প্রতি বছর আমাদের পাড়ার ক্লাবের বাৎসরিক পিকনিক হয়। এবারের ভেন্যু জয়দেবপুর। ব্যাপক পরিকল্পনা। খিলগাঁও পল্লীমা সংসদের উপরে কাপড়ের ব্যানার টাঙালাম। মুখে মুখে জানানো হল সবাইকে। বাকি ছিল মুরুব্বীরা। তাদের কাছে আমন্ত্রণ পত্রের ফটোস্ট্যাট কপি পাঠানো হল ।
এতকিছুতেও সাড়া না পেয়ে আয়োজকরা খুব হতাশ। একটা সময় পিকনিকের নাম শুনলে লোকে ছুটে আসতো। যে টাকা উঠত তাতে ব্যাপক আয়োজন শেষে আয়োজকদের পকেটে কিছু থেকে যেত।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিকনিকের কথা বললাম। কেউ বললো অফিস থেকে পিকনিকের ব্যবস্থা হচ্ছে। কারো কারো অসুস্থতা, ছেলের পরীক্ষা। মাস শেষে হিসাব করে দেখলাম ১০ টা ফ্যামিলির ২৬ জন সর্বমোট সদস্য যোগাড় হয়েছে। ৪০ সীটের ৩০০ টাকা করে চাঁদা লাগবে। কম লোকের যে খরচ বাড়বে কেউ দেবে না। পিকনিক অনিশ্চিত হয়ে গেল। প্রতিশ্রুত টাকার ভেতর নগদ পেতে দেরী হল। যে বাসাতেই যাই শুনতে পাই, “আরে একটু কম রাখো! রাখোই না, তোমার অমুক আমার ঘনিষ্ট বন্ধু!”
কাচা বাজারের মতো চাঁদার টাকা নিয়ে দাম দর করে। আমাদের উপলব্ধি হয় যে পৃথিবী দিন দিন যত ছোট হচ্ছে তার চেয়ে ছোট হচ্ছে মানুষের পকেট। বহিরাগত লোক নিলে খরচ উঠে আসতো কিন্তু কমবয়সী মেয়েদের কারণে তাতে বেশ আপত্তি।
পিকনিক বছরে একটাই বড় উৎসব যেখানে পাড়ার সবাই হৈ চৈ করে মজা করে। বাইরের লোক নেয়ার সিদ্ধান্ত হল। পিকনিক কমিটির সেক্রেটারি পিকু রাতে দেয়ালে দেয়ালে বিজ্ঞাপন দিলো। একসময় সে হতাশ হয়ে বললো, “এবার বোধ হয় পিকনিক আর হবে না”। আগ্রহীদের যোগাযোগের জন্য পিকুর মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছে। অল্প কয়েকজন পেলাম। ৩ দিন আগে টাকাপয়সা গুণে দেখা গেল অন্তত: দু’জন লোক হলেও পয়সাটা উঠে আসতো। আমার অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা কতে থাকি।
*
২ দিন বাকি পিকনিকের। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে ক্লাব ঘরে বসে আছি। পিকুর ফোন বাজলো। ওপাশ থেকে একটা লোক জানতে চাইলো পিকনিকে যাওয়া সম্ভব কিনা। আমরা স্বভাবত:ই খুশী হয়ে তার নাম ঠিকানা জানতে চাইলাম। উনার নাম আব্দুল মতিন পাটোয়ারী। গলা শুনে মনে হল বেশ বয়স্ক। উনি থাকেন খিলগাঁও তালতলা মেসে। বুঝতে পারলাম তিনি খুব উৎসাহী, আঞ্চলিক টানে বলতে লাগলেন,
“ভাইজান, পিকনিকের বিজ্ঞাপন দেখলাম। আমি গেরামের ছেলে। ঢাকায় আসছি অল্প কয়দিন হল। পিকনিকে যাওয়ার খুব ইচ্ছা"?
"কয়জন"?
