হরিণঘাটা থেকে লোকটা আমার পিছন পিছন আসছিল।
সিগারেটটা শেয়ার করা যাবে?
কণ্ঠস্বরটা শুনে না করতে পারলাম না। বললাম, যাবে।
দেশলাই? তোমার ঠোঁটে ওটা তেমন জ্বলছে না। আমি ওটা নিভিয়ে তারপর আবার জ্বালবো।
তুমি মদ খাও?
না। এত প্রশ্ন করার কি আছে? এ সময়ে আমি সিগারেট শেয়ার করতে যাই না। আপনাকে করলাম। কারণ আপনাকে দেখে মনে হল আপনার জরুরী দরকার।
হা হা, দয়া হলো আমার দিকে?
জ্বি না। আমি চেইন স্মোকার বলে বুঝতে পারি অসময়ে একটা বিড়ির তেষ্টা পেলে কেমন ছটফট লাগে। আমি নিজেই দু শলা এনেছি বহু কষ্টে। এত রাতে দোকান সব বন্ধ হয়ে যায়।
আমি বড় পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সহিসডাঙায় চলে এসেছি। এই নির্জন জায়গার দু মাইল পরই আলো মিলবে। আমি হরিণঘাটা বাজারে আলকাতরার স্টোরে কাজ করি। দিনের রোদেও আন্ধারি কাজ..স্যাৎসাতে আর কদাকার ড্রামে ওসব বস্তু তুলতে হয়! অনেক বার ধুয়ে ফেলার পরও পায়ের নিচে চটচট করে।
লোকটা আমার পাশে চলে এল। আকাশে আধখানি চাঁদ চড়ুই পাখির মত মেঘে ঢুকছিল আর বের হয়ে আসছিল।আবছা আলোয় দেখলাম একটা লম্বা আলখেল্লা পরা মানুষ। কাপড় নয় যেন চটের পোশাকে।
ভয় পাচ্ছো নাকি? বয়স হয়েছে তাই গলা ভাঙা। আমি যখন তোমার মত তরুণ নবীনগরে থাকতাম। হাতে টাকা পয়সার অভাবে আমি ডোমের কাজ নেই। মৃতদেহ সৎকারের অফিস থাকে খবর দিতো ট্রাক এসে বেওয়ারিশ লাশ নামিয়ে যেত। একাই কোদালে কবর খুঁড়তাম। আমার অনুভূতি বলে কিছু নেই। গোরচাপা দিয়ে বাড়িতে গিয়ে গোসল করে নির্দ্বিধায় ভাত পাক করে খেতাম।
এখন? আমার জানতে ইচ্ছে হল তার সম্পর্কে। এখন কি করেন?
এখন তো আর বেঁচে নেই। সময় আছে হাতে? বিড়িটা নিয়ে অশথ গাছের তলায় বসি। অথবা ঢাল দিয়ে হাঁটি তাতে কথা বলার সুবিধা হবে।
আমার বাড়িতে চিন্তা করবে। জলদি ফেরা দরকার। তবে অসুবিধা নাই।
লোকটা আমার চেয়ে দ্রুত হেঁটে আমাকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। তাকে অনুসরণ করে পাকা ইঁট বিছানো সড়ক থেকে নির্জন কাঁচা পথে চলে এসেছি। কোথাও ভুল হচ্ছে আমার। এ নিশ্চয়ই ভয় দেখানোর কেউ না। এই পথে বাড়ি ফিরি কম করেও পাঁচ বছর। এই পথে আমাকে ভুল ভাল নেয়ার উপায় নেই।
লোকটার মুখ দেখি নি।
আমার ভয় করছিল না যে তা বলবো না। চাঁদের কিরণ মিলিয়ে যায় তাই আন্দাজে পা ফেলতে হয়। একবার মনে হল এই ঢালে কেন নামাতে যাবে। কাদা থাকলে পা ডুবে যাবে। তখন যদি না উঠতে পারি?
আচ্ছা, তুমি মরা মানুষের ফিরে আসা বিশ্বাস করো?
কি বলছেন? কেন করবো?
বিশ্বাস না করলেও এটা সত্যি!
একটা অজ্ঞাত লোক আমার কৌতূহল হোক আর যাই হোক আমার দখল নিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু মনু নাম শুনে চমকে উঠে বললাম, ভাই, আপনি আমার নাম কোথা থেকে জানলেন? আপনি কি আমাকে চেনেন?
লোকটার মুখে সিগারেট নেই।
একি, আপনি না আমার আমার সিগারেট নিভিয়ে ফের জ্বালাবেন?
হা হা, অট্হাসি। দু পাশে ঝোঁপ কেপে উঠলো। মৃত মানুষের সিগারেট খাওয়া কি তোমার মত হবে? এখন সিগারেট ছাড়াই ভাললাগছে।
আমি এই মধ্যরাতে রসিকতা করে ফেলি - এত জোরে হাসছেন কেন? এরকম হাসে সাধারণ মানুষ!
