রাত আনুমানিক তিনটা বা তিনটা ত্রিশ।
রজনকে দেখা গেল আইজুল মিস্ত্রির নতুন দোকানে। আলমডাঙ্গা চিরবিদায় স্টোর্স। একশ ওয়াটের কমলা বাতি জ্বলছিল। একমাত্র এই দোকানটাই এত রাতে খোলা থাকে। নিশ্চিত দু:সংবাদ না হলে ওখানে কে যায়?
রজন ক্যাশে দাম দর করছিল। দ্রুত কেরোসিন কাঠের একটা কফিন ঠেলাগাড়িতে তুলে সে শ্যামলী গেল। জমির চাচা খুব আপন নয়। একমাত্র ছেলে লন্ডনে থাকে। ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে মৃত মানুষটির জন্য তার এই দায়িত্বপালনের বিকল্প নেই। আড়াই বছর বিছানায় প্যারালাইজড ছিলেন। বার্ধক্যজনিত এসব রোগের সমাধান দ্রুত মৃত্যু।
সব মিলিয়ে একাকীত্বে এই বৃদ্ধটির মৃত্যু যেন আকাঙ্ক্ষিত ছিল। তবে রজনের ভিতর ঝড় বইছিল। সে জানল এই মৃত্যুর জন্য সে দায়ী।
রজন ধানমণ্ডীতে বিদেশী একটা সংস্থার এক্সিকিউটিভ । মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্তে যাবার স্বপ্ন দেখে সে। অসময়ে হৃদযন্ত্রের বিশ্বাসঘাতকতায় তার পিতার মৃত্যু হল, আর এর পর গভীর সংকটে নিমজ্জিত ছিল পুরো পরিবার। প্রথম ধাক্কায় গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মত টালমাটাল ছিল সংসার। এখন মন্দ সময় বিস্মৃত। রিক্সার ভাড়া বাঁচাতে সে হেঁটে যেত। পয়সার প্রতিটি মুদ্রা গুণে রাখত। এখন বাসার সামনে ড্রাইভার হর্ন দেয়। ভাল ছাত্র হবার কারণে এবং বেশ চালাক চতুর হওয়ায় অফিসে পদোন্নতি বেশ দ্রুতই হয়েছে। রজনের সঙ্গে তার বাবার কিছু তফাৎ আছে। রজনের বাবা সৎ ও বোকা মানুষ ছিলেন। মানুষ বলতে বুঝতেন শুধুই শিক্ষাকে। রজন খারাপ নয়, তবে সে বিশ্বাস করে শিক্ষায় বড়জোর জ্ঞানী হয়, সুখের ভোমরাটা থাকে টাকার কলসির ভিতর। অর্থসঞ্চয়ে সে মনযোগী হয়, বাড়ি গাড়ী এসবের স্বপ্নে সে মশগুল হয়।
ঘটনাটা তুচ্ছই। গত সপ্তাহে দুপুরে অফিসে প্রথম একটা দুর্নীতি করল রজন। উৎকোচ নয়। একধরনের স্বজনপ্রীতি। অফিসের বস দায়িত্ব দিয়েছিল নতুন এক্সিকিউটিভদের রেজুমি বাছাই করতে। ক্রাইটেরিয়াতে ইংরেজিতে যোগ্যতা, আর ন্যুনতম দুটো প্রথম শ্রেণী প্রয়োজন ছিল। রেজুমি সেখানে ছিল। আর শর্ট লিস্টেড পাঁচজনের সবাইই মাস্টার্স। মেধাতালিকায় প্রথম দিকে থাকা মানুষটি তার পরিচিত। ওর নাম ইতিনা সুমাইয়া ইসলাম। ডাকনাম ইতিনা। যোগ্যতা অনুসারে মেধাবী ছাত্রীর টিকে যাওয়ার কথা। কিন্তু একটা ছেলের রেজুমি সব রেজুমিকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। ছেলেটির নাম ইমরোজ সবুক্তগীন। দেশের বাইরে ছিল। ইংরেজিতে পারদর্শী। আর ব্যাংককের বিখ্যাত একটা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করেছে। রজন আশাহত হল। একমাত্র প্রার্থী নিলে ইতিনা ঢুকতে পারবে না।
রজন সন্তর্পণে রেজুমিটা সরিয়ে ফেলল। এবার আর সমস্যা রইল না। রাতে খুশী মনে ইতিনাকে ফোন করল আগাম বার্তা দিতে। ইতিনা তার পঞ্চান্ন বয়সী গম্ভীর বাবার মতো আবেগহীন গলায় বলল
-জি, আমরা ভাল আছি, ভাল।
-খালা, খালু, পিনাকী?