"আমি একলাই। আমি আনমেরিড"
পাকা ব্যবসায়ীর মতো তিনি শুরুতেই জিজ্ঞেস করলেন টাকাটা ২০০ করা যায় কিনা।
লোকটার কথায় ও ভাবসাবে আমর সন্দেহ হল। আমি বললাম, “আপনি আগামীকাল আসুন, দেখি কি করা যায়”।
লোকটা এলেন। দেখে বোঝা গেল ঠিক আমাদের স্ট্যান্ডার্ডের নয়। মহসীন চাচা বহিরাগত বিরোধী। তাকে ইন্টারভিউ বোর্ডে রাখা হলো। চাচা পরিচয় জিজ্ঞেস করেছিলেন। শুনে বহিরাগত লোকটি গড় গড় করে বললেন যে ঢাকায় তার কেউ নেই। ব্যাচেলর ভাড়া দেয় না বলে মেসে থাকেন। যে চাকরী করেন সেটা গভর্নমেন্টের প্রেসের কালি ইম্পোর্ট করে। ওটা পেতে ৮,০০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। গ্রামের বন্ধুরা বলতো শহরের পিকনিক খুব আনন্দের। এজন্য উনার খুব ইচ্ছা হয়েছে।
লোকটার চেহারা, কথা বার্তায় কোন দোষ পাওয়া গেলনা বলে তার বিষয়ে সবাই একমত হলাম। চাঁদার রসিদটা বুঝে পেয়ে তিনি ফ্যাক করে বলে উঠলেন,
"পিকনিকে কি কি করতে হবে একটু বুঝায়ে বলবেন, আমার আবার ধারণা নাই"
কথাটা শেষ না হতেই তিনি বললেন, "আচ্ছা, চান্দা কি খাবার সহ? না ছাড়া?"?
তাকে আবারও বলতে হল আমরা খাবার সহই যাচ্ছি। বাবুর্চি যাবে, জয়দেবপুরে গিয়ে খাসির মাংস,পোলাও রান্না হবে, এছাড়া মুরগীর রোস্ট, কাবাব এসব থাকবে। আর সকালে পাউরুটি জেলি কলা আর কোকের নাস্তা। বিকালে চা টোস্ট ইত্যাদি। তিনি কি ভাবছিলেন যে খাবার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে?
তাকে বললাম পিকনিকের ওখানে আরও ইভেন্ট আছে। খেলা হবে। লটারি হবে। সেটা গেলেই দেখতে পাবেন।
লোকটা হজ্জ্ব করতে যাবে এমন খুশী হয়ে আমাকে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিলেন।
*
শনিবার কাক ডাকা ভোর। আবাবীল পরিবহনের বাসটা ক্লাবের লাল দেয়াল ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে। আমি আর সেলিম সবার আগে এসেছি। নির্ধারিত সময়ের আধাঘণ্টা আগে মতিন সাহেবকে হেটে আসতে দেখলাম। এসে আমাকে দেখে ধপ করে ফোল্ডিং চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন। পকেটে লাল ফিতায় পিকনিকের আইডি কার্ডটা ঝুলছিল। তিনি মনে হয় ভেবেছিলেন ওটা না দেখালে বাসে চড়তে দেয়া হবে না। পরেছেন কাল প্যান্ট। চকচকে নীল শার্ট ইন করাতে গতকালের চেয়ে ভাল দেখাচ্ছিল। তবে প্রিন্টেড সবুজ টাইটা এভাবে না পরলেই হতো।
সদ্য হানিমুন সেরে আসা পলিন ভাইয়ের স্ত্রী আমাকে ফিস ফিস করে বললেন, "আচ্ছা, এই আদমীটা কে? মরাগিট্টু দিয়েছে টাইতে? আর পায়ে... " । আমি তক্ষুনি লোকটার পায়ে আই কিউর গরমিল ছবির মতো হা করা চামড়ার স্যান্ডেল দেখতে পেলাম।
