পাস করার পর পর আমি একটা ফোন কার্ড বিক্রির অফিসে কাজ পেয়েছিলাম । অনেকটা পার্টটাইম । ব্যবহারকারীদের নানাবিধ সেবা দেয়া। এসব কাজ বেশ বোরিং হয়। যেমন কেউ ফোনের সমস্যায় পড়েছে। ফোন লাইন খারাপ, সে কার্ডের নামে গালি গালাজ করছে। ছেলে বিদেশ থাকে। বুড়ো বাপকে ইন্টারনেট কিনে দিয়েছে । সেই বৃদ্ধ হয়তো জানেই না কিবোর্ডে এস্কেপ কী কোথায় থাকে। টাস্কবার কি। তবুও ধীরে ধীরে ধৈর্য নিয়ে ওদের বোঝাতে হত। নিয়ম কানুন শেখাতে হত।
এসব জটিল কাজের পাশাপাশি আমি কাস্টমারদের ফোন করে সন্তুষ্টি জেনে নিতাম। কেউ প্রথম বার রেজিষ্টার্ড হয়ে ২ মিনিট কল করতে পারতো বিদেশে। আবার বিদেশ থেকেও কল করতে পারতো। যারা রেজিস্টার করতো তাদের ইমেইল/ফোনে যোগাযোগ করতাম। মেসেঞ্জারে কল সেন্টারের মত করে নম্বর এড করে কথা বলতাম, ইমেইল করতাম। তারপর মুছে দিতাম।
ইমেইলের লিস্ট ধরে ফোন করতে বিব্রত হতাম। ও প্রান্ত থেকে ধন্যবাদ দিতে চাইতো, বখশিশ দিতে চাইতো । কেউ আবার ইমেইল নম্বর চাইতো। কখনো আমি ইয়াহু নম্বরটা দিতাম। যদিও এভাবে নিজের ইমেইল দেয়াটা নিয়মে পড়তো না।
****
আজরিন সিমির সঙ্গে পরিচয় সেই সুত্রে। মিথ্যে বলব না নামটা শুনেই একটু আগ্রহ ছিল।
আমি রাতে একদিন মেসেঞ্জারের বসে আছি। একটা রিকোয়েস্ট এলো। আমি চিনতে পারলাম। তাকে আমি ইমেইল ঠিকানা দিয়েছিলাম।
এড করলাম তাকে।
পরিচয় হল। দুই একটা কথা বলে চলে গেল। মেয়েটার প্রোফাইলে মানুষের ছবি ছিল না। একটা সবুজ গাছের ছবি। রহস্যটা আরও গভীর হয় তাতে।
মাঝে মাঝে একটু আধটু কথা হতো।
একদিন মেয়েটা নিজ থেকেই আমার সম্মন্ধে জানতে চাইল। সে বলল, আজ আমি বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে। খুব একা । কম্পিউটারের পর্দায় আমি বাংলায় গান গাই গানটা বাজছে। আই এম ক্রাইং। আই লাভ বাংলাদেশ।
আমি অশ্রুপাতে দুর্বল মানুষ। আপন হয়ে তাকে সব জানতে চাইলাম।
সে বিস্তারিত না বলে বলল পাকিস্তানের এক ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক। ওই সূত্রে সে লাহোরে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে খুব। সমস্যাটা কি বলল না। শুধু বলল দেশেও আসতে পারছে না । কিন্তু সে চায় দেশে আসতে। আমি তখন প্রবাস-বন্দী এক বাঙালি রমনীর কথা শুনে কষ্ট পেয়েছিলাম।
বেশ কয়েক দিন পর আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সিমিকে সেদিন একটু স্বাভাবিক মনে হল। আমার সঙ্গে তার কথা হল নানান বিষয়ে।
সত্য কথাটা জেনেছিলাম সে দিন। তারা লাহোর থেকে ফিরে এসেছে। তার বিয়েই হয় নি। ঘটনাক্রমে মেয়েটার বাবা পাকিস্তানে চাকুরী করত। বাবার বন্ধুর ছেলে মুস্তফা। লম্বা, সুদর্শন সেই ছেলের সঙ্গে সিমির প্রেম হয়। সিমির আত্মীয়দের কেউ ওখানে মধ্যস্ততা করছিল। কথা ছিল বেড়াতে যাবার ছুতোয় সব ঠিক ঠাক হবে।
একটা মেয়ের পক্ষ এভাবে পাকিস্তান বিয়ে দিতে আগ্রহী এটা মেনে নিতেই সময় লাগল, তবে জানলাম শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয় নি।