তোমাকে না বললেই নয় মনু, তুমি যখন মরবে বুঝবে পরজন্মে মানুষ বদলায় না।
তোমাকে বলেছি আমি ডোম। যখনই ডাক পড়তো ্আমি আসতাম। আঁধারে একটা হারিক্যান জ্বালিয়ে মানুষ চাপা দিতাম। যতক্ষণ আমার নতুন মেহমান আসতো আমার খুশি লাগতো। বেওয়ারিশ লাশের কোনটি উদ্ধার হয়েছে কয়েকদিন পর। কড়া পঁচনের ঘ্রাণ। কোনটি সদ্য মৃত। দুর্ঘটনায় উদ্ধার করা একটা স্টিমারের তেরটি লাশ আমি একরাতে সৎকার করি। এরকম পেশায় যারা থাকে তাদের ধূমপানের নেশা পায়। সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল এক পশলা। ভ্যান গাড়িতে কনস্টেবলগুলো উঠে গেছে। আজকের মত ভয়ানক তেষ্টা পেলো বিড়ির। তখনই একটা মৃতদেহের বুকপকেটে সিগারেটের কেস পেয়ে গেলাম। ওস্তাদ বলতো সিগারেট জিনিসটা শবদেহের অনুকরণে বানানো। সাদা কাগজের কাফনে মোড়ানো। তারপর চিতার মত আগুন জ্বলে জ্বলে ধুঁয়া হয়ে যায়।
সেদিন এক ডজন লাশ সমাধিস্ত করার পর আমি খুব একা হয়ে যাই। মনে হল একটু আগে মৃত সংসারের সাথে ছিলাম। একটা কাটা শরীর গাছের মত পুঁতে দিলাম। একটা আস্ত বুক পেট চেপে মাটিতে ঢুকলাম। সবাইকে মাটির ভিতর রেখে আমার যেন কেউ থাকলো না। আমি খোদার কাছে বলি একজন মানুষ যেন থাকে আজ যে আমার বন্ধু।
তখন এই পথে তুমি আসছিলে। তোমার সঙ্গে বন্ধুটি ঠিক এখানে এসে বিদায় নিয়ে চৌরাস্তার দিকে চলে যায়। তোমার কাছে আমি সিগারেট ধার নেয়ার ছলে পরিচিত হই।
তুমি বোকা বলেই আমাকে একটা পুরো প্যাকেট দিয়েছিলে..
আজকে অনেক ক্ষণ ধরে পথের পাশে অপেক্ষায় আছি তোমার জন্য,
আমার জন্য?
হুম, আমার কণ্ঠহাড়টা দেখছো?
জি না আমি আঁধারে দেখতে পাই না।
আমার পুরো শরীর কেবল হাড় আর হাড়। পাঁজরের ভিতরে হৃদপিণ্ড শুকিয়ে খসে গেছে। সেজন্য ওটা দিয়ে ধৌঁয়া আর ঢোকে না। গলার পুরোটাই কঙ্কাস্থি। হাড়ের ভিতর ধোঁয়া কি আটকে?
জীবন বড় সুন্দর, মনু। তুমি কি সুন্দর ধোঁয়া খাচ্ছিলে। হিংসা লাগে আমার।
আমার ভয় সরে একটা মমতা জন্মেছে।
আপনি তাহলে জীবিত নন। কোথা থেকে এসেছেন?
আমি সিলেটের মন্দিরায় একটা চা বাগানের ভিতর কাজ নেই। বিলাতীদের একটা কবরস্থানে কাজ। সংখ্যায় অল্প মানুষ। বিলাতীদের আয়ু লম্বা। তাই অবসরেই কাটাতাম। ওখানে যাবার দু মাস পরে আমি সাপের কামড়ে মারা যাই। একটা বড় ইচ্ছে আমার পূরণ হলো না। আমার ইচ্ছে ছিল সহিসডাঙাতে আমার দাফন হবে। কিন্তু কেউ জানেনি বিধায় ইচ্ছেটা পূরণ হয় নি। তাই যখন ছুটি পাই এখােন আসি। কোন একটা খোলা গোরে ঢুকে বসে নিজের হাতে গোর দেয়া মানুষগুলোকে স্বজনের মত ভাবি।
আর একটা কথা মনু। তুমি আমাকে এক রাতে সঙ্গ দিয়েছিলে জানি না। যখন খুব ধূমপানের তৃষ্ণা হয় মনে হয় তুমি এক শলা দিলে ভাল হয়।
লোকটা খুব বিষাদে ধরা গলায় এটা বললো। যেন আমার বাজার থেকে কেনা একটা সিগারেটের শলাকা খুব দামী কিছু।
আমি পকেটে হাত বাড়িয়ে শেষ শলাকাটা বের করে বললাম,
ভাই, আমার একটা কথা রাখবেন? এইটা শেষ। কিন্তু এটাও খান।
তুমি তো দেখেছ আমি খেতে পারি না, কষ্ঠাস্থি নেই। তাই হাতে মুচড়ে শেষ করি।
আমি অনুরোধ করলাম।
লোকটা তর্ক করলো না, ঠিক আছে তুমি সিগারেট জ্বালাও।
সিগারেট জ্বললো.. একটা হাত বাড়িয়ে তিনি সেটা নিলেন।
খস খস শব্দ হয়ে দপ করে আগুন নিভে গেল।
চুপচাপ কিছুক্ষণ। আঁধার ঘুট ঘুটে।
একটা খুব করুণ শব্দ হলো। কেউ আবেগে কেঁদে দিল। আবার মনে হল কেউ নেই। মনের ভুল। চারপাশটা খালি অথবা কেউ মিথ্যে মিথ্যি কাশছে। শুনেছি মৃত আত্মা কথা বলতে জানে। মৃতদেহের পক্ষে কাশি দেয়া সম্ভব কিনা আমার জানা নেই।
=
ড্্রাফট ১.৬/ এডিট করেছি
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:৫৮