-সবাই ভাল
-নতুন কিছু? । রজন তখনো সারপ্রাইজটা দেয় নি।
-না, কি আর হবে নতুন। বিসিএস দিব।
-জবের জন্য বলেছিলে না, রেজুমিটা তো অফিসে এসেছে
-থ্যাংকস ভাইয়া, মেয়েটা সহজাত হিসাব করা গলায় বলে, যদি জবটা হয় তো খুব কাজ হবে
-সেটা হওয়ানো যাবে, রজন তার অস্তিত্ব জানান দেয়, ডোন্ট অরি। আমি ব্যবস্থা করা দেব
-না, থাক, ভাইয়া। এটা আমি চাই না। আপনার কিছু করার দরকার নেই। যদি যোগ্যতা থাকে তাহলে এমনি হবে।
রজন আশাহত হয়। বার বার ইচ্ছে হয় একটু তরল হতে। সে বলতে চেয়েছিল, কি ইতিনা, তোমার তো চাকুরী হয়ে গেলে প্রথম বেতনে আমাকে কি খাওয়াবে? প্রতিদিন তোমার সঙ্গে দেখা হবে। ভালই হবে তখন। শুকনো শরীরের মেয়ে ইতিনা। কিন্তু একটা দেড় টনের চাঁদের পাথর। রজন মজা করতে চায়। সাহস পায় না। চাপা পড়ে থাকে।
রজন ঠিক কবি টাইপের কেউ না। কবি না হলেও কেউ কেউ দ্রুত আহত হয়। একদিন ইতিনাদের বাসা থেকে ফিরে টেবিলে রাখা ভারী বইয়ে হাত চেপে ধরে দু পাশের কর্কশ অক্ষর চেপে প্রতিশোধ নিতে চায়। এত বিদ্যায় থেকে কী লাভ? নিচে গিয়ে একটা বিড়ি কিনে আনে। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিতে চায় ঠোঁট। মেয়েটা তাকে অবজ্ঞা করে না। কিন্তু এমন শ্রদ্ধার দুরত্বে থাকে যে রক্তমাংসের সম্পর্কটা তার কাছে নিষিদ্ধ ।
রজন এই শ্রদ্ধা যে চায় তা না। কিন্তু ভয়ও হয়। এজন্যই তার একটা অদ্ভুত আশা । ইতিনা যদি সহকর্মী হয়, মেয়েটার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হবে। দুপুরে খেতে বললে মাইণ্ড করবে না। বাড়ি ফিরতে দেরী হলে এগিয়ে দিতে পারবে।
***
পরদিনই এডমিন থেকে একটা নোটিশ দিয়ে গেল। তাকে সাইন করিয়ে নিতে। যে সমস্ত রেজুমি এসেছে কোনটি কবে রিসিভ করা হয়েছে তার তালিকা আছে। তারা টালিও করেছে একাডেমিক কোয়ালেফিকেশন দিয়ে। সেই ইমরোজ সবুক্তগীনের নাম আছে।
রজন মন ক্ষুণ্ন হল। লকারের ভেতর থেকে বাধ্য হয়ে ইমরোজের রেজুমির খামটা বের করে যথাস্থানে রেখে দিল। ইতিনার মা একটু পরে ফোন করে বলল ইতিনার একটা প্রস্তাব এসেছে কি করবে। রজন কিছু বলতে চাইল না। বলা বাহুল্য ইতিনার মা রজনকে নিজের ছেলের মত পছন্দ করে । সেখানেও রজনকে যে পাত্র হিসেবে দেখেন তা না। তিনি বলছিলেন, বাবা, আমার মেয়েটা তো পাগল। কথা জানে না। ও দেখতেও কাল। এ যুগে ফর্সা ছাড়া কেউ মেয়ে খোঁজে না। তুমি তো ভাল জায়গায় কাজ কর। ওর জন্য ছেলে পেলে দেখো। টাকা পয়সা চাইনা শিক্ষিত যেন হয়।ওকে যেন বুঝতে পারে।