মতিন নামটা শুনে সুরাইয়া আপা, মিতুল ও পিনু এরা গা-চিমটা চিমটি করছিল। পিনু আস্তে বললো, "নামে মতিন কামেও মতিন"! লোকটার কানে যেতে পারে। তাই চুপ করতে ইশারা করলাম। তবুও বলতে থাকলো, "মনে হয় ওয়াইজঘাট থেকে দৌড়ে বঙ্গ গিয়েছে। শার্ট টাই কিনেছে কিন্তু স্যান্ডেলটা অরিজিনালটাই আছে"।
তাদের কথোপকথন থেকে বুঝে নিলাম পিকনিকটা মতিন সাহেবের কল্যাণে ভালই জমবে। মজা করার একটা উসিলা পাওয়া গেছে।
বাসে ওঠার জন্য সীট নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। কেউ কার কথা শুনতে চাইলো না। চোখের নিমেষে ভাল জায়গাগুলো দখল করতে হুড়মুড় করে বাসে উঠলো। মেয়েরা শুরুতে বসেছে। আর সব শেষে ঢুকে মতিন সাহেব তখনো এক পায়ে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, “বসুন”। পিছনের ঝাঁকি খাওয়া সীটটায় বসলেন তিনি।
পিকু সৌজন্য রক্ষার্থে অন্যদের মতো তাকেও জিজ্ঞেস করলো, "সব ঠিক তো ভাইয়া"। মতিন সাহেব সে সময়ই প্রচণ্ড ঝাঁকি খেলেন কিন্তু কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বললেন, "জী"।
*
সাধারণত পিকনিকের দিন অভিভাবকদের ক্ষমতা অর্ধেক হয়ে যায়। বাসের উপরে মাইকে ব্যান্ডের গান বাজছে, চটুল সিনেমার গান বাজছে। মাইকের শব্দ ছাড়িয়ে কথা বার্তা চলছে। এর মধ্যে মতিন সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে গান শুনছিলেন। তারপর যেটা হল, "ও সাগর কন্যারে কাঁচা সোনা গায়"..গানটা বাজলো। হতে পারে ঝাঁকিতে অথবা খুব পরিচিত গান পেয়ে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন।
দুষ্টু বুদ্ধিটা গোপন করে গম্ভীর মুখে বললাম, "এই যে মতিন ভাই, মাইক্রোফোন টা নেন, আরাম করে গান করেন"। সেলিম হ্যাঁ নার জন্য অপেক্ষা না করে ঘোষণা করে দিল, "সবার দৃষ্টি আকর্ষণ, এবার আমাদের অতিথি মতিন পাটোয়ারী সাহেব সঙ্গীত পরিবেশন করবেন"। তার নামটা সবাই জেনে গেছে। বাসের ছেলেমেয়েরা এক সঙ্গে তালি বাজাল আর বললো, মতিন ভাই! মতিন ভাই...
মতিন সাহেব বেজায় খুশী হলেন। তিনি হয়তো ভাবলেন তাকে খুব খাতির করা হচ্ছে। কর্কশ আওয়াজের মতো ভেঙে ভেঙে গাইতে থাকলেন - "বেদের মেয়ে জুছনা আমায় কথা দিয়েছে".. । পুরো বাস তখন হাস্যোজ্জ্বল। তালিতে তালিতে মুখর।
“ওয়ান মোর ওয়ান মোর”। তিনি বললেন, "মাশাল্লা! আপনাদের এইসব গান ভাল লাগে?”?
সামনে থেকে একজন উঠে বললো
-"মতিন ভাই, থামবেন না চালান.."