মেয়েটার মন বলতে বলতে খারাপ হয়েছিল। আমি সেটা ভাল করতে চাইলাম। সঙ্গে হালকা কথা বলছিলাম। উপদেশ দিচ্ছিলাম। আর মজা করছিলাম যাতে এসব সে ভুলে যায় ।
কথায় কথায় সে উর্দু শব্দ বলত। আমি শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করতে থামাতাম। এক সময় সে গোলাম আলীর চুপকে চুপকে গানের লিঙ্ক দিল। ব্যাখ্যা করল। সে যে ভাল মুভি দেখতো জানালম।
একবার আমাকে বলল, সাইফ আমাকে ফোন কর।
আমি ফোন করি। তখন রাত ৩ টা বাজে। আমার ঘরটা ছোট্ট। পাশের ঘরের শব্দ শোনা যায়। কোন বিষয় ছাড়াই কথা হয় । সেই বলেছিল ঢাকায় তার বন্ধুদের কথা। কোন ইউনিতে পড়েছে।কি খেয়েছে আর খায় নি। সে ভাল রান্না পারে এসব। এর পরে সে প্রায়ই কথা বলত।
আমি দীর্ঘক্ষণ কথা বলায় অভ্যস্ত । তবুও মেয়েলি কথায় বোর হয়ে যেতাম।
আমাদের বাসয় তখন ল্যাণ্ডফোন এল। আমি একটা লাইনের প্যারালেল আমার রুমে নিয়েছিলাম।
এক রাতের ঘটনা মনে আছে আমি বিছনার ভিতর ফোন নিয়ে শুয়ে তার গল্প শুনছি। কখন কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়েছি জানি না। দেখি ফোনের হ্যাণ্ডসেটটা সকালে মাটিতে ঝুলছে।
এক সময় মেয়েটা তার শৈশবের কথা বলতো। তার বাবার কথা বলতো। মেয়েটার বাচন ভঙ্গী ছিল আদুরে ধনীর সন্তানদের মত । কিছু বুঝতোও না। আহ্লাদী কণ্ঠ সে আমাকে সে জোর খাটাতো।
একদিন সে নিজ থেকেই তার ছবি পাঠায় । ছবিটা দেখে আমি কিছুটা আশাহত হয়েছিলাম। এরপর থেকে আমাকে সে অনলাইনে এসেই নক করত। দৈনিক স্ট্যাটাস দিত। আর ছবি পাঠাতো প্রতিদিনই। আমি ছবি না তুললেও সে পীড়াপীড়ি করত ছবি দিতে।
আমার তখন সুমনার সঙ্গে সম্পর্ক চলছে আবার কাটাকাটি চলছে । মনে একটা অপরাধ বোধ জাগছিল। আমি এক সময় ঠাণ্ডা গলায় সিমিকে বললাম, সিমি আমি আসলে অন্য আরেকটি মেয়ের দিকে দুর্বল। সুতরাং যদি কিছু মনে না কর, শুধু বন্ধুত্বে থাকো।
সে যখন ওটা শুনলো সে চিৎকার করে বলল, হোয়াই ডিডন্ট ইউ টেল মি বিফোর?
তারপর মন ভার করে বলল, সে আমাকে "লাভ" করে। টেলিফোনে সে চুমু খেল। বলল, পৃথিবীতে ওর চেয়ে আমাকে কেউ বেশি লাভ করতে পারে না। এটা সে প্রমাণ দেবে।
তখন রাত চারটা। আমি খুব সামলে বলেছিলাম, দেখো আমি তোমার সঙ্গে সিম্পলি ফ্রেণ্ডশীপ চেয়েছি। এসব পার্সনাল ডিটেইল না বললে কি হয়।
আর এমন যদি হতো আমি বলতাম, সিমি আই লাভ ইউ। আর ঘটনা লুকাতাম। তাহলে না হয় আমাকে দোষ দিতে।
মেয়েটির গলা চড়তে থাকল। সম্ভব হলে ফোনের ওপাশ আমার বুকে আঁছড়ে কাঁদে আর কি।
সে বলল, সাইফ, আমি দেখতে আগলি। আমার চেহারা কাল, আমি মোটা আর বেটে । আমি যদি তোমাকে ইমেইলে সুন্দর মেয়েদের ছবি সেন্ড করতাম। তাহলে তুমি পুরুষ । ঠিকই আমাকে ভালবাসতে।আমি ট্র্যাশ, আমার রূপ নাই। আমার কিছু নাই। ইউ বাস্টার্ড মেইল রেইস।
ওর গালি গালাজ বাড়ছিল। আর সে কি যে বললো নিজেও জানে না। বলল, পাকিস্তানের ঘটনা। সেখানে ..এমন হয়েছে। দুর থেকে ভালবাসছে। সে ফ্যামিলি রাজি করিয়েছে। সামনা সামনি দেখে তাকে আর পছন্দ করে নি।
তার অনেক শেষ কথা হল আমি এক পুরুষ!