রজনের বিয়ের বয়স পার হয়েছে। ওর মা বিয়ের কথা বলে কিন্তু তার ফটোর তালিকায় মনের মত কাউকে পায় না। মা কিন্তু ইতিনার পরিবারকে জানে। কিন্তু মায়ের পছন্দের গাত্রবর্ণ ইতিনার নেই।
**
তারপর যেটা হল, রজন রেজুমিগুলো বস কে দিয়ে দিল। ইমরোজের কারণে খচ খচ করছিল তার মন। সরিয়ে দেবার তাৎক্ষণিক বুদ্ধি পাচ্ছিল না। তাছাড়া কে জানে হয়তো তদবির আছে ওর জন্যও। ডাকপড়বে। রজনের বাবার কথা মনে হয়। তার বাবা মিথ্যে বলা আর উৎকোচ ঘৃণা করতেন।
অন্যমনস্কভাবে রজন ছেলেটর রেজুমির একটা কোণা ছিঁড়ে ফেলল। আর তার ছবিতে নখ দিয়ে আঁচড় কাটতে লাগল। হঠাৎ সে দেখল ছবিটা নষ্ট। ছাপানো কাগজ থেকে বেরিয়ে আসছে নীল কালি।তার নখের উপর নীল প্লাস্টিক তরল ঢুকে গেছে। নেল পলিশের মত রং ধরেছে। বুকটা ধক ধক করে উঠল তার। এখন কি করবে সে? সে ইচ্ছে করে তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। নখের গাঢ় নীল ধুয়ে নিতে চাইল। পারল না। বেসিনে সাবান ডলে তুলতে পারল না।
***
ম্যানেজার যে সে বাছাই করা পাঁচটি রেজুমি পেয়েছে। তাদের কল করা হবে। ইন্টারভিউয়ের রেজুমির কপি করে দেয়া হবে সবাইকে। যদি প্রশ্ন ওঠে এই রেজুমির ছবিটা নষ্ট হল কি করে তখন তার দোষ হতে পারে । সে একটা মিথ্যে ঠিক করছিল মনে মনে। কিন্তু তার আগে নখের এই নীল রঙ তুলে ফেলতে হবে।
ছেলেদের একটা বিউটি কেয়ার সেন্টারে খুলেছে গুলশানে। লেজার ট্রিটমেন্ট সহ নানান ব্যবস্থা আছে। সে ওখানে গিয়ে আঙুল দেখাল। ওরা অবাক হল। বলল যে পুরো নখের ভিতর নীল রঙ । লেজার দিয়েও কাজ হবে না। এটা কোন অজানা অসুখ। তারা এটা দেখে নি। রজনের দুশ্চিন্তাটা এবার অন্য পথে মোড় নিয়েছে।
সে বাড়িতে এসে কাউকে বলতে পারল না। মা চা দিয়ে গিয়েছিল। শর্ষে দিয়ে মুড়ি মাখানো। কিন্তু সে দরজা বন্ধ করেই থাকল। হাত মুঠ করে বসে থাকল তার নিজের ঘরে। মা ভাবল তার ছেলে একা পড়াশোনা করছে। বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
রজন তার পুরনো এলবামটা বের করল। মনে হল কোন একটা অপরাধে এমন হয়েছে। বাবাকে দেখতে চাইল। বাবা মায়ের বিয়ের একমাত্র ছবি শুরুতে। একটা ছবিতে বাবা বসে আছে। সে বাবার কোলে । তার বোনটি তখনও হয়নি। তারপর আরেকটা ছবি। তারা একসঙ্গে সিলেটে বেড়াতে গেছে । শাহজালালের মাজারের সামনে। ছবিতে জমির চাচা বসেছিল। লোকটি তখন তরুণ। ধূর্ততায় তার নজির মেলানো ভার। বাবার কাছ থেকে বহুটাকা নিয়েছে তারপর অস্থানে খরচ করেছে। মা তাকে একদম পছন্দ করতেন না। বাবা বহুবার ঠকেও সবাইকে বাড়িতে ডাকতেন।