মতিন সাহেব ফ্রি হলেন। গান ধরলেন,
-"সব সখিরে পার করিতে"..."চুমকি চলেছে একা পথে"
অনেকে ক্রমাগত শব্দে ক্লান্ত হয়ে গেছে। ভাবছে কখন এই উপদ্রব থামবে। কিন্তু অল্পবয়সীদের কাছে মতিন ভাই ব্যাপক হিট । তিনি বাসের মাঝ খানে এসে গাইতে থাকলেন। নাচতে থাকলেন। মনে হল সবাই একটা সার্কাসের ভাল্লুক পেল । রসিকতার বাড়াবাড়ি হতে থাকে। কিন্তু কি আশ্চর্য মতিন সাহেব কিছুই বুঝতেই পারেন না। আমার কাছে বিষয়টি বাড়াবাড়ি লাগছিল। কিন্তু দশচক্রে ভগবানও ভুত।
*
দুপুরে একটা গণ্ডগোল হয়। সমস্যাটা ঘটায় বড়রাই। প্রথমে খেতে বসে ইচ্ছেমত খাবার খায়। অন্যান্য খাবার চলেছে কিন্তু রোস্ট ছিল হিসাব করা। যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সে নিজেও এমন কাজ করেছে। আমার আর পিকুর দিকে সবার ক্ষোভ। নুরুল ইসলাম পয়সার খোঁচা দিয়ে বললো, "তোমরা কেমন অর্গানাইজার যে খাবার কম পড়ে? পয়সা কি কম দিয়েছি"।
মাথায় রক্ত চড়ে যায়।মনে মনে বলি, "চাচা, আপনে অর্গানাইজ করে দেখায়েন পরের বার"। অবশ্য দোষ আমাদেরই। তাই চুপ থাকি।
পিকনিকে কিছু সমস্যা হয়েই থাকে। আমি, সেলিম ভাই, পিকু সহ আয়োজকেরা রোস্ট ছাড়াই খেতে বসলাম।বেচারা মতিন সাহেব! তাকে শুধু বলা হল যে একটু সমস্যা হয়েছে। তিনি বললেন, না, না ঠিক আছে ভাই, আপনারা খেয়ে তারপরে অতিরিক্ত থাকলে দিয়েন।
*
পড়ন্ত বিকেলে ক্লাবের সেলিম ভাই মাইকে ঘোষণা দেয় যে চা নাস্তার পর পরই মিউজিক্যাল চেয়ার শুরু হবে। এটা শুধু মেয়েদের জন্য। সবাই আগ্রহ নিয়ে আসলো। ছেলেরা তাদের স্ত্রী বা বোনদের বিজয়ী দেখতে চায়। মীরা ভাবী বসে মতিন ভাইকে হাতে ডাকলেন, “ভাইজান, আপনিও আমাদের সঙ্গে বসেন, কিচ্ছু হবে না"।
মতিন সাহেব রসিকতার পাত্র। আমাদের পাড়ার কেউ না, ভাবীদেরও পরিচিত না । কিন্তু এমনই পরিস্থিতি যে অভিভাবক, এমন কি পরিবারের কর্তারাও বুঝে গেছে লোকটা নির্বিষ। দেখে গেলো তারাও মিট মিট করে হাসছে।
মতিন সাহেব বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। আমার দিতে তাকালেন। আমি বললাম, "যান, যান, আপনার কপাল। ভাবী সাহেবাদের সুনজর পেয়েছেন। নিজের নিজেরাই তো, লজ্জা আর কী?"।
এরপর তাকে নিয়ে হাসাহাসি হল। বালিশ হাত থেকে ফেরে সম্ভব হলে মেয়েরা মাটিতে গড়াগড়ি যায়। পুরষ্কার বিতরণীতে উপস্থাপিকা লাবনী আপা, তার আঞ্চলিক উচ্চারণ নকল করে ফলাফল ঘোষণা করলেন। বাঙালী জাতি বোধ হয় এমনই, সামান্য মজার সুযোগ পেলে, কচলাতে কচলাতে তেতো করে ফেলেন। আমার কাছে একই রকম ভাঁড়ামি অতিরিক্ত মনে হয়। অথচ মতিন সাহেবের কোন আপত্তি নেই।
*
এভাবেই আমাদের পিকনিকের সফল সমাপ্তি ঘটে। রোদ পড়ে আসে। লটারির বিজয়ীরা উপহার সামগ্রী নিয়ে ফেরে। কোমল মিষ্টি রোদে জানলায় মেখে বাস ছুটতে থাকে ঢাকার দিকে। পিকু সামনে বসে ছিল। আমি আর সেলিম সফল সমাপ্তির জন্য হাস্যোজ্জল থাকি। আনন্দোজ্জল মুহূর্তটিতে বিকট একটা শব্দে চারদিক কেঁপে উঠলো। রাস্তায় একটা শিশু দৌড়ে যাচ্ছিলো। আর বাসের ড্রাইভার তাকে পাশ কাটিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পার্শ্ববর্তী শালগাছে আঘাত করে।