আমার তখন আর বোঝানোর মত ধৈর্য ছিল না। বললাম,
শাট আপ, ডোন্ট কল মি এগেইন। আমি টায়ার্ড।
হ্যা, আমি মেইল, তোমার ছবি দেখার পর ভালো লাগে নাই। লাগে নাই। তো কি হয়েছে? দুনিয়া তো বিউটি নির্ভর। আমি অন্যদের মত। সো হোয়াট?
ও পাশে ফোন ভাঙার শব্দ হল।
সে আর আমাকে ফোন করল না।
ইমেইলও না।
মেসেঞ্জারে ডিলিট করে দিল।
আমি এর পর নিজ থেকে একটা দীর্ঘ ইমেইল দিয়েছিলাম। সরি বলে।
মাথা গরম হয়ে আমি গালি দিয়েছিলাম তাকে। এমন কি স্লাট বা নষ্ট মেয়ে বলে ফেলেছিলাম।
সে ইমেইলে আমাকে ছোট উত্তর দিয়েছিল,
সাইফ, আই স্টিল লাভ ইউ। ইউ আর মাই হার্ট
আমি বললাম, সিমি, ইমোশনাল হয়ো না। ফোন ধরো। কথা আছে। আমার এই বন্ধুত্বটা নষ্ট করো না। ভালবাসা না হলেও সব ঠিক থাকে, সিমি।
সে বলল, তাইলে, তুমি আমার সঙ্গে দেখা কর।
আমি অনেক ভাবলাম। এর ভাল মন্দ দুটোই। দেখা করলে প্রবলেম আরো বাড়বে।
******
রাতে ফোন করলাম।
সে বলল, একটা কথা তোমাকে বলি নি, সাইফ।
---কি কথা
---আমি গতকাল রেপড হয়েছি
--মানে?!
---আমার বুকে পিঠে আঁচড়ের দাগ। ভিতরটা জ্বলছে। কী তীব্র তার যন্ত্রনা। আমার বাড়িতে মা একলা থাকে। মা ছিল না। আর তার এক কলিক এসেছিল। দরজা খুলতেই সে আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় আম্মার রুমে। আমি শক্তিতে পারি নি, সাইফ
বলেই সে কাঁদতে লাগল।
আমি শকড হলাম।
বললাম, তারপর?
সব শুনে আমি অস্ফুট স্বরে বলেছিলাম, এই যুগে, এই ঢাকা শহরের মত উজ্জ্বল নগরীতে এমন ব্রুটালিটিও হয়!
সে বলল, আমি অসুন্দর বলে সারাজীবন নিরাপদ ভেবেছি নিজেকে। রাতে বাড়ি ফিরতে আমাকে কেউ শিষ বাজাতো না। কেউ প্রেম পত্র ছুঁড়তো না।এমন কি গাউছিয়ার ভিঁড়ে অন্য মেয়েরা যখন সতর্ক থাকতো। আমাকে কেউ ছূঁতে চাইত না।
এস শুনতে আমার খারাপ লাগছিল।
সে বলে চলল, সাইফ। কিন্তু আমি খুব অহংকারী হয়েছি, অন্তত: একটা পুরুষ তো আমাকে ভোগ করতে চাইল!
আমার কথা থেমে যাচ্ছিল।
সিমি শুকনো শান্ত কণ্ঠে বলেছিল,
---সাইফ। এসব ঘটনা বললে, সবচেয়ে প্রিয় যে পুরুষ সেও চলে যায়। তুমি আমাকে ভালই বাসনি। তুমি তো যাবেই। তুমি যাও । তবে প্লিজ তুমি ফোনটা ধরে রাখো। আমি সুন্দর করে আমার রেপ হওয়ার ডিটেইল বলি তুমি যাতে আমাকে অনেক ঘৃণা করতে পার। একটা রাস্তার নষ্ট মেয়ে বলে ভাবতে পার।
আমি ফোন রেখে দিতে চাইলাম।
কিন্তু ওপাশ থেকে সে শ্লেষ্মা মিশ্রিত গলায় ঘটনা বলতেই থাকল কি করে তার জামাটা ছিঁড়ে ফেলা হল, কি করে সে দানবটাকে থামাতে পারল না। আমি এরকম নির্মম ঘৃনা ঘটনা আগে শুনিনি। তবে শুনতে একসময় সেটা আর খারাপও লাগছিল না।
****
অনেক দিন পর সুমনাকে বাসার সামনে ড্রপ করে কার্জন হলের সামনে দিয়ে ফিরছিলাম।
সিমির ফোন নম্বর ভেসে উঠল। একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম। সাইফ, আই এম স্টিল ফ্রি ফর ইউ । ইউ মিট মি এণ্ড টেইক মি। ডু এজ ইউ উইশ। ইউ ডোন্ট নিড টু পে মি এনি থিং।
ওটা ছিল আমার সঙ্গে সিমির শেষ ফোন।
----
ড্রাফট ১.০