এবার সে সৎ বাবার পাশে এমন বাজে লোকটিকে মানাতে পারল না। নখ দিয়ে চাচার ছবিটা সরিয়ে দিতে চাইল। আর নিমেষে বড় একটা আঁচড়ে চাচার মুখ মুছে গেল।
আধাঘণ্টাও অতিক্রম হয় নি। মা দরজা নক করলেন। রাজু রাজু, দরজা খোল
-কি হইছে আম্মা? দরজা তো ভাইঙা ফেলবা। রজন এলবামটা বন্ধ করে দরজা খুলল
-তোর জমির চাচার একটা খারাপ খবর আসছে। শ্বাসকষ্ট উঠছিল। ইন্তেকাল ফর্মাইসেন এইমাত্র।
ছ্যাৎ করে উঠল তার মন। তার নখে নীলটা যেন আরো ঘন হয়ে যাচ্ছে। আর আঙুলে ছবি থেকে ব্রোমাইডের চামড়া উঠে আসছে।
জমির চাচার চলে যাবার পর। দু রাত ঘুম হয়নি রজনের। তার ভয় হল। কি হচ্ছে এসব? সবই কি দৈবাৎ? বিজ্ঞানের এই যুগে এসব সংস্কার অবান্তর।
**
চাচার দাফন সেরে সে ক্লান্তিতে ডুবে গেল। এলবামটা পড়ে ছিল তখন টেবিলে। ড্রয়ার খুলে তাতে আড়াল করে দিল। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করল। সিক কল করে অফিসে গেল না। মন ভাল করতে একটা বই টেনে নিতে চাইল। উদ্বেগ কাটাতে টিভির খবর
দেখল। পত্রিকায় শুধু মৃত্যু সংবাদ। বাস খাদে পড়ে মরে গেছে। প্যালেস্টাইনে আঙুর বাগিচায় বোমা বর্ষণ। সে ফোন করল
-খালাম্মা, স্লামালেকুম। ভাল আছেন। ইতিনার শরীর ভাল হয়েছে?
-হ্যাঁ, ওর জ্বর নেই। তোমার চাচার খবর শুনলাম। লোকটা বড় ভালমানুষ ছিলেন।
-জি, ইতিনা আছে। থাকলে দেন
(নীরবতা। ইতিনা ফোন ধরে)
-ভাল আছ
-জি ভাইয়া।
-আজকে আমার মনটা খারাপ। কথা একান্তে বলে ফেলল রজন।
-আচ্ছা, ইতিনা রোবটের মত বলে, পরিবারে একজন মারা গেছে। এরকম ঘটনায় তো মন খারাপ হবেই। রজনের ইচ্ছে হচ্ছিল ইতিনা তাকে তার বাড়ি যেতে বলে। বৈষয়কি পড়াশোনা বা চাকুরী ছাড়া একটু সময় দেয়। অবশ্য ইতিনা ভাল শ্রোতা। বাড়ি গেলে চুপ করে শুনবে। এরপর বাই বলে, ডিলে না করে ধাম করে দরজা বন্ধ করে দেবে। সে অভদ্র না, কিন্তু রজনকে সে আলাদা করে ভাবে না। কখনো কখনো মনে হয় ইতিনা তাকে পছন্দ করে। কিন্তু তার প্রকাশটা একদম ভিন্ন।
এসব এড়াতে সে দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্র পড়ছিল। বেছে বেছে বিনোদনের পাতা পড়ছিল। নাটকের প্রিভিউ আর নতুন মডেল ভেনাসের ইন্টারভিউ।
-আপনার প্রিয় মাছ?