চিৎকার আর কান্না কাটিতে বাতাস মুখরিত হয়। কেউ পিঠে কেউ হাতে কেউ শরীরের নানা জায়গায় ব্যথা পেয়েছে। অবশ্য পিকু ছাড়া কেউ গুরুতর আহত হন নি। দুর্ঘটনাস্থলের আধা মাইল দুরে জয়দেবপুর থানা সদর হাসপাতালে নেয়া হল আহতদের। আমাদের কমিটির সদস্যরা বসে ছিলাম সামনে। এর ভেতর পিকু বসেছিল ঠিক গাছ বরাবর। উইন্ড শিল্ডের একখণ্ড কাচ তীব্র গতিতে তার বাম বাহুতে বিদ্ধ হয়। আর তার দেহ থেকে ক্রমাগত রক্তপাত হচ্ছে। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে নার্স এসে আমাদের বললো, “রক্ত পাওয়া গেল? প্লিজ যেভাবে পারেন রক্ত ম্যানেজ করেন। ”
*
এ পজিটিভ কমন গ্রুপের রক্ত। না পাওয়ার কারণ নেই। আমার গ্রুপ বি। সেলিম ভাই আহত। যাত্রীরা দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পিকুর এই আহ্বানটা যেন কানেই তোলে না। বরং নানান কায়দায় ঢাকায় ফেরত যাবার উপায় খুঁজছে। কেউ ড্রাইভারকে গালিগালাজ করছে, এমন কি সেই বিপদের মুহূর্তে আমাদেরকে অভিযুক্ত করেছে পয়সা বাঁচিয়ে খারাপ বাস নেয়ায়।
পিকুর জন্য আমার চোখে পানি। ফোনে সন্ধানী বলেছে রক্ত আসতে আসতে দুই-আড়াই ঘণ্টা। মোবাইল ফোনের সিগনালও ওঠা নামা করছে। হাসপাতালের এক তরুণ ডাক্তার নিজেই এক ব্যাগ রক্ত দিলেন। সবাই জটলা হয়ে হাসপাতালের গেটে, শত শত পরামর্শ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হল এতগুলো পূর্ণবয়স্কের কারো গ্রুপের রক্ত মিলছে না।
আমি চিৎকার করে কান্নাভাঙা গলায় বললাম, প্লিজ আমাদের পিকুকে বাঁচান। মতিন সাহেব মনে হয় দুরে কোথাও ছিলেন। শুনতে পেয়ে হাত ছুটে এসে বললেন, "ভাই, আমি রক্ত দিতে চাই। পিকু ভাইয়ের সঙ্গে কি আমারটা মিলবে?"।
-"আপনার কি গ্রুপ"। মতিন সাহেব চুপ মাথা নাড়েন। তিনি জানেন না।
নার্স দ্রুত পরীক্ষা করে হ্যাঁ বললেন। মতিন সাহেব মোনাজাতের মতো ভঙ্গীতে বললেন, "আল্লাহর রহমত। দয়া করে পিকু ভাইকে বাঁচাতে যত রক্ত লাগে নেন"। সারাদিন যে লোকটিকে এত হেনস্তা করেছি, সব ভুলে গেলাম, তার এই সহৃদয়তার পরিচয় পেয়ে বাকহারা হয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
*
ভিতরের কামরায় মতিন সাহেব চোখ বুজে আছেন। তার রক্ত পিক করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে । তিনি একটু ভয় পেয়ে আমাকে সঙ্গে নিলেন। স্বভাবতই ভীত, কাঁপছেন আর ঘামছেন। শুরু করার আগে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "ভাই, কতটুকু রক্ত দিতে হবে? আমি দুর্বল হলে, আমার ব্যাগের ভিতরের ঠিকানাটা মাকে দিয়েন।"
আমি এই ভীষণ বিপদেও না হেসে পারলাম না। বললাম, "আপনার শরীর থেকে মাত্র এক প্যাকেট রক্ত নেবে..বাকি অন্যদের কাছ থেকে যোগাড় হবে"
"আমি তো আবার ভাবলাম, আমার শরীরের রক্তের যতটা দরকার টেনে নিয়ে উনাকে বাঁচানো হবে।" পৃথিবীর সবচেয়ে হৃদয়বান বোকার মতো হেসে মতিন সাহেব অভয় দিয়ে বলে উঠলেন, "অসুবিধা নাই, যদি লাগে আরও রক্ত নেন"।