞতার বিজ্ঞান। তারই ধারাহিকতায় দর্শনও নিজের পদ্ধতি ও প্রকরণ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

ব্রেনতানো ‘মানসিক’(psychic) ব্যাপার বলতে কি বোঝায় এই ধরণের কোন আগাম সংজ্ঞা দিয়ে শুরু করেন নি। মনের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক নিয়েও তাঁর মাথাব্যাথা ছিল না। কিম্বা শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক নিয়েও কোন তত্ত্ব পেশ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন নি। তাঁর সময়ের মনোবিজ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে তাঁর চিন্তার পার্থক্য বিচার করলে তাঁর মৌলিকতা সহজে বোঝা যায়।

‘প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মনোবিদ্যা’র প্রথমাংশে তিনি মনোবিজ্ঞান আসলে কোন্‌ অর্থে বিজ্ঞান সেটা ব্যাখ্যা করেছেন। দ্বিতীয় অংশের ব্যাখ্যা মনের বিভিন্ন কারবার সম্পর্কে। প্রকৃতিবিজ্ঞান যেভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে, সেই ভাবে মনের গতিপ্রকৃতি ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যবেক্ষণ ও তাকে বর্ণনাত্মক ভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। মারটিন হেইডেগার বলেছেন, এই বর্ণনার সঙ্গে প্রকৃতি বিজ্ঞানের অবরোহী পদ্ধতির তফাত আছে। এই অর্থে যে মন যেভাবে কাজ করে তার গতিপ্রকৃতিকে সেইভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, কোন ধারণা নির্মাণ ছাড়া। ব্রেনতানো নিজেও বলেছেন মনের জীবন্ত অভিজ্ঞতার শ্রেণিকরণ হতে হবে স্বাভাবিক। স্বাভাবিক মানে মন ঠিক যেভাবে উপলব্ধি করছে সেভাবেই অভিজ্ঞতাকে বোঝা ও শ্রেণিকরণের চেষ্টা করা।

প্রশ্ন ওঠে, প্রাকৃতিক বিষয় আর মানসিক বিষয়ের মধ্যে কী পার্থক্য ? ব্রেনতানো বলছেন, তাদের পার্থক্য নির্ণয় করা যাবে মানসিক অভিজ্ঞতার গড়ন বা কাঠামো দিয়ে। দেখতে হবে কিভাবে তারা জীবন্ত অভিজ্ঞতার উপাদান হিসাবে হাজির রয়েছে – কোন জীবন্ত অভিজ্ঞতা কোন কিছু মনের সামনে হাজির করবার জন্য তৈরী, কোন কিছু মন ইচ্ছা করেছে বলে ইচ্ছা হিসাবে তৈরী, কোন কিছুর অভিজ্ঞতা তৈরী কিছু বিচার করেছি বলে, ইত্যাদি। মনের জীবন্ত অভিজ্ঞতাকে মনের বাইরের কোন কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত থাকা না থাকা দিয়ে ব্রেনতানো শ্রেণিকরণ করেন নি।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁর বিখ্যাত মনের বিষয়নিষ্ঠা (intentionality) ও বিষয়ের অনস্তিত্বের (Intentional Inexistence) ধারণা জড়িত। দর্শনে এই বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত ব্রেনতানোর হাতে। এডমুন্ড হুসার্ল একে আরো ব্যাখ্যা ও বিশ্লেশণ করেন, আর হেইডেগারের দর্শনের গোড়ায় এই ধারণাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইন্টেনশানালিটির বাংলায় আমরা ইচ্ছা বা ঐচ্ছিকতা বুঝি, যদিও সে অর্থে ব্রেনতানো ব্যবহার করেন নি। মধ্যযুগের দর্শন থেকে ব্রেনতানো শব্দটির নিয়েছেন। মধ্যযুগে intentio বলতে বোঝানো হোত নিজেকে কোন কিছুর প্রতি চালনা করা। ব্রেনতানো বলছেন, যেকোন জীবন্ত অভিজ্ঞতাই কোন না কোন বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠ; অভিজ্ঞতার মধ্যে যে প্রভেদ ঘটে সেটা সেই নিষ্ঠার পার্থক্য ও মাত্রা দিয়ে ঠিক হয়। আমরা মনের মধ্যে কোন কিছু হাজির করে ভাববার চেষ্টা করি। কোন কিছু ইচ্ছা করার সঙ্গে তার পার্থক্য আছে। যখন কোন কিছুকে বিচার করে সাব্যস্ত করতে চাই জিনিসটা আসলে কি, তখন সেটা বিচারনিষ্ঠার মধ্যে পড়ে। ইত্যাদি।

ব্রেনতানো বলছেন, “যে কোন মানসিক ব্যাপারকে মধ্য যুগের স্কলাস্টিক চিন্তাবিদরা (মনজাত) বিষয়ের অনস্তিত্ব হিসাবে গণ্য করতেন। পুরাপুরি দ্ব্যর্থহীন না হলেও বলা যায় এ হচ্ছে কোন একটি বিষয়ের দিকে নিষ্ঠা, বা স্বতঃস্ফূর্ত বৈষয়িকতা। (একে বিষয়ের অর্থ হিসাবে ভাবলে ভুল হবে)। মনের মধ্যে জেগে ওঠা যে কোন ব্যাপারের মধ্যেই কোন না কোন বিষয় অন্তর্গত থাকে, যদিও তারা প্রত্যকে একই প্রকার নিষ্ঠা দেখায় না। মনের মধ্যে যখন কোন কিছু আমরা হাজির করি তখন তার কাজ বিষয়ের প্রকাশ, যখন কোন কিছু বিচার করি তখন সেটা স্বীকার বা অস্বীকার, যখন প্রেম নিয়ে ভাবি তখন যা ভালবাসি তার প্রতি নিষ্ঠা, ঘৃণায় ঘৃণিত, কামনায় কাম্য এবং ইত্যাদি। ... অস্তিত্ব নাই, কিন্তু মনে বিষয় হিসাবে আছে এই ধরণের স্বভাব কোন প্রাকৃতিক বস্তু প্রদর্শন করে না। তাহলে আমরা সেইসকল বিষয়কেই মানসিক বলতে পারি যারা নিজের মধ্যে কোন না কোন বিষয়কে ধারণ করে বিষয়নিষ্ঠ থাকে”। কোন কিছুকে যদি মনের বিষয় হতে হয় তাহলে তাকে কোন না কোন বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠা রেখেই ‘বিষয়’ হতে হয়। কিন্তু এ এক অবস্থা যখন যে বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠা তার কোন অস্তিত্ব নাই।

এখান থেকেই বিষয়বিদ্যার বিখ্যাত প্রাথমিক সূত্রের প্রস্তাবঃ বিশুদ্ধ চিন্তা বলে কোন চিন্তা নাই, চিন্তা মাত্রই কোন না বিষয়ের চিন্তা, কোন না কোন বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠ থেকে ভাবনা।

আমরা যখন এডমুন্ড হুসার্ল ও মার্টিন হেইডেগার নিয়ে আলোচনা করব তখন দেখব এই সরল সূত্রটি কিভাবে দর্শনের গোড়াকে বদলে দিয়েছে।
ফরহাদ মজহার।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×