-ইলিশ।
-কবে থেকে গান করেন, কার কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন...
মডেল ভেনাসের ছবির উপর পত্রিকার রঙ পড়েছে বেশী। হয়তো ভুলে আঁচড় পড়েই গেল তাতে। রজন তার নখ সামলে নিল। মনে হল যদি সেখানে হাত পড়ে মেয়েটি সর্বনাশ হয়ে যাবে।
হঠাৎ উল্টো পাতায় একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল
তান্ত্রিক রহিতন চক্রবর্তী
যাদুটোনা, মন্ত্রের সাধন সহ যাবতীয় বিষয়ের সমাধান করা হয়। যে কোন রহস্যের সফল সমাধান করা হয়। গ্যারান্টি সহ চিকিৎসা। বিফলে মূল্য ফেরত।
সে কি ভেবে বিজ্ঞাপনটা ছিঁড়ে ফেলল ।
অফিসে ঢুকতেই রিসেপশনের মেয়েটি শুষ্ক মুখে বলল ম্যানেজার তাঁকে যেতে বলেছে। রজন ভাবছিল বিলম্বের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু তা না। ম্যানেজার জানিয়ে দিল যে একটা কোয়ালিফাইড ছেলে তাদের পছন্দের ছিল। এএইটির গ্র্যাজুয়েট। তার সঙ্গে যোগাযোগও হয়েছে। কিন্তু ছেলেটা জানিয়েছে সে অন্যত্র অফার পেয়েছে।
রজন খুশি হয়ে বাইরে এলো। এসেই সেলফোনে ইতিনার বাসায় ফোন করল। কেউ ধরছে না। ইতিনার মোবাইল নেই। থাকলে ধরত কিনা কে জানে। সে শুধু একটা সুসংবাদ জানাতে চায় ইতিনা ১ নম্বর ক্যান্ডিডেট।
[ মধ্যবর্তী বিরতি ]
আধাঘণ্টা পরে আবারও কল করল। ইতিনা ধরল । ধরেই বলল, একটু ব্যস্ত ভাইয়া। মাইন্ড করবেন না। তার পর মা কে দিয়ে দিল ফোন। রজন ইতিনা মাকে সুসংবাদটি দিল।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে গিয়ে বহু পথ সিএনজি তে এলো। সে ভুলেই গেছে ইন্টারভিউতে ডাক পাওয়া মানে টিকে যাওয়া না। আর টিকে গেলেই যে মেয়েটি তার মনের কথা জানবে না তা না। ইতিনাকে ফুল দিয়ে কনগ্রেচুলেট করলে কেমন হয়। কিন্তু এখনই কেন?
আবারও বাড়ি ফিরে সে তার ঘর বন্ধ করে ফেলল। তারপর ফিনান্সের বইটা বের করে ২০৩ নম্বর পাতা থেকে এক টুকরো কাগজ বের করল একটা ড্রইং বা স্কেচ। ওখানে একটা ছেলে মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে।
মেয়ের ছবিটা ইতিনার। মোবাইলে তোলা একটা বিয়ের ছবি দেখে গোপনে একটা ছবিটা এঁকেছিল সে পেনসিলে। তাও বছর দুই আগে। কাউকে দেখায় নি । স্কুলের বালকের মতো ছবিতে তার পাশে নিজেকে বসিয়েছিল। যুগলের ছবি এমন কিছু না কিন্তু ওর ভাল লাগে ।
মোবাইলে কল আসে।
-ভাইয়া, আমি ইতিনা। সরি বিজি ছিলাম।
-বল ইতিনা। একটা কারণে ফোন করছিলাম।
দুজনের ছবি দেখতে দেখতে সে ফোনে ইতিনার কণ্ঠ শুনতে থাকে। একটা স্বর্গীয় অনুভূতি ছেয়ে থাকে । ইতিনা এখনই কথা শেষ করে খট করে রেখে দেবে।
ইতিনা নিজেই বলল,
-আপনাদের অফিস থেকে ফোন করেছিল। ২৮ তারিখ যেতে বলেছে ১০ টায়।
-হ্যাঁ, তোমাকে সেটা আগেই জানাতে ফোন করেছিলাম
-ভয় লাগছে আমার খুব
-তোমার ভয়? রজনের বিশ্বাস হয় না।
-কেন?
-ইন্টারভিউতে টাফ কিছু জিজ্ঞেস করার কথা না।
-আপনি থাকবেন বোর্ডে?
-না
-না থাকলে ভাল। আমি নার্ভাস হয়ে যাব তাহলে বেশী।
সে ফোন নিয়ে হাটতে হাটতে কথা বলে। হাতে সেই টুকরো কাগজ। সে ভুলেই গেছে নখ বা আঙুলে কাগজটা বিদ্ধ হতে পারে। সন্ধ্যায় শুনেছে মডেল ভেনাস দুর্ঘটনায় আহত। জানলা খুলে
বাতাস টেনে নিতে চায়। ইতিনা কথা বলছে তখনো । যদিও কথাগুলো কাজের কথা
-ইন্টার ভিউয়ের জন্য পড়তে থাক, ইতিনা
-বই পড়ছি বড়ালের। ইংরেজিতে প্রশ্ন করবে না বাংলায়?
-দুটোই।
রজন জানালা খুলে দিয়েছিল। দমকা বাতাস আসছিল মৌসুমি হাওয়ায় ওড়া বকের মত। হু হু করে । কানে ফোনটা চেপে ধরে রজন জানলার পাশে এসে দাঁড়ায়। ইতিনা বেশী কথা বলছে? তবে কি সে কৃতজ্ঞ? আবেগাক্রান্ত, অথবা দুর্বল মুহুর্তের মুখোমুখি।
ঠিক তখুনি তীব্র হাওয়ায় ড্রইংটা উড়ে গেল। রজনের সেই নখটার উপর মৃদুশব্দ করে ঘষা খেয়ে জানালা দিয়ে উড়ে গেল নিচে।
রজন নখগুটিয়ে অস্ফুট শব্দ করে। গ্রিলের ভেতর দ্রুত হাত ঢুকিয়ে ছবিটা ধরতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে চরকির মত ঘুরতে ঘুরতে নিচে নামছিল । বিন্দুর মত নামতে নামতে থাকল অদৃশ্য হতে হতে লাল গোলাপের ঝোপের উপর পড়ল। মেঝেতে পড়ে থাকা সেলফোনে পরিচিত একটা কণ্ঠ তখনও বাজছিল।
রজন খেয়াল করল তার হাতের নখে নীল রঙটা আর নেই। একেবারে ধপধপে সাদা।
---
ড্রাফট ১.৫
--
গল্পটা শুনে অনেকেই হতাশ হল। কেউ বলল ছোট গল্প লিখতে চাইলে পেটে বিদ্যা লাগে। আমি আবারও [ মধ্যবর্তী বিরতি] থেকে সহজ করে লিখতে থাকলাম
.........
ইতিনাকে তার অফিসে ঢোকালে তাদের সম্পর্কটা সহজ হবে, হয়তো এজনই সেখানে ঢোকানো রজনের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। সে যা করল তা খুব অন্যায়। তিনজন শর্টলিস্টেড এর কাছে ইতিনা হেরে যেতে পারে। সে জন্য পরদিন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজারের ডেস্কে ছুতো করে রেজুমিগুলো দেখতে গেল ।তারপর ইতিনা ছাড়া সবার ছবির উপর নীল নখের মৃদু স্পর্শ দিল। রজন ধরে নিয়েছিল নখের স্পর্শ গভীর হলেও মৃত্যু বা দূর্ঘটনা থাকে। আর এই মৃদু স্পর্শে ওদের সামান্য অমঙ্গল হতে পারে। কথাটা ফলল না। ইতিনার প্রতিদ্বন্দীরা কেউই ভাল ইন্টারভিউ দিতে পারল না। হতে পারে এমনি অথবা নখের তেলেসমাতিতে।
রজন নখ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল । নখের আঁচড় এড়াতে লিউকোপ্লাস্ট জাতীয় একটা পাতলা ব্যাণ্ডেজের মত জিনিস আঙুলে জড়িয়ে রাখত। সবাই জানত আঙুলে ব্যথা। ইতিনা দুপুর বেলা দেখা হলেই অবাক হত।
ইতিনার সঙ্গে রজনের বিয়ে হয় পারিবারিক মিলমিশে।.ইতিনা চাপা মেয়ে কিন্তু সে রজনকে পেয়ে সুখেই ছিল। বিয়ের পর একদিন রজনের মনে হয় ইতিনা বদলে যাচ্ছে। সে ইতিনাকে রাতে অফিসের চাকুরী ছেড়ে দিতে বলে। পরিবারেরই যা আয় আছে দুজনের চাকরী না করলেও হবে।
ইতিনা রাজী হয় নি। ছয় মাস পরে তার কোম্পানীর মালিকানা বদল হয় । আর হঠাৎ করেই বিকেলে জানা গেলে রজন ছাটাই হয়ে গেছে। অন্যদিকে কিছুদিন পর তার স্ত্রীর বেতন বাড়ে, আর এই বৈপরীত্যে রজন যেন ভেঙে পড়েছিল। ইতিনা যুক্তি দেখিয়ে চাকুরী ছেড়ে দিতে চায় না। প্রায় সময়ই অফিসের কাজে ইতিনা দেরী করে ফেরে। আর রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে যায়।
সেদিন রজন আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল । হঠাৎ দরজায় জোরে শব্দ হল। বিদ্যুৎ চলে গেছে। হারিকেন জ্বলছে পাশের রুমে। সে হারিকেন নিয়ে দরজা খুলে সাদা চাদরে মোড়কে এক বৃদ্ধকে দেখল
-জমির চাচা! আপনি?
-কি অবাক হ'লি কেন?
-না, না, এত রাতে, ভেতরে আসে
-তোর ধারণা ভাঙতে আসলাম। তোর যে ধারণ নীল নখ একলা তোর, এটা ঠিক না। বংশের অনেকেরই এই নখ থাকে। এই দেখ
রজন দেখল সাদা চাদের ভেতর শীর্ণ হাত, সেখানে একটা আঙ্গুলের নীল রঙের ভাঙা নখ ।
-কিন্তু..আপনে..?
-কিন্তু কি?. কাল রা'তে দেখলাম একটা ছবিতে আঁচড় কাটতেসস।
-জি, আমার স্ত্রী ইতিনার ছবিতে
বৃদ্ধ মিলিয়ে গেলে, রজন ধড় ফড় করে জেগে উঠল। ঘরে খুব মৃদু বাতি জ্বলছে । ইতিনা রাশান রূপকথার বইয়ে রাজকন্যার মত কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। দৈবক্রমে সেও তার দীর্ঘ নখে রঙ দিয়েছে। তার রঙ ও নীল ।
===
ড্রাফট ০.১